জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট একবার ঢাকায় এসেছেন। উঠবেন কোথায়? হোটেল সোনারগাঁওয়ে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন হোটেলের কোন রুম খালি নেই। তখন মন্দের ভালো হিসেবে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গেলেন। সেখানে কোনো রুম খালি নেই। কী করেন?
চলে গেলেন লা ভিঞ্চিতে। এখানে রুম খালি আছে। কিন্তু লা ভিঞ্চির যত জৌলুশ থাক, সোনারগাঁওয়ের কাছে তা নিতান্তই সাদামাটা। কী আর করা, সেখানেই রাত কাটালেন। খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দুই চোখে ঘুম নেমে এল। দীর্ঘ আকাশ ভ্রমণের পর ক্লান্তি ভর করাই স্বাভাবিক। তাই সোনারগাঁওয়ের দুঃখ ভুলে আরামে ঘুম দিলেন। কিন্তু সোনারগাঁও তার পিছু ছাড়ে না। স্বপ্ন এসেও মনে করিয়ে দেয়।
হঠাৎ দৃশ্যপট পাল্টে যায় স্বপ্নের। হিলবার্ট আবিষ্কার করেন, তিনি প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন। এত টাকা কী করবেন ভেবে পান না। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়, ঢাকায় একটা হোটেল খুলবেন। এমন হোটেল যেন কখনো কাস্টমারকে ফিরে যেতে না হয়।
মনে মনে হিসাব কষলেন হিলবার্ট। ঢাকা শহরে প্রচুর লোক বাস করে। ধরা যাক, কোনো এক রাতে এদের সবাই সেই হোটেলে থাকতে চাইবে। তাহলে কতগুলো রুম লাগবে। ৫০ লাখ, ১ কোটি?
সঠিক সংখ্যাটা হিলবার্ট জানেন না। তিনি ঠিক করলেন হোটেলটার রুম সংখ্যা হবে অসীম। হ্যাঁ, অসীম নিয়ে হিসাব-নিকাশ করা কঠিন বটে, গণিতবিদদের কাছে অসীম বা ইনফিনিটি হলো ডাল-ভাত। নিত্যই ইনফিনিটি নিয়ে কাজ করতে হয়।
হোটেল তৈরি হলো। প্রথমেই অসীমসংখ্যক নয়, ১০০০ কামরার একটা হোটেল তৈরি করলেন। নিজেই নিলেন তার তদারকির ভার।
একদিন দেখেন, হোটেল পরিপূর্ণ। নতুন কেউ এলে জায়গা দেয়া সম্ভব নয়। সেই সময় এক লোক চেক আউট করল। ১০০০ নম্বর রুমের বাসিন্দা। সুতরাং নতুন গেস্টকে ১০০০ নম্বর রুমে জায়গা দেয়া কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, নতুন লোকটি ১০০০তম রুমে উঠতে চায় না। তখন হিলবার্ট ৯৯৯ রুমের গেস্টকে স্থানান্তর করলেন ১০০০ নম্বর রুমে। সহজেই নতুন গেস্টের জায়গা হয়ে গেল।
হোটেলের সার্ভিস খুবই ভালো। তাই গেস্টের সংখ্যা বাড়তে থাকল। কিন্তু হিলবার্ট সন্তুষ্ট নন। তাই সত্যি সত্যি রুমের সংখ্যা বাড়িয়ে অসীম সংখ্যায় নিয়ে গেলেন যেন রুমের ঘাটতি না পড়ে।
তারপরও সমস্যা হলো। একদিন সেই অসীমসংখ্যক রুমের সবকটি পূর্ণ ছিল। অর্থাৎ অসীমসংখ্যক রুম অসীমসংখ্যক গেস্ট দিয়ে ভরা। এখন কী করবেন?
হিলবার্ট গণিতবিদ, তার জন্য এটা কোনো সমস্যাই নয়। অসীমের সঙ্গে যত সংখ্যাই যোগ-বিয়োগ করুন, সংখ্যা সেই অসীমই হবে। অর্থাৎ হিলবার্টের সেই হোটেলে গেস্টে পূর্ণ রুমের সংখ্যা ছিল অসীম। খালি রুমের সংখ্যাও এখানে শূন্য হওয়ার সম্ভব নয়, তাই খালি রুমও ছিল অসীম। হিলবার্ট তাই গণিতের মারপ্যাঁচ কষলেন। ১ নম্বর রুমের গেস্টকে ২ নম্বর রুমে, ২-এর গেস্টকে ৩-এ, ৩-এর গেস্টকে ৪-এ এভাবে nতম রুমের গেস্টকে n+1তম রুমে স্থানান্তর করে নতুন গেস্টে ১ নম্বর রুমে জায়গা করে দিতে হিলবার্টের বেগ পেতে হলো না।
পরদিন সকালে হোটেলে অসীমসংখ্যক অতিথি নিয়ে একটি বাস এল এবং অসীমসংখ্যক অতিথির জন্যও অসীমসংখ্যক রুমের প্রয়োজন। হোটেল ম্যানেজার যেহেতু একজন তুখোড় গণিতবিদ, তাকে তো অতিথিদের জায়গা করে দিতেই হবে। তিনি চিন্তা করলেন, যেকোনো সংখ্যাকে ২ দিয়ে গুণ করা হলে সব সময়ই জোড় সংখ্যা পাওয়া যাবে। তাহলে n কে যদি ২ দিয়ে গুণ করা হয় তাহলে ফলাফল হবে 2n, তাহলে প্রতিটা রুমের পর্যটক তাদের রুমের সঙ্গে ২ গুণ করে অসীমসংখ্যক জোড় সংখ্যার রুম পাওয়া যাবে। বিজোড় সংখ্যার রুমের সব অতিথিকে তার সঙ্গে ২ দিয়ে গুণ করে যে জোড় সংখ্যা পাওয়া যাবে, সেসব রুমে শিফট করলে অসীমসংখ্যক বিজোড় রুম ফাঁকা হয়ে যাবে। ১ নম্বর রুমে গেস্টকে ২ নম্বর রুমে, ৩ নম্বর রুমের গেস্টকে ৬-এ, ৫-এর গেস্টকে ১০ নম্বর রুমে nতম রুমের বাসিন্দাকে 2nতম স্থানান্তর করলেন হিলবার্ট। তাহলে অসীমসংখ্যক বিজোড় রুম খালি হলো। নতুন অতিথিদের এই বিজোড় নম্বরের রুমে জায়গা দিতে কোনো অসুবিধা হলো না।
এক সপ্তাহ পরে আবার ঝামেলায় পড়লেন হিলবার্ট। সে দিনও অসীমসংখ্যক রুমে অসীমসংখ্যক গেস্টে ভরা। সে দিন আরও নতুন অতিথি এল। এবার একটা-দুটো গাড়িতে নয়। অসীমসংখ্যক গাড়ি এল। আর প্রতিটা গাড়িতেই অসীমসংখ্যক গেস্ট ছিল। এখন কী করবেন?
হিলবার্ট বলে কথা। তিনি এবার মৌলিক সংখ্যার রুম আলাদা করলেন। মৌলিক সংখ্যার সংজ্ঞাটা জানেন তো? না জানলেও ক্ষতি নেই, কোনো সংখ্যাকে যদি সেই সংখ্যা ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দিয়ে ভাগ না করা যায়, তাহলে সেটা মৌলিক সংখ্যা। যেমন ৩ কে ৩ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ভাগ করা যায় না। তাই এটা মৌলিক সংখ্যা। মৌলিক সংখ্যার সংখ্যাও কিন্তু অসীম।
১, ৩, ৫, ৭, ১১, ১৩, ১৭, ১৯, ২৩, ২৯… … …infi। তাই হিলবার্ট মৌলিক সংখ্যার রুমগুলো থেকে খালি করার কথা ভাবলেন। সেই রুমে বর্তমান গেস্টকে পাঠাবেন ২-এর ঘাত অনুযায়ী শিফট করলেন। যেমন ২-এর বর্গ ২২=৪, দুইয়ের গেস্টকে ৪ নম্বর রুমে; ৩ নম্বর রুমে গেস্টকে ২৩=৮ নম্বর রুম, ৪ নম্বরের গেস্টকে ২৪=১৬ নম্বর রুমে স্থানান্তর করলেন। এভাবে nতম রুমের গেস্টকে ২nতম রুমে শিফট করলেন। এভাবে প্রতিটা মৌলিকসংখ্যক রুম খালি হলো। নতুন অতিথিদের সেই রুমগুলোতে জায়গা করে দিলেন।
তবে এখানে একটা সমস্যা দেখা দিল। সমস্যাটা হলো, ২ নম্বর রুমের গেস্টকে ৪ নম্বর রুমে স্থানান্তর করা হলো, সেখানে আগেই গেস্ট ছিল। তাহলে?
