পাহাড়সম খেলাপি ঋণ, সুদহার নিয়ে নানা সমীকরণের মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা। সরকারের কাছ থেকে নানামুখী সুবিধা নিয়েও হচ্ছে না অবস্থার উত্তরণ। এর মধ্যেও ভালো ব্যবসা করছে ইসলামি ধারার ব্যাংক। ছয় মাসে এসব ব্যাংকের আমানত ১৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা বেড়েছে। ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাজার প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জে টিকে থাকতে প্রচলিত ধারার অনেক ব্যাংক শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে যাচ্ছে। কারণ, ইসলামি ব্যাংকগুলোতে স্বেচ্ছায় অনেক আমানত আসে। ধর্মপ্রাণ অনেকে এ ধারার ব্যাংকে লেনেদেনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এ জন্য আমানতকারীরা দর-কষাকষি করেন না। তাদের বেশির ভাগই একটি ব্যাংকে আমানত রেখেই খুশি থাকেন। তবে ঋণ বিতরণে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে পার্থক্য কিছু নেই।’
১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে দেশে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকিংব্যবস্থা চালু হয়। এরপর নতুন পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক যেমন এসেছে, তেমনি প্রচলিত ধারার অনেক ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডো চালু করেছে। আমানত সংগ্রহ, শিল্প, ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ, প্রবাসী আয় সংগ্রহে জনপ্রিয় হচ্ছে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
দেশে বর্তমানে পুরোদমে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে ১০টি ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো: ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, শাহ্জালাল ইসলামী, ইউনিয়ন, এক্সিম ব্যাংক, আল-আরাফাহ, আইসিবি ইসলামিক, স্ট্যান্ডার্ড ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। এসব ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ১ হাজার ৬৭১টি। এ ছাড়া প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১১টি ব্যাংকের ২৩টি ইসলামি ব্যাংকিং শাখা রয়েছে। ১৪ বাণিজ্যিক ব্যাংকের রয়েছে ৫৮৮ ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণায় দেখা যায়, চলতি বছরের ছয় মাস শেষে (জানুয়ারি-জুন) ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ৪ লাখ ৯ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। ছয় মাসে এসব ব্যাংকের আমানত ১৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা বেড়েছে।
আমানত সংগ্রহের দিক থেকে সবার শীর্ষে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। শরিয়াহ ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের ৩৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ সংগ্রহ করেছে ব্যাংকটি। এরপরই রয়েছে ক্রমান্বয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১০ দশমিক ৭২, এক্সিম ১০ দশমিক ৬২, আল-আরাফাহ ১০ দশমিক ১২, সোশ্যাল ইসলামী ৭ দশমিক ৭২, শাহ্জালাল ইসলামী ৫ দশমিক ৭২, ইউনিয়ন ব্যাংক ৫ দশমিক ১৬, স্যান্ডার্ড ৪ দশমিক ১৩, গ্লোবাল ইসলামী ২ দশমিক ৮৫ এবং আইসিবি ইসলামিক দশমিক ২৯ শতাংশ। এ ছাড়া ইসলামি ব্যাংকিং শাখাগুলোতে মোট আমানতের ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডোগুলোতে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ আমানত রয়েছে। ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের আমানত রাখার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে মুদারাবা আমানত সবচেয়ে বেশি ৪৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
জুন শেষে ইসলামি ধারার দশ ব্যাংকের বিনিয়োগ ৪ লাখ ২১ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। এ বিনিয়োগের মধ্যে ৩৩ দশমিক ৮০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করে শীর্ষে আছে ইসলামী ব্যাংক। এর পরই রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১২ দশমিক ৯৬, এক্সিম ১০ দশমিক ৭২, আল-আরাফাহ ১০ দশমিক ১১, সোশ্যাল ইসলামী ৭ দশমিক ৮৯, শাহ্জালাল ইসলামী ৫ দশমিক ৫৫, ইউনিয়ন ব্যাংক ৫ দশমিক ৫৬, স্ট্যান্ডার্ড ৪ দশমিক ১৬, গ্লোবাল ২ দশমিক ৯৬ ও আইসিবি ইসলামিক দশমিক ১৯ শতাংশ।
ইসলামি ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ‘বাই মুরাবাহ’ সবচেয়ে প্রচলিত। মোট বিনিয়োগের প্রায় ৪৭ দশমিক ২৬ শতাংশ করা হয়েছে এ পদ্ধতিতে। এরপর রয়েছে ‘বাই মুয়াজ্জল’। এ ব্যবস্থায় মোট বিনিয়োগের ২২ দশমিক ৮৬ শতাংশ করা হয়েছে। বাকি বিনিয়োগ করা হয়েছে বাই সালাম, ইজারা অ্যান্ড ইজারা, বাই ইসতিসনা, মুসারাকাসহ অন্যান্য পদ্ধতিতে।
ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে ব্যবসা ও বাণিজ্য খাতে ৩৮ দশমিক ০৩ শতাংশ। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে বৃহত্তর শিল্প খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। এ ধারার ব্যাংকগুলো আধুনিক ধারার সব ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য সুকুক বন্ড চালু করেছে। সুদবাহী বিনিয়োগ বন্ডে ইসলামি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারে না বলে নতুন ধরনের এ বন্ড চালু করা হয়েছে। তারল্য ব্যবস্থাপনার নতুন এ মাধ্যমে সরকার চাইলে ইসলামি ব্যাংকগুলো থেকেও মূলধন নিতে পারবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট প্রবাসী আয়ের ৪২ শতাংশের অধিক এসব ব্যাংকের মাধ্যমে আসে। অবশ্য এর মধ্যে কেবল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মাধ্যমেই আসে প্রায় ৫৩ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রবাসী আয়। জুন শেষে ব্যাংকগুলো ২২ হাজার ১৯২ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পেয়েছে।
এখন থেকে গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ করা ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার দাঁড়াবে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ। নীতি সুদহার বাড়ানোর পর ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করার সীমা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পাঠানো এক সার্কুলারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ‘স্মার্ট’ (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) সুদহারের সঙ্গে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করে ঋণ দেয়া যাবে। এতদিন এ হার ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। গত অক্টোবর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘স্মার্ট’ হার ঘোষণা করেছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সেই হিসাবে সোমবার থেকে বিতরণ করা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ।
