অধ্যাপক ড. হাসিনা শেখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৯৭ সালে। এরপর তিনি অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া থেকে ২০১৭ সালে ডক্টরেট ডিগ্রি ও ২০০৪ সালে নেদারল্যান্ডস থেকে করপোরেট স্ট্যাটেজির ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের প্রধান। সম্প্রতি দেশের অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণের প্রভাব বিষয়ে তিনি দৈনিক বাংলাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। দৈনিক বাংলার পক্ষে তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক এম এ খালেক
এম এ খালেক: আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশ ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের অনুমোদন পেয়েছে। এই ঋণের জন্য বাংলাদেশকে বেশ কিছু শর্ত মেনে নিতে হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার বিষয়টিও রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকার ব্যাংকিং সেক্টরের সংস্কারের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং এই সেক্টরে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে কতটা সক্ষম হবে বলে মনে করেন?
হাসিনা শেখ: বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল মানিটরি ফান্ডের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে। আইএমএফ শর্তযুক্ত ঋণ দিয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের টানাপোড়েন চলছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎসগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমে অর্থায়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বাড়ছিল। এই অবস্থায় সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সঠিক এবং সময়োপযোগী ছিল। যেহেতু আমরা আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাই এ ক্ষেত্রে আমাদের তেমন কোনো চয়েস ছিল না। অর্থাৎ সংস্থাটির দেয়া শর্তাদি আমাদের মেনে নিতেই হতো। সরকার আইএমএফের দেয়া শর্তাদি নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে। আইএমএফ ব্যাংকিং সেক্টরের সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের যে শর্ত দিয়েছে, তা আমাদের অর্থনীতির স্বার্থেই বাস্তবায়ন করা দরকার ছিল। আইএমএফ যে ঋণ দিচ্ছে তা একবারে ছাড়করণ করবে না। তারা পর্যায়ক্রমে ছয় কিস্তিতে ৪২ মাসে এই ঋণের অর্থ ছাড়করণ করবে। ইতিমধ্যেই অনুমোদিত ঋণের প্রথম কিস্তি বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণ করা হয়েছে। ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়করণের ক্ষেত্রে আইএমএফ কোনো শর্ত দেয়নি। দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়করণের সময় এসব শর্তের পরিপালনের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হবে। আগামী জুনে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়করণ করা হবে। তবে আমি মনে করি, আইএমএফ ঋণদানের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত পরিপালনের শর্ত দিয়েছে, তা বেশ ভালো এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিশীলতার জন্য শর্তগুলো পরিপালন করা একান্ত প্রয়োজন।
আপনি ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের কথা বললেন। খেলাপি ঋণ আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ব্যাপার। ব্যাংকিং সেক্টরের অনেক সমস্যার মূলে রয়েছে এই খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংক নানাভাবে চেষ্টা করলেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কোনোভাবেই যৌক্তির মাত্রায় কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। আমরা সবাই চাই ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো হোক। কিন্তু কোনোভাবেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো যাচ্ছিল না। এখন আইএমএফের চাপের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু আইএমএফ আমাদের ওপর চাপ দিয়েছে, তাই এ ক্ষেত্রে আমাদের বিকল্প কোনো চয়েস নেই। আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতেই হবে। আমরা যদি কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারি, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিশ্চিতভাবেই কমে আসবে। ব্যাংকিং সেক্টর আর পর্বতপ্রমাণ খেলাপি ঋণের ভার বইতে পারছে না। খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য ‘দুষ্টক্ষত’ হিসেবে বিরাজ করছে।
এম এ খালেক: বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাবায়ন করে তা নিয়ে অনেকেরই আপত্তি আছে। যেমন- বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ হিসাবায়নের সময় মামলাধীন প্রকল্পের কাছে পাওনা ঋণাঙ্ক, অবলোপনকৃত প্রকল্পের কাছে পাওনা ঋণ এবং পুনঃতফসিলীকরণকৃত ঋণের পরিমাণ বাদ দেয়। এতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?
হাসিনা শেখ: বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রস ভিত্তিতে খেলাপি ঋণের হিসাব করে থাকে। আইএমএফ এটা মানতে চাচ্ছে না। তারা বলছে, নিট ভিত্তিতে খেলাপি ঋণের হিসাবায়ন করতে হবে। আমি মনে করি, আইএমএফের অবস্থান সঠিক। নিট ভিত্তিতে খেলাপি ঋণের হিসাবায়ন করা হলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা যখন আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তারা বলছিলেন আমরা এখন থেকে গ্রস এবং নিট ভিত্তিতে খেলাপি ঋণের হিসাব করব। তাহলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র সবাই জানতে পারবে।
এম এ খালেক: ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান খেলাপি ঋণ কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমাদের যেকোনো মূল্যেই হোক খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতেই হবে। খেলাপি ঋণ কমানোর ব্যাপারে আপনার কোনো বিশেষ পরামর্শ আছে কি?
হাসিনা শেখ: আমাদের দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। গবেষণাও হয়েছে। আমরা সবাই মনে করি, খেলাপি ঋণের পরিমাণ যেকোনো মূল্যেই হোক কমিয়ে আনতে হবে, যদি ব্যাংকিং সেক্টরকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে চাই। কিন্তু তার পরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমছে না, বরং দিন দিন আরও বেড়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষীয় পর্যায়ে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানো একটি প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। আমি মনে করি, ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণ না কমার জন্য আমাদের সদিচ্ছার অভাবই দায়ী। আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে, আমরা কি সত্যি খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে চাই? যদি সত্যি আমরা খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হই, তাহলে অবশ্যই খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব। খেলাপি ঋণ নিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে। এখন আর ব্যতিক্রমধর্মী কোনো কিছু বলার নেই। আমাদের আসলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি সত্যি খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে চাই, নাকি চাই না? আমাদের দেশের ব্যাংকারদের মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তাহলো তারা সব সময়ই বৃহদাঙ্কের ঋণ দিতে চান। একজন উদ্যোক্তার হয়তো হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি সেই ঋণের কিস্তি ফেরত দিলেন না। তাহলে ব্যাংক সমস্যায় পড়বে। আমাদের আসলে এসএমই খাতে বেশি বেশি করে ঋণ দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যাংকগুলো এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে খুবই উদাসীন। তারা বৃহৎ উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে ঋণদানের টার্গেট পূরণ করতে চায়। ব্যাংকের একশ্রেণির কর্মকর্তার মাঝে এসএমই খাত, বিশেষ করে এই খাতের নারী উদ্যোক্তাদের ঋণদানের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড অনাগ্রহ লক্ষ করা যায়। কিন্তু এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। কারণ এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের অনেকের মাঝেই প্রচণ্ড সম্ভাবনা রয়েছে। তারা প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সহায়তা পেলে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। এ ছাড়া এসএমই খাতের উদ্যোক্তা এবং সার্বিকভাবে নারী উদ্যোক্তারা গৃহীত ঋণের কিস্তি নির্ধারিত সময়ে ফেরতদানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সিরিয়াস। তারা সাধারণত ঋণখেলাপি হন না। তাই আমাদের ব্যাংক কর্মকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। এসএমই খাতের উদ্যোক্তা, বিশেষ করে এই খাতের নারী উদ্যোক্তাদের বেশি বেশি করে ঋণ দিতে হবে। ব্যাংকের ঋণদান কার্যক্রম গ্রামীণ এলাকায় ছড়িয়ে দিতে হবে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো মূলত শহর এলাকার উদ্যোক্তাদের বিশাল অঙ্কের ঋণ দিচ্ছে। আমাদের গ্রামীণ এলাকায় সম্ভাবনাময় অনেক উদ্যোক্তা আছেন, যারা একটু সহায়তা পেলেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। এদের খুঁজে বের করে ঋণদানের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু ব্যাংকাররা তাদের পরিশ্রম বাঁচানোর জন্য ক্ষুদ্র পরিসরে ঋণ দিতে চান না। তারা চেষ্টা করেন কীভাবে বড় উদ্যোক্তাদের বেশি অঙ্কের ঋণ দেয়া যায়। ব্যাংকারদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কি শুধু প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন নাকি উদ্ভাবনীমূলক ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করবেন? এখন সুযোগ এসেছে। আইএমএফের শর্তের ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি ঋণখেলাপিদের আর কোনো ছাড় দেয়া হবে না। এ জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এম এ খালেক: ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করার একটি কথা শোনা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?
হাসিনা শেখ: ব্যাংকিং সেক্টরে আজকে যে সমস্যা, বিশেষ করে ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে সে জন্য মূলত ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরাই দায়ী। যেকোনো দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে দুই ধরনের ঋণখেলাপি থাকেন। এদের মধ্যে একটি শ্রেণি আছেন যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানা প্রতিকূলতার কারণে গৃহীত ঋণের কিস্তি সঠিক সময়ে পরিশোধ করতে পারেন না। এরা প্রকৃত ঋণখেলাপি। প্রয়োজনে এদের নতুন করে সহায়তা দিয়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধে সামর্থ্যবান করে তোলা যেতে পারে। আর একশ্রেণির ঋণখেলাপি আছেন যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছা করেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন না। এরা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা ঋণের অর্থ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা বা আত্মসাতের জন্যই ঋণ গ্রহণ করেন। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া উচিত হবে না। এদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তাদের চিহ্নিত করা খুবই জরুরি। কারণ এদের জন্যই ব্যাংকিং সেক্টরের আজকের এই দুরবস্থা। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ব্যাংকগুলো চেনে। কিন্তু তার পরও তাদের নানা অজুহাতে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন সময় আইনি সংস্কারের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের নানা সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছেন, তারা কোনো সুবিধা পাবেন না। আর যারা ইচ্ছা করে ঋণের কিস্তি আটকে রাখছেন, তাদের সুবিধা দেয়া হবে এটা অনৈতিক।
এম এ খালেক: অনেকে বলেন, ঋণদানের সময় জামানতকৃত সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করা হলে ঋণখেলাপির প্রবণতা অনেকটাই কমে যাবে। আপনি কী বলেন?
হাসিনা শেখ: আসলে আপনি লক্ষ করলে দেখবেন শর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে। একজন ব্যাংক ম্যানেজার যদি সততার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করেন। ঋণদানের আগে বন্ধকীযোগ্য সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করেন, তাহলে খেলাপি ঋণের প্রবণতা অনেকটাই কমে যেতে পারে। সাধারণত ঋণ গ্রহণের জন্য ১০০:১২৫ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০:১৫০ শতাংশ মূল্যের সম্পদ জামানত দিতে হয়। কোনো ব্যক্তি নিশ্চয়ই ১০০ টাকা ঋণ গ্রহণের জন্য ১২৫ বা ১৫০ টাকার সম্পদ হারাতে চাইবেন না। কিন্তু অধিকাংশ সময় সম্পদের অতিমূল্যায়ন করে দেখানো হয়। ফলে ব্যাংক মামলায় জয়ী হয়ে বন্ধকীকৃত সম্পদ বিক্রি করতে গেলে সঠিক মূল্য পায় না। একজন ব্যাংক ম্যানেজার বন্ধকীযোগ্য সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করলে পরবর্তী সময়ে সেই ঋণ খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা ভুল করলে ব্যাংককেই তার খেসারত দিতে হবে। ব্যাংক যে ঋণ দেয়, সেই ঋণের টাকা আসে আমানতকারীদের অর্থ থেকে। কাজেই ঋণদানের সময় কোনোভাবেই এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমানতকারীর অর্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
এম এ খালেক: ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারিত আছে। এটা কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন?
হাসিনা শেখ: অনেক দিন ধরেই স্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা ব্যাংকঋণের আপার ক্যাপ (৯ শতাংশ) তুলে দেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছেন। কিন্তু তা করা হয়নি। এবার আইএমএফ শর্ত দিয়েছে ব্যাংকঋণের আপার ক্যাপ তুলে দিতে হবে। এখন হয়তো আপার ক্যাপ তুলে দেয়া হতে পারে। ব্যাংকঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ করে না রেখে তাকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। ব্যাংকঋণের সুদের হার যদি বাজারভিত্তিক এবং বেশি হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ বেশি পরিমাণে আমানত ব্যাংকে সংরক্ষণ করে। ব্যাংকগুলোর তারল্যসংকট দূর হয়।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজেট তৈরি করা হয়নি। দেড় বছর ধরে দেশে ডলারসংকট। ডলারসংকটের কারণে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হচ্ছে না। এত বড় একটি ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে, যা ডলারসংকট আরও বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যালান্স শিট এক্সপ্যান্ড করেছে। ফলে এ অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাপা হয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়েছে। আবার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বাড়িয়ে দিলেও ডলারসংকটের চাপ একই রকম থাকবে।
ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিলে আবার ঝুঁকি তৈরি হয়। কারণ বর্তমানে ব্যাংক খাতে আমানত কম। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ কমছে না। ব্যাংক থেকে অনেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিনিয়ত ডলার কিনছে। এর বদলে নগদ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। তাই ব্যাংকে এমনিতেই এক রকমের তারল্যসংকট রয়েছে। ব্যাংক খাতের সক্ষমতা আগের চেয়ে কমেছে। তার মধ্যে সরকার বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে। সরকারকে ঋণ দিতে চাইবে ব্যাংক। এটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক। কারণ সরকারকে ৭-৮ শতাংশ সুদে ঋণ দিলেও এটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক। এতে এই টাকা আবার একটি নির্দিষ্ট সময় চলে আসবে। ব্যাংকের জন্য ঝুঁকি কম। ব্যক্তি খাতে ঋণ দিলে অনেক সময় খেলাপি হয়। তবে ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে আগ্রহী হলেও বেসরকারি খাতে প্রভাব পড়বে। রাজস্ব আয় পরোক্ষ করের ওপর জোর দেয়া হয়েছে বেশি। এমন যদি হয় বাইরের দেশে ডলারের দাম কমে যায় এবং জিনিসপত্রের দাম কমে যায়, তাহলে দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। তবে এ বছর দেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে কম, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বেশি। এই মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ ডলারসংকট। এযাবৎকালে এ রকম ডলারসংকট দেখা যায়নি বাংলাদেশে। ১৯৮৭-৮৯ সালে এ রকম ডলারসংকট দেখা দিয়েছিল। ফলে সার্বিক দিক বিবেচনা করলে এটি সময় উপযোগী বাজেট হয়নি।
এ বাজেট গতানুগতিক বাজেট। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ বাজেট দিয়ে অর্থনীতির অস্থিরতা রোধ করা সম্ভব হবে না। এ সময়ের জন্য একটি বাস্তবধর্মী বাজেট হওয়া দরকার ছিল। রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত নয়। ফলে সামগ্রিকভাবে এ বাজেট দিয়ে অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনা সম্ভব নয়। এবারের বাজেটে আগের চেয়ে সরকার ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ আগামী অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হবে বেসরকারি খাত। এটি অযোক্তিক।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। গত ১০ মাসের নিট বিক্রি নেগেটিভ। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙার পরিমাণ বেশি। সরকারের কোষাগার থেকে অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন বিধিনিষেধ বাড়ানো এবং আরোপ করার কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সামাজিক সুরক্ষা বিবেচনায় এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হয়নি। কারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর নির্ভর করে সংসার চালিয়ে থাকেন। নানা রকমের বিধি আরোপ করার কারণে সুদ কমে গেছে।
আর সুদের টাকা বেশি দিলেও তো মানুষের জন্যই তো এ ব্যয়। তাই সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা কমিয়ে আনা উচিত। ব্যাংকনির্ভরতা বাড়ালে সমস্যা দেখা দেবে। বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ পেলেও ছোট ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবেন না। কারণ ব্যাংকে এক ধরনের তারল্যসংকট তৈরি হবে।
