মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

শীতে ঘুরে আসুন মৌলভীবাজার

আপডেটেড
৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৪:৩৭
সালাহউদ্দিন শুভ
প্রকাশিত
সালাহউদ্দিন শুভ
প্রকাশিত : ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৪:৩৬

সবুজ চা-বাগানের গালিচা। ঘন কুয়াশায় ঘেরা পথ। বিশাল হাওরের বুকে জেগে উঠছে সূর্য। পাহাড় আর টিলার ভাঁজে ভাঁজে কুয়াশার হাতছানি। এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলার এখনকার চিত্র। চলছে শীতকাল। কুয়াশার চাদরে ঢাকা এই অমিত সম্ভাবনার ভূমি অপেক্ষা করছে অতিথি-পর্যটকদের জন্য। শুধু বাগানই নয়। আরও জনপ্রিয় কিছু স্থান এই শীত মৌসুমেই ঘুরে দেখার সময়।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ। চিরহরিৎ এই অরণ্যের নাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান। ১৯২৫ সালের দিকে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১২৫০ হেক্টর জমিতে বনায়ন করে। ১৯৯৬ সালে বনটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। দেশের ৭টি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে লাউয়াছড়া অন্যতম। আয়তনে ছোট হলেও এ বনে দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে এ বনে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা যায়। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য এ বন বিখ্যাত। এ ছাড়া এখানে রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, বানর, শিয়াল, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, এশীয় অঞ্চলের কালো ভালুক, মায়া হরিণসহ নানা প্রজাতির জীবজন্তু। রয়েছে সবুজ ঘুঘু, বন মোরগ, ইগল, হরিয়াল, কালো মাথা টিয়াসহ নানা বর্ণের নানা রঙের পাখির বসবাস। এ বনে অজগরসহ রয়েছে নানা প্রজাতির সরীসৃপ। রয়েছে হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপও। লাউয়াছড়া বনাঞ্চলে রয়েছে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। এর মধ্যে গর্জন, সেগুন, গামার, জামরুল, চাপালিশ, নাগেশ্বর, শিমুল অন্যতম। উদ্যানের পাশ ঘেঁষেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন খাসিয়া সম্প্রদায়ের মাগুরছড়া পানপুঞ্জি।

মাধবপুর লেক

সুনীল আকাশ, গাঢ় সবুজ পাহাড়, শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো মনোরম চা-বাগানের দৃশ্যে আপনি হারিয়ে যাবেন আপনমনে। চারদিকে সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝখানে অবস্থিত লেকটি সত্যি অপূর্ব। লেকের ঝলমল পানি, ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ, শাপলা-শালুকের উপস্থিতি আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে পরিবেশ। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে অবস্থিত ‘মাধবপুর লেক’ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি স্থান। ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) মাধবপুর চা-বাগানের ১১ নম্বর সেকশনে অবস্থিত এই লেক। চা-বাগানের শ্রমিকরা এটিকে ‘ড্যাম’ বলে অভিহিত করেন। সময়ের পরিক্রমায় এটি বৃহৎ ও আকর্ষণীয় ড্যামে পরিণত হয়েছে।

বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ

ধলই সীমান্তে ঘটনাস্থল এলাকায় চিরসবুজ চা-বাগানের মাঝে স্থাপন করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ। বর্তমান সরকার এ স্মৃতিসৌধ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে তথ্য ও চিত্র সমন্বয়ে এখানে গড়েছে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান জাদুঘর। হামিদুর রহমান ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার খোরদা খালিশপুর গ্রামে ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আক্কাস আলী মণ্ডল এবং মায়ের নাম কায়মুন্নেসা। সেনাবাহিনীর সিপাহী পদে ১৯৭০ সালে যোগ দেন হামিদুর রহমান। পরের বছরের অক্টোবরে হামিদুর রহমান ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট সি-কোম্পানির হয়ে ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল অভিযানে অংশ নেন। তার এ বীরত্বে অবশেষে ওই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয় এবং ধলই সীমান্ত ফাঁড়িসহ এ এলাকা দখল করে নেন মুক্তিযোদ্ধারা। তবে তার আগেই শহীদ হয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর। তাৎক্ষণিক তাকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কমলপুরের আমবাসা গ্রামে সীমান্তের কাছেই দাফন করা হয়। পরে ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর সেখান থেকে মরদেহ এনে ঢাকার মীরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