নতুন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ধার নেয়ার খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদ হারও বাড়বে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশা এর ফলে ঋণ বিতরণ কমবে, বাড়বে আমানত সংগ্রহ।
অবশ্য নতুন সুদহার অনুযায়ী, প্রি-শিপমন্টে রপ্তানি ঋণ এবং কৃষি ও পল্লী ঋণে সুদহার নির্ধারণ করতে স্মার্ট সুদহারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ মার্জিন যোগ করা যাবে, যা এতদিন ছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ। সেই হিসাবে কৃষি ও পল্লী ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার দাঁড়াবে ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় গত জুলাই থেকে সুদহার বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে বলে এরই মধ্যে আশাবাদ জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান। গত রোববার নীতি সুদহার বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রানীতির সংকোচনের পদক্ষেপ অব্যাহত রাখবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেদিন নীতি সুদহার হিসেবে পরিচিত ওভারনাইট রেপো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে এ হার ছিল সাত দশমিক ২৫ শতাংশ।
এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রেপো সুদহার শূন্য দশমিক ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাত দশমিক ২৫ শতাংশ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রেপো রেট বাড়ানোর এ হার ছিল গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রায় দশ শতাংশের ঘরে থাকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত জুলাই থেকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পথে হাঁটছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসাবে গত প্রায় পাঁচ মাসে তিন দফায় সুদহার বাড়ানো হলো।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাংলাদেশের পাঁচ উন্নয়ন প্রকল্পে প্রায় ১০৩ কোটি ডলার ঋণ দিতে সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং এডিবির বাংলাদেশ অফিসের মধ্যে মঙ্গলবার এই ঋণচুক্তি সই হয়। চুক্তিতে সই করেন ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী এবং এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিনটিং।
এডিবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গ্যাসের আবাসিক গ্রাহকদের জন্য সাড়ে ৬ লাখ স্মার্ট প্রিপেইড মিটার স্থাপনের একটি প্রকল্পে ২০ কোটি ডলার ঋণের একটি চুক্তি সই হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে এর কাজ চলবে।
ম্যানিলাভিত্তিক ঋণদানকারী সংস্থাটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, স্মার্ট মিটারিং এনার্জি এফিসিয়েন্সি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট প্রাথমিকভাবে দক্ষিণ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য স্মার্ট প্রিপেইড গ্যাস মিটার (এসপিজিএম) ইনস্টল করে লোকসান কমাতে সরকারের প্রচেষ্টাকে সহায়তা করবে।
প্যারিস চুক্তির অধীনে বাংলাদেশের নিজস্ব জলবায়ু প্রশমন ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটি হলো এসপিজিএম ইনস্টল করা। এডিবি জানিয়েছে, প্রকল্পটি বছরে প্রায় ৪ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হ্রাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গিনটিং বলেছেন, ‘এই প্রকল্প গ্যাস বাঁচাতে সাহায্য করবে; গ্যাসের অপচয় রোধ করা; গ্যাসের নিরাপদ ও দক্ষ ব্যবহার সম্পর্কে গ্রাহকদের সচেতনতা তৈরি করা; রাজস্ব প্রবাহ বৃদ্ধি করে এবং বিল তৈরি, সংগ্রহ ও নিরীক্ষণের খরচ কমিয়ে গ্যাস বিতরণ কোম্পানির আর্থিক কর্মক্ষমতা উন্নয়ন করে।’
এতে বলা হয়েছে, ‘প্রকল্পটি গ্যাস বিতরণ উপখাতের জন্য বাংলাদেশের জলবায়ু প্রশমন লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও অবদান রাখবে। যেমনটি ২০২১ সালের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানের আপডেট করা হয়েছে।’
প্রকল্পটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দেশের বৃহত্তম গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের রূপান্তরমূলক এবং আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে অপারেশনাল দক্ষতা বাড়ায়।
এর মধ্যে রয়েছে উন্নত ডিজিটাল প্রযুক্তি, যেমন ইউনিফাইড মিটারিং ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত স্মার্ট মিটার এবং একটি স্বয়ংক্রিয় ওয়েবভিত্তিক অভিযোগ ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের ব্যবহারের প্রচার।
১ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলারের একটি সহগামী প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে এডিবি সরকারকে তার স্বল্প-কার্বন জ্বালানি রূপান্তর এবং গ্যাস বিতরণ উপখাতের জন্য মিথেন লিকেজ ক্ষতি হ্রাস পরিকল্পনায় সহায়তা করবে।
এর মধ্যে রয়েছে উদ্ভাবনী ক্লিন এনার্জি সলিউশনের ওপর প্রাক-সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন তৈরি করা এবং কার্বন ক্রেডিট ব্যবহারসহ ভবিষ্যতের প্রকল্প অর্থায়নের জন্য ব্যক্তিগত পুঁজি অভিগম্যতার কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা।
কারিগরি সহায়তা বিশেষ তহবিল থেকে ১ মিলিয়ন ডলার অনুদান এবং এডিবির পরিচালিত রিপাবলিক অব কোরিয়া ই-এশিয়া এবং নলেজ পার্টনারশিপ ফান্ড থেকে ৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার অর্থায়ন সহায়তা করা হবে।
এ ছাড়া গোপালগঞ্জে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানির টিকা উৎপাদন কারখানা প্রতিষ্ঠায় ৩৩ কোটি ৬৫ লাখ ডলার ঋণের আরেকটি চুক্তি হয়েছে। দক্ষিণ এশীয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা কর্মসূচির (সাসেক) অধীনে ঢাকা থেকে উত্তরাঞ্চলে আধুনিক মহাসড়ক নির্মাণে ৩০ কোটি ডলার এবং বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও যশোর ইউিনভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কম্পিউটার ও আইটি শিক্ষার প্রকল্পে ১০ কোটি ডলার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নের একটি প্রকল্পে ৯ কোটি ডলার ঋণের চুক্তি সই হয়েছে।
দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ছে লাগমহীন। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়েছে ৩৮ হাজার টাকার বেশি। প্রতি ভরি সোনার দাম এখন এক লাখ ৮ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে, যা তিন বছর আগেও ছিল ৭০ হাজার টাকার কম। তিন বছরের ব্যবধানে দেশের বাজারে ভালো মানের সোনার দাম ৫৪ শতাংশ বেড়েছে।
দেশে সোনার দাম বাড়ানো কিংবা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি বা বাজুস। গত মার্চেই তারা দাম প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা বাড়িয়েছিল। এরপর ৭ জুন বাড়িয়েছিল আরও প্রায় দুই হাজার টাকা। মাঝে অল্প কিছু কমে আবার বেড়ে দাম হয়েছিল ৯৮ হাজার ৪৪৪ টাকা। গত ২১ জুলাই প্রতি ভরির দাম ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক লাখ টাকার মাইলস্টোন অতিক্রম করে। এরপর গত ৪ মাসে মূল্যবান ধাতুটির দাম বেড়েছে ৮ হাজার টাকার বেশি।