অর্থনীতিতে নানা রকমের ইন্ডিকেটর রয়েছে। সেই ইন্ডিকেটর মোতাবেক একটি সূচক আরেকটি সূচকের ওপর নির্ভর করে। ফলে সামষ্টিকভাবে পর্যালোচনা করলে এই বাজেট বাস্তবসম্মত নয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সম্প্রতি সাতমসজিদ রোড এলাকার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে সড়ক বিভাজন তৈরি করতে গিয়ে সেখানে গাড়ির চাপ ও যানজট বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন গাছ কাটার প্রতিবাদ জানালেও জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া গাছ কাটার প্রক্রিয়া কয়েক মাস বন্ধ রাখার পর গত ৮ মে থেকে রাতের আঁধারে আবার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এলাকার বট, বরই, বকুল, কৃষ্ণচূড়া শিরীষগাছসহ ঝোপঝাড়, লতাগুল্ম এলাকার পাখি, পতঙ্গ ও সরীসৃপের মতো জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া প্রকৃতির এসব অনুষঙ্গ দীর্ঘকাল এলাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, যা ধ্বংস না করেই সেখানকার সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন সম্ভব ছিল বলে অভিমত পরিবেশবাদী সংগঠনের। অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রখ্যাত পাবলিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিকল্পনা কার্যকর করতে গাছ কাটার মহোৎসবের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিছুদিন আগে। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামের এক প্রকল্পের আওতায় নাকি সহস্রাধিক গাছও কেটে ফেলা হয়েছে! নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যে নানা প্রজাতির প্রাণী ও পাখির বিচরণ ছিল, বৃক্ষ নিধনের ফলে তা হুমকির মুখে পড়বে বলে পরিবেশবিদদের অভিমত। মানুষের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে নগরায়ণ আর উন্নয়নকাজে গাছ কাটার প্রয়োজন হতেই পারে। তবে তা কখনো প্রকৃতিকে ধ্বংস করে হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নগরায়ণ কার্যক্রমকে সফল করতে বিভিন্ন অঞ্চলে কাছ কাটা হয়েছে। বিশেষ করে মানুষের লোভের কবলে পড়ে দেশে নির্বিচারে নানা প্রজাতির গাছপালা নিধন করা হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। একটি অসাধু চক্র উন্নত প্রজাতির পুরোনো গাছ কেটে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে মুনাফা লুটেছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের কারণেও বিনষ্ট হচ্ছে বিপুল বনসম্পদ, বিপন্ন হয়েছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ।
জীববৈচিত্র্য রক্ষার লক্ষ্যে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে বহুবার। এই আদেশবলে কোনোক্রমেই বনভূমি থেকে কোনো গাছ কাটা যাবে না। এমনকি ঝড়ের কবলে অথবা মড়কে আক্রান্ত হয়ে বনাঞ্চলে যেসব গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, সেগুলোও কেউ সংগ্রহে নিতে পারার কথা নয়। কিন্তু কোনো আইনকানুন-বিধিনিষেধ আরোপ করেও বৃক্ষনিধন বন্ধ করা যায়নি। লুকিয়ে নয়, প্রকাশ্যে, লোকচক্ষুর সামনেই চলছে গাছ কাটার মহাযজ্ঞ।
সারা দেশে এমনই বৃক্ষ নিধনের মহাযজ্ঞে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতীক পাহাড় কাটার পাশাপাশি পাহাড়ের বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধনের ফলে জীববৈচিত্র্য হচ্ছে হুমকির সম্মুখীন, বন্য প্রাণী হারাচ্ছে আবাসস্থল। প্রকৃতি হয়ে পড়ছে ভারসাম্যহীন। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসাবমতে, বাংলাদেশে বর্তমান বনভূমির পরিমাণ ১১ দশমিক ২ শতাংশ, যা বিশ্বের কম বনাঞ্চলের দেশ হিসেবে এশিয়ায় অবস্থান তৃতীয়। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সময় দেশে যে আয়তনের বনাঞ্চল ছিল, এখন তার অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বৃক্ষ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য। দেশে বর্তমানে মোট ভূমির পরিমাণ ১ কোটি ৪০ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে ১২ লাখ হেক্টর রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯০ সাল থেকে ১০ বছর মেয়াদে সংরক্ষিত বনে গাছ কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর বেশ কয়েকবার এর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় বৃক্ষ কাটা থেমে থাকেনি। ভাওয়াল গড়, মধুপুর গড় দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। একসময় বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ বনভূমি কেটে ফেলে আবাসস্থল তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু এর বিপরীতে নতুন করে অধিক পরিমাণ গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়নি বহুকাল ধরে। উপরন্তু দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অবিরাম চলছে নগর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। মানুষের নিত্যনতুন চাহিদা মেটাতে তৈরি হতে থাকে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা। আর এসব করতে গিয়ে কেটে ফেলা হয় প্রচুর পরিমাণ গাছপালা।
প্রাকৃতিক নিয়মেই উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে গঠিত জীববৈচিত্র্য অপরের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকে। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিতভাবে অবদান রাখে। বাংলাদেশের পাহাড় অঞ্চল, সমতল ভূমি এবং উপকূলীয় এলাকার সামান্য বনাঞ্চল, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড় এলাকার বনের কিছু গর্জন, সেগুন, জারুল এবং গামারিজাতীয় বৃক্ষ, দিনাজপুর, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের বনাঞ্চলের গাছপালা প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় অনেকটা সহায়তা করছে। বাংলাদেশের অহংকার তথা বিশ্বের প্রধান ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির গাছের ১০৬টির অস্তিত্ব ইতিমধ্যে বিলুপ্তপ্রায়। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমে খুলনা ও পটুয়াখালীজুড়ে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন দীর্ঘকাল ধরে দেশের জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রেখে চলেছে। প্রায় ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশের মোট বনভূমির প্রায় ৪৪ শতাংশজুড়ে এ বনের সুন্দরী, গেওয়া এবং কেওড়াগাছ রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় সুন্দরবনের বিপুল পরিমাণ গাছপালা ও পশুপাখির ভূমিকা অপরিসীম। কারণ উপকূলীয় বনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে বাতাসে আর্দ্র থাকে। বনভূমি যেকোনো উৎস থেকে আসা পানিপ্রবাহের চাপ কমায় এবং ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস থেকে দেশের মাটিকে রক্ষা করে। অধিকন্তু গাছপালা বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ কমিয়ে দিয়ে বাতাসে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়। ঝড়ঝঞ্জা, সাইক্লোন, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে। বাংলাদেশের ওপর স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলো দেশের বিভিন্ন স্থানসহ উপকূলীয় এলাকার বিশাল একটি অংশ লণ্ডভণ্ড করে দেয়। বিশেষ করে দেশের অমূল্য সম্পদ সুন্দরবন উপকূলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকার বন বিনষ্ট হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে সুন্দরবনের অবস্থানের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিশাল জনবসতি এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। সুন্দরবনই ঝড়ের গতিবেগ রোধ করে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ প্রকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করেছে। বাঁচিয়েছে উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য মানুষকে।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে বনভূমি উজাড়, বন্য প্রাণীর বিলুপ্তিসহ অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পকারখানার দূষণকে দায়ী করা হয়ে থাকে। এটি অনস্বীকার্য যে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়ে দেশের পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করতে অধিকতর বনাঞ্চল সৃষ্টি করা অত্যাবশ্যক। এ ক্ষেত্রে উপকূলীয় বনায়নেরও কোনো বিকল্প নেই। দেশের অরক্ষিত বিশাল চরাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বনাঞ্চল সৃষ্টি করে সবুজবেষ্টনী গড়ে তোলা জরুরি। উপকূলীয় বনভূমি সুরক্ষাসহ উপকূলীয় এলাকায় নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি জোরদার করা হলে তা ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে দেশকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। পুরোনো বন সংরক্ষণ, নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি এবং সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করে দেশের বনভূমিকে আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে উন্নীত করা অবশ্যই সম্ভব। পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়কে গুরুত্ব যতদূর সম্ভব গাছপালা, বনভূমি উজাড় না করে উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলমান রাখা জরুরি। উন্নয়নের পথে অগ্রসরমাণ বাংলাদেশের পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করে উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে বন্ধ করতে হবে বৃক্ষ নিধন। গাছ কাটা একটি আইনগত অপরাধ। রাজধানী ঢাকায় ইমারত নির্মাণ, সড়কসহ নানা ধরনের নগর অবকাঠামো তৈরির প্রক্রিয়ার ফাঁদে গাছপালা, জলাধার রক্ষা ব্যাপারটি উপেক্ষিত থাকার ফলাফল ইতিমধ্যেই টের পাওয়া গেছে।
পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়ার আগেই বৃক্ষ নিধন, জলাধার ভরাট বন্ধ করে এক বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আগামীতে রাজধানীসহ দেশের যেকোনো অঞ্চলে গাছ কাটা বন্ধসহ পরিবেশ রক্ষায় দেশের প্রত্যেক মানুষকে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী
একাদশ জাতীয় সংসদের সর্বশেষ বাজেট অধিবেশনে গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি হচ্ছে সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট। এই বাজেট বাস্তবায়নকালেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কাজেই এবারের বাজেট নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি হচ্ছে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থাপিত পঞ্চম জাতীয় বাজেট এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট। এর মধ্যে ৫২টি পূর্ণাঙ্গ বাজেট এবং একটি ছিল খণ্ডিত বা আংশিক সময়ের জন্য বাজেট। এর মধ্যে আজকে যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে সেটিসহ আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বিভিন্ন সময় সর্বাধিক ২৫টি বাজেট উপস্থাপন করছে। বিএনপি আমলে বিভিন্ন সময় মোট ১৭টি বাজেট উপস্থাপন করা হয়। আর সেনাশাসক এরশাদ আমলে মোট ৯টি বাজেট প্রণীত হয়। বাংলাদেশে সর্বাধিক ১২টি করে বাজেট প্রণয়ন করেন বিএনপি-দলীয় অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও আওয়ামী লীগ-দলীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য প্রথম বাজেট প্রণয়ন করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সেই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য যে বাজেট বর্তমানে বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে, তার আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট আজ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার সার্বিক আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেট চরিত্রগত দিক থেকে সম্প্রসারণমূলক বাজেট। বাজেটে রাজস্বপ্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশের মতো। মোট রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে রাজস্ব আসবে ৪ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করার জন্য আগামী বাজেট বাস্তবায়নকালে বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের যে অবস্থা তাতে বাড়তি ৪৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা বেশ কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। উল্লেখ্য, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। কাজেই আগামী অর্থবছরের জন্য এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সংশয় প্রকাশ করছেন। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত সূত্র থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যাবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জন্য যে বাজেট প্রস্তাবনা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা এমন একসময় প্রণয়ন করা হয়েছে যখন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। এখনো বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার শুরু হয়নি। তবে যেকোনো সময় মন্দা দেখা দিতে পারে। নানা ধরনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখনো তিন বছর ধরে চলা করোনা অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে ২০২২ সালের সূচনালগ্নে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যে এতটা দীর্ঘমেয়াদি হবে, তা অনেকেই অনুধাবন করতে পারেননি। বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব হয়েছে অতি ভয়ংকর। ফলে এক দেশের অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি হলে তার প্রভাব অন্য দেশের ওপরও পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে তার প্রভাব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পড়েছে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রচণ্ডভাবে পড়েছে। অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই নিম্নমুখী রয়েছে। অর্থবছরের সমাপ্ত হওয়া ১০ মাসের অর্থনীতির যে চিত্র তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। একমাত্র রেমিট্যান্স ও পণ্য রপ্তানি খাতের আয় কিছুটা ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। অবশিষ্ট প্রায় সব খাতের অবস্থাই এখন অত্যন্ত খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। কথায় বলে, উচ্চ রিজার্ভ এবং ব্যক্তি খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ একটি দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অবস্থা। এমনকি তুলনামূলক কম স্ফীত রিজার্ভ এবং ব্যক্তি খাতে উচ্চমাত্রায় বিনিয়োগও কাম্য হতে পারে। কিন্তু বিনিয়োগবিহীন রিজার্ভ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যক্তিবিনিয়োগ এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ উভয়ই নিম্নমুখী রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল ২৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। পরবর্তী তিন অর্থবছরে এটি ছিল যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ ও ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ানো না গেলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পেতে পেতে গত মে মাসে ৩ হাজার ১৭ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ জুলাই, ২০২২-এ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৯৫৯ কোটি ডলার। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে পরিসংখ্যান প্রদান করে আইএমএফ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা তার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে পরিমাণ প্রদর্শন করে তার মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডে দেয়া ৭ বিলিয়ন ডলারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু যে অর্থ আমার হাতে নেই তাকে কোনোভাবেই রিজার্ভ অর্থ হিসেবে প্রদর্শনের সুযোগ নেই। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমার কারণে সরকারকে তার উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। সরকার যদি ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করে, তাহলে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক-ঋণপ্রবাহ নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে। বিনিয়োগ কার্যক্রম ব্যাহত হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে ৭৯ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) সরকারের ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে সরকার ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকাসহ অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করবে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করবে। চলমান মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। গত আগস্টে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ শিল্প ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমেছে ৫৬ শতাংশ। আর মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ৩১ শতাংশ। কাঁচামাল আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ শিল্প খাতে এক ধরনের স্থবিরতা রিরাজ করছে। কিন্তু ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি সেই হারে কমছে না। তার অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণ নিয়ে একটি মহল অন্যত্র প্রবাহিত করছে। এমনকি বিদেশে পাচার করছে বলে অনেকেই মনে করেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অস্বাভাবিক উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি। আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। এপ্রিলে এসে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো, এমনকি ভারতও তাদের উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য প্রদর্শন করতে পারছে না। এই অবস্থায় আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়ে দিয়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত এক বছরে অন্তত তিনবার পলিসি রেট বাড়িয়েছে। আগে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ, এখন তা ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু পলিসি রেট বাড়ানোর এই উদ্যোগ বাজারে অর্থ সরবরাহ কমানোর ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বাড়ালেও ব্যাংকঋণের সুদের আপার ক্যাপ (৯ শতাংশ) প্রত্যাহার করেনি। ফলে ব্যাংকঋণ গ্রহণ করা এখন আরও সহজ এবং সস্তা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই হার খুব একটা উচ্চাভিলাষী বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ উচ্চমাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব অনুসারে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়ে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে সাড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। তবে এই মুহূর্তে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাজেটে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্পমূল্যে খাবার জোগানসহ নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি বাড়ানো হয়েছে।
নিকট-অতীতে কখনোই সরকার রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তেমন একটা সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেনি। তাই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অথচ নেপালের মতো দেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে ২৩ শতাংশ। কাজেই আমাদের এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে হবে। আগামী অর্থবছরে ট্যাক্স আদায় বৃদ্ধির জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেয়া হলেও এই সুযোগ কেউ গ্রহণ করেননি। তাই আগামী অর্থবছরে এই সুযোগ আর থাকছে না। এটি খুব ভালো একটি উদ্যোগ। কারণ পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুযোগ দিলেও খুব বেশিসংখ্যক মানুষ এই সুযোগ গ্রহণ করেনি। এ ছাড়া টাকা পাচারকারীদের শাস্তিদানের পরিবর্তে সামান্য ট্যাক্স প্রদানের বিনিময়ে অবৈধ অর্থ দেশে ফেরত আনতে দেয়াটা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, করমুক্ত আয় পুরুষদের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লাখ টাকা এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৪ লাখ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। আগামী অর্থবছর থেকেই সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হবে। যারা টিআইএনধারী, তারা রিটার্ন দাখিল করলেই ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