হামহাম জলপ্রপ্রাত

ঝরনার যৌবন হলো বর্ষাকাল। ঝরনার ঝরে পড়া পানি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঝিরি পথ তৈরি করে বয়ে চলেছে। এ রকম বিভিন্ন ছোট-বড় ঝিরি পথ পেরিয়ে জঙ্গলের পথ পেরিয়ে ঝরনার কাছে পৌঁছাতে হয়। ঝরনায় যেতে হলে কুড়মা বন বিটের চাম্পারায় চা-বাগান হয়ে যেতে হয়। চম্পারায় চা-বাগান থেকে ঝরনার দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। পথে অত্যন্ত খাড়া মোকাম টিলা পাড়ি দিতে হয় এবং অনেক ঝিরি পথ কাদা মাটি দিয়ে পথ চলতে হয়। ঝিরি পথে কোথাও কোথাও চোরাবালিও তৈরি হয়, কিন্তু সেসব স্থানে পর্যটকদের জন্য কোনো নির্দেশিকা দেখা যায় না, সুতরাং আপনার নিজেকেই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এছাড়া গভীর জঙ্গলে বানর, সাপ, মশা এবং জোঁকের অত্যাচার সহ্য করে পথ চলতে হয়। বর্ষাকালে হামহামে যাওয়ার কিছু আগে পথে দেখা পাওয়া যায় আরেকটি অনুচ্চ ছোট ঝরনার। হামহামের রয়েছে দুটো ধাপ, সর্বোচ্চ ধাপটি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে মাঝখানের ধাপে এবং সেখান থেকে আবার পানি পড়ছে নিচের খাদে। পাহাড় অরণ্যঘেরা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এই জলপ্রপাতটি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের জন্য এটি হলো অন্যতম স্থান।

ক্যামেলিয়া লেক

চা-বাগানের শ্রমিকদের কাছে যে লেকের নাম ‘বিসলার বান’। তবে এর প্রকৃত নাম হলো ক্যামেলিয়া লেক। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের শমশেরনগরে ব্রিটিশ কোম্পানি ডানকান ব্রাদার্সের মালিকানাধীন শমশেরনগর চা-বাগানে দৃষ্টিনন্দন এ লেকের অবস্থান। এ বাগানের আয়তন প্রায় ৪৩২৬ দশমিক ৪৭ একর।

পাথারিয়া পাহাড়

মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় পাথারিয়া পাহাড় অঞ্চল অবস্থিত। এই পাহাড়েই রয়েছে মনোমুগ্ধকর মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। প্রায় ২০০ ফুট ওপর থেকে আছড়ে পড়া জলের স্রোত। এ ছাড়া এই পাহাড়ের বুকজুড়ে রয়েছে আরও অসংখ্য ছোট ছোট ঝরনা। যেগুলোর মধ্যে সন্ধ্যানী, মায়াবন, মায়াকানন অন্যতম। যেই দুর্গম ঝরনাগুলোতে বর্ষার মৌসুমে যাওয়াটা বেশ দুষ্কর। এখন এই শীতই হচ্ছে ঘুরে দেখার উত্তম সময়। বড় বড় পাথর, ক্ষীণ জলস্রোত আর প্রশান্তিদায়ক সবুজে ঘেরা মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতে প্রায় সারা বছরই থাকে পর্যটকদের আনাগোনা। মৌলভীবাজার থেকে বড়লেখাগামী গাড়ি করে বড়লেখা পৌঁছার আগে কাঁঠালতলী নামক বাজারে নামতে হবে। সেখান থেকে ৮ কিলোমিটার পূর্বে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ও পাথারিয়া বনভূমি অবস্থান।

বাইক্কা বিল

দূর দেশগুলোতে যখন শীতের কারণে বরফ বাতাসে উঠছে, তখন পাখিগুলো কোথায় আশ্রয় নেয়? পাখিগুলো ডানা জাপটে উড়ে আসে বাইক্কা বিলে। একাধারে পাখি, মাছ ও গাছগাছালির অভয়ারণ্য বাইক্কা বিল মূলত হাইল হাওরের অন্তর্ভুক্ত একটি অংশ। অগভীর এই হ্রদটিতে বিভিন্ন গাছপালার দেখা মেলে। সেই সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় জলাভূমিও। বিলের ঘেরাটোপে প্রবেশ করতেই পাখিদের মন মাতানো কলকাকলিতে মন ভরে উঠবে। যেহেতু বাইক্কা বিলে মাছ ধরা নিষেধ, বিলে থাকা মাছের ঝাঁক প্রতিবছরই পাখিদের আকর্ষণ করে। শীতকালে এখানে পরিযায়ী পাখিরা ভিড় করে। তাই প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য অন্যতম পছন্দের জায়গা এই বিল। পাখি দেখতে আসেন অনেকে, বিজ্ঞানীদেরও দেখা যায় দূরবীন নিয়ে বসে পড়তে। বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় এখানে নৌভ্রমণের অনুমতি দেয়া থাকে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল পৌর শহর থেকে মৌলভীবাজার আসার মাঝ পথে বরুনা নামক এলাকায় এলে পশ্চিম দিকে বাইক্কা বিল যাওয়ার সড়ক।