সর্বশেষে গতকাল সোমবার দেশের বাজারে সোনার দাম ভরিতে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭৪৯ টাকা বেড়েছে। তাতে ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ১২৫ টাকা। দেশের বাজারে এটিই এখন পর্যন্ত সোনার সর্বোচ্চ দাম।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের সোনার দাম অনেকটা লাগামছাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতে দাম বেড়েছে ২৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
ভারতের গত তিন বছরে ভরিপ্রতি সোনার দাম ১২ হাজার ২২৪ রুপি বাড়লেও বাংলাদেশে বেড়েছে ৩৮ হাজার ১২৫ টাকা। গত রোববার প্রতিবেশী ভারতে ২২ ক্যারেটের সোনার দাম ছিল ৬১ হাজার ১৩০ ভারতীয় টাকা আর ২৪ ক্যারেট ৬২ হাজার ৪৫০ টাকা।
তিন বছর আগে ভারতের একই পরিমাণ ২২ ক্যারেট সোনার দাম ছিল ৪৮ হাজার ৯০৬ টাকা আর ২৪ ক্যারেট ছিল ৫২ হাজার ৫১৫ টাকা। আর তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালে বাংলাদেশে সোনার ভরি ছিল ৭০ হাজার টাকার সামান্য কম।
সোনার আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন ‘বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি’ আর ‘অকার্যকর আমদানি নীতি’র কারণে সোনার দাম বেড়েই চলেছে, যা কমার লক্ষণ খুব একটা নেই বলেই মনে করেন তারা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখলেও এত দাম হওয়া উচিত নয়। বরং সোনার যথাযথ বাজার মেকানিজম না থাকাকেই দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার জন্য দায়ী বলে মনে করেন তারা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশে সোনার দামের ক্ষেত্রে উল্লম্ফন ঘটেছে কিন্তু এই উল্লম্ফনের কোনো ‘যৌক্তিক ও সুনির্দিষ্ট’ কারণ নেই। যুদ্ধ ও অন্যান্য কারণে দাম বাড়বে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এতটা বাড়বে কেন? এভাবে আকাশচুম্বী হচ্ছে দাম সোনার কার্যকর বাজারব্যবস্থা ও রেগুলেশন্স না থাকায়।
যদিও চলতি বছরের শুরুতেই বিশেষজ্ঞরা আভাস দিয়েছিলেন, এ বছর সোনার দাম অনেক বেড়ে যেতে পারে। বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারিতে বাংলাদেশে প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ৯৩ হাজার ৪২৯ টাকা। জুলাইতে এসে এই দাম এক লাখ অতিক্রম করে এবং গতকাল এক লাখ ৮ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। চলতি বছরের ১১ মাসে সোনার দাম ভরিতে বেড়েছে ১৪ হাজার ৬৯৬ টাকা। এই দাম শিগগিরই কমে আসার কোনো সম্ভাবনাও দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ব বাজারে প্রতি আউন্স সোনা (২৪ ক্যারাট) গতকাল ২০১৩ ডলারে দাড়িয়েছে।
বাজুসের কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়া সোনার উৎপাদনকারী বড় দেশ এবং যুদ্ধের জের ধরে কয়েক বছর ধরে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার স্বর্ণ বাজারে আসছে না। হঠাৎ করে কাল যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো দাম কমতে পারে। এ ছাড়া ডলারের বিনিময় হার, ক্রুড ওয়েলের দামসহ আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনায় নিলে বলতে হয় দাম কমার আপাতত কোনো লক্ষণ আমরা দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুদের হার বৃদ্ধি এবং মন্দার আশঙ্কার কারণে বিশ্ব বাজার অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় সোনার দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা করছিলেন অনেকে। আবার বিশ্বের অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতি ধারণার চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গত বছর ব্যাংকগুলো সোনাতেই বেশি বিনিয়োগ করছিল। একই সঙ্গে ডলারের দাম ব্যাপক বেড়ে যাওয়াকেও অনেকে সোনার দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী করে থাকেন। আবার অন্য বৈশ্বিক মুদ্রার সঙ্গে ডলারের দাম কমে গেলেও সোনার দাম বেড়েছে।
অনেক বিশ্লেষক অবশ্য কোভিড মহামারির পর আবার যুদ্ধ পরিস্থিতি ও চীনের অর্থনীতির গতি ধীর হওয়াকেও সোনার দাম বৃদ্ধির জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আবারও নীতি সুদহার বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতি সুদহার বা পলিসি রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে বাড়বে আমানত ও ঋণের সুদহারও।
গত ২২ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে পুনর্গঠিত মনিটারি পলিসি কমিটির (এমপিসি) ভার্চুয়ালি প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পলিসি ডিপার্টমেন্টের পরিচালক মো. আব্দুল কাইউম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
নীতি সুদহার বাড়ানোসহ মুদ্রানীতি কমিটির সভায় নতুন চারটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রথমত, রেপো রেট একবারে দশমিক ৫০ শতাংশ পয়েন্ট বাড়ানো হবে। এখন নীতি সুদহার ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, তা বৃদ্ধি করে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করে, তার সুদহার বাড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে রাখা আমানত ও ব্যাংকঋণের সুদহারও বাড়বে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহের পথে হাঁটছে।
দ্বিতীয়ত রিভার্স রেপো (বর্তমান নাম স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি-এসডিএফ) নিম্নসীমার সুদহার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ হতে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর সুদ বাড়িয়ে তা তুলে নেয়।
তৃতীয়ত, নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্পেশাল রেপো বা এসএলএফ-স্টান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির সুদহার ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় সংকটে পড়া ব্যাংক উচ্চ সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে।
চতুর্থত, যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এখন ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে, সেই স্মার্ট বা সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলের সুদ ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো। এখন স্মার্ট রেট ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ, ব্যাংকগুলো এর সঙ্গে সাড়ে ৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করতে পারে। নতুন সিদ্ধান্তে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করতে পারবে ব্যাংকগুলো। তাতে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ।
এ ছাড়া ডলারের বিনিময় হারকে বাজারমুখী করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান প্রচেষ্টা জোরদার ও ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এত দিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হন।