২ নং রুমের বাসিন্দাকে ৪ নম্বর রুমে যখন শিফট করা হচ্ছে ৪ নম্বর রুমের গেস্টকে ২৪=৬৪ নম্বর রুমে শিফট করা হলো। সেই রুমের গেস্টকে ২৬৪তম রুমে স্থানান্তর করা হলো। যেহেতু অসীমসংখ্যক রুম খালি করা সম্ভব, তাই একসময় গিয়ে খালি রুম পাওয়া যাবেই। অন্য সংখ্যাগুলোর ক্ষেত্রেও প্রক্রিয়া একই।
এখানে প্যারাডক্সটা হলো, অসীমের হেঁয়ালি। গণিতে সংখ্যার কোনো শেষ নেই। কিন্তু আমাদের জীবন, মহাবিশ্ব সবকিছু সসীম। এমন কোনো হোটেল কখনোই তৈরি করা যাবে না, যার কামরা সংখ্যা সমীম। এই প্যারডক্সের আবিষ্কর্তা আইনস্টাইনের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। ধারণা করা হয়, আর সপ্তাহখানেই দেরি করলে আইনস্টাইন নয়, হিলবার্টই জেনারেল থিউরি অব রিলেটিভিটি জনক হয়ে যেতেন। এই প্যারাডক্সটা হিলবার্ট’স ইনফিনিটি গ্র্যান্ড হোটেল প্যারাডক্স নামে পরিচিত।
পুরান ঢাকার শ্রীশ দাস লেনের হলুদ রঙের দোতলা ১ নম্বর বাড়িটি। এই বাড়িটিতে ৫০-৬০ দশকে জমে উঠত কবি-সাহিত্যিক-লেখকদের আড্ডার পসরা; চলত শিল্প ও সাহিত্যের চর্চাও। রাজনীতি চর্চাও কম হতো না। সেখানে যেমন বঙ্গবন্ধু আসতেন, তেমনি আসতেন কবি সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমান আর বেলাল চৌধুরীরা। এখানে বসে যারা আড্ডা জমাতেন, তাদের বলা হতো ‘বিউটিয়ান’। আজ কোথায় সেই বিউটিয়ানরা? এখন সবাই আসে ছবি তুলতে, কয়েক মিনিটের জন্য প্রদর্শন করতে। এখন সেই দিন আর নেই, নেই অতীত সেই ঐতিহ্যও। অভিজাতরাও তেমন আসেন না, হয় না সেই সাহিত্য ও শিল্পচর্চা আর রাজনীতি নিয়ে গরম গরম কথার জমজমাট আড্ডা। বিউটি বোর্ডিংয়ে আসতেন কবি শহীদ কাদরী। কাদরীর পদচারণে বেড়ে যায় কবি-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিদের আনাগোনা। বেড়ে যায় শিল্প ও সাহিত্যের চর্চাও। কবি-সাহিত্যিকরা ছুটে আসার আরেকটি কারণও ছিল। মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু পুরান ঢাকার বাংলাবাজারে হওয়ার কারণে। শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘মনে পড়ে একদা যেতাম প্রত্যহ দুবেলা বাংলাবাজারের শীর্ণ গলির ভেতরে সেই বিউটি বোর্ডিংয়ে পরস্পর মুখ দেখার আশায় আমরা কজন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখানে বসে সভা করতেন, দিকনির্দেশনা দিতেন। এখানে বসেই আব্দুল জব্বার খান প্রথম সবাক বাংলা চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশের’ পাণ্ডুলিপি রচনা করেন। শামসুর রাহমানের নিজস্ব একটি টেবিল ছিল, যেখানে বসে তিনি কবিতা লিখতেন, এই টেবিল কেউ ব্যবহার করত না। তার প্রথম কবিতাও এখান থেকেই ছাপা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী বিউটি বোর্ডিংকে শ্মশানে পরিণত করে। ২০০৫ সাল থেকে প্রণীত হয় বিউটি বোর্ডিং সম্মাননা। প্রতি বছর এক বা একাধিক ব্যক্তি এই সম্মাননায় ভূষিত হন।
যেভাবে যাবেন
পুরান ঢাকার বাংলাবাজার এলাকায় অবস্থিত বিউটি বোর্ডিং। দক্ষিণবঙ্গ থেকে আসতে চাইলে যেকোনো লঞ্চে সদরঘাট নেমে, ২০-৩০ টাকা রিকশা ভাড়ায় কিংবা ৫-১০ মিনিট হেঁটে চলে আসা যাবে বিউটি বোর্ডিংয়ে। ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে সদরঘাটগামী বাসে এসে নামতে হবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বাহাদুরশাহ পার্ক বা ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে। সেখান থেকে হেঁটে ১০ মিনিটের পথ বিউটি বোর্ডিং।
জেনে রাখুন
সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে বিউটি বোর্ডিং। এখানে রয়েছে ২৭টি ঘর, যার ১৭টি একজনের, ১০টি দুজনের থাকার মতো। ঠিক ১১টায় বন্ধ হয়ে যায় প্রধান ফটক। এখানে যারা রাত যাপন করবেন, তাদের পরবর্তী দিন বেলা ১টার মধ্যেই কক্ষ ত্যাগ করতে হবে। না হলে গুনতে হবে পরবর্তী দিনের ভাড়া। এখানে সমাজবিরোধী ও রাজনৈতিক আলাপ সম্পূর্ণ নিষেধ। বিউটি বোর্ডিংয়ের দোতলায় যেতে হলে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট নিতে হবে। থাকা যাবে যতক্ষণ ইচ্ছা।
যেসব খাবার পাওয়া যাবে
প্রতিদিন ২৫ রকমের খাবার পাওয়া যায়। ভাত, ডাল, সবজি, ডিম, মাছ, মাংস সবই আছে এখানে। মাছের মধ্যে ইলিশ, বোয়াল, পাবদা নিয়মিত পাওয়া যায়। মাংসের মধ্যে মুরগি ও খাসি। এ ছাড়া ভর্তা, বড়া, মুড়িঘণ্ট, চাটনি আর দইও আছে। এখানে ১৫ টাকায় মিলবে দুধ চা।
ছুটির দিন মানে ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে ভ্রমণের দিন। ঠিক তেমনি এক ছুটির দিনে আমরা ৫ বন্ধু মিলে চলে গেলাম চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের অতি পরিচিত একটি ঝরনাতে। ঝরনার নাম নাপিত্তাছড়া ঝরনা। নাম শুনলে হয়তো একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে। তবে এই অদ্ভুত নামের ঝরনাটিতে পাবেন চমৎকার ট্রাকিং আর প্রকৃতি দেখার সুযোগ। নাপিত্তাছড়া ঝরনার সৌন্দর্য উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম বন্ধুরা মিলে। এই ভ্রমণে সঙ্গী হতে বোয়ালখালী থেকে দুই বন্ধু এবং একজন বড় ভাই এসেছেন। আর চট্টগ্রামে আমরা দুই বন্ধু তো আছিই। সর্বমোট ৫ জনের এই গ্রুপটি সকাল ৮টায় চট্টগ্রামের এ কে খান থেকে রওনা দিলাম মিরসরাইয়ের নয়দুয়ারি হাটের উদ্দেশে। চট্টগ্রাম নগরীর এ কে খান থেকে ঢাকা-কুমিল্লাগামী বাসে উঠে নয়দুয়ারি বাজার বা হাট বললেই নামিয়ে দেবে। জনপ্রতি ৫০-৬০ টাকা করে নেবে।
যা-ই হোক বাসে উঠলাম, প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছলাম নির্দিষ্ট স্থানে। অর্থাৎ নয়দুয়ারি হাটে। গাড়ি থেকে নেমে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে ঝরনা দেখতে যাওয়ার রাস্তা কোনটি। চাইলে ওই গ্রাম থেকে একজন গাইড নিয়ে নিতে পারেন, ৪০০-৫০০ টাকার মতো নেবে ৪-৫ ঘণ্টার জন্য। আমরাও একজন গাইড নিলাম। ভদ্রলোকের নাম আব্দুল করিম। আমরা করিম ভাই বলেই ডাকছি তাকে।
এরপর পাহাড়ি অরণ্যে ঝিরিপথ বরাবর চলা শুরু করলাম করিম ভাইয়ের পেছন পেছন। করিম ভাই বলেন, এখানে মোট ৪টি ঝরনা আছে- টিপরাখুম ঝরনা, কুপিটাকুম ঝরনা, মিঠাছড়ি ঝরনা ও বান্দরখুম ঝরনা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ এবং প্রচণ্ড গরম আমাদের কিছুটা ক্লান্ত করেছে। তবে যত যাচ্ছি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। বড় বড় পাথর আর পানি তো আছেই। সঙ্গে আছে বিশাল বিশাল পাহাড়ের খাদ। ভয়ংকর কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। দুই পাশে পাহাড় আর মাঝখানে সরু রাস্তা। রাস্তা বলতে এটা সহজ রাস্তা নয়। কখনো বড় বড় পাথর পাড়ি দিতে হবে, কখনো ছোট ছোট পানির গর্ত পাড়ি দিতে হবে, আবার কখনো উঠতে হবে পাহাড়ে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা মিলবে এই পথে যাওয়ার সময়। তবে ঝরনায় যাওয়ার এই রাস্তাটির প্রতিটি অংশই অদ্ভুত সুন্দর। এভাবেই আমাদের গাইড করিম ভাই আমাদের নিয়ে চলে এলেন ঝরনার কাছে। ঝরনা চারটি বেশি দূরে নয়। আমরা প্রথম ঝরনাটির সামনে চলে এলাম। তবে এই টিপরাখুম ঝরনার পানি ততটা স্বচ্ছ নয়। কিন্তু বাকি ঝরনাগুলোর চেয়ে এই ঝরনাটি সবার আগে। তাই অনেকে ক্লান্ত হয়ে এখান থেকেই ফিরে যায়। এর প্রায় ১০-২০ মিনিট যাওয়ার পর দ্বিতীয় ঝরনা কুপিকাটাকুম পেয়ে যাবেন। অনেক সুন্দর একটি ঝরনা। ঝরনায় পানির পরিমাণও ভালো। ঝরনাটির সামনের পানির অংশটি কিছুটা গভীর। তাই একেবারে ঝরনার সামনে যেতে হলে আপনাকে সাঁতার কেটে যেতে হবে। সেই সঙ্গে ঝরনার পানি বেশ ঠাণ্ডা। সূর্যের এই তাপের মাঝেও একটুখানি প্রশান্তি পাওয়া যায় এই ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিলে। পানিগুলো পানও করা যায়।