টিলাগাঁও ইকো ভিলেজ

রিসোর্ট

কনকনে শীত অবহাওয়া। বাঁশের সঙ্গে ছনের ঘর। চারপাশে সবুজ গাছ আর পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ। মৌলভীবাজার অসংখ্য ইকো রিসোর্টগুলোকে সাজানো হয়েছে এভাবেই। প্রাকৃতিক বিভিন্ন স্থানগুলোর পাশাপাশি পর্যটকদের মন কেড়ে নেয় বিভিন্ন পাঁচ তারকা ও ইকো রিসোর্টগুলো। সুলভ মূল্য থেকে শুরু করে বিলাসবহুল সব রিসোর্ট গড়ে উঠেছে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ। যার মধ্যে রয়েছে গ্রান্ড সুলতান টি-রিসোর্ট, লেমন গার্ডেন, বালিশিরা রিসোর্ট, নভেম ইকো রিসোর্টে, ওয়াটারলিলি, টি হ্যাভেন ও টিলাগাঁও ইকো ভিলেজ, অরণ্যনিবাস ইকো রিসোর্ট অন্যতম। এ ছাড়া মৌলভীবাজার জেলা শহরের পাশেই রয়েছে দুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা, মুক্তানগর রিসোর্ট ও রাঙাউটি রিসোর্ট।

লেখক : প্রতিনিধি,মৌলভীবাজার


চিনামাটির পাহাড়

শাহ বিলিয়া জুলফিকার
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
শাহ বিলিয়া জুলফিকার

যান্ত্রিক পৃথিবীর কোলাহলে আবদ্ধ আমাদের জনজীবন। তাই সকলেই চায় প্রকৃতিতে হারিয়ে যেতে। প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য অন্যতম আদর্শ স্থান হলো বিজয়পুর চিনামাটির পাহাড়। এটি পাহাড়, নদী ও ঐতিহ্যবাহী স্থানে ভরপুর প্রকৃতির রাজ্য, অপরূপ লীলাভূমি সুসং দুর্গাপুরে অবস্থিত। সেখানে গেলে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্যে মুগ্ধ হবেন যেকেউ। চারিদিকে সবুজ গাছগাছালি আর তারই মাঝে দেখতে পাবেন সাদা মাটির পাহাড়। একটি দুটি নয়, মোট ১৬৩টি সাদামাটির টিলা আছে সেখানে।

চিনামাটিকে সাদা মাটি বলে আখ্যায়িত করলেও চিনামাটি পুরোপুরি সাদা নয়। বরং কোথাও দেখতে পাবেন লালচে, ধূসর, হালকা নীলাভ, গোলাপি, ঈষৎ বেগুনি, হলুদ কিংবা টিয়া রংয়েরও। বিচিত্র রংয়ের মাটির সংমিশ্রণে পাহাড়গুলোর নিচে রয়েছে আবার স্বচ্ছ নীল পানির হ্রদ। আর বিস্তৃত মাঠ জুড়ে সবুজের সমারোহ। পাহাড় কেটে মাটি উত্তোলন করার ফলে থৈরি বড় বড় গর্ত। সেসব গর্তে বা ঢালুতে বৃষ্টির পানি জমে তৈরি হয়েছে এ স্বচ্ছ নীল পানির হ্রদ।

চিনামাটির পাহাড়ের কাছেই রয়েছে কমলার বাগান, বিজিবি ক্যাম্প ও নয়নাভিরাম আরো দর্শনীয় স্থান। বর্তমানে চিনামাটি উত্তোলন বন্ধ থাকায় এটি পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম একটি টুরিস্ট স্পটে।

বিজয়পুর চিনামাটির পাহাড়ের রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অতুলনীয় গুরুত্ব। এটি টারশিয়ারি যুগের পাহাড়ের অন্তর্ভুক্ত। এখানকার মাটি মিহি, কোমাল- ট্যালকম পাউডারের মতো, যা সিরামিক শিল্পের প্রধান কাঁচামাল। ১৯৫৭ সাল থেকে এই চিনামাটি উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। প্রথম কোহিনূর অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে চিনামাটি উত্তোলন শুরু করে ১৯৬০ সালে।

বিজয়পুরে ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে ১৩টি কূপ খনন করা হয়। ১৯৭৩ সালে বিসিআইসি সে কাজে অংশগ্রহণ করে। ধীরে ধীরে মোট ৯টি প্রতিষ্ঠান চিনামাটি উত্তোলনের কাজ জড়িত হয়। বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের অন্যতম খনিজ অঞ্চল বিজয়পুর। পুরো এলাকা ঘিরে ছোট-বড় টিলা বা পাহাড় ও সমতল ভূমি মিলিয়ে দৈর্ঘ্যে ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও প্রস্থে ৬০০ মিটার খনিজ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এ পর্যন্ত ৫ লাখ মেট্রিকটন মাটি উত্তোলন করা হয়েছে। মজুদ আছে ১৩.৭৭ লাখ মেট্রিক টন। উল্লেখ্য যে, এই প্রাকৃতিক সম্পদটিকে জিআই স্বীকৃতি দিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছিল নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের কার্যালয়। ২০২১ সালে এসে স্বীকৃতি পায়।