তিন মাস ধরেই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত অক্টোবর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গতকাল রোববার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, পুনর্গঠিত মুদ্রানীতি কমিটির প্রথম সভা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান, প্রধান অর্থনীতিবিদ মো. হাবিবুর রহমান, অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাসুদা ইয়াসমিন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. এজাজুল ইসলাম অংশ নেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সভায় অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ছাড়া বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি, বিনিময় হার, তারল্য ও সুদহার পরিস্থিতি এবং নীতি সুদহারের গতিবিধি নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো যেমন- নীতি সুদহার বৃদ্ধি, আমানত ও ব্যাংকঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে তা বাজারমুখী করা, টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ প্রদান স্থগিতকরণ, আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারমুখী করা, আমদানি মূল্য যাচাইসহ বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে তদারকি বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ থেকে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের আমদানি ব্যয় মেটানোর ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে কমিটির সদস্যদের অবহিত করে।
কমিটির সদস্যরা সভায় এসব বিষয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে এবং ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের সমস্যা মোকাবিলায় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে সভায় গুরুত্বারোপ করা হয়। এ ছাড়াও বর্তমানে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিনিময় হার এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ প্রশমনে বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সভায় ঐকমত্য পোষণ করা হয়।
সভায় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত নীতি পদক্ষেপ, বিশ্ববাজারের পণ্য মূল্যে নিম্নমুখী ধারা, আসন্ন আমন ধানের ফলন ভালো হওয়ার সম্ভাবনা এবং শীতকালীন ফসল সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে আগামী দিনে মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় নেমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। আলোচনা ও পর্যালোচনা শেষে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বরে ৮ শতাংশে এবং আগামী জুন শেষে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়। পাশাপাশি বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নীতি সুদহার বাড়ানোর।
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গত অর্থবছরের শেষ তিন মাসে দেশে ৫০ কোটি টাকার বেশি জমা আছে, এমন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে ১ হাজার ৮২৪টি অ্যাকাউন্টে ৫০ কোটি টাকার বেশি জমা ছিল। তবে ৩১ মার্চ পর্যন্ত এ ধরনের অ্যাকাউন্ট ছিল ১ হাজার ৭৫৮টি। এই ১ হাজার ৮২৪টি অ্যাকাউন্টে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত জমা ছিল ২ লাখ ৫৮ হাজার ৫৪৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা, যা দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এদিকে জুন শেষে ১৪ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৯২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট জমা ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এ ছাড়া চলতি বছরের মার্চ শেষে ৫০ কোটি টাকার বেশি জমা আছে এমন ১ হাজার ৭৫৮টি অ্যাকাউন্টে জমা ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ১৩১ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা দেশের মোট ব্যাংক আমানতের ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৪ কোটি ১১ লাখ ৩৭ হাজার ২৫৬টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ১৩ হাজার ৬২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন এশিয়ান পাওয়ার অ্যাওয়ার্ডস-২০২৩ অর্জন করেছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এশিয়ান পাওয়ার অ্যাওয়ার্ডস-২০২৩ প্রদান করা হয়। ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান পুরস্কারের ক্রেস্ট ও সনদ গ্রহণ করেন।
এ উপলক্ষে গত বুধবার রাতে ঢাকায় বিদ্যুৎ ভবনে ডিপিডিসির বোর্ড রুমে এক অনুষ্ঠানে প্রাপ্ত পুরস্কার সম্পর্কে ডিপিডিসির পরিচালনা পর্ষদকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান। অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও ডিপিডিসির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান এবং পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন।
ডিপিডিসির জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম ম্যাপিং প্রকল্পে ‘ইনোভেটিভ পাওয়ার টেকনোলজি অব দ্য ইয়ার’ ক্যাটাগরিতে এবং জনাকীর্ণ এলাকায় সিঙ্গেল পোল ট্রান্সফরমার স্থাপন-সংক্রান্ত উদ্ভাবনের জন্য ‘পাওয়ার ইউটিলিটি অব দ্য ইয়ার’ ক্যাটাগরিতে এই পুরস্কার অর্জন করে।
এশিয়ান পাওয়ার অ্যাওয়ার্ড একটি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার, যা বিদ্যুৎ খাতের ব্যতিক্রমী উদ্ভাবন, যুগান্তকারী প্রকল্প ও উদ্যোগকে স্বীকৃতি দেয় এবং টেকসই উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে। পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে সেরা প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করে তাদের সাফল্যকে উদ্যাপন করা হয়।
‘এশিয়ান পাওয়ার অ্যাওয়ার্ডস-২০২৩’ প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ডিপিডিসির নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
কুয়ালালামপুরে পুরস্কার গ্রহণের পর ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান বলেন, এ অর্জন শুধু ডিপিডিসির নয়, এই পুরস্কারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ সরকার যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার স্বীকৃতি প্রদান করল। এ অর্জনকে তিনি পুরো বাংলাদেশের অর্জন বলে অভিহিত করেন।
শ্রম অভিবাসনে বড় এক মাইলফলক অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে টানা দুই বছরে ১০ লাখের ঘর ছাড়িয়েছে জনশক্তি রপ্তানি।
চলতি ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ ৯৯ হাজার বাংলাদেশি কর্মী প্রবাসে চাকরি নিয়ে গেছেন। গত বছরের রেকর্ডসংখ্যক ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী রপ্তানির ধারাবাহিকতা এ বছরেও দেখা যাচ্ছে।