যা-ই হোক, ঝরনার পানি পান করলাম, ছবি তুললাম, নাশতা করলাম এবং হালকা বিশ্রাম নিলাম। এরপর তৃতীয় ঝরনা মিঠাছড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। মিঠাছড়ি ঝরনায় যাওয়ার সময় ছোট একটি পাহাড়ের প্রায় খাড়া একটি ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। এটা বেশ ভয়ংকর। তাই যাদের ট্রাকিং করার অভিজ্ঞতা কম, তাদের এ সময় কিছুটা সতর্ক থাকতে হয়। ঝরনাটি বেশ কাছেই। ২০ মিনিটের মধ্যেই মিঠাছড়ি ঝরনায় পৌঁছে যাবেন। ঝরনাটির উচ্চতা বেশ। ওপর থেকে পানি পড়ার সময় অর্ধেকটা অংশ পার হওয়ার পর দুই ভাগ হয়ে দুই দিকে পানি পড়ে। নিজের চোখে না দেখলে দৃশ্যটি সত্যি বলে বোঝানোর মতো নয়। বিশেষ করে বর্ষার সময় এই ঝরনাটি খুব সুন্দর দেখায়।
মিঠাছড়ি ঝরনায় কিছুক্ষণ থাকার পর সর্বশেষ ঝরনা বান্দরকুম বা বান্দরিছড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু কললাম। প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট ঝিরি পথ বরাবর হাঁটার পর ঝরনাটি পেয়ে যাই। এই ঝরনাটিও বেশ সুন্দর। বাকি তিনটি ঝরনার চেয়ে এই ঝরনাটির উচ্চতা সবচেয়ে বেশি। ঝরনায় যাওয়ার ঝিরি পথটা অনেক সুন্দর। তেমন কোনো ভয়ংকর রাস্তাও ছিল না। তবে এই ঝরনাগুলো দেখতে বর্ষার সময় আসাটাই সবচেয়ে ভালো সময়, তাহলে ঝরনার সর্বোচ্চ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
দীর্ঘ সময় ঝরনার মনোরম দৃশ্য উপভোগ করলাম। এবার ফেরার পালা। রওনা দিলাম গাইড করিম ভাইয়ের পেছন পেছন। ৪-৫ ঘণ্টা বললেও আরও বেশি সময় লেগেছে আমাদের। প্রায় সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আর বেশি সময় থাকা যাবে না।
গাইড নেয়ার সুবিধাটা উপলব্ধি করলাম আমরা শেষ সময়ে। যেদিক দিয়ে এসেছিলাম, সেদিক দিয়ে সবাই যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যখন ফিরে যাচ্ছি, তখন ভিন্ন পথ দিয়ে যাচ্ছি। এই ভিন্ন পথে যাওয়ার কারণটা হচ্ছে সহজ রাস্তা। আর এই সহজ রাস্তাটা গাইড থাকার কারণেই চেনা। ঝরনার পাশেই পাহাড়ে বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। এরপর অল্প হেঁটেই পাহাড় দিয়ে শুধু নামলেই চলবে। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা নেমে গেলাম। তখনই বুঝলাম গাইড কেন প্রয়োজন। গাইড না থাকলে এমন সহজ পথ আছে কেউ জানত না। তবে পাহাড় বেয়ে উঠা যেমন কষ্ট, নামাও তেমন কষ্ট। এটা নাপিত্তাছড়া ঝরনা ভ্রমণে না এলে বুঝতে পারতাম না।
পুরো ভ্রমণের সার্থকতা খুঁজতে চাইলে প্রথমেই বলতে হবে ট্রাকিংয়ের কথা। বড় বড় পাথর আর পাহাড়ের গহিনে যাওয়াটা সহজ বিষয় না। এ ছাড়া পরিবেশ-প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার স্বাদ তো পাবেনই। তবে ঝরনার কাছাকাছি চলে এলে দূর হয়ে যাবে আপনার সব ক্লান্তি। নিজের চোখে জলপ্রপাত দেখার এই অপূর্ব অনুভূতি একমাত্র যিনি দেখেন তিনিই জানেন।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে উঠে নয়দুয়ারি বাজারে নেমে যেতে হবে। ট্রেনে করে এলেও সীতাকুণ্ডে নেমে নয়দুয়ারি বাজার আসা যায়। চট্টগ্রামের এ কে খান থেকে নয়াদুয়ারি বাজার আসতে পারবেন বাসযোগে।
কোথায় থাকবেন?
এই ভ্রমণ এক দিনের। তাই থাকার দরকার পড়বে না, তবুও নিতান্তই রাতে থাকতে চাইলে মিরসরাই বা সীতাকুণ্ডে হোটেল পাবেন। ভালো হোটেলে থাকতে চাইলে চট্টগ্রাম চলে যেতে হবে।
খাবেন কোথায়?
ট্রেইলে যাওয়ার পথে একটা ছোট হোটেল আছে, সেখানে যাওয়ার আগে কী খাবেন তার অর্ডার দিয়ে যেতে হবে। তাহলে রান্না করে রাখবে, ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া করতে পারবেন। এ ছাড়া ভালো মানের খাবার খেতে চাইলে মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডে ভালো মানের রেস্তরাঁ রয়েছে।
গ্রাম বনে এখনো শিয়ালই রাজা। তবে টলমল করছে তাদের রাজত্ব। স্রেফ বুদ্ধির জোরেই এত বড় প্রাণী আজও টিকে আছে বাংলার মাঠে। কিন্তু আর কদিন? দশ কি বিশ বছর পরে বাংলার মাঠে শিয়াল আর দেখা যাবে কি না সন্দেহ। তবে শিয়াল টিকবে কি টিকবে না, সে তর্কে এখন যাব না। আজ বরং একটা গল্প বলি।
ছোটকালে নানার মুখে শিয়ালদের নানা কীর্তি-কাহিনি শুনেছি। এখন ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ও ডিসকভারির কল্যাণে সেসব গল্পের বাস্তব রূপ দেখতে পাই।
নানাদের গ্রামটি এখনো জঙ্গলে ঠাসা। ব্রিটিশ আমলে গহিন অরণ্য ছিল। মেছো বাঘ, গেছো বাঘ, ভালুক, ভাম, বন্য বরাহদের আস্তানা ছিল বনজুড়ে। এক দিন নানা মাঠে গিয়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখেন। দুটি শিয়াল আক্রমণ করেছে একটি মা বন্য শূকরকে। শূকরটি তার তিন-চারটি ছানা নিয়ে আস্তানায় শুয়ে ছিল। শিয়ালের টার্গেট ধাড়ি নয়, ছানা। একটি শিয়াল সন্তর্পণে এগিয়ে যায় শূকরের নাক বরাবর। মা শূকর বুঝে ফেলে শিয়ালের মতলব। সে কিছুতেই আস্তানা ছেড়ে নড়ে না। তখন শিয়াল আরও এগিয়ে যায়। একেবারে ধাড়ির কোল থেকে বাচ্চা ছিনিয়ে নেয়ার উপক্রম! তখন বাধ্য হয়ে মা শূকর শিয়ালটিকে তাড়া করে। এই সুযোগ অন্য শিয়ালটি একটু আড়ালে ছিল। সে বেরিয়ে এসেই একটি শূকর ছানা নিয়ে পালায়।
শুকরটা আস্তানা ছেড়ে বেশি দূর যায় না। শিয়ালকে কিছু দূর তাড়িয়ে দিয়ে আসে। ফিরে দেখে আরেকটি শিয়াল তার ছানা নিয়ে পালাচ্ছে। ‘শূকরের গো’ বলে কথা! প্রাণপণে সে তখন এই শিয়ালটিকে ধাওয়া করে। ততক্ষণে আগে ধাওয়া খাওয়া শিয়ালটি ফিরে এসে আরেকটা ছানা নিয়ে পালায়।
নানার মুখে শুনেছি শিয়ালগুলো এভাবে সবকটি শূকরছানা দুই দিনের মধ্যেই গায়েব করে দেয়।
এক দিন এ ধরনের একটি দৃশ্য দেখে গল্পটি মনে পড়ে গেল। সেবার বাড়ি গিয়েছিলাম ছুটিতে। ক্যাননের নতুন একটা ক্যামেরা কিনেছি। ট্রাইপডও নিয়ে নিলাম একটি। কম্প্যাক্ট ক্যামেরায় জুম করে ছবি তুলতে গেলে ট্রাইপড ছাড়া চলেই না। এবার শুধু গাছগাছালির জন্য বাড়ি যাচ্ছি না। পাখির ছবি তোলারও ইচ্ছা আছে। শিয়ালের ছবি তোলার ইচ্ছেটাও ঘুরপাক খচ্ছিল। বর্ষাকাল হলে তবুও সম্ভাবনা ছিল কিছুটা। কিন্তু বসন্তে অসম্ভব ব্যাপার। এখন শিয়াল কমে গেছে। দেখা পাওয়াই দুর্লভ ব্যাপার। যদিও সন্ধেবেলায় মাঝে মাঝে দেখা যায়। কিন্তু দূর থেকে কম আলোতে ছবি নেয়া এই ক্যামেরায় একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু এভাবে শিয়ালের ছবি পেয়ে যাব, ভাবিনি! সঙ্গে ছিল আমার ছোট ভাই শাহেদ।
ইছামতীর পাড়ে বড় বাগানটায় এসে শাহেদ চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভাইয়া শিয়াল!’