দুনিয়ার সপ্তম আশ্চর্যের যারা আবিষ্কারকর্তা, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ঘর কাবাকে এ তালিকায় স্থান দেননি। বস্তুত কাবাঘরের সৌন্দর্যও অপরূপ রূপের, যা হাজার হাজার বছর ধরে দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে মানুষকে আকর্ষণ করে রেখেছে। প্রতিটি বছর আর কোনো স্থাপনাকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি মানুষের আবর্তনের ঘটনা দুনিয়ায় আর একটিও নেই।
এ ঘরের অনেক নাম রয়েছে। প্রথমত কাবা, যার অর্থ ‘সম্মুখ’ বা ‘সামনে’। আর একটি রয়েছে বায়তুল্লাহ, এর অর্থ আল্লাহর ঘর। একে হারাম শরিফও বলা হয়। কারণ এখানে যেকোনো প্রকার গুনাহ এবং যাবতীয় নাজায়েজ কাজ হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধও এখানে নিষেধ।
ইবনে কাসির হাদিস শরিফ বায়হাকির উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, রাসুলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া দুনিয়ায় আগমনের পর আল্লাহতাআলা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে তাদের কাবাঘর নির্মাণের আদেশ দেন। ঘর নির্মিত হয়ে গেলে তাদের তা তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করার নির্দেশ দেয়া হয়।’ এ সময় আল্লাহ দুনিয়ার প্রথম নবী আদম (আ.)-কে বলেন, ‘হে আদম আপনি দুনিয়ার প্রথম মানুষ এবং এ গৃহ মানবজাতির জন্য প্রথম ঘর।’ (তাফসির ইবনে কাসির)।
মাওলানা জাকারিয়া কান্ধলবি তার কিতাবে এ ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন, আল্লাহতাআলা যখন আদম (আ.)-কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নামিয়েছেন, তখন তার সঙ্গে আল্লাহ তার নিজের ঘরও নামিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘হে আদম, আমি আপনার সঙ্গে আমার নিজের ঘরও নামাচ্ছি। দুনিয়ায় এর তাওয়াফ করা হবে, যেমনটা আমার আরশে এর তাওয়াফ করা হয় এবং এর দিকে ফিরে এমনভাবে নামাজ পড়া হবে যেমন আমার আরশের দিকে ফিরে নামাজ পড়া হয়ে থাকে।’ (ফাজায়েলে হজ, অনুবাদ: মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের, দ্বীনি প্রকাশনী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ১৪৪০ হিজরি, পৃষ্ঠা ৮)।
কাবাঘরের এ স্থাপনা হজরত নূহ (আ.)-এর যুগ পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল। কিন্তু নূহের যুগে যে মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়, তাতে কাবাঘরের এ স্থাপনাও বিধ্বস্ত হয়। পরে হজরত ইব্রাহিম (আ.) প্রাচীন ভিত্তির ওপরই এ গৃহ পুনর্নির্মাণ করেন। মুফতি শাফি (র.) তার পবিত্র কোরআন তাফসির কিতাবে লিখেছেন, ‘ইব্রাহিম (আ.) এবং ইসমাইল (আ.) কাবার প্রাথমিক ভিত নির্মাণ করেননি, বরং আগের ভিতের ওপরই কাবাঘর পুনর্গঠন করেন।’ (পবিত্র কোরআনুল করিম, মুফতি শাফি (র.) তাকসিরকৃত, কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প, মদিনা, ১৪১৩ হি. পৃষ্ঠা ১৮৮)। সুরা হজেও উল্লিখিত হয়েছে, ‘যখন আমি ইব্রাহিমের জন্য কাবাঘরের স্থান ঠিক করে দিলাম।’ (সুরা হজ, আয়াত : ২৬)। এ থেকে আলেমরা সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, কাবাঘরের জায়গা আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। কোনো কোনো কিতাবে বলা হয়েছে, ইবারাহিম (আ.)-কে কাবাঘর নির্মাণের আদেশ দেয়ার পর ফেরেশতাদের মাধ্যমে বালুর স্তূপের নিচে পড়ে থাকা কাবাঘরের পূর্বের ভিতকে চিহ্নিত করে দেয়া হয়।
পরবর্তীকালে এক দুর্ঘটনায় প্রাচীর ধসে গেলে কাবার পাশে বসবাসকারী জুরহাম গোত্রের লোকেরা একে পুনর্নির্মাণ করেন। এভাবে কয়েকবার বিধ্বস্ত হওয়ার পর একবার আমালেকা সম্প্রদায় ও একবার কোরাইশরা এ গৃহ নির্মাণ করে। সর্বশেষ এ নির্মাণে মহানবী (সা.)-ও শরিক ছিলেন এবং তিনিই ‘হাজরে-আসাওয়াদ’ স্থাপন করেছিলেন।
কিন্তু ইসলাম-পূর্ব যুগে কোরাইশদের এ নির্মাণের ফলে ইব্রাহিম (আ.)-এর মূল ভিত্তি সামান্য পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রথমত, একটি অংশ এর ‘হাতিম’ কাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, ইব্রাহিম (আ.)-এর নির্মাণে কাবা গৃহের দরজা ছিল দুটি, একটি প্রবেশের জন্য এবং অন্যটি পশ্চাৎমুখী হয়ে বের হওয়ার জন্য। কিন্তু কোরাইশরা শুধু পূর্ব দিকে একটি দরজা রাখে। তৃতীয়ত, তারা সমতল ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে, যাতে সবাই সহজে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। বরং তারা যাকে অনুমতি দেয়, সে-ই যেন প্রবেশ করতে পারে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার হজরত আয়েশা (রা.)-কে বলেন, ‘আমার ইচ্ছা হয়, কাবাগৃহের বর্তমান নির্মাণ ভেঙে দিয়ে ইব্রাহিমের নির্মাণের অনুরূপ করে দিই। কিন্তু কাবা গৃহ ভেঙে দিলে নতুন মুসলিমদের মনে ভুল-বোঝাবুঝি দেখা দেয়ার আশঙ্কার কথা চিন্তা করেই বর্তমান অবস্থা বহাল রাখছি।’ হজরত আয়েশা রাজিয়াল্লাহু আনহার ভাগ্নে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) মহানবী (সা.)-এর উপরোক্ত ইচ্ছা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের পর যখন মক্কার ওপর তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তিনি ওপরে ওই ইচ্ছাটি কার্যে পরিণত করেন এবং কাবাঘরের নির্মাণ ইব্রাহিম (আ.)-এর নির্মাণের অনুরূপ করে দেন। মাওলানা আমিনুল ইসলাম তার তাফসির কিতাবে আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়েরের এ সংস্কারকাজ ৬৪ হিজরির ২৭ রমজানে শেষ হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। (তাফসিরে নূরুল কোরআন, আলবালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০১২, পৃষ্ঠা ৪৪৫)।
কিন্তু হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর ইসলাম-পূর্ব জাহেলিয়াত আমলের কোরাইশরা যেভাবে নির্মাণ করেছিল, সেভাবেই পুনর্নির্মাণ করেন। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের পর কোনো কোনো বাদশাহ উল্লিখিত হাদিস অনুযায়ী কাবাঘরকে ভেঙে আবার নির্মাণ করার ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন ইমাম হজরত মালেক ইবনে আনাস (রা.) ফতোয়া দেন যে, ‘এভাবে কাবাঘরের ভাঙাগড়া অব্যাহত থাকলে পরবর্তী বাদশাহদের জন্য একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়ে যাবে এবং কাবাঘর তাদের হাতে একটি খেলনায় পরিণত হবে। কাজেই বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে, সে অবস্থায়ই থাকতে দেয়া উচিত।’ গোটা মুসলিম সমাজ তার এ ফতোয়া গ্রহণ করে নেয়। তবে মেরামতের প্রয়োজনে ছোটখাটো কাজ সব সময়ই অব্যাহত থাকে। মাওলানা আমিনুল ইসলাম তার তাফসির কিতাবে লিখেছেন, ‘কোশাই বিন কিলাব নামে একজন কাবাঘরের সংস্কার করেছিলেন এবং তিনি প্রথম কাবাঘরকে গিলাফ দ্বারা আবৃত করেন।’ (তাফসিরে নূরুল কোরআন, প্রথম খণ্ড, আলবালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পঞ্চম মুদ্রণ, ২০১২, পৃষ্ঠা ৪৪৪)।
কাবাঘর বানানোর পর আল্লাহতাআলা এ ঘর এবং এ ঘরের চারপাশকে ‘নিরাপদ’ বলে ঘোষণা করেন:
১. ‘ওরা কি দেখে না আমি কাবাঘরের চারপাশ যা হারাম শরিফ বলে পরিচিত, তাকে নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছি।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত: ৬৭)।
২. ইব্রাহিম (আ.)-ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ, মক্কাকে নিরাপদ শহর করে দিন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১২৬)।
৩. ‘যে কেউ কাবাঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।’ (সুরা আল-ই-ইমরান, আয়াত: ৯৬-৯৭)।
৪. ‘মসজিদ-উল-হাবামের কাছে (কাবার কাছে) যুদ্ধ করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯১)।
৫. ‘আমার ঘরকে পবিত্র রেখো।’ (সুরা হজ, আয়াত: ২৬)।
৬. ‘আমি কাবাঘরকে মানুষের মিলনক্ষেত্র ও আশ্রয়স্থল হিসেবে তৈরি করেছি।’ [সুরা বাকারা, আয়াত: ১২৫)।
তাই কাবাঘর হলো দুনিয়ার মধ্যে একটি বিশেষ নিরাপদ স্থান। দুনিয়ায় এ রকম আরেকটি দৃষ্টান্তও নেই। এটি ইমানদারদের জন্য একটি মিলনক্ষেত্র এবং আশ্রয়স্থলও। তবে যারা অবিশ্বাসী, ইমানহীন এবং আল্লাহর সঙ্গে শিরক করে, আল্লাহর অংশীদার বানায়, তারা কাবাঘরে প্রবেশ করতে পারবে না। (সুরা তওবা, আয়াত: ২৮)।
লেখক: গবেষক ও ইতিহাসবিদ
নির্বাচনের রাজনীতি একটা বিজ্ঞান- এখানে হিসাব খুব জটিল। ভুল হলে গরল। আওয়ামী লীগ সেই হিসাবে ব্যর্থ হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম বলেছিলেন, ‘নৌকার বিজয় হয়েছে।’ সমসাময়িক রাজনীতির যে হালচাল, তাতে নৌকার নয়, তারই জয়। তবে নৌকার পরাজয় হয়েছে কি না সেই প্রশ্নটা জরুরিভাবে উসকে দিচ্ছে- জাহাঙ্গীর আলমের ভাষায় ‘এটি নৌকার নয় বরং ব্যক্তি আজমত উল্লার পরাজয়’- এ আলাপে। নেটিজেনদের ঠাট্টা- সুষ্ঠু ভোটের জন্য আমেরিকার চাপে প্রথম ‘বলি’ হলেন আজমত উল্লা।
জাহাঙ্গীর ঠিকই বুঝিয়ে দিয়েছেন নির্বাচনের অঙ্ক তিনি ভালোই বোঝেন। আঁচ করতে পেরেছিলেন তাকে নির্বাচন করতে দেয়া হবে না, তাই মাকে প্রার্থী করে রাখেন। তার এ কৌশলী সিদ্ধান্তের কাছে আওয়ামী লীগ হেরেছে। জাহাঙ্গীরের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা, উপস্থিত বুদ্ধি ও জনগণের সজাগ দৃষ্টির কাছে আওয়ামী লীগের ‘কৌশল’ হেরেছে। এ ছাড়া গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার রাজনীতির কাছে, তার আদর্শের কাছে হেরেছে।
আওয়ামী লীগ ভেবেছিল জাহাঙ্গীরের মা অখ্যাত। ছেলের মতো প্রভাব ফেলতে পারবেন না তিনি। ব্যাপারটা হালকাভাবে নেয়াটা আওয়ামী লীগের ভুল ছিল। বহু দিন ধরে তারা এ কাজটি করে আসছে, ‘প্রতিপক্ষকে কখনো দুর্বল ভাবতে নেই’।
প্রার্থী হওয়ার আগে জাহেদা খাতুনকে রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে গাজীপুরের মানুষ চিনত না, নির্বাচন তো দূরের কথা, কোনো রাজনৈতিক কমর্সূচিতে তিনি ছিলেন না। জাহাঙ্গীর তার সেই মায়ের পক্ষে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটকে একাট্টা করেছেন। নীরব সমর্থকদের সংগঠিত করেছেন। তিনি তার মাকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে গেছেন, কান্নাকাটি করেছেন। ভোটারদের সহানুভূতি আদায় করেছেন। আর আজমত উল্লা ভোটারদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না। জাহাঙ্গীরের মাকে তিনি খুব একটা হিসাবে ধরেননি। এটা ছিল ক্ষমতাসীনদের ভুল।
বাংলাদেশে এতদিন উত্তরাধিকারের রাজনীতির সংস্কৃতিতে বাবা কিংবা মায়ের আসনে সন্তান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। এবার তার উল্টোটি ঘটতে দেখা গেল। ছেলে আর মা মিলে আজমত উল্লাকে ১৬ হাজার ভোটে পরাজিত করেছেন। তা নিশ্চিত করেছেন আওয়ামী লীগের কৃপাধন্য ব্যক্তিরাই। তারা বিশ্বাস করেন, জাহাঙ্গীর রাজনীতিতে আসার পর এবং মেয়র হয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। সরকারের ভেতরেও অনেকে আছেন যারা তার থেকে সুবিধা নিয়েছেন। এটাকে কাজে লাগিয়েছেন জাহাঙ্গীর।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গাজীপুরের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানান সমীকরণ-নানা আলাপ শুরু হয়েছে। এটা ঠিক, সরকারের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল এ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার ব্যাপারে। কেননা, জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, মানুষের মুখে ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন- নির্বাচন হবে তো? তাতে সব দল অংশ নেবে তো? কাজেই সেই চ্যালেঞ্জকে অনেকটাই সামাল দিতে পেরেছে সরকার। এটা একটা ইতিবাচক দিক। এ নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা বাড়াবে। দলের নেতারা ইতিমধ্যে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন একইভাবে অবাধ-সুষ্ঠু হবে। এ শুধু কথার কথা। নিজের নাক কেটে কেউ অপরের যাত্রা ভঙ্গ করে না।
আওয়ামী লীগের ভেতর আরেকটি আওয়ামী লীগ তৈরি হয়েছে, তা প্রমাণ হয়েছে এ নির্বাচনে। এ আওয়ামী লীগ মোটেও ‘অরিজিনাল’ নয়। এর আগেও আমরা নানাভাবে এটা বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এ বিষয়টিকে অনেকটা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গত ১৫ বছরে নানা ছদ্মাবরণে নানাভাবে একটি গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের ভেতরে ঢুকে গেছে, এরা যে কখন আওয়ামী লীগের ভেতর প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে, দল এটা ধারণা করতে পারেনি। এখন যারা আওয়ামী লীগ করেন তাদের মধ্যে একটা অংশ তা করেন স্বার্থসিদ্ধির জন্য, দলের আদর্শের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি খুব ক্ষীণ- এটাও এ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছিল অতি আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী। ২০১৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে অহঙ্কার এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মনে করেন, দল যাকে মনোনয়ন দেবে তাকে প্রভাব খাটিয়ে জিতিয়ে আনবে। গাজীপুরে সেই প্রবণতা দেখা গেছে। যার কারণে যেভাবে গুরুত্ব সহকারে মাঠে কাজ করার দরকার ছিল, সেভাবে তারা গাজীপুরে কাজ করেননি। রাজনীতি হুমকি, ধমকের বিষয় নয়। একটি সমঝোতার কৌশল। এ চিরন্তন সত্যটা আওয়ামী লীগ ভুলেই গেছে।
জাহাঙ্গীর ও তার মা যখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন, তখন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ‘দমননীতি’ কৌশল নিয়েছিল। জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ভুল কৌশল প্রয়োগ করেছেন। ভোটের আগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা, দুদকে তলব, প্রচারের সময় গাড়ি ভাঙচুর, তার কর্মীদের ওপর পেশিশক্তি প্রয়োগ- সবই জনগণের মধ্যে জায়েদা খাতুনের পক্ষে এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি করেছে। ভোটের দিন দেখা গেছে, নৌকা গলায় ঝুলিয়ে তারা ঘড়ি মার্কায় ভোট দিয়েছেন।
গাজীপুরে পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললাম। তারা জানাল- ব্যক্তি জাহাঙ্গীর আলমের ইমেজ ও তার উন্নয়ন কাজ নগরবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। তারা বলছেন, মেয়র থাকাবস্থায় সড়ক সম্প্রসারণের নামে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি নেয়াসহ নানারকম অনিয়মের কারণে কিছুটা জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। তবে তার তিন বছরের শাসনামলে এলাকায় অনেক উন্নয়ন করেছেন তিনি। রাস্তাঘাটসহ এলাকার চিত্র পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এর প্রতিদান তারা ভোটের মাঠে দিয়েছেন। তাদের ধারণা, তাকে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হলে থমকে যায় উন্নয়ন কাজ। নানা ষড়যন্ত্র ও প্রতিহিংসার শিকার হয়ে নাজেহাল হন জাহাঙ্গীর। কিন্তু সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা তার ওপর অটুট থাকায় নির্বাচনের মাঠে প্রভাব ফেলে জায়েদা খাতুনের বিজয়।
জাহাঙ্গীর আলমের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনের কারণেই তার বিজয় সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। ঋণখেলাপির দায়ে তার প্রার্থিতা বাতিল হবে- এটা জানত জাহাঙ্গীর। তাই তার পক্ষে মা জায়েদা খাতুনকে তিনি মেয়র পদে দাঁড় করান। ছেলের কৌশলে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছেন মা। সাধারণ নারী ভোটারদের অকুণ্ঠ সমর্থন, শ্রমিকদের মধ্যে জাহাঙ্গীরের জনপ্রিয়তাও জায়েদা খাতুনের জয়ে ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া নির্বাচনের প্রচারে কয়েক দফা হামলা, বাধা দেয়ার বিষয়টি মানুষের নজর কেড়েছে। ফলে মানুষ অনেকটা বিরক্ত হয়েই আজমত উল্লা খানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। বিরোধী শিবিরের ভোটও পড়েছে জাহাঙ্গীরের মায়ের ব্যালটে। বুকে নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে অনেকেই ভোট দিয়েছেন ‘আম্মাজানকে’। জায়েদা খাতুন যেসব আসনে এজেন্ট দিতে পারেননি, সেখানেও জিতেছেন তিনি। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় তারা ও তাদের শরিকরা জায়েদা খাতুনের প্রতীকে ভোট দিয়েছেন।
আজমত উল্লা মার্জিত, বিনয়ী ও স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ হিসেবে গাজীপুরের রাজনীতিতে পরিচিত হলেও তার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলের তৃণমূলের নবীন কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে। সেটি বয়সের কারণে হোক কিংবা তার ব্যক্তিগত অন্য কোনো কারণেই হোক।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে ঢিলেমি ছিল প্রচারে। বড় বড় শোডাউন এবং রোডশো করলেও মানুষের দ্বারে দ্বারে যাননি। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একাধিক নেতা পরাজয়ের কারণ হিসেবে বলছেন, দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী মধ্যে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং। এতে আওয়ামী লীগের ভোট দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের একাংশ গোপনে ঘড়ির পক্ষে কেন্দ্রে কাজ করেছে। নৌকার প্রার্থী তা ধরতে পারেননি। তার এজেন্টরা কেন্দ্রের ভেতরেও নৌকার পক্ষে তৎপর ছিলেন না। ভোটের পর আজমত উল্লা বলেছেন, দলে থাকা বেইমানদের গাদ্দারিতে হেরেছেন। আবার সাধারণ মানুষের সঙ্গে আজমত উল্লার যোগাযোগ জাহাঙ্গীরের মতো নিবিড় নয়। গাজীপুর-টঙ্গীর ভোটারদের একটি বড় অংশ শ্রমিক। তারা জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে নানা সময়ে সাহায্য-সুবিধা পেয়েছেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো ও নির্বাচনী ব্যবস্থাটি এমন জায়গায় চলে গেছে যে, কার চেয়ে কে কতটা যোগ্য ও ভালো মানুষ- সেটি তার জয়-পরাজয়ের নিয়ন্ত্রণ করে না। মানুষ এখন ভোট দেয় কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, বরং অনেক সময় ভোট দিয়ে তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। যে কারণে দেখা যায়, দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকের বাইরে থাকা বিপুল ভোটারের অনেকেই সুযোগ পেলেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হন। আবার ক্ষমতাবানের কাছ থেকে তার কমিউনিটির অনেক মানুষ যেমন উপকৃত হন, তার বিপরীতে বিপুলসংখ্যক মানুষ বঞ্চিত এবং নানাভাবে নির্যাতিতও হন। ফলে তারা ভোটের সময় ‘দেখিয়ে দেয়ার’ অপেক্ষায় থাকেন। এ দেখিয়ে দেয়ার ব্যাপারগুলো গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঘটেছে। মানুষের ক্ষোভের আঁচটা যে মাত্রায় ছড়িয়েছে, এর প্রভাবটা এ নির্বাচনে পড়েছে। প্রশ্ন হলো- এ জয় কি তাহলে মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ?
বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়েছিল আওয়ামী লীগই। দলের মধ্যে একটা অংশ তো বিরুদ্ধে ছিলই। গাজীপুর নির্বাচন আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ এবং বিভক্তির ভয়ংকর রূপ বের হয়েছে। উপরিভাসা দলে ঐক্য থাকলেও ভেতরে দলীয় কোন্দল চরমে। যার খেসারত আওয়ামী লীগকে দিতে হয়েছে। আর এ কারণেই গাজীপুরের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি, অভ্যন্তীরণ দ্বন্দ্ব, জনগণের মনোভাব ইত্যাদি সম্পর্কে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে যে সঠিক তথ্য নেই, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনগুলোতেও যদি এরকম অন্তর্কলহ থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য বিষয়টি শুভ হবে না। আওয়ামী লীগকে উন্নয়নগর্বে আত্মমগ্ন থাকলে চলবে না। দলের মধ্যে বিভেদ, একশ্রেণির নেতা-কর্মীর ঔদ্ধত্য, বাড়াবাড়ি আচরণের জন্য ভেতরে ভেতরে যেসব শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা পূরণ করার ক্ষেত্রে আলসেমি করলে ফল কেমন হবে তা গাজীপুরই জানিয়ে দিচ্ছে।
লেখক: প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন
হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে তোলা সভ্যতা এখন ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। আমাদের সংস্কৃতিতে বিদ্রোহ আছে, বিষণ্ণতা আছে। সেখানে ভাষা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির ঐক্যের ভিত্তি। ওই ভাষা বিকশিত হয়েছে, বাংলা ভাষায় অতুলনীয় সাহিত্য ও সংগীত রচিত হয়েছে, কিন্তু ভাষা বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। শ্রেণির কারণে। বাঙালি তার ভাষার দ্বারাও বিভক্ত বটে। সেখানে সাম্প্রদায়িকতা ছিল, ছিল আঞ্চলিকতা; সব বাঙালিকে আজও শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব হয়নি, শিক্ষিত বাঙালি সবাই বই পড়ে না, উচ্চশিক্ষিতরা চর্চা করে ইংরেজি ভাষার। এ থেকে উত্তরণের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।
অর্থনীতির বিশেষ বিন্যাসের ওপর শ্রেণির অবস্থান। কিন্তু এ সত্যটাকে সে চায় এড়িয়ে চলতে। অর্থ যত বাড়ে, ততই বাড়ে ঘরের আসবাব আর বাড়ে কতকগুলো অমূর্ত ধারণার তার উৎসাহ। তখন সে কথা তোলে চরিত্রের, সত্যের, নীতির, ন্যায়-অন্যায়ের। এরাও আসবাবই এক প্রকারের- মানসিক আসবাব। কিন্তু বড় বড় ধারণার নিচে নিয়ামক শক্তি যে স্থূল অর্থনীতি, সেই স্পষ্ট সত্যটাকে যতক্ষণ পারা যায়, যেভাবে পারা যায়, যতবার পারা যায় অস্বীকার ও উপেক্ষা করার কাজটা সমানে চলতে থাকে। যেন রৌপ্য মুদ্রার দাপটটা মেনে নিলেই শুভকর্মের সমস্ত শুচিতা বিনষ্ট হয়ে যাবে, যেন অর্থোপার্জনের ব্যতিব্যস্ত কাজটা অতিশয় নোংরা ও নীতিবিগর্হিত।
অমূর্ত ধারণাগুলোকে নিয়ে অনেক রকম শব্দ করা হয়, কিন্তু সব শব্দ ছাপিয়ে ওঠে একটা কথা- শিক্ষা। শিক্ষা চাই, শিক্ষা দিতে হবে, শিক্ষার আলো লাগলে অন্ধকারের আর রক্ষে নেই, একেবারে উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। এর কারণ আছে। শিক্ষাই সেই সদর সিঁড়ি যা বেয়ে আমরা মধ্যবিত্তরা উঠে এসেছি। বিদ্যা দিয়েই বিত্ত অর্জন করেছি, যদি করে থাকি এবং যেটুকু করেছি। আর দেশ যেহেতু একই সঙ্গে অজ্ঞ ও দরিদ্র তাই বিদ্যা নিজেই একধরনের বিত্ত। কিন্তু যখন শিক্ষা প্রসারের হট্টগোল ওঠে তখন এ কথাটা খেয়াল করা হয় না যে, প্রসারের জন্য পথঘাট তৈরি আছে কি না শিক্ষা আমরা ক্রয় করি। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতা তো সবার নেই, যার আছে শিক্ষা শুধু সে-ই পাবে, এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীর বুদ্ধিগত যোগ্যতার কথাটা প্রায় অবান্তর। অর্থাৎ শিক্ষাবিস্তারের বড় বড় সড়ক আটকে রেখে শিক্ষাকে তাড়া দেয়া হচ্ছে ছড়িয়ে পড়ার। আর পরিসংখ্যানের হিসাব দেখিয়ে বড়াই চলছে যে, শিক্ষা দেশের আনাচে-কানাচে বিস্তর আলো বিতরণ করছে। বড় প্রশ্ন আরও একটা আছে। যে শিক্ষাটা তাড়া দেয়া হচ্ছে তার প্রকৃতিটা কী? ঔপনিবেশিক যুগের শিক্ষাব্যবস্থা কেরানি তৈরির যন্ত্রের চেয়ে বড় কিছু ছিল না, একটা প্রচলিত সমালোচনা। সেই ব্যবস্থার সংশোধন হয়তো কিছুটা হয়েছে, কিন্তু তার খোলনলচে বদল অনেক দূরের কথা। আর যদি শুধু কেরানি তৈরি নাও হয়, রদবদলের মাধ্যমে ব্যবস্থাটা যদি উৎপাদনশীল হয়েও ওঠে, তাহলে কি দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে দুধ ও মধুর বন্যা বয়ে যাবে? ধরে নিলাম অনেক বিজ্ঞানী, কারিগর, অর্থনীতিবিদ কি পণ্ডিত তৈরি হলো, দেশের উৎপাদনও বাড়ল কিছু, কিন্তু তাতে দেশের অগুনতি মানুষের বিশেষ কি আসবে যাবে? যা উৎপন্ন হবে তার প্রায় সবটাই তো বিত্তবান ও মধ্যবিত্তরা দখল করে নেবে। যেমন নিয়েছে অতীতে, নিচ্ছে এখনো। বস্তুত এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ধনবণ্টনের প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার মধ্যে কুশলী ও দক্ষ মানুষ তৈরি অর্থ মধ্যবিত্ত শ্রেণিটাকেই আরও খানিকটা শক্ত ও স্ফীত করা। বিদ্বানের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে উৎকেন্দ্রিকতা, পরিবেশ সম্পর্কে হীনম্মন্যতা, ক্ষোভ ও ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণা। পরিপুষ্টি যা ঘটছে তা এ বোধেরই। তাই শিক্ষা যদি বিবেকের উদ্বোধন না ঘটায় তাহলে তার সদম্ভ বিস্তারে বরং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কারণ আছে। সংখ্যায় বাড়ছে অথচ ক্রয়ক্ষমতায় বাড়ছে না এমন অবস্থা অর্থনীতিতে বিপজ্জনক; শিক্ষাব্যবস্থায় ততোধিক। শিক্ষাস্ফীতি মুদ্রাস্ফীতির চেয়েও ক্ষতিকর।
শিক্ষা বিস্তারের উল্টো পিঠে আরেকটা সমস্যার অস্তিত্বও স্বীকার করতে হয়। শিক্ষিত হলে মানুষ অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে চায়, তার প্রবণতা হয় নিজের চারপাশে একটা দূরত্ব ঘনিয়ে নেয়ার। সেই খানে প্রয়োজন সাহিত্যের। সাহিত্য পারে মানুষকে তার সংকীর্ণ স্বার্থের ক্ষুদ্র বিবর থেকে বের করে এনে বাইরের বৃহৎ জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে। কাজেই শুধু শিক্ষার সংখ্যাগত বিস্তার ঘটছে, সৎ ও বিবেকবান সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে না—এটাও সুখবর নয়, কেননা এর তাৎপর্য হলো, বুদ্ধি এগিয়ে গেছে, বিবেক আছে পেছনে পড়ে। কিন্তু সাহিত্যের যে প্রকারভেদ আছে সেটাও মেনে নেয়া আবশ্যক। সাহিত্যের মাধ্যমে যদি মধ্যবিত্তের মানসবিলাস, উগ্র নগরচেতনা, নকল আধুনিকতা, বিষয়বস্তুর চেয়ে আঙ্গিককে অধিক গুরুত্ব দেয়ার অভিরুচি—ইত্যাকার বিষয়কে দেশময় ছড়িয়ে দেয়া হয় তাহলে সেই সংক্রামক ব্যাধিতে কোনো মঙ্গল সূচিত হবে এমন বিবেচনা করা কঠিন। আসলে মধ্যবিত্ত সাহিত্যের বিস্তার মানে মধ্যবিত্ত চেতনারই বিস্তার, নব্যশিক্ষিতের অবরোধ দশাটা যাতে আরও পাকাপোক্ত হয় তারই ব্যবস্থা গ্রহণ। পাকিস্তান আমলে দেখা গেছে, সাহিত্যের ঐতিহ্য নিয়ে বিস্তর বিতণ্ডা হয়েছে এবং ঐতিহ্য দেশে খুঁজে না পাওয়া গেলে বিদেশেও তার খোঁজাখুঁজি চলছে। এ কাজটার পেছনে শুধু যে শাসকের প্ররোচনা ছিল তা নয়, সেই সঙ্গে সক্রিয় ছিল মধ্যবিত্তের অভিমান ও অহমিকা। তার অতীত থাক বা না থাক, অতীত নিয়ে গর্ব থাকা চাই। কিন্তু আপত্তি এখানে যে, আমরা আমাদের মধ্যবিত্ত অভিমান ও অহমিকার বোঝা দেশের মানুষের দুর্বল ও নিরপরাধ কাঁধের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছি। সাহিত্যকেও তাই মধ্যবিত্ত গণ্ডির বাইরে আনা অত্যন্ত আবশ্যক।
শিক্ষা ও সাহিত্য পরিবর্তনের পন্থা বটে, কিন্তু তাদের চেয়ে সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত ফলপ্রসূ পন্থা আছে। সেটা রাজনীতি। মধ্যবিত্তের ছুঁতমার্গ ও শুচিবাইগ্রস্ততা রাজনীতির প্রশ্নে যতটা স্পষ্ট, তেমন বোধহয় আর কোথাও নয়। তার দৃষ্টিতে রাজনীতি হলো একটা পেশা। পেশাদার যারা এতে শুধু তাদের এখতিয়ার—যেমনটা সত্য আর পাঁচটা পেশার ব্যাপারে। কিন্তু এ পেশাটা আর পাঁচটা পেশার মতো মহৎ নয়, এমনকি সত্ত্ব নয়; বরং এটা খারাপ পেশাই, খারাপ লোকদেরই পেশা, বখাটেদের শেষ আশ্রয়। কূটকৌশল ও চক্রান্ত এ পেশার ভিত্তি, অসত্য ভাষণ ও নীতিহীন আচরণ এর অবলম্বন। ভালো মানুষ ও ভালোমানুষির পক্ষে এ পেশা—একে ব্যবসায়ও বলা যায়—খুবই অনুপযোগী। অর্থাৎ অনেক নীতিচিন্তার কুজ্ঝটিকার মধ্যে এ সত্যটিকেই অবজ্ঞা করা হয় যে, রাজনীতিকে জীবন থেকে আলাদা করা যায় না, রাজনীতি শুধু খবরের কাগজ, জনসভা বা সংসদ কক্ষের ব্যাপার নয়। এ আমাদের গৃহজীবনেরও অনিবার্য অঙ্গ। দেশের রাজনীতির আওতার বাইরে আমরা কেউই নই। সমাজ-সম্পর্কের এ জটিলতার দিনে সমাজের প্রভাবকে এড়িয়ে সাধু বা সুফিদের মতো ব্যক্তিগতভাবে সৎ জীবনযাপন করার কথা ভাবা অবাস্তব ও অবান্তর কল্পনাকে প্রশ্রয় দেয়া। কেননা, সমাজ প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকে আক্রমণ করছে, ব্যক্তিগত জীবন কী চেহারা নেবে তা ঠিক করে দিচ্ছে। কাজেই সমাজ যাতে সততার সহায়ক হয় সে চেষ্টা করা দরকার সৎ থাকার ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই। সব দিক দিয়েই রাজনীতি হচ্ছে এ কালের মানুষের বিধিলিপি একে অবজ্ঞা করা, তেমনি অসম্ভব যেমন অসম্ভব আলো-বাতাসকে অবজ্ঞা করা। অসুস্থ রাজনীতিকে সুস্থ করার উপায় রাজনীতি থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়, রাজনীতিতে স্বাভাবিকভাবে অংশগ্রহণ করা।
ব্যক্তির জীবনে রাজনীতির এ গুরুত্ব প্রাচীনকালে অ্যাথেন্সবাসী এবং আধুনিককালে চীন দেশবাসী যথার্থ উপলব্ধি করেছেন। গ্রিক ভাষায় ‘নির্বোধ’ বলতে বোঝায় তেমন মানুষ, সামাজিক ব্যাপারে যে অংশগ্রহণ করে না (অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞানী হ্যামলেট একজন নির্বোধ, কিন্তু নির্বোধ বলে নিন্দিত ডন কুইক্সট একজন বুদ্ধিমান)। নির্বোধকে এভাবে নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করার মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত অ্যাথেনীয় গণতন্ত্রের সৃজন ও বিকাশে তার বড় একটি ভূমিকা ছিল। প্রাচীন অ্যাথেন্সে রাজনীতিকে মনে করা হতো সামাজিক জীবনের প্রধানতম অংশ ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকশক্তি। সব নাগরিকের অংশগ্রহণ, সবাইকে একত্র সংলগ্নকারী চেতনা এবং সবার নাগরিক অধিকার-সচেতন সাম্যদৃষ্টিকে বাদ দিয়ে অ্যাথেন্সের কালজয়ী ও বিশ্ববন্দিত সভ্যতাকে কল্পনা করা অসম্ভব।
নব্যচীনের প্রায় অবিশ্বাস্য শক্তির উৎসও ওই একই স্থানে। চীনে রাজনীতিই প্রথমে আসে—শিল্পের আগে, এমনকি উৎপাদন ব্যবস্থারও আগে। রাজনীতিই নিয়ন্ত্রিত করে সামাজিক ব্যবস্থার সব এলাকাকে। সঠিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন সঠিক উৎপাদন নেই, সঠিক শিক্ষা নেই। সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পর্কে নানাবিধ প্রচারের কুয়াশা ভেদ করেও যেটুকু তথ্য জানা গেছে তাতে বোঝা যায় বিপ্লবের কর্মীদের যে মানসিকতার সঙ্গে তীব্র দ্বন্দ্বে নিয়োজিত হতে হয়েছে তার সেই অতি প্রাচীন ব্যাধি যা না-কি বলে, অনবরত বলে, যে যিনি পদার্থবিজ্ঞানী তিনি হবেন শুধু ওই বিজ্ঞানেরই বিশেষজ্ঞ, ঐতিহাসিক যিনি তার একমাত্র দায়িত্ব ইতিহাসের জ্ঞান সঞ্চয় করা, তার বাইরে তিনি যাবেন না, গেলে ক্ষতি হবে জ্ঞানের, অপচয় ঘটবে সময়ের, বিচলিত হবে নিমজ্জিতচিত্ত অভিনিবেশ। তাকে হতে হবে পিপীলিকা, অথবা মাকড়সা, সংগ্রহ করবেন পরিশ্রমে, নয়তো প্রতিভা বলে গড়বেন সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ঊর্ণনাভ। এই মনোবৃত্তির মধ্যে পৃষ্ঠপোষকতা আছে সামাজিক অজ্ঞতার ও বিচ্ছিন্নতার এবং ততোধিক আছে আত্মনিমগ্নতা ও স্বার্থপরতা। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য এ মনোবৃত্তি সম্পূর্ণ অনুপযোগী ও মারাত্মকরূপে ক্ষতিকর। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গ্রিকরা যাকে নির্বুদ্ধিতা বলতেন, নব্যচীনেরা যাকে বলেন ব্যাধি, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের চিত্তভূমিতে তা একটি অত্যুজ্জ্বল ও অতিপ্রাথমিক সত্য। এ মধ্যবিত্তের জীবনে সামাজিকতা অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকতা আছে বহুদিন, কিন্তু সমাজবদ্ধতা নেই আন্তরিক; ঐক্যবোধ ও সাম্য-দৃষ্টি—অনুপস্থিত উভয়েই। রাজনীতিতে অনুৎসাহ, এবং রাজনীতির বাইরে থাকাকে উৎকৃষ্ট নৈতিক গুণ মনে করার তাৎপর্য তাই নিতান্ত সামান্য নয়।
দেশের উন্নতি হচ্ছে এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে হবে সেটা কার উন্নতি। আর দেখতে গেলেই দেখা যাবে, সে উন্নতি আসলে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের। শ্রেণিভেদটা যে গড়ে উঠেছে তা ভবিষ্যৎ সংঘর্ষেরই প্রস্তুতি। বৈষম্যে, অত্যাচারে, নিষ্পেষণে সেই প্রস্তুতিই তীব্র হচ্ছে, তার শক্তিই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতের সংগ্রামে হ্যামলেটদের বড় ভূমিকা থাকবে না, তা তারা যতই বিচক্ষণ হন, ডন কুইক্সটদের থাকবে তা তাদের নিয়ে বিজ্ঞমন্য হ্যামলেটরা যতই হাস্যকৌতুক করুন।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি
পরিবেশ কিংবা জলবায়ুর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু শব্দ সাধারণ মানুষের বুঝতে সমস্যা হয়। এর অর্থ এই নয় যে শব্দগুলো অনেক কঠিন ভাষায় রচিত। আসলে শব্দগুলো সহজ-সরল বাংলা ভাষায়ই রচিত। এগুলো বহুল প্রচলিত শব্দ হলেও এর অর্থ সর্বসাধারণের মাথায় ঢোকে না। আবার সামান্য একটু বুঝিয়ে দিলেই বিষয়টি মনে রাখতে পারেন অনেকেই। তেমনি কিছু শব্দ আছে, যেমন: জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ওজোনস্তর ও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ইত্যাদি। ইতিপূর্বে শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলেও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি এখনো। তাই আজকের আলোচ্য বিষয়- ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ নিয়ে।
তবে আলোচনার আগে আমাদের জেনে নিতে হবে সেই উপরোক্ত শব্দগুলোর অর্থগুলো। যেমন: ‘মানুষের নানা কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বোঝায়।’ সহজ বাংলায় পরিবেশ অথবা জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হলে ওই এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ বলা হয়। ইংরেজিতে বলা হয় ‘ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ সংক্ষেপে ‘ইসিএ’। যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে শব্দগুলো ব্যাপক পরিচিত। অন্যদের কাছেও যে অপরিচিত শব্দ, তা কিন্তু নয়। শুধু বোঝার ব্যাপারটাই কাজ করে; অন্য কিছু নয়।
আমাদের দেশে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নিরূপণ করা হয়েছে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে। সেই আইনে প্রথম দেশের আটটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও চারটি এলাকা সংযোজন করা হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশই জলাভূমি। এলাকাগুলো যথাক্রমে সুন্দরবন, কক্সবাজার, টেকনাফ উপদ্বীপ (পেনিনসুলা), সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড়, ঢাকাবেষ্টিত বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী ও গুলশান-বারিধারা লেক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর সংশোধিত ধারা ৫-এর বিভিন্ন উপধারায় বিস্তারিত তথ্য দেয়া আছে। ব্যাখ্যা দেয়া আছে, কেন এই ১২টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ব্যাখ্যার যৎসামান্য তথ্য নিম্নে তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমরা।
প্রথমে সুন্দরবনের কথাই আসা যাক। এই বন শুধু আমাদের জাতীয় সম্পদই নয়, এটি আমাদের জাতীয় বনের মর্যাদাও পেয়েছে। এ ধরনের শ্বাপদসংকুল বৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। যেমন দুর্গম, তেমনি জীববৈচিত্র্যে ঠাসা এ বন। এই বনটি বিভিন্ন কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন বিধায় এর চারপাশের প্রান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। ফলে যে কেউ ইচ্ছা করলেই অবাধে মৎস্য আহরণ, গাছগাছালি কর্তন করতে পারে না। তাতে করে মৎস্যসম্পদ ও বৃক্ষরাজি রক্ষার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের সার্কেল সুরক্ষিত হচ্ছে।
সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড় মিঠাপানির জলাশয়। এতদ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, জলজ উদ্ভিদ, পরিযায়ী পাখি স্থানীয়দের অত্যাচারের কারণে অস্তিত্বসংকটে পড়েছিল। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার এই হাওর-বাঁওড়গুলোকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলে কেউ মর্জি মোতাবেক সম্পদ বিনষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছে না এখন আর।
কক্সবাজার-টেকনাফের উপদ্বীপে বন্য প্রাণীর প্রজননক্ষেত্র এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের নিরাপদ চারণভূমি বিধায় এ দুটি অঞ্চলকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তাতে করে সামুদ্রিক প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে।