রিক্রুটিং এজন্সিগুলো বলছে, মহামারির কারণে দুই বছর বিদেশে যেতে না পারা অনেক শ্রমিকই ২০২২ ও ২০২৩ সালে গেছেন, এ সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে থাকায় তাদের চাকরির বাজারও উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি সব ধরনের সৌদি প্রতিষ্ঠানে অভিবাসী বাংলাদেশীদের জন্য নির্ধারিত কোটা ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার ঘটনাও অবদান রেখেছে রেকর্ড এই প্রবৃদ্ধিতে।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের শীর্ষ গন্তব্য সৌদি আরব, এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ৩৭ শতাংশই হয়েছে উপসাগরীয় এ দেশটিতে। তারপরই রয়েছে মালয়েশিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, কাতার, কুয়েত ও জর্ডান।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন- বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া বেশির ভাগ শ্রমিক পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নির্মাণকাজ ও অন্যান্য গৃহস্থালি কাজ পেয়েছেন, তাদের মাসিক বেতন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। আবার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনেকে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি পেয়েছেন, যেখানে বেতন ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া, কিছুসংখ্যক দক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিক বিভিন্ন দেশে প্লাম্বার এবং এসি ও ফ্রিজের ইলেক্ট্রিশিয়ান বা টেকনিশিয়ান হিসেবে গেছেন, - যোগ করেন তিনি।
তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে বিদেশ গেছেন ৬ লাখ ১৭ হাজার কর্মী। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে গেছেন ১ লাখ ৯০ হাজার কর্মী। আর ৫১ হাজার জনশক্তি বিদেশে পাঠিয়ে একক জেলা হিসেবে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে কুমিল্লা। জনশক্তি রপ্তানিতে চলতি বছর আগের সব রেকর্ড ভাঙার আশা সংশ্লিষ্টদের।
জনশক্তি কর্মসংস্থা ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয় ১৯৭৬ সাল থেকে। ওই বছর ৬ হাজার ৮৭ জন কর্মী বিদেশে যান। তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়মিত জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে। দীর্ঘ ৪৮ বছরের মধ্যে শুধু ২০১৭ সালে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে আগের রেকর্ড ছিল। চলতি বছর ছাড়া ২০১৭ সালেই শুধু ১০ লাখের মাইলফলক পার করেছিল বাংলাদেশ। সেই বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন কর্মী গিয়েছিলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলছেন, জনশক্তি রপ্তানিতে মধ্যপ্রাচ্য নির্ভরতা কাটানোর চেষ্টা চলছে। এর ফলে বিকল্প শ্রমবাজার হিসেবে ইউরোপকে ভাবছে সরকার।
যুগোস্লাভিয়া, আলবেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও রোমানিয়ায় কিছু সংখ্যক কর্মী ইতিমধ্যে গেছেন। এই দেশগুলো ভবিষ্যতে বিপুলসংখ্যক কর্মী নেবে। এ ছাড়া গ্রিস, মাল্টা, আলবেনিয়া ও সার্বিয়াও বাংলাদেশি কর্মী নেবে বলে জানিয়েছে। সম্প্রতি ইতালির সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে চুক্তি হয়েছে।
এ ছাড়াও, মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকেও নজর রয়েছে সরকারের। উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং হংকংয়ে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি ভাবছে সরকার। ফলে সামনের দিনগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানবিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলছেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করার চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে বৈধভাবে কর্মী পাঠানো যায়। এর অংশ হিসেবে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে জাপানে বৈধভাবে কর্মী প্রেরণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান-বিষয়ক মন্ত্রী ইমরান আহমদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্টদূত ইতো নাওকি। বৈঠকে জাপান বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কর্মী নিতে রাজি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকি বলেন, জাপান ২০২৫ সালের মধ্যে সারা বিশ্ব থেকে ৫ লাখ কর্মী নেবে। জাপানি ভাষা জানলে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এই বাজার বাংলাদেশকে ধরতে হবে।
কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও উন্নত বিশ্বের নীতি সুদহারের ক্রমাগত বৃদ্ধিসহ নানা প্রতিকূলতার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈদেশিক খাত সাম্প্রতিককালে অনেকটা চাপের মুখে পড়ে। তা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতির প্রকৃত খাতের প্রায় সব সূচকই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে। আগামী সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন হওয়ার পর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে এবং চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারি নীতি-সহায়তার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পরিস্থিতি বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। পাশাপাশি শিল্পোৎপাদন, যা শিল্প উৎপাদন সূচকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তাতে ভালো প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের উৎপাদনমুখী ও উন্নয়নমুখী ব্যয় বৃদ্ধি অর্থনীতির গতিশীলতাকে চলমান রাখার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে রাজস্ব আহরণের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে সরকারের রাজস্ব আয়ও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান গতিধারা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র তুলে ধরেছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সন্তোষজনক থাকবে বলে আশা করা যায়। সরকারের বিভিন্ন অবকাঠামোগত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নসহ শিল্প ও সেবা খাতে চলমান ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬.৫ শতাংশের অধিক হবে বলে প্রতীয়মান হয়।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও উল্লেখ করে, বিরাজমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ভালো প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও আমদানি ব্যয়ের অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধির ফলে সাম্প্রতিককালে দেশের বৈদেশিক খাত বিশেষ করে বৈদৈশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ওপর জোরালো চাপ পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া বৈশ্বিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, বাংলাদেশি টাকার অবমূল্যায়ন এবং অভ্যন্তরীণভাবে মৌসুমি আবহাওয়ার প্রতিকূল প্রভাব ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়াসহ সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ বিনিময় হার এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ প্রশমনে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে নীতি সুদহারের বৃদ্ধি, আমানত ও ব্যাংক ঋণের সুদহারে সীমা তুলে দিয়ে তা বাজারমুখী করা, টাকা ছাপিয়ে সরকারকে লোন না দেয়া, আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেয়া, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারমুখী করা, আমদানি মূল্য যাচাইসহ বৈদেশিক মুদ্রা বাজার তদারকি বৃদ্ধি করা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানি ব্যয় মেটানোর ব্যবস্থা নেয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