দ্রুত কাঁধ থেকে ট্রাইপড নামাতে নামাতে একটি শিয়াল ধীরপায়ে জঙ্গলের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল। আসলে শিয়াল দুটি এসেছিল ছাগল কবজা করতে। একপাল ছাগল চরছিল বাগানটির পাশেই একটা ঘেসো জমিতে। রাখাল গিয়েছিল শ্যালো মেশিনে পানি খেতে। এই ফাঁকে শিয়াল দুটি আক্রমণ করে। কিন্তু টের পেয়ে যায় রাখাল। তার হাতে বাঁশের লাঠি। হৈ হৈ করে তেড়ে আসে। কিন্তু শিয়াল দুটির ভাব দেখে মনে হলো, রাখালকে পরোয়া করছে না। লাঠি হাতে তেড়ে আসতে দেখে শিয়াল দুটি এগোয়। তবে দুটি দুই দিকে। একটা গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ঝোপের আড়ালে। কিন্তু আরেকটার কোনো তাড়া আছে বলে মনে হলো না। কিছুটা এগোচ্ছে আর থামছে। ঘুরে দেখে নিচ্ছে ছাগলগুলোর অবস্থা। হঠাৎ আমাদের দেখে দুঃসাহসটা আর দেখাতে পারল না। কারণ, উত্তর দিকে রাখাল, দক্ষিণে আমরা। শিয়াল কিছুতেই ছাগল নিয়ে পালাতে পারত না। কিন্তু শিয়ালটি যদি আমার মনের কথা জানতে পারত, তাহলে দুজন মিলে শূকরছানা ধরার মতো করে একটি ছাগল ঠিকই কবজা করত। আমি চাচ্ছিলাম শিয়াল ছাগল ধরে নিয়ে যাক। মানুষ বন-জঙ্গল উজাড় করে বন্য প্রাণীদের অধিকার ধূলিসাৎ করেছে। এখন ওরা যাবে কোথায়, খাবে কী? তাই মানুষের পোষা প্রাণীতে ওদের ভাগ ন্যায্য বলে আমি মনে করি।
কিন্তু শিয়ালটি সে ঝুঁকিতে গেল না। সঙ্গীটি না পালালে কী করত জানি না। সেও ধীরে, খুব ধীরে একরাশ হতাশা নিয়ে বাঁশবনের ভেতরে ভাট-আশশ্যাওড়ার জঙ্গলে হারিয়ে গেল। তবে যাওয়ার আগে আমাকে দিয়ে গেল মহামূল্যবান একটা ছবি।
পানির ছোঁয়া পায়নি মাটি, যাচ্ছিল তাই ফেটে
এমন ছবি যাচ্ছে পাওয়া ঘাঁটলে পরে ‘নেট’-এ।
বাস্তবে এই মাটির কাছে আজ বিকেলে এসে
ঘ্রাণ পেয়েছি আহ্ কি সোঁদা! একটু বৃষ্টি শেষে।
বুক ভরে সেই ঘ্রাণ নিয়েছি মাটির কাছে শুয়ে
গাছের পাতা ঘন সবুজ ধুলোবালি ধুয়ে।
বৃষ্টি মাটি দেয় ভিজিয়ে ওঠে গরম ভাপ
মাটির ভেতর জেগে ওঠে ইতিহাস-উত্তাপ।
মাটির ঘ্রাণে কী জাদু এক! পাই না ভাষা খুঁজে
কোন্ চেতনা রক্তে জাগে ভাবছি দু’চোখ বুজে।
এই মাটিতে রক্তের দাগ, ত্যাগের কথা আছে
ব্রিটিশ শোষণ দু’শো বছর, সাক্ষী মাটির কাছে।
পাকিস্তানের অত্যাচারের কথা মাটি জানে
বীর ছেলেদের রক্ত শেষে স্বাধীনতা আনে।
এক পশলা বৃষ্টি আমায় ইতিহাসের ঘ্রাণ
দেয় ছড়িয়ে মগজজুড়ে মাটিই আমার প্রাণ।
কী কথা হয় পাড়ের সাথে-
নদীর জলের, জোছনা রাতে?
কচুরি ফুল পাড়ে এসে
জোয়ারে ফের যাচ্ছে ভেসে।
পাড়ের সাথে জলের কথা
হঠাৎ হঠাৎ নীরবতা।
দূরে কোথাও মাঝির গান
কেমন করে উঠল প্রাণ।
পাড়ে যখন জলের ছোঁয়া
জমাট শ্যাওলা হচ্ছে ধোয়া।
বাঁশিঅলা করুণ সুরে
বাজায় বাঁশি কোন্ সুদূরে।
মাঝরাতে চাঁদ নদীর জলে
নেমে অনেক কথা বলে।
কেউ দেখেনি দেখলো খুকি
ছাদ থেকে কাল দিয়ে উঁকি।
নদীর পাড়েই ওদের বাড়ি
পরছে দু’পাড় জলের শাড়ি।
জলের শাড়ির নীল রঙা পাড়
এসব কিছু কল্পনা তার...
তুলতুলের তিনটে উড়োজাহাজ। একটার রং লাল। একটার রং গোলাপি। আরেকটা নীল রঙের। লাল উড়োজাহাজে চড়ে সে দাদুবাড়ি আর নানুবাড়ি যায়। নীলটায় চড়ে পাহাড়ে। গোলাপি রঙের উড়োজাহাজটা দুই দিন আগে বাবা কিনে দিয়েছেন। ওটায় চড়া হয়নি। স্কুল খুললে ওটাতে চড়ে স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে সমুদ্র দেখতে যাবে। এখন শুধু খেলা। সকালে খেলা। দুপুরে খেলা। বিকেলে খেলা। উড়োজাহাজ নিয়ে খেলতে খেলতে সুন্দর সকালটা কেটে যায়।
দুপুরে তুলতুল কার্টুন দেখে। ‘টম অ্যান্ড জেরি’ ওর প্রিয় কার্টুন। একাই দেখে আর হাহা হিহি করে হাসে। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। ‘টম অ্যান্ড জেরির' খেলা দেখে তুলতুলভাবে সেও বুঝি ওদের সঙ্গে খেলছে। এ রকম খেলতে খেলতে ওর ভারি মজার দুপুরটাও শেষ হয়ে যায়।
বিকেলেও তুলতুলের ফুরসত নেই। বিকেলে গল্প পড়ার সময়। এতগুলো গল্পের বই আছে ওর। ফুলের গল্প। পাখির গল্প। নদীর গল্প। আরও আছে রূপকথার, রহস্যের ও ভূতের। একেকটা গল্প পড়ে আর মনে হয় গল্পগুলোর সঙ্গে ও খেলছে। ফুলের গল্পে সৌরভের খেলা! পাখির গল্পে কলকাকলির খেলা! নদীর গল্পে ঢেউয়ের খেলা! খেলা ছেড়ে উঠতে মন চায় না তুলতুলের। খেলতে খেলতেই প্রিয় বিকেলটা ফুরিয়ে যায়।
তুলতুলের বাবারও খেলতে ইচ্ছে করে তুলতুলের সঙ্গে। কিন্তু দুজনের একসঙ্গে খেলা হয়-ই না। কেমন করে হবে! বাবা সারা দিন বাসায় থাকে না। তুলতুলও উড়োজাহাজ, কার্টুন, গল্প ওসব নিয়ে ব্যস্ত। ব্যবসার কাজ সেরে রাতে বাবা ফেরেন ঠিকই, সারা দিন এত খেলে খেলে ক্লান্ত হয়ে তুলতুল ততক্ষণে ঘুমিয়েই পড়ে।
একদিন উড়োজাহাজ নিয়ে খেলতে খেলতে তুলতুল বাবাকে বলল, ‘ইস! তুমি যদি উড়োজাহাজ হতে! এখন তোমাকে নিয়ে খেলা করতাম।’
কথাটা শুনে বাবা এক লাফ দিয়ে বললেন, ‘উড়োহাজাজ! ওটা কোনো ব্যাপারই না।’ বলেই বিছানায় দুই পা গেঁথে, দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে কী সুন্দর উড়োজাহাজ হয়ে গেল তুলতুলের বাবা। তুলতুলও মজা করে উড়োজাহাজ বাবার পিঠে বসে মিষ্টি হেসে বলল, ‘এটা হচ্ছে উড়োজাহাজের ককপিট। আমি পাইলট।’
তারপর দুজনে সাঁ করে উড়ে গেল। উড়তে উড়তে তুলতুলের দাদুবাড়িতে গিয়ে গুড়-মুড়ি আর নানুবাড়িতে জিলেপি-সন্দেশ খেয়ে আবার ফিরে আসে। এসেই উড়োজাহাজ বাবা ল্যান্ড করে বললেন, ‘দেখেছিস! কেমন উড়োজাহাজ হয়ে তোকে নিয়ে কত জায়গায় ঘুরে এলাম!’