সেন্ট মার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপের গুরুত্ব এবং জীববৈচিত্র্যের আধিক্যের কারণে এ দুটি দ্বীপকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়ছে। এখানে দুর্লভ অলিভ রিডলি টার্টলের (জলপাইরঙা কাছিম) প্রজননস্থল। এ ছাড়া সোনাদিয়া দ্বীপে বিপন্ন প্রজাতির পাখি চামচঠুঁটো বাটানের আবাসস্থল। অন্যদিকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে দুর্লভ জীববৈচিত্র্য ছাড়াও পরিবেশগত কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন। বিশেষ করে এ দ্বীপ পর্যটক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। যেমন: পলিথিন, কোমলপানীয়ের কৌটাসহ নানা ধরনের আবর্জনা ফেলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে পর্যটকদের রাত্রিযাপন কিংবা আয়েশের জন্য বেশ কিছু হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। এতে করে মাটি খোঁড়াখুঁড়ির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে সেন্ট মার্টিন ভাঙনের কবলে পড়ে, বিষয়টি গোচরীভূত হতেই সরকার রাত্রিযাপনে নিষেধাজ্ঞাসহ দ্বীপটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
অন্যদিকে বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু-শীতলক্ষ্যা নদী ও গুলশান-বারিধারা লেক অসহনীয় মাত্রায় দূষণের কবলে পড়ে। কলকারখানা নির্গত অপরিশোধিত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, পলিথিন ও গৃহস্থালির আবর্জনায় জলাশয়ের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পানি বিবর্ণ হয়ে এসেছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ, পোকামাকড় ও মাছ মারা যাচ্ছে; স্থান বদল করছে। এসব প্রতিবেশগত কারণে জলাশয়গুলো হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, ফলে সরকার সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে এ এলাকাগুলোকে।
দেশে এ ধরনের আরও কিছু সংকটাপন্ন এলাকা রয়েছে। তার মধ্যে ‘চলনবিল’ অন্যতম। আমরা আশাবাদী বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সেটিও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত হবে একদিন। শুধু চলনবিল-ই নয়, দেশে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জলাশয় কিংবা বন-বনানী রয়েছে, সেসব এরিয়াকে অতিসত্বর ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে বলে নেয়া আবশ্যক, সরকার বিভিন্ন সংকটাপন্ন এলাকা সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারের একার নয়; আমাদের ঘাড়েও বর্তায়, যা সবার মনে রাখতে হবে। কারণ দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সবারই। আমাদের বেঁচে থাকতে হলে জলবায়ুর পরিবর্তন যেমন ঠেকাতে হবে, তেমনি জীববৈচিত্র্যও রক্ষা করতে হবে। বলে নেয়া ভালো, আমাদের বেঁচে থাকার সঙ্গে এই সার্কেলটি বিশেষভাবে যুক্ত। সুতরাং আমরা জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করি উদ্দাম গতিতে।
আমরা জানি, পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে হলে একটি মাধ্যম প্রয়োজন। আর সেই উকৃষ্ট মাধ্যমটি হচ্ছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তাই আমরা ইচ্ছা করলে সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে, সবুজ বাঁচিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে পারি। পাশাপাশি পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর গুরুত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরি। নিজের উদ্যোগে প্রচারকাজে অংশ নিয়ে দেশকে সবুজ সমাহারে ভরে তুলি। এ বিষয়ে কাজ করতে যুব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি আমরা, ‘আসুন ফেসবুকে সময় না কাটিয়ে দূষণমুক্ত বাংলাদেশ তথা সবুজ বিশ্ব গড়ে তুলি নিজ দায়িত্বে।’ নিজ নিজ উদ্যাগে এই সংরক্ষিত এলাকাগুলোর প্রতি নজরদারি এবং পরিধি বাড়িয়ে দিই আমরা। যাতে এতদাঞ্চলে কোনো ধরনের উপদ্রব না ঘটে। তবেই আমাদের এই সবুজ গ্রহ স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে পারবে, সেই সঙ্গে আমরাও বেঁচে থাকার যথাযথ উপাদান পেয়ে যাব।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট
বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাপান আর যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। প্রকৃত অর্থে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, নিরাপত্তার স্বার্থ, আর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর ভিত্তি করা যুক্তরাষ্ট্র-জাপান সম্পর্ক মূলত যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য বিস্তারের এক কার্যকরী পন্থায়ই পরিণত হয়। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী চুক্তি ও সমঝোতার দরুন জাপানের শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ওপর নিজ নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য নির্ভরশীল থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জাপানকে নিজ স্বার্থ অনুযায়ী বিশ্বব্যবস্থায় ব্যবহার করা আরও সহজ হয়ে ওঠে। এ জন্যই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপান ওয়াশিংটনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।
এই মিত্রতা এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল অনেকটাই একই লক্ষ্য অর্জনের জন্য গঠিত। ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ও স্বার্থ বাস্তবায়নে এখন এক অনন্য ও সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে জাপানের সফট্ পাওয়ার বেশ কার্যকরী ও এর ব্যাপ্তিও অনেক। এ অঞ্চলে জাপান যে পরিমাণ বাণিজ্যিক ও উন্নয়নমূলক বিনিয়োগ করেছে তাতে সৃষ্ট জাপানের প্রভাব এই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে দুর্বলতাগুলো উত্তরণে সহায়তা করবে। যুক্তরাষ্ট্র এখন উপলব্ধি করছে যে, ভারত মহাসাগর এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলব্যাপী নিজ স্বার্থ ও কৌশল বাস্তবায়নে যে বিশ্বাসযোগ্যতা, সফট্ পাওয়ার ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রয়োজন সেটা ওয়াশিংটনের নেই। আদৌ সেটা হওয়ারও নয়। কিন্তু জাপান এর ঠিক উল্টো। এ ক্ষেত্রে জাপানের এই অঞ্চলব্যাপী বিস্তর সুখ্যাতি রয়েছে। জাপানের সামরিক সীমাবদ্ধতার কারণে জাপানকে নিয়ে এ অবধি তেমন কোনো আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বা আশঙ্কারও সৃষ্টি হয়নি। ফলে ইন্দো-প্যাসিফিক ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে জাপানের বিভিন্ন পর্যায়ের বিনিয়োগ ও বহুমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা আজও হয়নি।
তবে জাপান এখন তার বৈশ্বিক পরিচিতি পরিবর্তন করতে অনেকটাই সচেষ্ট। জাপান এখন ভারত মহাসাগর অঞ্চলে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী, যাতে নিজ প্রভাব আরও বিস্তৃত করতে পারে। এর প্রধান কারণ, অবশ্যই চীনের প্রভাব বিস্তার রোধ করা। চীন ভারত মহাসাগর, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে যে পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করেছে, সেটাকে প্রতিরোধ করতে জাপান এখন তার কূটনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতিতে বিপুল পরিবর্তন আনতে প্রতিনিয়ত কাজ করছে।
জাপানের এই পরিবর্তন প্রচেষ্টায় জি৭ সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ এক সুযোগে পরিণত হয়। এ বছরের জি৭ সম্মেলনের স্বাগতিক ও জি৭ গ্রুপের প্রেসিডেন্ট জাপান। একই সঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদও পেয়েছে জাপান। এরই সুবাদে জাপান সম্প্রতি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলপত্র প্রকাশ করেছে। এই কৌশলপত্রগুলো জাপানের আঞ্চলিক নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল, নীতি পরিবর্তনের সবচেয়ে প্রকট নিয়ামক বহন করে। তিনটি কৌশলপত্রই জাপানের জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বর্ধন কর্মপরিকল্পনা। অর্থাৎ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে জাপান যে এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নয়, বরং নিজ সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে আরও সক্রিয় ও প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে চায়, সেটা তারা পরিষ্কার করেই বিশ্বব্যাপী জানান দিয়েছে। জাপানের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গির এই ব্যাপক পরিবর্তন দেশটির সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই করা হচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী আগ্রাসী মনোভাব থেকে সরে আসার প্রত্যয়ে জাপান যে সংবিধান, চুক্তি ও সমঝোতাগুলো প্রবর্তন করে, সেগুলোর প্রতি এখনো শ্রদ্ধা বজায় রাখছে। পরিবর্তন শুধু এতটুকুই যে, জাপান এখন আঞ্চলিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে তার কূটনীতি বিস্তৃত করতে আগ্রহী। জাপানকে এখন আর সেই নীরব পরোক্ষ দর্শক নয়, প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যাবে ভারত মহাসাগর ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে।
জাপান তার এই অভিলাষ খুব স্পষ্টভাবেই জি৭ সম্মেলনে প্রকাশ করেছে। জি৭ সম্মেলনের সদস্যদের পাশাপাশি জাপান এবার ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ করে। আমন্ত্রিতদের তালিকা পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হয় যে, জাপান এখন বৈশ্বিক পর্যায়ে, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথ অঞ্চলে আরও নিবিড়, ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ভূমিকা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। এ জন্যই দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। জাপান এখন পশ্চিমাবিশ্ব, তথা বিশ্ব সাত মোড়লের হয়ে এই অঞ্চলে তাদের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা প্রদান করতে চায়। জাপান এই অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্যিক ও উন্নয়নমূলক বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে চায়। একই সঙ্গে যেখানে প্রয়োজন সেখানে বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতা বা নিরাপত্তা নীতি পরিবর্তন কিংবা প্রতিরক্ষা নীতি পরিবর্ধন, অর্থাৎ যেকোনো পদক্ষেপ নিয়ে জাপান পশ্চিমাদের জন্য এ অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করতে এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যাতে চীনের বর্ধমান প্রভাব ও আধিপত্য যেকোনো মূল্যে প্রতিরোধ করা যায়। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মাধ্যমে চীন প্রতিরোধের যে কৌশল নিয়েছিল, সেটা এখন ওয়াশিংটন জাপানের মাধ্যমে করতে আগ্রহী। ভারতকে দিয়ে যে কাজ হচ্ছে না, সেটা যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই অনুভব করছিল। ভারতকে চীনের প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই ব্যর্থ। ভারত কার্যকর রূপে এই ভূমিকা পালনের কথা বারংবার বলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আঞ্চলিক সুবিধাই ভোগ করেছে। কিন্তু তেমন কোনো কার্যকরী প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি দিল্লি। উল্টো ভারতের সঙ্গে তথাকথিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে এই অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বেড়েছে বৈকি কমেনি।
এই অঞ্চলে চীনের প্রতিরোধক ও যুক্তরাষ্ট্রের চোখ-কানের ভূমিকায় ভারতের ব্যর্থতার কারণ নিয়ে একটু কথা না বললেই নয়। ভারতের মতো একটি রাষ্ট্রের তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে এখন যে সম্পর্ক সেটা আসলেও অবাক করার মতো। প্রায় সবার সঙ্গেই ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন। ভারত শুধু তার নিজের স্বার্থ দেখে, অন্যদের নয়, এমনটা সর্বদাই শোনা যায়। আর ভারত এখনো তার আমদানিকারক পণ্যের দীর্ঘ তালিকার অধিকাংশের জন্যই চীনের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ চীনের প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার সক্ষমতা বলতে গেলে নেই ভারতের। সুতরাং ভারত যে তার আকাঙ্ক্ষিত ভূমিকা কেন পালন করতে পারছে না, সেটা পরিষ্কার। আর সেটা এখন যুক্তরাষ্ট্র ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে। মজার বিষয় হলো, ভারতের যেসব দুর্বলতা ও অক্ষমতার কারণে ভারত চীনকে এই অঞ্চলে প্রতিরোধে ব্যর্থ, জাপানের সেগুলোর একটিও নেই। অন্যদিকে একটি নির্ভরযোগ্য, সক্ষম ও প্রভাবশালী আঞ্চলিক নেতৃত্ব প্রদানে যা যা প্রয়োজন জাপানের তার প্রত্যেক বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। জাপানও বিষয়টি এখন উপলব্ধি করা শুরু করেছে। সুতরাং এই অঞ্চলে আরও প্রভাবশালী ভূমিকার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ভারতের জায়গায় অধিষ্ঠিত হতে সচেষ্ট এখন জাপান। আবার টোকিও দিল্লিকে সরিয়ে নয়, বরং সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে চাইছে। ভারতের উঠোনে, ভারতকে বাদ দিয়ে যে কাজ করা যাবে না, সেটা জাপান ভালোই জানে।
এতে করে জাপানের অনেক সুবিধাও হচ্ছে। চীনকে প্রতিরোধ করতে, ভারত মহাসাগরে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে জাপানের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জাপান ও সাউথ চীন সমুদ্র অঞ্চলে নিজ নৌবাহিনীর সক্ষমতা দিয়ে জাপান চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে সক্ষম। এ জন্য ভারত মহাসাগরে প্রতিরক্ষা প্রভাব প্রতিষ্ঠায় যে পরিমাণ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করা দরকার সেটা জাপানের আপাতত নেই। তাই ভারত মহাসাগরে নিজের নতুন প্রতিরক্ষা ভূমিকা প্রণয়নে টোকিও আপাতত ভারতের ওপর নির্ভর করছে।
বাংলাদেশের জন্য জাপান এক নির্ভরশীল, সম্মানিত, শ্রদ্ধেয় ও পরীক্ষিত বন্ধু। জন্মলগ্ন থেকেই জাপান বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন অংশীদার। আর ২০২০ সাল থেকে জাপানের সর্বাধিক উন্নয়ন সহায়তা গ্রহণকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। এই দুটি তথ্যই বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্কের ব্যপ্তি, ঘনিষ্ঠতা, গুরুত্ব, গভীরতা প্রকাশে যথেষ্ট। বাংলাদেশের কৌশলগত ভূরাজনৈতিক অবস্থান উভয় জাপান ও ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের জন্য প্রয়োজনীয়। জাপান ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি করতে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে আরও বিনিয়োগ করছে।
বাংলাদেশের মতো, মিয়ানমার, ভারত ও এই অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্রেও জাপানের উন্নয়ন সহায়তা প্রশংসনীয় ও কার্যকরী। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব প্রতিরোধে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক এক অত্যন্ত কার্যকর ও প্রভাবশালী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে জাপানের অংশীদারত্ব এ ক্ষেত্রে আরও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বাংলাদেশে এ জন্যই জাপান একটি শিল্পনগরও প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যাতে উত্তর-পূর্ব ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সাপ্লাই চেইন সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা যায়। জাপানের এই আকাঙ্ক্ষা গত এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকালে জাপান আরও জোরালোভাবে ব্যক্ত করে। একই সঙ্গে জাপান বাংলাদেশে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। এর মধ্যে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনে এক অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিনিয়োগ জাপানের বিগ-বি উদ্যোগের অংশ হিসেবেই করছে টোকিও। এই বিগ-বি উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশে আরও কতগুলো উন্নতমানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প ও বিনিয়োগ করবে জাপান।
জাপানের মোট বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে হয়। এ জন্য বঙ্গোপসাগর জাপানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই সমুদ্র অঞ্চলে বাংলাদেশের মাধ্যমে জাপান সরাসরি সংযোগ স্থাপন করছে। এ জন্য শুধু বাণিজ্য, আঞ্চলিক সংযোগের জন্যই নয়, জাপানের নতুন প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী প্রক্সির ভূমিকা পালনেও বাংলাদেশকে জাপানের প্রয়োজন।
যাই হোক, জি৭ সম্মেলন, উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন, আর জাপানের নতুন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গিও মাধ্যমে জাপান তার নতুন পরিচয় বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে এই ভারত মহাসাগর অঞ্চলে প্রতিষ্ঠায় তৎপর। আসন্ন দিনগুলোতে আমরা এক নতুন জাপানকে দেখব। এতদিন যে যুক্তরাষ্ট্রের পেয়াদা হিসেবেই এগিয়েছে, এখন কিন্তু সে বোর্ডের আরেক প্রান্তে পৌঁছে গেছে। এ অঞ্চলে বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক দাবা খেলার নতুন উজিরে পরিণত এখন জাপান।
লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম, অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি তিনি দেশের জনস্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ে দৈনিক বাংলাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। দৈনিক বাংলার পক্ষে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক এম এ খালেক
এম এ খালেক: আপনি সম্প্রতি বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ে একটি চমৎকার গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করেছেন। এই গবেষণার উদ্দেশ্য এবং ফাউন্ডিংসগুলো সংক্ষেপে বলবেন কি?
মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: ২০২২ সালের জুন মাসে ’৫০-এ বাংলাদেশ: জনসংখ্যা ও উন্নয়নে পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আমি ও আমার সহগবেষকদের একটি গবেষণা প্রবন্ধ ‘জার্নাল অব গভর্ননেন্স, সিকিউরিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’–এ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এশিয়ান পপুলেশন অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে ২০২৩ সালের জানুয়ারির ২৬ তারিখে ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে জাতীয় জনসংখ্যা বিষয়ে আয়োজিত ওয়েবিনারে আমি জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগ, বিশ্বব্যাংক উন্নয়ন সূচক ও দেশীয় জাতীয় উপাত্ত ব্যবহার করে একটি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করি। সে গবেষণারই একটি অংশে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল।
ওই গবেষণায় মূলত দেখতে চেয়েছি, দেশের জনসংখ্যার আকার, বণ্টন, জনমিতিক প্রক্রিয়া (জন্ম, মৃত্যু ও স্থানান্তর) অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের গতিধারা ও চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে সমাধান খোঁজা। এ ক্ষেত্রে গবেষণায় শহুরে জনসংখ্যার ক্ষেত্রে যে ফলাফল দেখতে পেয়েছি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নগরে বসবাসকারী জনসংখ্যা ছিল ৮ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। (জনশুমারি ২০২২ অনুযায়ী) তবে ইউএন হ্যাবিটেট বা বিশ্বব্যাংকের তথ্যে আরও বেশি। সে প্রেক্ষাপটে ২০৩০ সালে ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ আর ২০৪০ সালে ৫২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ বাস করবে নগরে।
মোট জনসংখ্যায় নগর জনসংখ্যার আকার ও আনুপাতিক হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেশে বর্তমানে নগরবাসী শতকরা হিসাবে ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ (জনশুমারি ২০২২ অনুযায়ী), ২০৩০ সালে ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০৪০ সালের (৫২ দশমিক ২ শতাংশ) মধ্যে প্রতি দুজন বাংলাদেশির একজন হবে নগরবাসী (জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত জনসংখ্যা বিভাগের বিশ্ব নগর ২০১৮ তথ্যানুযায়ী)। দ্রুত নগরায়ণের ফলে শহরে জনসংখ্যার আকার যেমন বেড়েছে, তেমনি শহরে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (২ দশমিক ৫ শতাংশ) দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের (১ দশমিক ২২ শতাংশ) দ্বিগুণ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
দ্রুত নগরায়ণের পাশাপাশি যানবাহন ও কাঠামোগত পরিবর্তন, মানুষ পল্লি এলাকা থেকে শহর অভিমুখে স্থানান্তর করছে জীবন-জীবিকা নির্বাহে কাজের সন্ধানে কিংবা অধিকতর মঙ্গল জীবনযাত্রার জন্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য, নদীভাঙনের জন্য এবং অন্যান্য কারণে। অদূর ভবিষ্যতে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত বিশেষ করে জলবায়ুজনিত কারণে শহরে স্থানান্তরের সম্ভাবনা বেশি রয়েছে। ফলে শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পরিকল্পিত নগরায়ণই কেবল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, হেলদি সিটি ও টেকসই নগরে রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এম এ খালেক: বাংলাদেশের শহরগুলো অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত। এই অবস্থায় ২০৪০ বা ২০৫০ সালে ঢাকা শহরের অবস্থা কেমন হতে পারে বলে মনে করেন? সেই পরিবর্তিত অবস্থা মোকাবিলার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত?
মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: ঢাকা শহর বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম মেগা সিটিতে রূপান্তরিত হয়েছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের তথ্যে ঢাকা শহর বর্তমানে পৃথিবীর নবম জনবহুল শহর। ২০৩০ সালে ঢাকা বিশ্বের চতুর্থ জনসংখ্যাবহুল শহরে পরিণত হবে। তখন দিল্লি, টোকিও ও সাংহাইয়ের পর এ শহরের জনসংখ্যা হবে প্রায় ২ কোটি ৮০ লক্ষ। ব্রাজিলের সাওপাওলো ও ভারতের মুম্বাইয়ের মতো বড় শহরও ঢাকার পেছনে পড়বে। জনঘনত্ব অনেক বেড়ে যাবে।
আমরা সেই অবস্থার জন্য মোটেও প্রস্তুত নই। আমাদের এখনই প্রস্তুত হতে হবে- বিশেষ করে নাগরিক পরিষেবার ক্ষেত্রে। আমি বিশেষভাবে চিন্তিত ঢাকা শহরের যানজট নিয়ে। সাধারণত একটি আদর্শ শহরে শতকরা ২৫ ভাগ সড়ক থাকতে হয়। ঢাকা শহরে আছে মাত্র ৭ ভাগ এবং তাও বিভিন্নভাবে দখলের কারণে সংকুচিত হচ্ছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করা হলে যানজট অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে মেট্রোরেল যানজট সমাধানে কেবল একটি কার্যকর পদক্ষেপ তবে তা সময় সাপেক্ষ। তবে অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার বাড়লে ফ্লাইওভার নির্মাণ যানজট নিরসনে কার্যকর হবে না তা ইতিমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। এ শহরে নিয়ন্ত্রিত ও পরিমিত যান চলাচল করছে না। হাঁটার জন্য পর্যাপ্ত স্থান নেই। কোথাও কথাও থাকলেও তা দখলে চলে যাচ্ছে। পথচারীবান্ধব নয় এ শহর। বিশেষ করে প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও শিশুদের চলাচল উপযোগী নয়। অথচ আমরা ঢাকাকে একটি সুন্দর, শোভন ও টেকসই নগর হিসাবে দেখতে চাই।
এম এ খালেক: রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে যানজট একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আগামী জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে যানজট সমস্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। সেই অবস্থায় যানজটের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য আপনার কোনো নির্দিষ্ট পরামর্শ আছে কী?
মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: যানজটের আর্থিক ক্ষতি কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রয়োজন। সঠিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা চালু করা দরকার। ভিয়েতনাম ও চীনের অভিজ্ঞতাকে এ ক্ষেত্রে উদাহরণ নিতে পারে বাংলাদেশ। উন্নত গণপরিবহন প্রবর্তন, গণপরিবহনের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, পার্কিং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারীদেরও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন প্রয়োজন। ট্রাফিক আইন মেনে পথ চলা। সড়কপথের পাশাপাশি বিকল্প যোগাযোগব্যবস্থাকে (খাল বা দীর্ঘ লেক) চলাচল। পথচারীবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। তবে শহরে পার্কিং ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনয়ন অতি দ্রুত জরুরি। প্রয়োজনে সপ্তাহে ২-১ দিন বাসা থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অফিস করারও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, যানজটের কারণে শুধু আর্থিক ক্ষতি নয় নাগরিকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব পড়ছে। কারণ, ঢাকা শহরে সীমিত সড়ক ও যানবাহনের আধিক্যই মাত্রাতিরিক্ত যানজটের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া সড়কের সংস্কার ও উন্নয়নের কাজ যথাসময়ে ও সঠিকভাবে সম্পন্ন না হওয়াও আরেকটি কারণ। ফলে যানজট নিরসনে প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ ও পরিকল্পিত নগরায়ণ। যানজটের জন্য মাত্রাতিরিক্ত স্থানান্তর বা অভিবাসনও দায়ী। ফলে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে তা না হলে যানজট পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাবে এবং ভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে বৈকি কমবে না।
এম এ খালেক: আপনি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের কথা বলেছেন, যা আর ১০-১৫ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তখন দেশে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতার অভাব রয়েছে। এই অবস্থায় সরকার ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল পাওয়ার জন্য আশু কী করতে পারেন?
মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: বর্তমানে বাংলাদেশে নির্ভরশীল জনসংখ্যা সবচেয়ে কম এবং কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যার বয়স-কাঠামোর বিবেচনায় দেশে ৬৫ দশমিক ২৩ শতাংশের বেশি মানুষ ১৫-৬৪ বছরের মধ্যে যারা অর্থনীতিকভাবে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। এ জনসংখ্যাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ত্বরায়ণ- জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের সর্বাধিক সুবিধা নিতে পারবে আগামী ১৪-১৫ বছর পর্যন্ত। তবে তা নির্ভর করছে কী নীতি ও কৌশল প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হচ্ছে তার ওপর। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক নীতি ও সুশাসন প্রত্যেকটি নিশিচত করার ওপর নির্ভর করছে জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জন। সব পর্যায়ে নীতি- কৌশল বাস্তবায়নে সচেতনতা ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জন নির্ভর করে তার সুযোগ সৃষ্টি, সুযোগের সদ্ব্যবহার এবং তা দীর্ঘায়ন করার ওপর। আমাদের ক্ষেত্রে এ সুযোগ সৃষ্টি হলেও এ লক্ষ্যে সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল প্রয়োজন। আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান (চাকরি) ও সুশাসনসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। শ্রম বাজারে অংশগ্রহণের হারে নারী ও পুরুষের বিদ্যমান বিশাল ব্যবধান লাগব করতে হবে। বেকারত্বের হার বিশেষ করে যুব বেকারত্বের হার হ্রাস করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো- বাল্যবিবাহ, দ্রুত সন্তানধারণ, শ্রমবাজারে নারীদের কম অংশগ্রহণ, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় স্থানীয়-পরিবর্তিত বিশ্ববাজার মাথায় রেখে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া, শিক্ষার গুণগত বিকাশ ও দক্ষতা বৃদ্ধি না হওয়া এবং সুশাসন নিশিচত না করা। সরকার ও নীতিনির্ধারকদের এসব বিবেচনায় নিয়ে যেসব দেশ জনমিতিক লভ্যাংশের সুবিধা পেয়েছে তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পনা দরকার সঠিক ও গুণগত উপাত্তের বিশ্লেষণে। দরকার প্রশিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা, উচ্চ হারে অর্থ সঞ্চয় ও বিনিয়োগ করা, শ্রমবাজারে সফল চাকরির জোগান বৃদ্ধি, কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক বিনিয়োগ, গুণগত পাবলিক প্রতিষ্ঠান এবং শ্রম বাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।
এম এ খালেক: জনসংখ্যা হচ্ছে একটি দেশের জন্য একই সঙ্গে ‘সম্পদ ও দায়’। বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: মানবসম্পদ সৃষ্টিতে যেসব সূচক ব্যবহৃত হয় তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষা। কেবল পরিকল্পিত ও সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমেই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চাহিদার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসাবে ঘরে তোলা সম্ভব। একটি সর্বজনীন ও গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গুণগতমানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা গবেষণা ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহে জাতীয় বাজেটে সর্বাধিক বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি উৎপাদনশীল সুস্বাস্থ্যবান শ্রমশক্তি তৈরিতে স্বাস্থ্য খাতেও ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর ও বাস্তব জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা নিশিচত করতে হবে। বৈশ্বিক শ্রমবাজার ও দেশীয় স্থানীয় শ্রমবাজারের বর্তমান বাস্তবতায় চাহিদার প্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষাকে অধিকতর অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এম এ খালেক: দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কতটা অবদান রাখছে?
মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: আমি মনে করি, পূর্ণাঙ্গ দক্ষ জনবল হিসাবে তৈরি হচ্ছে না আমাদের শিক্ষার্থীরা। দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা একজন শিক্ষার্থীকে দক্ষ জনবল হিসাবে গড়ে তুলতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে বেশ ঘাটতি রয়েছে। শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী জনবল তৈরি করতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সম্পর্ক জোরদার করতে হবে এবং চাহিদা অনুযায়ী জনবল তৈরি করতে হবে।
এম এ খালেক: দেশের বর্তমান জনসংখ্যানীতি সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: বাংলাদেশের বিদ্যমান জনসংখ্যানীতিটি হালনাগাদ করা ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বিবেচনায় নিয়ে পরিমার্জন করা বিশেষ প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘জাতীয় জনসংখ্যানীতি ২০১২’ অনুযায়ী আমরা এখনো জনসংখ্যানীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। বাংলাদেশের জনসংখ্যানীতির বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদ রয়েছে। এ পরিষদ প্রয়োজনে জনসংখ্যানীতিতে যেকোনো ধরনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের নির্দেশ প্রদান করবে। কিন্তু যতদূর জানি, গত ১২ বছরের অধিককালেও এ পরিষদের কোনো সভা হয়নি। ফলে জনসংখ্যা নিয়ে সরকারের ভাবনা-চিন্তা কী তা স্পষ্ট নয়। অথচ এ পরিষদের উচিত ছিল জনসংখ্যা ও উন্নয়ন-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলোকে চিহ্নিত করা ও সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। আমি মনে করি, জাতীয় জনসংখ্যানীতি ২০১২ হালনাগাদের পাশাপাশি দরকার যথার্থ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বে জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদের পুনর্গঠন করা।
সবাই উদগ্রীব এখন জাতীয় বাজেটের জন্য। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে আমজনতার জীবন ও জীবিকার বাজেট জাতীয় বাজেটের থেকে আলাদা কিছু কি না। মিডিয়ায় প্রশ্নটা বরাবরের মতো আরও স্পষ্ট হতে হচ্ছে যে সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখিত ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ’ সেই আপামর জনগণ অর্থাৎ আমজনতার আশা-অকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়ার দাবি-দাওয়া বাজেটে প্রতিফলিত হয় কিংবা হবে কি না। এ প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক যে, জাতীয় বাজেটের মধ্যে করোনায় বিধ্বস্ত ও কিয়েভ-ক্রেমলিন যুদ্ধের দ্বারা আহত অর্থনীতি গণস্বাস্থ্য জন-শিক্ষা পুনরুদ্ধারের মতো জরুরি বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে কি না।
প্রশ্ন এ কারণেও উঠতে পারে যে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রকৃত প্রস্তাবে প্রয়োজনীয় খাতে (এ মুহূর্তে যেমন জীবন ও জীবিকা) যথাযথ (দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি সহনীয়করণ, ব্যয় সাশ্রয়ী, অর্থায়ন আয় বৃদ্ধি ও কৃচ্ছ্র সাধন অর্থে ব্যয় সংকোচন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি-বেসরকারি খাত দল-মতনির্বিশেষে ঐকবদ্ধভাবে সংকট মোকাবিলায়) ব্যবহৃত হচ্ছে কি না। নতুন বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সবাই পরামর্শ দেন, সুপারিশ করেন, দাবি তোলেন, কিন্তু সেই বরাদ্দের বিপরীতে অর্থায়ন ও লক্ষ্যভেদী বাস্তবায়নের পরিস্থিতি, সেই ব্যয়ের তাৎক্ষণিক, স্বল্প-মধ্য দীর্ঘমেয়াদি ইমপ্যাক্ট ও অভিঘাত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার অবকাশ বরাবরই হালে পানি পায় না। সাধারণ সময়ে সেই অবকাশ কমবেশি দেরিতে মিললেও করোনার অভিঘাত ও বৈশ্বিক প্রভাব মোকাবিলার মতো জরুরি সময়ে বরাদ্দ ব্যবহার এবং কর্মপরিকল্পনা প্রয়োগও জরুরি এ কারণে যে ‘রোগী মারা যাওয়ার পর চিকিৎসকের উপস্থিতির’ মতো পরিস্থিতির যেন উদ্ভব না হয়। এটি এ জন্যেও বিবেচিত যে সবাই নতুন বাজেট আসার বা আনার সময় আলোচনা-পর্যালোচনা এমনকি মৃদুমন্দ সমালোচনা করেন। কিন্তু বাজেট পাস হওয়ার পর সারা বছর সেই বাজেট বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে, তাৎক্ষণিক করণীয় নিয়ে কোনো কথা তো হয়ই না, বরং বিনা বাক্যব্যয়ে সম্পূরক বাজেটে সারা বছরের অপব্যয়, অপচয়, অতিরিক্ত ব্যয়, আয়ে অপারগতা, ব্যয়ে বাড়াবাড়ি, তছরুপ-দুর্নীতি- সবই গৃহীত হয়ে যায়। নির্বাচনের বছরের বাজেট গুণধারী হওয়ার চাইতে দৃশ্যধারী হওয়ার প্রবণতা প্রেক্ষাপটেও।
জীবন ও জীবিকার জন্য বাজেটকে জাতীয় বাজেট থেকে আলাদা অলিন্দে নয়, একীভূত হিসেবে দেখাই জরুরি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি খাতে অগ্রাধিকার ঘোষণা এবং কিঞ্চিত বরাদ্দ বাড়ালেই বাজেট জনগণের বাজেট বা ইতিবাচক হয় না, স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ালেই মহামারি মোকাবিলা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অটোমেটিক্যালি বাড়ে না, বিদেশি ঋণের টাকায় টিকা কেনা এবং ফ্রি বিতরণসহ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের সক্ষমতা ও সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন বহাল থাকে, দুর্নীতি অব্যবস্থাপনা অপারগতায় আকীর্ণ থাকে এবং তা নিরসন-নিয়ন্ত্রণে তথা জবাবদিহিকরণে ‘কথায় নয় কাজে’ অগ্রগতি না থাকে। বাজেটে বরাদ্দ বড় কথা নয়, অর্থনীতিতে সেই বরাদ্দের দ্বারা কতটা সম্পদ ও সেবা সৃষ্টি হলো, প্রভাব ফেলতে পারল সেটিই বড় কথা। বাজেট বাস্তবায়ন সক্ষমতা-অক্ষমতা প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকার পরিস্থিতি যথা সময়ে দেখভালের ব্যবস্থা না থাকলে সে বাজেট শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কৌশল হিসেবে পরিণতি লাভ করে।
করোনা ও কিয়েভ-ক্রেমলিন সংকটে বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কর্মসংস্থান, বহির্বাণিজ্য-শিল্পবাণিজ্য বিনিয়োগ উদ্যোগ অভিঘাত প্রশমন, দ্রব্য ও সেবা মূল্যেও অস্বাভাবিক গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার মতো খাতগুলো অগ্রাধিকারপ্রাপ্য। বছর দুই আগে থেকে (এখনো পর্যন্ত চলতি বাজেট বর্ষে) করোনার প্রভাবে বাজেট প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের গুরুত্ব আলোচিত হলেও, সেখানে বরাদ্দ নমিনাল টার্মে আপেক্ষিকভাবে কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও দেখা যায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষা, দক্ষ জনসম্পদ তৈরি, ফর্মাল ও ইনফর্মাল সেক্টরে কর্মসৃজনমূলক শিল্প উদ্যোগে কার্যকর পদক্ষেপের, বাস্তবায়নের খাতে বরাদ্দ সে হারে আরও বাস্তবে বাড়ানো ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন ছিল, যেভাবে বা হারে অন্যান্য অনেক অগৌণ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছিল সেভাবে বা হারে করোনা যে আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধন করেছে তা পুনরুদ্ধারে পরিপূরক ও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারত। সে সব খাত যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা খাতে দৃশ্যগত হয়নি। তথাপি এবং তদুপরি সেই বরাদ্দকৃত অর্থের বণ্টন ও ব্যবহার বা বাস্তবায়নের হিসাব মেলানোর সুযোগ সীমিত। অথচ কৃচ্ছ্র সাধন বা ব্যয় সংকচোন নিয়ন্ত্রণ ব্যপদেশে হলাহলপূর্ণ পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। করোনাকালে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ শিক্ষাকার্যক্রমবিহীন (বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে) খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। বিদ্যমান ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে মহানগর ও শহরে বিকল্প (অনলাইনভিত্তিক) শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা চললেও, ব্যাপক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পাঠবিমুখ করা হয়েছে। টেবিল-চেয়ার পাহারা আর দায় দায়িত্ব কর্মহীন শিক্ষকের পেছনে এবং বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণে ব্যবহৃত হয়েছে সিংহভাগ বরাদ্দ। অগৌণে শিক্ষা খাতের দিকে দৃষ্টি না দিলে শিক্ষায় বা সমাজে যে ক্ষরণ ও ক্ষত সৃষ্টি হবে তা হবে করোনার সেরা দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত। জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্য যত বাড়বে তত জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস মাঠে মারা যাবে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠা নেয়া হলে, ঝরে পড়াদের সংখ্যা বাড়ত না, বাল্যবিবাহের সুচক উর্ধ্বগামী হতো না। বিকল্প শিক্ষা কার্যক্রম স্থানীয়ভাবেই সাময়িকভাবে হলেও চালু রাখার যৌক্তিতাকে মাথায় না নিয়ে অটো পাস কিংবা কর্তিত সিলেবাসে পরীক্ষা দেয়ার মতো আত্মঘাতী পদক্ষেপে যাওয়া থেকে দূরে থাকা হতো জাতীয় কাণ্ডজ্ঞানে দায়িত্বশীলতার পরিচয়। জীবন-জীবিকার বাজেটে শুধু বরাদ্দ নয়, গুণগতমানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে অর্থনীতির প্রাণবায়ু কৃষি খাতে কৃষির উৎপাদন কৃষি তথা সামগ্রীকভাবে কৃষি খাতের উন্নতি একটি সম্মিলিত প্রয়াস। যেখানে কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষক ও কৃষি উপকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাইভেট সেক্টর, আমিষ, শর্করা সরবরাহকারীরাও সরাসরি জড়িত। কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি/প্রণোদনা যেন যথাযথভাবে এবং যথা সময়ে সত্যিকার প্রান্তিক চাষিরা, খামারিরা পায়। নতুন নতুন উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের অবদান কম নয়। সেজন্য পাবলিক সেক্টরের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরেও বাজেট বরাদ্দ থাকা উচিত। রাসায়নিক সারের তুলনায় জৈব সারে মাটির স্বাস্থ্য ভালো করে বিধায় রাসায়নিক সারের মতো বাজেটে জৈব সার উৎপাদনে ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তা, খামারি, মাছ চাষির কাছে স্টিমুলাস প্যাকেজের টাকা পৌঁছায়নি। ব্যাংক বা আর্থিক খাতে বিশাল ব্যাধির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি। ধনী আরও ধনী হওয়ার সহজ সুযোগে আয়বৈষম্য বেড়েই চলেছে। অন্তর্ভুক্তির নামে বিচ্ছিন্নতাই বাড়তে থাকলে ‘কাউকে পেছনে ফেলা যাবে না’ এসডিজি গোল অর্জনের এ মর্মবাণী সকরুণ ব্যর্থতার বিবরে উন্নয়নশীল অর্থনীতির কপোলে কালো তিলক আঁকতেই থাকবে।
এই মুহূর্তে করোনা মোকাবিলায় দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে চলমান ও টেকসই রাখতে সুপরিকল্পিত বাজেটের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, বাজেট বাস্তবায়নে যথাযথ পরিবীক্ষণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ধর্মী যোগাযোগ ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সমঝোতা বৃদ্ধি, ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সবার সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করতে পারলে করোনা-উত্তর দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং সে সম্ভাবনার সুযোগকে কাজে লাগানোর সময় এখনো আছে। করোনাকাল সহসা চলে যাবে এমন ধারণায় চলতিসহ বিগত দুটি বাজেট করা হয়েছিল, করোনা তখন যায়নি, এখনো তার রেশ কাটেনি, জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ঝুঁকি নিয়ে আগের ধাক্কা সামলানোর নিজের থেকে ছোটাছুটি করছে এটাকে স্বস্তির ও আত্মতৃপ্তির বিষয় ভাবা সমীচীন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। করোনার অভিঘাত অব্যাহত থাকবে এটা মনে রেখে বাজেট পরিকল্পনা করতে হবে। ব্যয়-কৃচ্ছ্র সাধনে ঢিলেমি কিংবা যেকোনো প্রসঙ্গ পলায়নি মনোভাব, কঠিন শর্তের ঋণ নিয়ে (ব্যয় সাশ্রয়ী ও বেহাত হতে দিয়ে বৈষম্য সৃষ্টির মহড়া নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ ব্যতিরেকে) কতিপয়ের ঘি খাওয়া, লাভের গুড় পিঁপড়েকে খেতে দেয়া অব্যাহত থাকলে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন অর্থবহ ও টেকসই হতে সময় লাগবে।
সামনের কয়েকটি বাজেটে বৈষম্য বৃদ্ধির বিবরে প্রান্তিক পর্যায়ের জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন প্রথম, দ্বিতীয় ইস্যু হচ্ছে জীবিকা। তৃতীয় এবং অন্যতম ইস্যু সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত দুর্নীতি দমন, সমন্বয়হীনতা, সামাজিক ঐক্যে অন্তর্ভুক্তির নামে বিচ্যুতি ঠেকানো। অভ্যন্তরীণ বাজার ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো। সবসময় দেখতে হবে নতুন বাংলাদেশ। নতুন পরিস্থিতি, নতুন সমস্যা, নতুন সম্ভাবনা। অর্থনীতির কাঠামো পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে। মোদ্দা কথা, অর্থনীতিতে রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার এবং মানবদেহে ইমিউন পাওয়ার বাড়াতে হবে। সামনের চ্যালেঞ্জগুলো যেমন ব্যয়ের বাজেটে অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ (রাজস্ব আয়) সম্পদের অপ্রতুলতা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে দৃশ্যত স্থবিরতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অনুপস্থিতির আড়ালে, দুর্নীতিগ্রস্ততায় অর্থনীতিতে ক্ষরণ, কস্ট অব ডুয়িং বিজিনেসের ঊর্ধ্বগামিতা, মেগা প্রকল্পে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার পরিবর্তে ব্যয় বৃদ্ধি, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, করোনাকালে কিংবা করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছ্রসাধন ও ব্যয় সংকোচনের দাবি ও যৌক্তিতা অনুসরণে অপারগ পরিস্থিতি ও পরিবেশ, বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, প্রবাসী আয় কমে যাওয়া, রপ্তানি বাজার সংকুচিত হওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তনহেতু বন্যা, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ে কৃষি উৎপাদন ও জানমালের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, করোনা ও আঞ্চলিক সংঘাত সমর পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বহির্মুখীন খাত ও ক্ষেত্রসমূহ সংকুচিত হওয়াকে সব সময় বিবেচনায় রাখতে হবে।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা আপাতত রাজস্ব আহরণ খাতে চলমান সংস্কার ও অনলাইনিকরণ বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত ও সময়সূচিভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা। বিদ্যমান আইনের সংস্কার এবং অনলাইনিকরণ ব্যতিরেকে বিদ্যমান কর্মকাঠামো ও লোকবল দিয়ে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি ও পরিবেশের উন্নয়ন সাধন সম্ভব ও সমীচীন হবে না। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে অচল অর্থনীতিকে সচল রাখার, বেকার ও ক্ষুধা রোখার, করোনায় ক্ষতি পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন, করোনায় সৃষ্ট মন্দা মোকাবিলা এবং সম্ভাব্য সুযোগের (কৃষি, স্বাস্থ্য খাত, আইটি, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার খাতে অধিক মনোযোগ ও দক্ষ জলবল সৃষ্টিসহ বিদেশফেরত বিদেশি বিনিয়োগ ঘরে আনা) সদ্ব্যবহার ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি মোকাবিলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ, কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা আগামী বাজেটগুলোয় আয়-ব্যয় বণ্টনে, কৌশল নির্ধারণে তার প্রতিফলন থাকতে হবে।
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
স্বপ্নের পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে নির্মিত রেললাইনে পরীক্ষামূলক রেল চলাচলের মধ্য দিয়ে বাঙালির বিশ্ব জয়ে নতুন মাত্রা সংযোজন হচ্ছে দেশের ইতিহাসে অনন্য মাইলফলক। আর এই অনন্য মাইলফলকের সঙ্গে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে এই সেতু ও রেললাইন ঘিরে পদ্মার দুই তীরে গড়ে ওঠা বৃক্ষরাজির মনোমুগ্ধকর ও নয়নাভিরাম ‘সবুজ বলয়।’ পদ্মা সেতু ও
রেল সড়কের দুই পাশে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে ‘সবুজ বলয়’।
এই সেতু ও রেললাইন দিয়ে চলাচল করার সময় নানা প্রজাতির গাছগাছালিতে শোভিত বৃক্ষরাজি। এই দৃশ্য দেখে মনে হবে এ যেন কোনো বৃক্ষ নয়, সবুজের অনন্য সমাহার, এসব বাহারি গাছগাছালির অনাবিল মুগ্ধতা ছাড়াছে সেতুর চারদিকে।
সকালের সূর্যোদয়ে আর বিকেলের সূর্যাস্তের দৃশ্যে মানুষকে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের অন্য জগতে নিয়ে যায়। শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবায় পদ্মা সেতুর টোলপ্লাজা থেকে মাদারীপুরের শিবচরের পাচ্চর পর্যন্ত সাড়ে ১০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের শুরুতে উভয় পাশে বিস্তৃর্ণ সবুজ প্রান্তর, মাঝে ধানক্ষেত, সড়কের দুই পাশে নানা জাতের ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানো হয়েছে। আর সড়ক বিভাজকের ওপর লাগানো হয়েছে নানা জাতের ফুলের গাছ। সেখানে সারা বছরই ফুল ফোটে। শুধু ফলদ, বনজ, ঔষধি গাছ নয়, এসব স্থানে রয়েছে নানা জাতের ফুল, নানা জাতের দেশি-বিদেশি ফলের গাছ।
এই সড়কের পাশাপাশি পদ্মা সেতুর চারটি পুনর্বাসন কেন্দ্র, দুটি সার্ভিস এরিয়া, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ও শেখ রাসেল সেনানিবাস এলাকায় বনায়ন করেছে শরীয়তপুর বন বিভাগ। পদ্মা সেতু প্রকল্প ও এক্সপ্রেস এলাকা বনায়ন প্রকল্পের আওতায় আম, জাম, কাঁঠাল, তেঁতুল, নারকেল, পেয়ারা, লিচু, সেগুন, জারুল, শিলকড়ই, রাজকড়ই, গামার, তেজপাতা, দারুচিনি, নিম, বহেড়া, অর্জুন, হরীতকী, বকুল, পলাশ, দেবদারু, কৃষ্ণচূড়া, শিমুলসহ ৬১ ধরনের ফলদ, বনজ, ঔষধি গাছসহ বিভিন্ন ফুলের গাছ রয়েছে। সরকারের পাঁচটি সংস্থা পৃথক পৃথকভাবে পদ্মা সেতু ও রেললাইনের পাশে, পদ্মা নদীর তীরে নির্মিত বাঁধের পাশে বিভিন্ন প্রজাতির ১০ লক্ষাধিক গাছ রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে এসব সংস্থার এই উদ্যোগ শতভাগ বাস্তবায়ন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাঙালির সাহস, গর্ব, সক্ষমতা, বিশ্বে মর্যাদা বৃদ্ধির অনন্য বিস্ময়ের প্রতীক পদ্মা সেতুকে ঘিরে ‘সবুজ বলয়’ সৃষ্টির এই উদ্যোগ গ্রহণ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতুর টোলপ্লাজা পার হওয়ার পরই চোখে পড়বে এসব ফুল-ফলের গাছ। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরুর সময় লাগানো এসব গাছ এখন চারদিকে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। দেশের অন্য কোনো প্রকল্পে এত বনায়ন হয়নি। বনায়ন প্রকল্পের আওতায় দুই লক্ষাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণ করা হয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে স্থানীয় ব্যক্তিদের রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই বনায়ন প্রকল্প।