উক্ত পদক্ষেপসমূহের ফলে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে এবং মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর বিদ্যমান চাপ অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। চলতি হিসাবের ভারসাম্য গত বছরের প্রায় ৩.৩ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি কাটিয়ে সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো উদ্বৃত্ত পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে, ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের পূর্বের একটা স্বস্তিদায়ক উদ্বৃত্ত অবস্থা থেকে ঘাটতি পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে সার্বিক বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে এখনো কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। আশা করা যায়, বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে শিগগিরই একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থা ফিরে আসবে, যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণসহ মুদ্রা বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা আনয়নে আরও সহায়ক হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োপযোগী ও কার্যকর নীতি গ্রহণের ফলে বর্তমানে বিদ্যমান মুদ্রা বিনিময় হার প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার সূচকের সঙ্গে অনেকটাই সংগতিপূর্ণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগামীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি তাদের নীতি সুদহার আর না বাড়ায় কিংবা হ্রাস করে তাহলে আমাদের বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা আনয়নে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
উল্লেখ্য, বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান রিজার্ভ আইএমএফের বিপিএম-৬ অনুযায়ী প্রায় ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো আছে, যা দিয়ে প্রায় ৪ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যেকোনো অর্থনীতির জন্য স্বস্তিদায়ক বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং এর প্রত্যাশাকে ধরে রাখার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। একই সঙ্গে সরকার অনুৎপাদনশীল খাতে তার ব্যয় সংকোচন করেছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির অভিঘাত নিরসনকল্পে সামাজিক নিরাপত্তা জালের (যেমন, ১ কোটি ফ্যামিলি কার্ড, ট্রাক সেল ইত্যাদি) আওতা ও ব্যপ্তি বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকারের সংকোচনমূলক যুগপৎ নীতি-পদক্ষেপ এবং উৎপাদন ও বিনিয়োগ সহায়ক নীতির ফলে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির আশু উন্নতি হবে বলে আশা করা যায়। উল্লেখ্য, আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে দেশের মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ৮ শতাংশে এবং জুন শেষ নাগাদ ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সাম্প্রতিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার উভয়েই আর্থিক ও রাজস্ব খাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে শিগগিরই দেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির বৈদেশিক খাতে স্থিতিশীলতা এবং মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থা ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়। দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক ভূ-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আগামীতে বাংলাদেশ আরও শক্তিশালী অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে- বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনটিতে এমন প্রত্যাশার কথাও বলা হয়েছে।
দেশের চলমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি আর্থিকভাবে টেকশই দেশ গড়ে তুলতে কয়েকটি খাতে বাংলাদেশকে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দেবে বিশ্বব্যাংক। এ জন্য বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে পাঁচটি ঋণচুক্তি সই হয়েছে।
বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এ চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরীফা খান ও বিশ্বব্যাংকের পক্ষে সংস্থাটির আবাসিক প্রধান আবদৌলায়ে সেক সই করেন। পরে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানানো হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পাঁচটি চুক্তির আওতায় প্রাপ্ত অর্থ শিশুর শৈশবের বিকাশ, মাধ্যমিক শিক্ষা খাত, গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, যমুনা নদী রক্ষা, নাব্য বাড়ানো, শহরের ডেঙ্গু প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, গ্যাস বিতরণের দক্ষতা বাড়ানোসহ বেশ কয়েকটি কাজে ব্যবহার করা যাবে। পরে আরেকটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিশ্বব্যাংক জানায়, একটি প্রকল্পের আওতায় গ্রামাঞ্চলের প্রায় ৯ লাখ তরুণকে চাকরি প্রদান ও উদ্যোক্তা হতে সহায়তা করবে দাতাসংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংক জানায়, প্রথম প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রায় ১৭ লাখ গর্ভবতী নারী ও শিশুকে নগদ সহায়তা ও কাউন্সিলিং সেবা প্রদান করা হবে। এতে শিশুমৃত্যুর হার কমার পাশাপাশি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা হবে বলে আশাবাদ জানানো হয়। আরেকটি প্রকল্পের আওতায় ৩০০ মিলিয়ন ঋণ দেয়া হবে, যেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা হবে বলে জানানো হয়েছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময়ে যেসব শিক্ষার্থীর ক্ষতি হয়েছে তাদের সহায়তার আওতায় আনা হবে। আরেকটি প্রকল্পের আওতায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম ও সাভারে মশা নিধনে সহায়তা প্রদান করা হবে। ফলে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে বলেও জানানো হয়েছে।