দাদুবাড়ি, নানুবাড়ি বেড়ানো শেষে ফিরে আসতে আসতে সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেছে। কার্টুন দেখারও সময় হয়ে গেছে তুলতুলের। বাবাকে বলল, “ইস! তুমি যদি ‘টম অ্যান্ড জেরি’ কার্টুন হতে, এখন তোমাকেই দেখতাম।”
কথাটা শুনে বাবা নেচে উঠে বললেন, ‘টম অ্যান্ড জেরি!’ হে রে! সে তো আমারও খুব প্রিয়। বলে টুস করে টম হয়ে গেলেন। বাবা টমটা একবার ফুড়ুৎ করে এদিকে দৌড়ায়, আরেকবার ওদিকে। বাবার এমন কাণ্ড দেখে আনন্দ পায়। আনন্দে আনন্দে সেও জেরি হয়ে বাবার সঙ্গে খেলতে শুরু করে। খেলতে খেলতে খেলতে একেবারে পুরো বাড়ি দাপিয়ে বেড়ায়। একটুখানি জিরিয়ে নিয়ে বাবা বললেন, “বাপ-ছেলের ‘টম অ্যান্ড জেরি’ খেলাটা বেশ হয়েছে! তাই না, তুতু?”
এবার তোতলাতে শুরু করে তুলতুল। বাবা ও রকমই ডাকে তুলতুলের ‘ল’ দুটো বাদ দিয়ে তুতু। বাবার মুখে ওরকম ডাক শুনলে তুলতুলের মুখ দিয়ে সহজে কথা বেরোয় না। তোতলায়। এদিকে ওরা ‘টম অ্যান্ড জেরি’ খেলতে খেলতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। গল্পের বই পড়ার সময় হয়ে গেছে। তুলতুল তোতলাতে তোতলাতে বাবাকে বলল, ‘ইস! তুমি যদি গল্পের বই হতে, এখন তোমাকেই পড়তাম।’
কথাটা শুনে বাবা হো হো করে হেসে বললেন, ‘গল্প! সে কী রে! শুধু বইতে কেন? বাবার কাছেও মজার অনেক গল্প আছে। চাঁদ-সূর্যের গল্প, ঘাস-ফড়িংয়ের গল্প, বন-বৃক্ষের গল্প।’ এই কথা বলেই বাবা লম্বা একটা গল্প বলতে শুরু করলেন। গল্প শুনতে শুনতে বিকেল পেরিয়ে রাত, রাত পেরিয়ে ভোর, ভোর পেরিয়ে সকাল হলো আর তুলতুলের ঘুমও ভাঙল। ঘুম ভেঙে স্বপ্নে সারা রাত কত কী দেখেছে ভেবে একটু হাসিও পেল। হাসতে হাসতে দেখে বাবা ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। অমনি বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। প্রিয় তুলতুলের শরীরের গন্ধ পেয়ে বাবা হকচকিয়ে বললেন, ‘হে রে! সকাল হয়ে গেছে রে! তোর উড়োজাহাজগুলো নিয়ে আসি! এখন খেলবি?’
বাবার কপালে আলতো চুমু খেয়ে তুলতুল বলল, ‘তুমিই আমার উড়োজাহাজ, তোমার সঙ্গেই খেলব, প্রিয় বাবা।’
প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ সবাই। ঘরে থেকেও যেন স্বস্তি মিলছে না একটুও। এই গরমে ঘরের ভেতর একটুখখানি স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিতে কিছু টিপস জেনে নিন-
জানলা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিন
সকালের রোদ আরামদায়ক ও মিষ্টি হলেও দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদ যেন তেতে উঠে। তাই ঘড়ির কাঁটা এগারোটা পেরোলেই জানলা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিন। এতে ঘরে তাপ ঢুকবে কম। পাখা চলিয়ে রাখলেও আরাম পাবেন। আবার বিকেলের দিকে জানলা খুলে দিন।
সুতি বা লিনেনের পর্দা লাগান
সুতির বা লিনেনের মতো প্রাকৃতিক ফ্যাব্রিকের পর্দা এবং বেড শিট ব্যবহার করুন। তা যেন হালকা রঙের হয়। হালকা রঙের চাদর আর পর্দা তাপ প্রতিফলিত করবে, ফলে ঘর ঠান্ডা থাকবে।
অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার কমাতে হবে
কেবল প্রয়োজনের খাতিরেই না বরং সৌন্দর্যের খাতিরেও অনেকেই নানারকম আলোর ব্যবহার করে থাকেন। ঘরের তাপমাত্রা সহনীয় রাখতে অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার কমাতে হবে। যতটুকু না হলেই না ঠিক ততটুকু আলোই ব্যবহার করুন।
ঘরে গাছ রাখুন
ঘরের মধ্যে গাছ রাখলে তা দেখতেও সুন্দর লাগে, তাপও শুষে নেয়। মানিপ্লান্ট, অ্যালোভেরা, স্নেক প্লান্ট, অ্যারিকা পাম ঘরে রাখলে দেখতে যেমন সুন্দর লাগে তেমনি ঘরের পরিবেশও হয়ে উঠবে আরামদায়ক।
রান্না করার সময় এগজস্ট ফ্যান চালু রাখুন
রান্না করার সময় ঘরের মধ্যেটা গরম হয়ে যায়। তাই অবশ্যই এগজস্ট ফ্যান চালিয়ে রাখুন।
মহাবিশ্বের জন্ম হলো কীভাবে? একসময় এ প্রশ্নের উত্তর ছিল না। গ্রিক দার্শনিকদের অনেকেই মনে করতেন পৃথিবী আদি এবং অনন্ত। এর শুরু বা শেষ নেই। আর তাই মহাবিশ্বের শুরু এবং শেষ নিয়েও কোনো ব্যাখ্যা তাদের কাছে ছিল না। এমনকি বিংশ শতাব্দীতে এসেও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা বিজ্ঞানীদের ছিল না।
১৯২০-এর দশকে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। ১৯১৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, একটি মাত্র সমীকরণের সাহায্যে। সেই সমীকরণে আইনস্টাইন দেখান মহাকর্ষ আসলে কোনো আকর্ষণ বল নয়। কোনো ভারী বস্তু স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়। সেই বাঁকানো স্থান-কালের ভেতর যখন আরেকটা বস্তু এসে পড়ে, তখন মনে হয় প্রথম বস্তুটা দ্বিতীয়টাকে আকর্ষণ করছে। অর্থাৎ নতুন করে লেখা হয় মহাকর্ষের ইতিহাস।
এক লাইনের একটি সমীকরণ ছিল ওটা। তবে এর ছিল বহু সমাধান। একেক জন একেকভাবে সমাধান করেন। ১৯১৬ সালে জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্জশিল্ড একটা সমাধান বের করেন। সেই সমাধান থেকেই মানুষ, বিজ্ঞানীরা পান ব্ল্যাকহোলের কথা। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন একটা পরীক্ষার মাধ্যমে জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটির প্রমাণ পান। এরপর ছুটতে থাকে এই তত্ত্বের জয়রথ। ১৯২০ এর দশকে মার্কিন বিজ্ঞানী এডউইন হাবল দেখালেন, মহাবিশ্বে আরও গ্যালাক্সি আছে। এর আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, গোটা মহাবিশ্বে একটায় মাত্র গ্যালাক্সি, সেটা হলো আমাদের মিল্কিওয়ে। হাবলের এই আবিষ্কার নাটকীয়ভাবে বদলে দিল মহাবিশ্বের ইতিহাস ওই দশকেই রুশবিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান প্রমাণ করলেন মহাবিশ্বের প্রতিটা বস্তু (আসলে গ্যালাক্সি) পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যে গ্যালাক্সি আমাদের থেকে যত দূরে, তার দূরে সরে যাওয়ার গতি তত বেশি। অর্থাৎ মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে সব সময়।
অবশ্য আইনস্টাইন নিজেই ওই প্রসারণ তত্ত্ব মানতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্ট বা মহাজাগতিক ধ্রুবক যোগ করলেন তার সমীকরণে, যাতে কাগজে-কলমে মহাবিশ্বের প্রসারণ বন্ধ করা যায়। সেটা করলেন বটে, কিন্তু বাস্তবে যেটা প্রসারিত হচ্ছে, অঙ্কে গোঁজামিল দিয়ে সেটা বন্ধ করা যায় না। পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণ বলছে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, আইনস্টাইন সেটা বন্ধ করতে চাইলেও তো বন্ধ হবে না।
মহাবিশ্ব সত্যি সত্যিই প্রসারিত হচ্ছে, কিন্তু কেন? বিজ্ঞানীদের মাথায় এল তখন নতুন ভাবনা। যেহেতু মহাবিশ্বের প্রতিটা গ্যালাক্সি একটা থেকে আরেকটা দূরে সরে যাচ্ছে, তার মানে এরা একসময় একসঙ্গে ছিল। সেখান থেকে কোনো এক বিস্ফোরণে এরা চারপাশে ছুটে যায়। অনেকটা বোমা ফাটার মতো ব্যাপার। বিস্ফোরণের পর বোমার ভেতরের পদার্থ যেগুলোকে আমরা স্প্লিন্টার বলি, সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে। তাহলে মহাবিশ্বেও কি এমন কোনো ঘটনা ছিল? মহাবিশ্ব কি আগে একটাই বিন্দু ছিল, সেই বিন্দুতেই ঘটে বিস্ফোরণ। আর সেই বিস্ফোরণের পরেই জন্ম হয় বস্তুকণার, সময়ের বিবর্তনে সেসব বস্তু গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ইত্যাদিতে পরিণত হয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছে?