সে যে ডাকাতিয়া নদী

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
জিহাদ হোসেন রাহাত

অসাধারণ অনুভূতি আর নৌকা ভ্রমণ শব্দ দুটি ডাকাতিয়ার বুকে মিলেমিশে একাকার। ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে নৌকা ভ্রমণ কতোটুকু মানসিক প্রশান্তিদায়ক তা হয়তো একজন ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবেন না। পুরনো দিনের অমলীন জীবন ধাঁচের সুন্দর ঐতিহ্য আর অপরূপ সৌন্দর্যের আঁধার লক্ষ্মীপুরের রায়পুর দিয়ে বয়ে চলা ডাকাতিয়া নদী। ঋতু পরিবর্তন হতেই নীল আকাশের নিচে অপরূপ সৌন্দর্য ধারণ করেছে এই ডাকাতিয়া নদী। তবে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দিয়েছে নৌকা ভ্রমণে বাগড়া। অবশ্য বর্ষার পানি আসায় যেন, হারানো যৌবন ফিরে পেয়েছে নদীটি। গ্রামীণ জনপদে প্রকৃতি যেন বিলিয়ে দিয়েছে এক অফুরন্ত সম্ভাবনা এবং মনভোলানো অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য। সৌন্দর্যের ষোলোকলায় পরিপূর্ণ এই নদীটি ভ্রমণ পিপাসুদের মনে জোগায় আনন্দের খোরাক। আজকের বিশেষ ফিচারে শোনাতে যাচ্ছি ভ্রমণ প্রিয় পাঠকদের তেমনই এক ভ্রমণ গল্প।

বৃষ্টিঝরা বিকেল গড়ানোর কিছুক্ষণ আগে হলো ডাকাতিয়ার বুক চিরে বন্ধুত্বের জয়গান গাওয়ার হুটহাট পরিকল্পনা। রায়পুরে নতুন বাজার এলাকা থেকে বন্ধু কামরুল হাসান সোহান ও মাহি হাসান হলো লেখকের ভ্রমণ সঙ্গী। অটোয় চড়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য দেবিপুরের সোলাখালি ব্রিজ। মুলত উপজেলার এ অংশেই দেখা মেলে ডাকাতিয়ার মনমুগ্ধকর রুপ। ডাকাতিয়ার পাড়ে ঘর বানিয়ে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বসবাস করা আবদুল আজিজ নামে এক ভদ্রলোকের কাছে নৌকা ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে বিনয়ের সাথে জানতে চাইলে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন নৌকা তিনি ভাড়ায় দেবেন না। চাইলে পারবো বিনা ভাড়ায় চালাতে। এমন দৃশ্যপট ডাকাতিয়ার সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি মুগ্ধ করলো আমাদের। একটি সুন্দর মন যে এমন করে মুগ্ধ করতে পারে- সেটির প্রমানও পেলাম ডাকাতিয়ার পাড়ে।

নৌকা পাওয়া মাত্রই একে একে তিনজন দুমাথা আর মাঝের জায়গাটা দখল করে বসলাম। নৌকা চালানোর ক্ষেত্রে বিজ্ঞতার পরিচয় দিলো বন্ধু কামরুল সোহান। শিখিয়ে দিলো কেমন করে বৈঠা বাইতে হবে। সোলাখালি ব্রিজের নিচ দিয়ে পালাক্রমে নৌকার বৈঠা হাতে দিলাম দীর্ঘ পথ পাড়ি। গানের সুরে কোমলপ্রাণ যেমন একদিকে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উঠেছিলো ঠিক একই মুহূর্তে সেসব ক্যামেরাবন্দী করে যাচ্ছিল বন্ধু মাহি হাসান। ডাকাতিয়ার পাড় ঘেঁষে বিস্তীর্ণ জনপদ, মাঠ ভরা ফসল, আর নদী তীরের কোনো এক উন্নত জাতের শোভাবর্ধক ঘাঁষ ছিলো আমাদের মূল আকর্ষণ।

ডাকাতিয়া মূলত বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্তের একটি নদী। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২০৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থ প্রায় ৬৭ মিটার (২২০ ফুট)। এটি আসলে মেঘনার একটি উপনদী। ভারতের ত্রিপুরার পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লার বাগসারা হয়ে বাংলাদেশে করেছে প্রবেশ এবং পরবর্তীতে প্রবাহিত হয়েছে লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর জেলার ওপর দিয়ে। নদীটি মূলত কুমিল্লার লাকসাম, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ, চাঁদপুরের শাহরাস্তি ও হাজীগঞ্জ উপজেলা অতিক্রম করে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে ঘটিয়েছে সঙ্গম। ডাকাতিয়ার ধরণ প্রকৃতি অনেকটা সর্পিলাকার। একসময় এ নদী দিয়ে মগ-ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় করতো প্রবেশ এবং নদীতে করত ডাকাতি। ফলস্বরূপ ডাকাতের উৎপাতের কারণে নদীটির নাম ডাকাতিয়া হয়েছে বলে ধারণা করেন অনেকে।