অন্য আরেকটি প্রকল্পের আওতায় গ্যাস সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেবে। যার আওতায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ১২ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা সম্ভব হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া যমুনা নদী সুরক্ষা ও বাঁধ নির্মাণে ঋণচুক্তি হয়েছে বলেও জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রধান আবদৌলায়ে সেক বলেন, এসব প্রকল্প বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলা এবং ভবিষ্যতের জন্য শিশুদের যোগ্য করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
সোনার দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। দাম ছাড়িয়েছে লাখ টাকার ওপরে। সোনার দাম বাড়ার পর স্মারক মুদ্রার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিটি মুদ্রার দাম পাঁচ হাজার টাকা করে বাড়িয়ে ৯৫ হাজার টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।
নতুন এ দর আজ থেকে কার্যকর হবে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে সোনার দাম বাড়ায় এ মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। এর আগে গত ২ নভেম্বর প্রতিটি স্মারক মুদ্রার দাম তিন হাজার টাকা বাড়িয়ে ৯০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক মুদ্রিত ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০০০’, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ১৯২০-২০২০’ এবং ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ১৯৭১-২০২১’ শীর্ষক স্মারক স্বর্ণমুদ্রার দাম পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। ২২ ক্যারেট স্বর্ণ দ্বারা প্রস্তুত করা ১০ গ্রাম ওজনের ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০০০’, ‘ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ১৯২০-২০২০’ এবং ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ১৯৭১-২০২১’ শীর্ষক স্মারক স্বর্ণমুদ্রা (বাক্সসহ) প্রতিটির বিক্রয় মূল্য ৯৫ হাজার টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হলো।
আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে সোনার মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে স্বর্ণমুদ্রার মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে, যা বুধবার (২২ নভেম্বর) থেকে কার্যকর হবে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রগতি স্কিমের মাধ্যমে যেকোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের জন্য পেনশন হিসাব পরিচালনা করতে পারবে। এজন্য বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত কর্মচারীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ সহজ করতে একটি সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে।
গতকাল সোমবার অর্থ বিভাগের অধীন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন যৌথ-মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের মধ্যে এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রগতি স্কিমের মাধ্যমে যেকোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের জন্য পেনশন হিসাব পরিচালনা করতে পারবে। এ স্কিমের অধীনে ২ হাজার, ৩ হাজার, ৫ হাজার ও ১০ হাজার টাকা জমার চারটি অপশন আছে।
যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর দেশের বিভিন্ন ধরনের যৌথ ও একক কোম্পানি এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন দিয়ে থাকে। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ২ লাখ ৮৭ হাজার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরটি হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রগতি পেনশন স্কিমে নিবন্ধন করা অনেক সহজ হবে।
সমঝোতা স্মারকে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের পক্ষে স্বাক্ষর করেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান এবং যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের নিবন্ধক মো. আবদুছ সামাদ আল আজাদ।
এর আগে, চলতি বছরের ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন স্কিমের শুভ উদ্বোধন করেন। এরপর যে চারটি স্কিমের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে সেগুলো হলো – প্রবাস (প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য), প্রগতি (বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য), সুরক্ষা (স্বকর্মে নিয়োজিতদের জন্য) এবং সমতা (স্বল্পআয়ের নাগরিকদের জন্য)।
দেশের অন্তত ১০ কোটি মানুষ পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আসবেন- এমন প্রত্যাশা সরকারের রয়েছে। বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনা এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার লক্ষ্য নিয়েই পেনশন স্কিম চালু করা হয়। দেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিক পেনশন কর্মসূচিতে যোগ দেবেন, সরকারের এমন প্রত্যাশা থাকলেও প্রথম তিন মাস পর্যন্ত মানুষের সাড়া খুবই কম।
চারটি কর্মসূচির মধ্যে প্রগতিতে এখন পর্যন্ত চাঁদা দিয়েছেন সাত হাজার জনের কিছু বেশি। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মরত কর্মচারীদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ আরও সহজ করার লক্ষ্যে আরজেএসসির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
প্রগতি স্কিমের মাধ্যমে যেকোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের জন্য পেনশন হিসাব পরিচালনা করতে পারেন। এ স্কিমের অধীন এত দিন ২ হাজার, ৩ হাজার ও ৫ হাজার টাকা পরিমাণে মাসিক অর্থ (চাঁদা) জমা রাখার সুযোগ ছিল। এখন ১০ হাজার টাকা চাঁদা জমারও সুযোগ রাখা হয়েছে।
গোলাম মোস্তফা জানান, আরজেএসসির সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষরের ফলে নিবন্ধিত এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রগতি পেনশন স্কিমে নিবন্ধন করা অনেক সহজ হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের যাচাইপ্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যাবে।
দেশের বিভিন্ন ধরনের যৌথ, একক কোম্পানি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন দিয়ে থাকে আরজেএসসি। গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত সরকারি এ সংস্থা ২ লাখ ৮৭ হাজার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন দিয়েছে।
নিয়ম অনুসারে, প্রগতি স্কিমের চাঁদা কর্মচারীরা ৫০ শতাংশ এবং মালিকপক্ষ ৫০ শতাংশ হারে বহন করবে। তবে কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্কিমে অংশ নিতে না চাইলে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা নিজ উদ্যোগে এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত ১৫ হাজার ৮৫৮ জন বাংলাদেশি নাগরিক সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন করেছেন। এ কর্মসূচিতে জমা হওয়া অর্থ থেকে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে ১১ কোটি ৩১ লাখ টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করেছে।