তেমনটাই বলেন রুশ-মার্কিন বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো আর রাফল আলফার। তারা সেই বিস্ফোরণের নাম দেন বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ। বিগ ব্যাং তত্ত্বের পক্ষে বড় প্রমাণ আদিম মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ বা সিএমএমবিআর। ১৯৬৫ যক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবরেটরির দুই বিজ্ঞানী আর্নো পেনজিয়াস আর রবার্ট উইলসন পান সেই আদিম বিকিরণ সিএমবিআরের সন্ধান।
সুতরাং মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব আজ প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব। এই তত্ত্ব মতে, একটা সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু থেকে বিস্ফোরণ হয়। সেই বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে যেমন মহাবিস্ফোরণের জন্ম, তেমনি জন্ম স্থান ও কালের।
মহাবিস্ফোরণ মেনে নিতে কারও অসুবিধা নেই, এটা এখন প্রতিষ্ঠিত। সমস্যা হলো সেই বিস্ফোরণের আগে তা হলে কী ছিল? এ প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীই এটাকে অবান্তর প্রশ্ন বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন। তাদের মতে, মহাবিস্ফোরণের আগে সময় বলে কিছু ছিল না। আর সময়ের অস্তিত্বেই যেখানে নেই সেখানে কোনো ঘটনাই ঘটতে পারে না। তাই বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল, সে প্রশ্ন তোলাই ঠিক নয়।
কিন্তু বিজ্ঞানে যেকোনো যৌক্তিক প্রশ্ন তোলার অধিকার সবার আছে। বর্তমান হলো অতীতের বিভিন্ন ঘটনার ফলাফল। একটা ঘটনার ফলাফল জন্ম দেয় আরেক ঘটনার। মহাবিশ্বের ইতিহাসের পেছন দিকে হাঁটলেই ঘটনার পরম্পরা দেখতে পাওয়া যায়। অতীতের একটা ঘটনা বর্তমানের কোনো ঘটনার কারণ। তেমনি অতীতের কোনো না কোনো ঘটনার ফলাফল হলো বর্তমানের কোনো ঘটনা।
তাই বলা নেই কওয়া নেই, সময়ের বালাই নেই, হঠাৎ করে কোনো একটা ঘটনা ঘটে গেল? সবচেয়ে বড় কথা আমরা যেটাকে শূন্যস্থান বলি, বা মহাশূন্য বলি, এগুলোর অবস্থান আমাদের এই মহাবিশ্বের মধ্যেই। তাই বিগ ব্যাংয়ের আগে যখন কিছুই ছিল না। তখন কী শূন্য-মহাশূন্য বলে কিছুই ছিল না? স্পেস বা স্থানই যদি না থাকে, তা হলে মহাবিস্ফোরণ ঘটল কোথায়?
শুধু মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বই নয়। এখন এর পাশাপাশি আরও দুটি তত্ত্ব দাঁড়িয়ে গেছে। ইনফ্লেশন বা স্ফীতি তত্ত্ব। তবে এটি মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের সঙ্গে হাত ধরাধরি করেই চলছে। আরেকটি হলো বিগ বাউন্স। দুটি তত্ত্বই মহাবিশ্বের সৃষ্টি আর বিকাশের কথা যেমন বলছে, বলছে মহাবিস্ফোরণের আগের কথাও।
ইনফ্লেশন তত্ত্ব আসলে মহাবিশ্বের মহাস্ফীতির কথা বলে। মহাবিশ্বের জন্মের ১০৩০ সেকেন্ডের মধ্যে মহাবিশ্ব ১০৩৬ গুণ স্ফীত হয়ে ওঠে। আসলে এটাই এ তত্ত্বের শেষ কথা নয়। স্ফীতি তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসে মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্বের ধারণা। স্ফীতি তত্ত্বের জনক আল্যান গুথ গত শতাব্দীর আশির দশকে স্ফীতি তত্ত্বের প্রস্তাব করেন। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্ফীতি তত্ত্ব আজ জৌতিঃপদার্থবিদ্যার প্রতিষ্ঠিত এক তত্ত্ব।
সমাধান যাই হোক, বিগব্যাংয়ের আগে কী ছিল সেটা এক মস্ত প্যারাডক্স। কেউ কেউ বলেন, এর আগে আরেকটা মহাবিশ্ব ছিল, সেটা সংকুচিত হয়ে সিঙ্গুলারিটিতে পৌঁছায়। তা হলেও প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাই, সেই মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হলো। সেটা যদি আরেকটা বিগব্যাংয়ের মাধ্যমে জন্ম নেয়, তার আগে কী ছিল। এ প্রশ্নের জবাব নেই। মিথ বা পৌরাণিক মতে, অনেক জবাব পাবেন। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে এই প্যারাডক্সের কোনো সমাধান নেই।
কেনাফ পাটের মতো পরিবেশবান্ধব আঁশজাতীয় ফসল। উষ্ণমণ্ডলীয় ও অবউষ্ণ অঞ্চলের দেশগুলোতে আঁশ উৎপাদনের জন্য এ ফসল ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। উঁচু-নিচু, পাহাড়ি, চরাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে বপন উপযোগী কেনাফ ফসলে পাটের চেয়ে নিড়ানি ও পরিচর্যা কম লাগে এবং রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি। কেনাফ কাগজের মণ্ড, ব্লেন্ডেড কাপড়, টেক্সটাইল, বিল্ডিং উপকরণ, বায়োকম্পোজিট, তৈল শোষক ও অন্যান্য শিল্পজাত দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রায় পাট ও আঁশজাতীয় ফসলের অবদান প্রায় আট বিলিয়ন। দেশের জিডিপিতে এ খাতের অবদান প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ আর কৃষিতে তা ২৬ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাট ও আঁশজাতীয় ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। বিশ্বে পাট ও আঁশজাতীয় ফসল উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের প্রায় ১৩৫টি দেশে ২৮২টি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকা, পাহাড়ি এলাকার ঢালু জমি এবং উপকূলীয় ও চরাঞ্চল ফসল উৎপাদনের উপযোগী নয় বা আউশ ফসলের জন্য লাভজনক নয়- এমন অনুর্বর জমিতেও অল্প পরিচর্যায় কেনাফ চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এ ছাড়া দেশে যেসব এলাকায় সেচের ব্যবস্থা নেই, সেখানে ধানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি খরা ও জলাবদ্ধতা সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন কেনাফ চাষ কৃষকের প্রথম পছন্দ। বর্তমানে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গাজীপুর, চাঁদপুর ও গোপালগঞ্জ কেনাফ উৎপাদনকারী প্রধান প্রধান জেলা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে কেনাফ ও মেস্তা চাষের মাধ্যমে আঁশ উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৬৮ হাজার বেল। যদিও আমাদের দেশের অনেক এলাকায়ই কেনাফ আঞ্চলিক ভাষায় মেস্তা হিসেবে পরিচিত। চলতি ২০২৩-২৪ পাট উৎপাদন মৌসুমে ৭ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসল চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে জাতীয় বীজ বোর্ডের ১০৯তম সভায় বেসরকারি পর্যায়ে ভারত থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রত্যায়িতমানের ৫৭৬ টন কেনাফ বীজ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিজেআরআইর সহায়তায় কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলায় কেনাফ বীজ উৎপাদন সমিতি গড়ে তোলা হয়েছে। এতে মোট বীজ উৎপাদনকারী কৃষকের সংখ্যা প্রায় ৬১২ জন। দেশে উৎপাদিত ও আমদানীকৃত কেনাফ বীজ সঠিক সময়ে আবাদ করা সম্ভব হলে এ বছর কর্তিত জমির পরিমাণ ৮০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে।
মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের মতো কেনাফের গুরুত্বও অপরিসীম। কেনাফ ফসলের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত ‘প্লাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে মাটির উপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলী ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১০০ দিন সময়ের মধ্যে প্রতি হেক্টর কেনাফ ফসল বাতাস থেকে প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ এবং ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। পৃথিবীর বহু দেশে কাগজের মণ্ড ও উন্নতমানের কাগজ ছাড়াও বহু মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী কেনাফ থেকে উৎপাদিত হয়। কেনাফ আঁশ পৃথিবীর বহু দেশে শিল্পজাত দ্রব্য হিসেবে বোর্ড, জিও টেক্সটাইল চট, কম্বল, প্লেন পার্টস, মোটর কার পার্টস, কম্পিউটার পার্টস, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য- শিকা, মাদুর, জায়নামাজ, টুপি, স্যান্ডেল এবং কাপড়চোপড়-জাতীয় সোফার কভার, পর্দার কাপড়, বেডশিট, কুশন কভার, শাটিংশুটিং, পাঞ্জাবি, সোয়েটার ছাড়াও বিভিন্ন কাজে ইনটেরিয়র ইনসুলেটর হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। কেনাফের খড়ি অধিক পানি শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় তা বেডিং মেটারিয়ালসহ জ্বালানি ও উন্নতমানের চারকোল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কেনাফের বীজ থেকে ঔষধি গুণসম্পন্ন তেল পাওয়া যায়।