আবার কারো মতে, ডাকাতিয়া নদীর করাল গ্রাসের কারণে এর দুই পাড়ের মানুষ হারাতো সর্বস্ব। জীবন বাঁচাতে ডাকাতিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য মানুষের সলিলসমাধি হয়েছে- এমন তথ্য জানতে পারি ইতিহাস মারফত। এমন পরিস্থিতিতে ডাকাতের মতো সর্বগ্রাসী হওয়ায় এর নামকরণ করা হয়েছে ডাকাতিয়া নদী।

ডাকাতিয়ার এখন পানিতে টুইটুম্বর। দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। দুঃখের বিষয় হলো দখল-দূষণে নাব্যতা হারিয়েছে ডাকাতিয়ার রায়পুরের একটি অংশ। তবে ডাকাতিয়ার অন্য অংশগুলো বর্ষাকালে সৌন্দর্যের লীলাভূমি হয়ে ওঠায় এ সময়ে নদীর সৌন্দর্য দেখতে গ্রামে ছুটে আসেন যান্ত্রিক শহরে থাকা বহু মানুষ। মনের আনন্দে তারা যান ডাকাতিয়ার বুকে ছুটে। অনেকে দলবেঁধে নৌকাযোগে ছুটে যান দূর-দূরান্তে। নদীর বুকে অনেকে আয়োজন করেন বনভোজনের। রাতের বেলায় শীতল বাতাস ডাকাতিয়ার গর্জন পথচারীদের মনে জোগায় আনন্দের খোঁড়াক।

ডাকাতিয়ার এই অংশে নৌকা ভ্রমণের জন্য যেতে হলে প্রথমেই পাড়ি দিতে হবে চাঁদপুর হয়ে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর পর্যন্ত। সেখান থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা যোগে মাত্র টাকা বিশেকের ভাড়ায় পৌছানো যাবে ডাকাতিয়ার সোলাখালি ব্রিজ অংশে।

দেখতে দেখতে সময় গড়ালো অনেক। বিকেল তিনটায় শুরু হওয়া নৌকা ভ্রমণ গিয়ে ঠেকল সাড়ে চারটার আশপাশে। আকাশ তখনো মেঘাচ্ছন্ন। কুয়াশার মতো হচ্ছে বৃষ্টি। মামা মশাই খ্যাত সূর্যও নিয়েছেন অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি। সন্ধ্যা নামার তখনো অনেক বাকি। আমরাও আর বাড়ালাম না ডাকাতিয়া প্রতি মায়া। ততক্ষণে সারি সারি কচুরিপানারাও বিদায় জানালো আমাদের।


সুদূর তুরস্ক থেকে লালন শিকড়ে

বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়ার আগে লালন দর্শনের খোঁজে ছুটে যান কুষ্টিয়ার প্রাগপুরে
আপডেটেড ১৩ মে, ২০২৩ ১৯:৪২

তিন বছর সময়ে বাংলাদেশের নানা বিষয় সম্পর্কে জেনেছেন তুরস্কের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান। বাংলার মাটি-বাতাসকে আরও জানতে ও চিনতে, লালন আদর্শের খোঁজে ছুটে যান কুষ্টিয়ার প্রাগপুরে। বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়ার আগে লালন দর্শনের খোঁজে ছুটে যান কুষ্টিয়ার প্রাগপুরে। লালন দর্শনে বিশ্বাসী তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ফরাসি নাগরিক দেবরাহ্ জান্নাতের আমন্ত্রণে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার প্রাগপুর সীমান্তে হেম আশ্রম দর্শন করেন। লালন দর্শন সম্পর্কে জানতে প্রবীণ সাধু দরবেশ নহির ফকিরের সঙ্গে কথা বলেন। হেলিকপ্টারযোগে হেম আশ্রমে পৌঁছালে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান গার্ড অব অনার দেয়া হয়। হেম আশ্রম আঙিনায় নিজ উপস্থিতির নিদর্শন রেখে আসতে একটি আমগাছের চারা রোপণ করেন তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান। রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ছিলেন সুফি চিত্রশিল্পী ও গবেষক আইরিন খান। আইরিন খান জানান, ‘লালন আদর্শ অনেক বিস্তৃত। আমাদের দেশের অনেক বিষয় নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের আগ্রহ আছে। লালনের আদর্শ নিয়ে সারা বিশ্বের অনেক মানুষের কৌতূহল আছে। সেই কৌতূহলীদের একজজন তুরস্কের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরান। তিনি লালনকে জানতে, লালন আদর্শ নিয়ে যারা চর্চা করেন সেসব সাধুর জীবনবোধ বুঝতে সরাসরি কুষ্টিয়া চলে আসেন। আমরা চেষ্টা করেছি তাকে ভাষার সীমাবদ্ধতার মধ্যেই সবকিছু দারুণভাবে চেনানোর সুযোগ করে দিতে।’