যেকোনো দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার জায়গা ধরা হয় মানি লন্ডারিং অর্থাৎ অবৈধ উপায়ে বিদেশে টাকা পাচার করা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি আরও বেশি মাথাব্যথার কারণ। এতে একদিকে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যায়, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ব্যাপকভাবে বাধার মুখে পড়ে।
গেল কয়েক বছর দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ছিল অর্থ পাচার কী করে বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে। কানাডার বেগমপাড়া, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে করছাড় দেন অর্থমন্ত্রী। এমনকি দেশে কেউ অর্থ ফিরিয়ে আনলে তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। তার সেই ঘোষণার কোনো সুফল পাওয়া গেছে বলে জানা যায়নি।
তবে এবার দেশ থেকে অর্থ পাচার কমার মতো সুখবর দিল সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা সংস্থা দ্য ব্যাসেল ইনস্টিটিউট অন গভর্ন্যান্স।
সংস্থাটি তাদের অ্যান্টি মানি লন্ডারিং-এএমএল ইনডেক্স-২০২৩ রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়েছে, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের পাঁচ ধাপ উন্নতি হয়েছে, যা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ পাঁচটি দেশকে পেছনে ফেলে বর্তমানে ৪১ থেকে ৪৬ নম্বরে অবস্থান করছে। আশার কথা, ২০২২ সালেও বাংলাদেশ তার আগের বছরের তুলনায় সূচকটিতে আট ধাপ অগ্রগতি লাভ করেছিল। অর্থাৎ পরপর দুই বছরে বাংলাদেশ তেরো ধাপ এগিয়েছে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ইনডেক্সে।
সূচকে দেখা যায়, মানি লন্ডারিংয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ক্যারিবীয় দ্বীপের দেশ হাইতি। দেশটি ইনডেক্সে সবার ওপরে অবস্থান করছে। এরপর দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চাদ, মিয়ানমার ও কঙ্গো। অন্যদিকে তালিকায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ আইসল্যান্ড। দেশটি ব্যাসেল ইনডেক্সে ১৫২-তে অবস্থান করছে।
তালিকায় বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে চীন। লন্ডারিং ইনডেক্সে দেশটি অবস্থান করছে ২৭তম অবস্থানে। এ ছাড়া তালিকায় পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান যথাক্রমে ৬১ ও ৬২তম। তবে উন্নত বিশ্বের দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রয়েছে যথাক্রমে ১১৯ ও ১৪০তম অবস্থানে। ব্যাসেল ইনস্টিটিউট অন গভর্ন্যান্স বিশ্বের ১৫২টি দেশের মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন ঝুঁকি নিরূপণ করে এই তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকা তৈরিতে প্রতিষ্ঠানটি ২০২২ সালের তথ্য ব্যবহার করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সূচকে উন্নয়নের কারণ হিসেবে আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ কাঠামোর মানোন্নয়নের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয় বৃদ্ধি, আর্থিক খাতে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থার উন্নয়ন, এ খাতে সরকারের লোকবল বৃদ্ধি ও অর্থের সংস্থান ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।
ব্যাসেল ইনস্টিটিউট অন গভর্ন্যান্স গত ১২ বছর ধরে পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এ রিপোর্ট করে আসছে। যার মধ্যে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের ওপর ৬৫ শতাংশ, ঘুষ ও দুর্নীতির ওপর ১০ শতাংশ, আর্থিক স্বচ্ছতা মানদণ্ডে ১০ শতাংশ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে ৫ শতাংশ এবং আইনগত ও রাজনৈতিক ঝুঁকির ওপর ১০ শতাংশ।
ডলারের তীব্র সংকট চলছে। ফলে ব্যাংকগুলো নিয়মিত ঋণপত্র (আমদানি-এলসি) খুলতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনে বেশি দামে প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার কেনার সুযোগ পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এতে কিছুটা হলেও বাড়ছে রেমিট্যান্সপ্রবাহ। রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি নভেম্বরের প্রথম ১৭ দিনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ পথে ও ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১১৮ কোটি ৭৭ হাজার ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৩ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১১ টাকা ধরে)। সে হিসেবে দৈনিক আসছে ৬ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে প্রবাসী আয় দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি মাসের ১৭ দিনে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে তার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৭ কোটি ৮৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৭০ হাজার ডলার, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ১০৭ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৩৬ লাখ মার্কিন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৭৬ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস রেমিট্যান্সপ্রবাহ ধারাবাহিকভাবে কমেছিল। ডলার সংকটের কারণে গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয়ে বড় হোঁচট খায়। ওই মাসে গত সাড়ে ৩ বছর বা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় আসে বাংলাদেশে, যা পরিমাণে ১৩৪ কোটি ডলার। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ১০৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স আসে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার এবং আগস্টে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত মার্চের পর থেকে দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক; কিন্তু তাতে সংকট আরও প্রকট হয়। পরে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় তারা সভা করে ডলারের রেট নির্ধারণ করে আসছে।
সবশেষ ব্যাংকগুলোর ঘোষণা অনুযায়ী, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনার ক্ষেত্রে ডলারের ঘোষিত দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আজ রোববার আন্তব্যাংকে ডলার লেনদেন হয় ১১১ টাকা দরে। তবে কোনো ব্যাংকের প্রয়োজনে চাইলে ব্যাংকের নিজস্ব প্রণোদনাসহ সর্বোচ্চ দাম হবে ১১৬ টাকা। তবে আমদানিকারকদের কাছে ব্যাংকগুলোকে ১১১ টাকায় বিক্রি করতে হবে, এর বেশি নেয়া যাবে না। কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে নগদ এক ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১২৫ টাকা। চিকিৎসা, শিক্ষা বা ভ্রমণের জন্য যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের নগদ প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১২৫ টাকা পর্যন্ত।