বাস্তব প্রয়োজনে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে উর্বর জমি ব্যবহৃত হচ্ছে খাদ্যশস্য উৎপাদনে এবং পাট স্থানান্তরিত হচ্ছে প্রান্তিক ও অপ্রচলিত (লবণাক্ত, পাহাড়ি ও চরাঞ্চল) জমিতে। তা ছাড়া নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও বাড়তি জনসংখ্যার বসতবাড়ি নির্মাণে প্রতি বছর প্রায় ০.৭% হারে হ্রাস পাচ্ছে আবাদি জমি। অন্যদিকে, দেশের দক্ষিণের খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল লবণাক্ততা ও খরাপ্রবণ এলাকায় হাজার হাজার একর জমিতে পাট উৎপাদন মৌসুমে (মার্চ-জুলাই) কোনো ফসল থাকে না বললেই চলে। খুলনার কিছু কিছু এলাকায় তিল চাষ হলেও বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা বা খরার ঝুঁকি রয়েছে। উপকূলীয় লবণাক্ততা, খরা ও একফসলি আমন পরবর্তী পতিত জমিতে অথবা চর এলাকায় কেনাফ চাষের সম্ভাবনা ও উৎপাদিত বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গবেষণা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিন বিভাগের গবেষক দল। বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-২ ও এইচসি-৯৫ কেনাফ জাত নিয়ে গবেষণা শেষে রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেখানে লবণাক্ততার জন্য পাট চাষ সম্ভব নয়, সেখানে অনায়াসেই কেনাফ চাষ সম্ভব এবং বীজের অঙ্কুরোদগম ও গাছ বৃদ্ধির সময় কেনাফ ৮ থেকে ১৪ ডিএস/মি. পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। গবেষণাগারে সফলভাবে কেনাফ খড়ি এবং আঁশ থেকে কাগজের মণ্ড ও কাগজ এবং কেনাফ বীজ থেকে ৭ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত তেল পাওয়া যায় বলে দাবি করেছে গবেষক দল। অনুরূপভাবে বিজেআরআইর বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষণের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে কেনাফ চাষের সফলতা পেয়েছেন। লবণাক্ততা, খরা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত এই তিনটি পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই কেনাফ বেড়ে উঠতে পারে।
দেশের কৃষি পরিবেশ ও কৃষকদের চাহিদা বিবেচনায় গত ২ মার্চ ২০২৩ দ্রুত বর্ধনশীল, জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু, কাণ্ড ও গোড়াপচা রোগ প্রতিরোধী বিজেআরআই কেনাফ ৫ (ফাল্গুনী কেনাফ) জাতটি সারা দেশে চাষাবাদের নিমিত্তে ছাড়করণের অনুমোদন দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। জাতটি পাটের মতোই আঁশ উৎপাদনকারী এবং মালভেসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি উন্নত জাত। জাতটি ছাতরা পোকা ও স্পাইরাল বোরার প্রতিরোধ করতে পারে- যা এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত জাতগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অধিক ফলনশীল ও বায়োমাস-সম্পন্ন এ জাতটি কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হলে অনাবাদি ও অনুর্বর জমিও চাষাবাদের আওতায় আসবে এবং পাটচাষিরা অধিক লাভবান হবেন। ভারতীয় জাতের কেনাফ ফসলের পাতায় হলদে ছিটা রোগ তুলনামূলকভাবে বেশি সংক্রমিত হওয়া এবং গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কম হওয়ায় বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-৯৫, বিজেআরআই কেনাফ-৩ (বট কেনাফ) ও বিজেআরআই কেনাফ-৪ (লাল কেনাফ) সারা দেশে উন্নত জাত হিসেবে কৃষকের কাছে অধিক সমাদৃত।
শতকরা আশি ভাগ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতাসম্পন্ন কেনাফ বীজ ১১ থেকে ১২ কেজি হেক্টরপ্রতি বপন করে ৪ মাসে ৩ থেকে ৩.৫ টন কেনাফ আঁশ পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের বাজারে পাট ও কেনাফ আঁশের দাম একই হওয়ায় কৃষকদের নিকট কম পরিচর্যায় অধিক ফলন প্রাপ্তিতে কেনাফের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে উন্নতমানের দেশীয় জাতের কেনাফ বীজ। যদিও স্থানীয় বাজারে ভারতীয় কেনাফ বীজ তুলনামূলক কম টাকায় পাওয়া যায়, তারপরও ভালো ফলনের জন্য অধিক মূল্য দিয়ে দেশীয় জাতের বীজ সংগ্রহ করছে কৃষকরা। দেশীয় জাতের কেনাফে আঁশের ফলন ও মান দুটোই ভালো এবং বীজের দামও তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে লাভজনক বীজ ফসল হিসেবে কেনাফকে শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে বীজের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে।
উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকাসহ দেশে ফসল চাষের অনুপযোগী প্রায় ১০ লাখ হেক্টর জমি প্রতি বছর অনেকটাই পতিত পড়ে থাকছে। অথচ এসব জমিতে অল্প পরিচর্যা ও কম খরচে অধিক ফলনশীল কেনাফ চাষ করে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট
নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরীর 'ইছামতি থেকে ইস্ট রিভার' বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি কামাল চৌধুরী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান, দীপ্ত টিভির প্রধান নির্বাহী ফুয়াদ চৌধুরী, স্কলার্স বাংলাদেশ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি এম ই চৌধুরী শামীম ও স্কলার্স বাংলাদেশ সোসাইটির প্রধান নির্বাহী দিলারা আফরোজ খান রুপা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাবেক সিনিয়র সচিব মোকাম্মেল হক।
অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক কবি কামাল চৌধুরী বলেন, বইটির লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরীর দেশের প্রতি যে মমত্ববোধ ও সংবেদনশীলতা এই বইয়ে সেটি ভালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। লেখক তার বর্তমান সময়টা যেভাবে দেখেন সেটা তুলে ধরেছেন। এই বই পড়ে পাঠকরা বর্তমান সমাজ সম্পর্কে ধারণা পাবেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতি সাবেক সিনিয়র সচিব মোকাম্মেল হক বলেন, যারা বিদেশে থাকেন, বিদেশে জীবনযাপনের বৈচিত্রতা ফুটে উঠেছে এ বইয়ে। ছোট ছোট গল্পের মতো মনে হলেও জীবনের মান অভিমান আনন্দ বেদনা দু:খ, হাসি উঠে এসছে বইটিতে।
লেখক মাহমুদ রেজা চৌধুরী তার বক্তব্যে বলেন, বইয়ের গল্পগুলো একেবারে খুব কাছ থেকে দেখা। নিউইয়র্কে যেসব বাঙালি থাকেন তাদের দেখে সুখী সুখী মনে হলেও আসলে তারা দু:খী। খুব কাছ থেকে দেখা গল্পগুলো বইয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
স্কলার্স বাংলাদেশ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি এম ই চৌধুরী শামীম বলেন, এনআরবি স্কলার্স পাবলিশার্স যাত্রা শুরু করেছে প্রবাসী বাঙালি লেখকদের বই প্রকাশের লক্ষ্য নিয়ে। ইতিমধ্যে আমরা ১৮০টি বই প্রকাশ করেছি। যার মধ্যে ৮০ শতাংশ বই প্রবাসী বাঙালি লেখকদের। এর মধ্যে অনেক বই পাঠকপ্রিয় হয়েছে।
দীপ্ত টিভির প্রধান নির্বাহী ফুয়াদ চৌধুরী বলেন, লেখক এ বইয়ে অভিবাসী বাঙালিদের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন যেগুলো খুবই বাস্তবিক। আমি দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার কারণে বইয়ের গল্পগুলো মনে হয়েছে খুব কাছ থেকে দেখা।
দীর্ঘ তিন যুগ ধরে লিখছেন মাহমুদ রেজা চৌধুরী। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৯টি। তার লেখার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম ও মানুষের মনস্তাত্ত্বিক আচার আচরণের বিশ্লেষণ।