জীবনের নানা ঘটনাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেন লালন সাঁইজি। সেই বিষয়টি নিজের ভাবনায় বোঝার চেষ্টা করতেই প্রাগপুরে ছুটে যান রাষ্ট্রদূত মোস্তফা। সাধুদের জীবন নিয়ে জানার আগ্রহের যেন শেষ ছিল না তার। পুরো আশ্রম ঘুরে দেখেন তিনি। সাধুদের সঙ্গে কথা বলেন, কেমন আছেন বলে অনেককেই চমকে দেন সবাইকে। লালন আদর্শে উজ্জীবিত সাধুদের প্রত্যাহিক জীবনের নানা বিষয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। সাধুরা কীভাবে বিভিন্ন নিয়মের মধ্যে জীবনযাপন করেন তা বুঝে জীবন-প্রকৃতির সংযোগ অনুসন্ধান করেন এই কূটনীতিক।

লালনের খোঁজে রাষ্ট্রদূত মোস্তফা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রাগপুরে মাথাভাঙ্গা নদীর কাছে হেম আশ্রমে ছুটে যান। বাংলা-তুর্কি ভাষার দূরত্ব অনেক। তবে মানবজীবনের ভাবনা কিংবা নানা সমীকরণ জীবনবোধকে দুই মহাদেশের দূরত্বের মধ্যেও যেন এক করে ফেলে। সেই জীবনবোধকে জানতে সরল সব প্রশ্নের খোঁজ করেন রাষ্ট্রদূত মোস্তফা। লালন দর্শন সম্পর্কে প্রবীণ সাধু দরবেশ নহির ফকির বলেন, লালন দর্শন হলো- মানবতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সৃষ্টিকুলকে ভালোভাবে জানা ও বোঝা। রাষ্ট্রদূত মোস্তফার নানা প্রশ্নে দরবেশ নহির ফকির বলেন, ‘লালন দর্শনে শাস্ত্রীয় জ্ঞান, আত্মিক জ্ঞান ও ঐশরিক জ্ঞান লাভ করা যায়। শান্তি, ভালোবাসা আর জীবনবোধ নিয়ে রাষ্ট্রদূতের প্রশ্নের উত্তরে নহির ফকিরের সরল উত্তর, মানুষকে ভজন-সাধনের মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা যায়। সেই পথে ফিরে যেতে হবে আমাদের। প্রকৃতির সন্তান আমরা, সেখানেই আমাদের সব সংযোগ।’ লালন আদর্শের নানা অনুষঙ্গ জানতে সাধুদের পরিবেশনায় লালনের গান শোনেন মোস্তফা ওসমান তুরান। সাধুদের পরিবেশনায় গুনগুনিয়ে নিজের ভাষায় লালন দর্শনকে বোঝার চেষ্টা করেন তিনি। লালন আদর্শ ও ফকির দর্শন নিয়ে নানা বিষয় জানার চেষ্টা করেন তিনি। তুরস্কের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানা বিষয় সম্পর্কে সাধুদের জানানোর চেষ্টা করেন। কবি জালাল উদ্দিন রুমির ভীষণ ভক্ত মোস্তফা ওসমান তুরান। প্রাচ্যের অখ্যাত গ্রামে জন্ম নেয়া রুমি এখন সারা বিশ্বে ভীষণ আলোচিত। তার মতে, রুমির ব্যক্তিত্ব আর বক্তব্য শত শত বছর ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তে দারুণভাবে জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয়। রুমি জীবনের শেষ পঞ্চাশ বছর কাটিয়েছিলেন কোনিয়ায়। দুনিয়ার সব দরবেশের কাছে রুমির আবেদন এখনো দারুণভাবে খেয়াল করা যায়। রুমির মৃত্যুর হাজার বছর পরও আজও তার ভাবনা ছড়িয়ে আছে নানা প্রান্তে, নানা আঙ্গিকে। রুমি চিন্তার মাধ্যমে জীবনের নানা বিষয়কে আশ্চর্য সজীবতার মধ্যে তুলে ধরেন। প্রায় সব ধর্মের মানুষের কাছে রুমির আবেদন সব সময় দারুণভাবে খেয়াল করা যায়। বিশ্বব্যাপী ধর্ম-বর্ণের যে বিরোধ-হানাহানি তার বিপরীতে রুমি যেন একপ্রস্থ বৃষ্টি।

লালন আদর্শে উজ্জীবিত সাধুদের প্রত্যাহিক জীবনের নানা বিষয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন বিদায়ী রাষ্ট্রদূত