২০০৭-০৮ সালে যখন পদ্মা সেতুর জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়, তখন এ এলাকা ছিল ফসলের জমি আর লোকালয়। জমি অধিগ্রহণের পর নিচু জায়গা বালু দিয়ে ভরাট করা হয়। তারপর সড়কসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এরপর ২০১২-১৩ সাল থেকে এসব স্থানে বনায়ন কার্যক্রম শুরু করা হয়। খুলনা-ঢাকা সড়কের বাসচালক মোক্তার হোসেন জানান, দেশের অনেক অঞ্চলের বিভিন্ন সড়কে গাড়ি চালিয়েছেন। পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া এমন সবুজে ঘেরা ও ফুলের সৌন্দর্যবর্ধিত সড়ক কোথাও পাননি তিনি। শরীয়তপুর বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ১০ বছর ধরে নিয়মিত পরিচর্যা আর রক্ষণাবেক্ষণ করে গাছগুলো পরিপক্ব করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রেখেছে বন বিভাগ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বনায়ন প্রকল্পটি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের (সেতু বিভাগের) সহকারী প্রকৌশলী পার্থ সারথি বিশ্বাস বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নে বনায়ন করা হয়েছে। সেতু এলাকার সব অবকাঠামো ধরে বনায়ন করা হয়। বিভিন্ন প্রজাতির সবুজ গাছে ও বাহারি ফুলে এখন এলাকাটিতে অন্য রকম মুগ্ধতা সৃষ্টি করছে। এখানে আসা মানুষ ক্ষণিকের জন্য প্রকৃতির অপার স্নিগ্ধতার পরশ পাবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প ঘিরে আশপাশের এলাকায় সবুজায়নও এগিয়েছে সমান তালে। নদীর দুই পাড় ও এক্সপ্রেস ওয়ের দুই পাশে রোপণ করা হয়েছে লাখো গাছের চারা। কয়েক বছরে এসব চারা বড় হয়ে সবুজের আবহ তৈরি করেছে পুরো এলাকায়।
পদ্মা পারের জনপদ ছিল অনেকটা রুক্ষ। সেখানে এখন শোভা পাচ্ছে নানা প্রকারের বনজ, ফলদ, ঔষধি আর সৌন্দর্যবর্ধক বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ। শরীয়তপুরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় বনায়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে সংযোগ সড়কের পাচ্চর থেকে টোলপ্লাজা পর্যন্ত রোপণ করা হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৫০টি বনজ ও সৌন্দর্যবর্ধক ফুলের গাছ। এই জেলার দুটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে রোপণ করা হয়েছে দুই লক্ষাধিক ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ। এ ছাড়া সার্ভিস এরিয়া, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড, শেখ রাসেল সেনানিবাসসহ প্রকল্প এলাকায় রোপণ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির আরও তিন লাখ গাছের চারা। পদ্মা সেতু প্রকল্প ও এক্সপ্রেস এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বনায়ন প্রকল্পের আওতায় আম, জাম, কাঁঠাল, তেঁতুল, নারকেল, পেয়ারা, লিচু, সেগুন, জারুল, শিলকড়ই, রাজকড়ই, গামার, তেজপাতা, দারুচিনি, নিম, বহেড়া, অর্জুন, হরীতকী, বকুল, পলাশ, দেবদারু, কৃষ্ণচূড়া, শিমুলসহ আরও বিপুল পরিমাণ ফলদ, বনজ, ঔষধি গাছসহ বিভিন্ন ফুলের গাছ রয়েছে। ইতিমধ্যে সার্ভিস এরিয়া ও পুনর্বাসন (আরএস) এলাকায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে কৃষ্ণচূড়া, বকুল, কাঞ্চন, সোনালু, মহুয়া, বহেড়া, অর্জুন, পলাশ, শিমুলসহ অন্তত দেড় লাখ ফলদ ও ঔষধি গাছ। পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্তের মহাসড়কের দুই পাশজুড়েও দৃষ্টিনন্দন ফুল-ফলগাছ চোখে প্রশান্তি এনে দেয়।
পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের শরীয়তপুরের জাজিরা থেকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পাচ্চর গোলচত্বর পর্যন্ত ছয় লেনের এক্সপ্রেস হাইওয়ের মাঝখানের অংশে নানা ধরনের গাছ রোপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পাতাবাহার, মসুণ্ডা, সোনালু, বোতল ব্রাশ, এরিকা পাম্প, উইপিং দেবদারু, রঙ্গনসহ বিভিন্ন ধরনের বাহারি ফুলের ছয় হাজার গাছসহ ৫৬ প্রজাতির প্রায় দেড় লাখ গাছ। বন বিভাগের কর্মীদের পরিচর্যা আর প্রকৃতির মহিমায় সড়কের ঢালে ফলদ ও বনজ গাছের চারাও বেড়ে উঠছে। গাছ যেমন একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনে। অন্যদিকে মানুষের মনের খোরাকও মেটায়। পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কে গেলে মনটা ভরে যায়। চোখ ধাঁধানো ফুলের সমারোহ। তবে রাস্তার ক্ষতি যেন না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। ছোট ছোট গাছ, ফুল ও হালকা ফলের গাছ থাকলে তেমন ক্ষতি হবে না, বরং এতে মন জুড়িয়ে যাবে।
পদ্মা সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়কের আইল্যান্ডে যে গাছ লাগানো হয়েছে, তা সত্যি অসাধারণ। মহাসড়কের এই ১০ কিলোমিটার পথে চলার সময় মনে হয় না বাংলাদেশে আছি। মহাসড়কের মাঝে আইল্যান্ডে ফুলের গাছ, দুই পাশে ফলের গাছ। এমন সৌন্দর্যময় প্রকৃতি দেশে আর কোথাও চোখে পড়েনি। তবে পরিচর্যার অভাবে অনেক স্থানে গাছ মরে গেছে। পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ পদ্মা সেতুর দক্ষিণ শিবচর প্রান্তে বন বিভাগের মাধ্যমে গত দুই বছরে সবুজায়নের প্রকল্প হাতে নেয়। এরই অংশ হিসেবে ফুল, ফল ও ঔষধি গাছের চারা লাগানো হয়েছে। ইতিমধ্যে এটি পর্যটন এলাকায় পরিণত হয়েছে। ভ্রমণপিয়াসু দর্শনার্থীর ভিড় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমাদের প্রত্যাশা, পদ্মা সেতু ও রেল সংযোগ ঘিরে গড়ে উঠেছে এই অপরূপ নয়নাভিরাম দৃশ্য তথা প্রকৃতির আধার ‘সবুজ বলয়’ রক্ষা ও সম্প্রসারণ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হবে। তাহলে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার এই মহতী উদ্যোগ স্থায়ী রূপ পাবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জুলিও কুরি শান্তি পদক অর্জনের ৫০ বছর অতিক্রান্ত হলো গত ২৩ মে। ২৮ মে রোববার জুলিও কুরি আন্তর্জাতিক শান্তি পদক অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে এ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার আবেগময় বক্তৃতার মধ্য দিয়ে আমাদের পঞ্চাশ বছর আগে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন কিছুক্ষণের জন্য। অনুষ্ঠানের প্রাবন্ধির এবং আলোচকরা বঙ্গবন্ধুর মানবতাবাদী দর্শন ও বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তার আজীবন সাধনার কথা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করিয়ে দিলেন সবাইকে। আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এ আয়োজন এতটাই ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ এবং নান্দনিক ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর মতো এক মহান বিশ্বনেতার ৫০ বছর আগে অর্জিত ওই আন্তর্জাতিক সম্মাননার তাৎপর্য বাঙময় হয়ে উঠেছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতায় শান্তিবাদী নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ ধরেই যে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে সে কথাই পুনর্ব্যক্ত হলো। এবং বঙ্গবন্ধুর জোট নিরপেক্ষ নীতির মধ্য দিয়ে আজকের অশান্ত পৃথিবীতেও বাংলাদেশ তার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অক্ষুণ্ন রেখে এগিয়ে চলার অঙ্গীকার পুনরুচ্চারিত হলো। এই পুরস্কারের তাৎপর্য কমবেশি আমাদের সবারই জানা। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত হওয়ার ঘটনা শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্য গৌরবময় অর্জন ছিল না, তা ছিল বাংলাদেশের জন্যই এক বিরল গৌরবের ঘটনা এবং প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক সম্মাননা অর্জন।
১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্বশান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে তাকে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিশ্বের ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওই সভায়।
পরের বছর ২৩ মে আজীবন শান্তি ও বিশ্বমানব কল্যাণের প্রবক্তা বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে জুলিও কুরি শান্তি পদক পরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা হয়।
জুলিও কুরি শান্তি পদক বঙ্গবন্ধুর আগে-পরে যাদের দেয়া হয়েছে, তারা সবাই বিশ্বশান্তির জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য নন্দিত। মানবকল্যাণে তারা সবাই কঠিন ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
যারা এ পুরস্কার পেয়েছেন তাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে কত উচ্চ মর্যাদার এই স্বীকৃতি! এই পদকে ভূষিত হয়েছেন যারা তাঁদের মধ্যে রয়েছেন: নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মার্টিন লুথার কিং, ইয়াসির আরাফাত, লিওনিদ ব্রেজনেভ, পাবলো নেরুদা, মিশরের প্রেসিডেন্ট কামাল আব্দুল নাসের, শিল্পী পাবলো পিকাসো, ভারতের জওহরলাল নেহরু প্রমুখ।
বঙ্গবন্ধুকে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে বিশ্বশান্তি পরিষদের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল রমেশচন্দ্র চন্দ বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ আখ্যায়িত করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের বন্ধু নন, তিনি বিশ্বের বন্ধু।’ তার এ মন্তব্য ছিল যথার্থই। কারণ বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থেই ছিলেন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের বন্ধু। সেই ১৯৫৬ সালেই তিনি স্টকহোমে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বলেছিলেন, ‘নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত শান্তি ও স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী মানুষ যেকোনো স্থানেই হোক না কেন, তাদের সঙ্গে আমি রয়েছি।’
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাষণ দিতে গিয়েও তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়া চীন’ কিংবা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে তার এই বিশ্বজনীনতা এবং বিশ্বমানব সম্প্রদায়ের কল্যাণ নিয়ে চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ আমরা প্রত্যক্ষ করি। আর সে কারণেই সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে যেসব উচ্ছ্বসিত অভিমত প্রকাশ করেছেন, তাও আজ আর আমাদের অজানা নেই।
এ প্রসঙ্গে একটি বইয়ের কথা উল্লেখ করতে চাই এবং একজন নিভৃতচারী বঙ্গবন্ধু অনুরাগী কবি ও গবেষকের কথা উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হতে পারে। তিনি সত্তর দশকের কবি কানাডাপ্রবাসী সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। কবি হিসেবে তার মূল পরিচয় হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে নিভৃতে অনেক কাজ করছেন তিনি। গবেষকের নিষ্ঠায় তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দেশে-বিদেশে কবি-সাহিত্যিকদের লেখালেখির অনুসন্ধান করে ১৯৯১ সালে প্রকাশ করেছিলেন একটি ছোট্ট অথচ তাৎপর্যপূর্ণ সংকলন। তার সম্পাদিত ওই সংকলনের শিরোনাম ‘বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা।’ এই সংকলনটি আমাদের চমকে দিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজসহ বিশ্বের ৩৫টি ভাষার কবিদের কবিতা উদ্ধার করেছেন দুলাল। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার কবিদের কবিতায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে গভীর শ্রদ্ধা এবং একজন আন্তর্জাতিক মানের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে সংগ্রামের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব যে কত উচ্চতায় স্থান পেয়েছিল বিদেশি কবিদের চোখে, তা কবিতাগুলো না পড়লে বোঝা যাবে না।
এই সংকলনটি প্রসঙ্গে একটি লেখায় সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল উল্লেখ করেছেন, ‘‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার চতুর্থ বই এবং প্রথম সম্পাদনা সংকলন ‘বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা’। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে গিয়ে সে দেশের কবিদের সাথে দেখা করে, বই-পত্র-পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করে এবং লাইব্রেরি ওয়ার্ক করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় কবিতা জোগাড় করতে থাকি। ১৯৯১ সালের ছোট্ট সংকলনটিকে সম্প্রসারিত করতে থাকি ধীরে ধীরে। পরে ১৯৯৫ সালে ১৫ আগস্ট দৈনিক জনকণ্ঠের শোক দিবস বিশেষ সংখ্যায় ‘বিদেশি ভাষার কবিদের কবিতায় বঙ্গবন্ধু’ ছাপা হলে তা দেখে তৎকালীন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার একান্ত সচিব নজরুল ইসলাম খান আমাকে ফোন করে বললেন, নেত্রী আপনাকে খুঁজছেন। আমি যেন সুধা সনদে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি। দেখা হলে তিনি কবিতাগুলো নিয়ে বই করার পরামর্শ দেন এবং শুভেচ্ছা বাণীও লিখে দেন। পরে তা ছোট্ট গ্রন্থাকারে প্রকাশ করি।’’
উল্লেখ্য, দুলালের প্রকাশিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ছড়াসহ ৭০টি গ্রন্থের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা মৌলিক গ্রন্থই ৯টি, সম্পাদিত গ্রন্থ চারটি এবং প্রকাশিতব্য দুটি। এসব কাজের গুরুত্ব বোঝা যাবে শামসুর রাহমান এবং নির্মলেন্দু গুণের লিখিত মন্তব্য থেকে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল রচিত ‘কানাডায় খুনি নূর চৌধুরী’ গ্রন্থ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহু ধরনের বই রচনা ও সম্পাদনা করেছেন কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। কানাডায় নিরাপদে বসবাসরত বঙ্গবন্ধুর অন্যতম আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে নিয়ে দুলালের লেখা গ্রন্থটির কথা আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন দুর্ধর্ষ খুনির বিরুদ্ধে লেখা এই তথ্যসমৃদ্ধ এবং অনুসন্ধানীমূলক গ্রন্থটির জন্য আমি কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালকে কৃতজ্ঞতা ও সম্মান জানাই।’
১৯৯১ সালে প্রকাশিত গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘সাহিত্যের শুভ্র কাফনে শেখ মুজিব’ এবং, ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ‘শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব’ গ্রন্থের জন্য যথাক্রমে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পদক ১৯৯৬’, (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে) এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার ১৯৯৭ অর্জন করেন দুলাল। অবশ্য এসব সাহসী কাজ করতে গিয়ে বিএনপির শাসনামলে তাকে সরকারি চাকরিটি হারাতে হয় (বাধ্যতামূলক অবসর)।
‘সাহিত্যের শুভ্র কাফনে শেখ মুজিব’ বইটি নিয়ে কবি শামসুর রাহমান দৈনিক ভোরের কাগজ-এ একটি কলাম লিখেছিলেন। তাতে তিনি লিখেছেন, “সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হয়েও রাজনীতি সচেতন। দেশ ও দশের কথা ভাবেন; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত এই তরুণ সব সময় কিছু না কিছু করছেন। প্রশংসনীয় তাঁর কর্মতৎপরতা’। ...তিনি এই সব রচনায় মূল্যায়ন করতে সচেষ্ট হয়েছেন তার এই গ্রন্থে। তাকে বহু কবিতা পড়তে হয়েছে, অন্যান্য তথ্যের জন্যও তথ্যান্বেষী হতে হয়েছে। ...শেখ মুজিবকে নিয়ে যে বহু ছড়া, গান, গল্প ও প্রবন্ধ রচিত হয়েছে, তারও পরিচিতি এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। দুলালের ‘পক্ষে-বিপক্ষে, নিরেপক্ষ জাতির পিতা’ নিবন্ধটি বেশ কৌতূহল-উদ্দীপক। মোট কথা, এই বইটি লিখতে গিয়ে দুলাল যে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন, তার তারিফ না করে পারা যায় না।’’
পরে আরও কয়েক বছর গবেষণার পর এবং সেই সময় পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ করে আরও চারটি লেখা যুক্ত করে নাম পাল্টিয়ে ‘শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব’ শিরোনামে ১৯৯৬ সালে বইটি নতুন ভাবে প্রকাশ করে শিখা প্রকাশনী। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের বঙ্গবন্ধু গবেষণা নিয়ে আলোচনা এ নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেও যে কী তীব্র অনুরাগ এবং শ্রদ্ধাবোধ সে প্রসঙ্গেই কবি দুলালের শ্রমসাধ্য কাজ নিয়ে এই আলোকপাত। আগামীকাল ৩০ মে তার জন্মদিন, এই উপলক্ষে তাকে শুভেচ্ছা জানাই।
বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিক জুলিও কুরি শান্তি পদক অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। আজ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আমরা সেই গৌরবময় অর্জনের আনন্দ জাতীয়ভাবে উদযাপন করছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সারা পৃথিবী যার মহত্ত্ব এমন গভীরভাবে উপলব্ধি করল, কেবল রাজনৈতিক ক্ষুদ্র স্বার্থে সংকীর্ণ মনোভাবের কারণে আমরা সর্বসম্মতভাবে এই মহান নেতার নেতৃত্বের গর্বে গর্বিত হতে পারছি না! পাকিস্তানি দুঃশাসকদের যুগ অবসিত হয়েছে ৫২ বছরে আগে, কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে আজও রয়ে গেল সেই কালো ছায়া! এর চেয়ে লজ্জা আর গ্লানির কিছু নেই! জানি না কবে শেষ হবে এই আঁধার।
লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক। সাবেক পরিচালক বার্তা বাংলাদেশ টেলিভিশন