ঋতুস্রাব চলাকালীন শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম করা উচিত কী অনুচিত- এ নিয়ে মতদ্বিমত থাকতেই পারে। কেউ কেউ বলে থাকেন এ চক্র চলাকালীন হালকা ব্যায়াম রক্তের প্রবাহ বাড়িয়ে তলপেটের ব্যথা কমায়। কেউবা আবার বলেন, ব্যায়াম থেকে বিরত থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ এ সময়ে। এ সব কিছু নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে খেয়াল রাখুন কেবল একটা বিষয়। সেটি হচ্ছে, যদি শরীর সায় না দেয় সে ক্ষেত্রে ব্যায়াম না করাই উত্তম। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ঋতুস্রাব চলাকালীন ব্যায়াম করা যাবে না- এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।
নিয়মিত ব্যায়াম পিরিয়ডের আগে এবং পিরিয়ডের সময় ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। ব্যথা ছাড়াও পিরিয়ডের সময় হরমোনজনিত কারণে-অকারণে মন খারাপ থাকে বা ডিপ্রেশন তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে অ্যারোবিক্স বেশ সাহায্য করে। অ্যারোবিক্সের কিছু উদাহরণ হচ্ছে- অল্প হাঁটাহাঁটি, সাইক্লিং, দৌড়ানো ইত্যাদি। অল্প কার্ডিয়ো এবং যোগব্যায়াম ক্ষতি করবে না শরীরের। কিছু শারীরিক কসরত করতে পারেন ঋতুস্রাব বা পিরিয়ড চলাকালীন সময়েও। জেনে নিন সেসব-
হাঁটা
কেউ যদি এ সময়টাতে নিতান্তই ব্যায়াম করতে না চান তারা হাঁটতে পারেন। নিয়মিত হাঁটা শরীরের পক্ষে সব সময়ই ভালো। তাই ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়েও অল্প হাঁটাহাঁটি ও সাইক্লিং করা যেতে পারে। তবে দৌড়ানো একদমই উচিত নয়।
যোগব্যায়াম
উপকারী ও স্বাস্থ্যসম্মত ব্যায়াম মাত্রই যোগব্যায়ামকে নির্দেশ করা হয়। যারা পিরিয়ডকালীন এক স্থানে বসে শরীরচর্চা করতে চান, তাদের জন্য এটি সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। তাই অন্যসব ব্যায়াম এড়িয়ে গেলেও যোগব্যায়ামকে করতে পারেন আলিঙ্গন।
অল্প ওজন উত্তোলন
পিরিয়ডের সময় অল্প ওজনের ডাম্বল দিয়ে ব্যায়াম করতে পারেন, যা এক হাতের সাহায্যে সহজেই তোলা সম্ভব। যেকোনো স্থানে দাঁড়িয়ে একটি ডাম্বলের সাহায্যে ধীরে ধীরে হাত, কোমর ও পিঠের ব্যায়াম করতে পারেন। এ ধরনের ব্যায়ামে কোনো ঝুঁকি নেই।
সাঁতার
ঋতুস্রাব চলাকালীনও খুব স্বাভাবিক নিয়মে সাঁতার কাটা সম্ভব। এ সময় সাঁতার কাটা সবচেয়ে বেশি উপকারী শরীরচর্চা। এতে শরীর ভালো থাকবে ও পিরিয়ডকালীন নানা সমস্যা কমবে। তবে খেয়াল রাখুন সঠিক স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করছেন কি না। সবচেয়ে ভালো হয় সাঁতারের সময়টায় টেম্পন বা মেন্সট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করা গেলে।
প্রতি মাসের নির্দিষ্ট সময়ে ঋতুচক্র শুরু হলে তলপেটে ব্যথা, মাথা চিনচিন ব্যথা, শরীরে হালকা ব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব অনুভূত হওয়াসহ মেজাজ খিটখিটে থাকার লক্ষণও দেখা যায়। এ সময়টায় কিছু অভ্যাস আয়ত্ত করতে পারলে ভালো। আর কিছু কাজ যা ঋতুস্রাব চলাকালীন একেবারেই করা উচিত নয় তা জেনে নিন-
পানি কম পান করা
অনেকেই এ সময়টায় পানি পান করার কথা ভুলে যান। কিংবা প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি পান করেন। অথচ পিরিয়ডের সময়ই বেশি করে পানি পান করা উচিত। প্রচুর পরিমাণে পানি পান শরীরকে দুর্বল হবার হাত থেকে বাঁচায়। এ ছাড়া রক্তের তারল্যের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও এ সময় প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল খাবার খাওয়া উচিত।
ভারী জিনিস তোলা
খুব বেশি ভারী জিনিস টেনে তোলা নারীদের জন্য কখনোই ভালো নয়। এতে ডিম্বাশয়, জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর পিরিয়ডের সময় তো একেবারেই নয়। কেননা এ সময়টাতে জরায়ু বেশ নাজুক অবস্থায় থাকে।
উপুড় হয়ে শোয়া
অনেকেরই পেটে ভীষণ ব্যথা থাকে বলে পেটে চাপ দিয়ে শুয়ে থাকেন। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলে তা পেটে এমনভাবে চাপ ফেলে যে সেটা মোটেও ভালো নয়। এ ছাড়া এই সময় উপুড় হয়ে শুইলে হার্ট রেটে তারতম্য হয়, রক্ত সঞ্চালন ব্যাহত হয় এবং অক্সিজেন ঠিকমতো সরবরাহ হয় না বলে মাথা ঝিমঝিম বা ব্যথা করে।
ভারী ব্যায়াম
পিরিয়ডের সময় ভারী কোনো ব্যায়াম করা একেবারেই উচিত নয়। পিরিয়ডের সময় করার জন্য বিশেষ কিছু ব্যায়াম রয়েছে, সেগুলো করতে পারেন। যোগব্যায়ামের কিছু আসন পিরিয়ডের ব্যথা কমাতে খুবই কাজে দেয়।
প্রাকৃতিক কাজ আটকে রাখা
এই বদঅভ্যাসটা অনেকেরই আছে। প্রস্রাব পেলে তা আটকে রাখা কখনোই উচিত নয়। এটি কিডনির ওপরে ভয়াবহ রকমের চাপ ফেলে। বারবার প্যাড পাল্টানোর ভয়ে অনেকেই পিরিয়ডের সময় প্রস্রাব চেপে রাখেন। এটি খুবই অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস। এই সময়ে এ কাজ তলপেটের ওপর চাপ ফেলে এবং ব্যথা দীর্ঘসময় থাকে।
জোরে চিৎকার করা
পিরিয়ডের সময় রাগ, বিরক্তি, জেদ তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। রেগে গিয়ে জোরে চিৎকার চেঁচামেচি করা উচিত নয়। এর ফল হবে ভয়ানক। এটি সরাসরি তলপেটে চাপ ফেলে। কাউকে ডাকতে গিয়েও জোরে চিৎকার করা ঠিক নয়। চিৎকার করতে শরীরের যেসব পেশির ওপর জোর দিতে হয় তার মধ্যে পেটের পেশিও আছে।
নারী মাত্রই ঘরে-বাইরে সবকিছু সমানভাবে সামলাতে পারে। যারা চাকুরে বা ব্যবসায়ী, তাদের জন্য সেসব সামলে সংসারের বাড়তি চাপ তো থাকেই। সেই সঙ্গে যদি বাসায় ছোট শিশু থাকে, তাহলে কাজের ধকল অনেক বেড়ে যায়। আর যারা গৃহিণী, তাদের পরিশ্রমও কি কম?
সংসার সামলানো, সবার খেয়াল রাখা, বাজার করা, বয়স্কদের দেখাশোনা ও শুশ্রূষা, মেহমানদারি, বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেয়া কম ঝক্কি নয়। সব সামলে দশভুজা নারী হয়ে পড়েন ক্লান্ত। কিন্তু ক্লান্ত থাকলেও কাজ তো কমেনা মোটেও। যার ফলে নারীর শরীর দ্রুতই ভেঙে পড়ে, নানান অসুস্থতা শরীরে বাসা বাঁধে, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ পড়ে, সুশ্রী চেহারা নষ্ট হয়ে যায় খুব দ্রুত।
বর্তমান শহুরে জীবনে যৌথ পরিবারের সংখ্যা একেবারেই কম। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়ে উঠেছে। আর তাতে করেই স্বামী-স্ত্রী দুজনের ওপরেই সংসারের কাজের চাপ থাকে। কর্মজীবী হোন বা গৃহিণী- নারীকে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়। তার বিশ্রাম বা নিজের জন্য সামান্য সময়ও থাকে না বললেই চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষ সদস্য বোঝেন না। পরিবারের জন্য এমন পরিশ্রমের ব্যাপারে কিন্তু না বোঝার সংখ্যাই বেশি।
স্বামী-স্ত্রী মিলেমিশে সংসারের কাজ ভাগাভাগি করে নিলে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও বজায় থাকে। সন্তানকে পড়তে বসানোর কাজটাও অনেক ধৈর্য ও সময়ের ব্যাপার। কাজ থেকে ফিরে পুরুষরা কাজটি করলে কিছুটা অবসর মেলে স্ত্রীর।
সন্তান খুব ছোট হলে রাতে বারবার খাওয়ানো, পাশাপাশি সন্তান থাকলে বা যমজ সন্তান থাকলে তাদের দেখভাল, সময় দেয়া, স্কুলে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি একা হাতে করতে গিয়ে নারীর মেজাজ খিটখিটে হওয়াই স্বাভাবিক। এমন হলে নারীকেই সংসারের ফাঁকে খুঁজে নিতে হবে নিজের জন্য সময়। শিশুদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বা স্কুলে পাঠিয়ে ঘুরে আসা যেতে পারে পছন্দের কোনো জায়গায়, পার্কে, শপিংমলে, নয়তো দেখা করা যেতে পারে প্রিয় কোনো বন্ধুর সঙ্গে। অল্প সময়ের জন্যও যদি বন্ধু বা পছন্দের আত্মীয়ের সঙ্গে আড্ডা জমানো যায়, কথা বলা যায় মন খুলে, তবে মন থাকবে চনমনে।
স্বামীর আর স্ত্রীর ছুটির দিন মিলিয়ে কোনো ট্যুর, লং ড্রাইভ বা রেস্টুরেন্টে পুরো পরিবার মিলে খেতে গেলেও ভালো লাগবে। একটু সময় বের করে পার্লারে গিয়ে স্পা করিয়ে নিলেও নিজেকে লাগবে ঝরঝরে। নিয়মিত খালি হাতে ব্যায়ামের অভ্যাস করতে পারলে শরীর থাকবে ফিট।
নিজেকে নিজে উপহার দিন প্রিয় কোনো বই, গাছ বা পোশাক। মন ভালো রাখতে বাগান করতে পারেন। পড়তে পারেন পছন্দের কোনো বই, শুনতে পারেন প্রিয় কোনো গান। মেডিটেশন করলেও মন ভালো থাকবে। আর সেই সঙ্গে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় নিজেই নিজেকে বলুন, ‘আমি ভালো আছি, আমি ভালো থাকব।’