প্রাগপুরে রাষ্ট্রদূত মোস্তাফাকে একনজর দেখার জন্য সারা দিনই ছিল সাধারণ মানুষের ভিড়। আশ্রমের মূল প্রবেশ থেকে শুরু করে পুরো পথের সবখানে ছিল সাধারণ মানুষের অবস্থান। সুলতান সুলেমানের দেশের রাষ্ট্রদূত আসবেন প্রাগপুরে এটা দারুণ এক আনন্দের বিষয় ছিল তাদের জন্য। অনুবাদকের টিপ্পনি হিসেবে কিছু কথা না বললেই যেন নয়। লালন সাঁইয়ে গুরুত্বপূর্ণ নানা তত্ত্ব নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। লালন সাঁইয়ের আধ্যাত্মিক ফকির সাধনা নিয়ে নানা অনুসন্ধান ও গবেষণা করছেন বিখ্যাত গবেষক ও লালন সাধকরা। মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক লালন সাঁইয়ের ভাবনা আর বক্তব্যের গুরুতত্ত্ব এখনো গবেষণার বিষয়। তার গান আর ভাবনার এখন প্রকৃতি অনুবাদ নিয়ে চলছে নানা কাজ। ভাবুন তো, ‘গুরু যারে সদয় হয় এ সংসারে/ লোভে সঙ্গ দিয়ে সেই যাবে সেরে/ আঘাটায় আজ মরণ আমারে/জানলাম না রে গুরুর করণ কি ধারা।’ বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ কতটা কঠিন হবে। সেই প্রেক্ষিতে একজন সাধারণ গবেষক হিসেবে রাষ্ট্রদূত মোস্তফাকে ইংরেজি-বাংলায় লালন সাঁইকে চেনাতে রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। নানা কিছু শেখার সুযোগ মিলেছে এই অভিজ্ঞতা থেকে।

মধ্যদুপুরে রাষ্ট্রদূত মোস্তফা যখন ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেন, তাকে প্রশ্ন করি, ‘এরপরে কোথায়?’ রাষ্ট্রদূতের সরল উত্তর যেন লালন বহু আগে বলে গেছেন, ‘চল দেখি মন, কোন দেশে যাবি।’ নিজ দেশে নিজভূমে ফিরবেন তিনি। জীবনের বাকিটা সময় এই মধুর স্মৃতি আর লালন আদর্শের নানা বিষয়কে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন। যাওয়ার সময় সাধুদের কাছ থেকে একটি একতারা উপহার গ্রহণ করেন রাষ্ট্রদূত মোস্তফা। সেই একতারা হাতে নিয়েই প্রাগপুরে লালন দর্শন শেষে ঢাকার পথে উড়াল দেন তিনি।

লেখক: জাহিদ হোসাইন খান, এমফিল গবেষক ও অনুবাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


খানিক বিরতির কার্শিয়াং

ডাউহিল স্কুল
আপডেটেড ১৩ মে, ২০২৩ ১৯:৪২
এ এস এম শাহীন

দার্জিলিং যেতে-আসতে প্রতিবারই কার্শিয়াং ছুঁয়ে গেলেও দুপুরের খাবারের জন্য হিল কার্ট রোডের কার্শিয়াং ট্যুরিস্ট লজ ছাড়া থামিনি কোথাও। ফলে গল্প আর উপন্যাসের পাতায় পড়া কার্শিয়াং বাস্তবে আর দেখা হয়নি। এবারের দার্জিলিং ট্রিপের শেষ দুই দিন তাই কার্শিয়াং থাকার প্ল্যান করলাম, উদ্দেশ্য দুটো- ঘুরে বেড়ানো আর অল্প সময়ে স্বল্প দূরত্বের নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে কলকাতার ট্রেন ধরা। দার্জিলিং থেকে কার্শিয়াং ৩০ কিলোমিটার দূরে ১ ঘণ্টার পথ আর কার্শিয়াং থেকে শিলিগুড়ি/নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের দূরত্ব বেশি হলেও দেড় ঘণ্টার বেশি লাগে না।

দার্জিলিং জেলার অন্তর্ভুক্ত কার্শিয়াং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত। একসময়ে সিকিম রাজ্যের অংশ কার্শিয়াং নেপালের দখলে থেকে আবার সিকিম রাজার হাত ঘুরে ব্রিটিশদের অধীনে আসে। সমতলের গরম থেকে রক্ষা পেতে ব্রিটিশরা দার্জিলিংয়ে বসবাস শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে মাঝপথের কার্শিয়াংয়ের গুরুত্বও বাড়তে থাকে। কার্শিয়াংয়ে প্রচুর হোমস্টে, আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট আছে। ঢাকা থেকেই ওয়েবসাইট আর ইউটিউব ঘেঁটে আমাদের পছন্দের শীর্ষে ছিল গিদ্দাপাহাড় চূড়ার আলিটিয়া রিসোর্ট। দার্জিলিং থেকে নেমে আসা হিল কার্ট রোড ছেড়ে ঠিক কার্শিয়াং রেলস্টেশনের উল্টো দিকের রাস্তায়, শহরের বসতি পেরিয়ে চার কিলোমিটার দূরে এই গিদ্দাপাহাড়। এখানেই ভাই শরৎচন্দ্র বসুর বাড়িতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৬ সালে সাত মাস গৃহবন্দি ছিলেন, দুই স্বাধীনতাকামীর স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি বর্তমানে নেতাজি মিউজিয়াম নামে পরিচিত।

রিসোর্টে ঢোকার আগেই গিদ্দাপাহাড় ভিউ পয়েন্টে বিরতি নিলাম- মন ভালো করা পাহাড় আর চা-বাগানের দৃশ্য। রিসোর্টের সীমানায় প্রবেশ করে দেখলাম নানা ধরনের ফুলে শোভিত বাগান আর বিশাল লনসহ ছিমছাম স্থাপনা। চেক ইন করে রুমের জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম নিচে কার্শিয়াং শহরের রাস্তায় চলমান গাড়ির সারি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ডিনারের আগে পর্যন্ত রিসোর্টের লন, বাগান আর ইনডোর গেমস এরিয়াতেই সময় কাটালাম। রাতের বেলা এখান থেকে কার্শিয়াং শহরের আলো-ঝলমলে ভিউ আরও চমৎকার।

কার্শিয়াংয়ের জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পটের মধ্যে আছে রেলস্টেশন ও সেখানে থাকা দার্জিলিং হিমালয়ান রেল মিউজিয়াম, ডাউহিল চার্চ, গার্লস স্কুল ও ভিক্টোরিয়া বয়েজ স্কুল, ডিয়ার পার্ক নামে পরিচিত ডাউহিল পার্ক ও ফরেস্ট মিউজিয়াম, ঈগল ক্রেগ ভিউ পয়েন্ট অন্যতম। এ ছাড়া একটু দূরে মাকাইবাড়ি টি এস্টেট, সালমান্দার লেক ও চিমনি নামে পরিচিত প্রাচীন একটি ব্রিটিশ বাংলো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।

চিমনি হেরিটেজ পার্কে টিকে আছে কেবল ২৪ ফুট উঁচু লাল রঙের এই চিমনি

সকালে উজ্জ্বল আলোতে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি শেষে নাশতা করে বেরিয়ে পড়লাম সাইট সিয়িংয়ের উদ্দেশে। প্রথম গন্তব্য ডাউহিল চার্চ-ভিক্টোরিয়া স্কুলের কাছে অবস্থিত অনেক পুরোনো ও পরিত্যক্ত এই চার্চ নানা ধরনের অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার সুবাদে ভারতবর্ষের অন্যতম হন্টেড হাউস হিসেবে পরিচিত। নির্জন পাহাড়ের বিশাল বিশাল গাছের মাঝে জীর্ণ এই চার্চের সঙ্গে জড়িত ঘটনাগুলো জানা থাকলে তা অবশ্যই দেখা উচিত। ২০১৯ সালে ১৪০ বছর পূর্ণ করা ডাউহিল গার্লস স্কুল ও ভিক্টোরিয়া বয়েজ স্কুলের ব্রিটিশধাঁচের নির্মাণশৈলীও চমৎকার। সময় থাকলে কাছাকাছি অবস্থিত ডিয়ার পার্ক ও ফরেস্ট মিউজিয়াম হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো যায়।

ডাউহিল থেকে পরের গন্তব্য চিমনি হেরিটেজ পার্ক- এটা আসলে দার্জিলিং শিলিগুড়ির সংযোগকারী পুরাতন মিলিটারি রোডসংলগ্ন একটি ব্রিটিশ বাংলোর শেষ চিহ্ন। ১৮৩৯ সালে পাহাড়চূড়ায় ৭ হাজার ২০০ ফুট উঁচুতে নির্মিত এই বাড়ির পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে, শুধু টিকে আছে প্রায় ২৪ ফুট উঁচু লাল রঙের এই চিমনি। অর্কিড ও ফুলের বাগানের পাশাপাশি এই চিমনি থেকে আশপাশের নিচু পাহাড়ের ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়। নির্জন এই হেরিটেজ পার্কে সাধারণত খুব বেশি পর্যটক আসেন না, যদিও আমাদের কাছে জায়গাটা অনেক ভালো লেগেছে। রাতযাপনের জন্য এখানে কয়েকটি হোমস্টে রয়েছে, চেষ্টা করব পরের ট্রিপে এখানে এক রাত থাকার।

চিমনিতে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে অন্য পথে হনুমান স্ট্যাচুর সামনে থেকে কার্শিয়াং শহরকে ব্যাকগ্রাউন্ডে একদফা ফটোসেশন করে মাঝপথে আরেকবার I LOVE KURSEONG পয়েন্টে ছবি তুলে ঠিক ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের এক নাম্বার প্ল্যাটফর্ম থেকে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে কলকাতার পথে যাত্রা করলাম।


হিমালয়ের দুর্গম গিরিতে নির্ভীক শাকিল

আপডেটেড ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৬:২৬
শাকিব হুসাইন

গল্পটা এক তরুণ পর্বতারোহীর। নাম ইকরামুল হাসান শাকিল। জন্ম গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ১৯৯৪ সালে। গাজীপুরের জনতা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে উত্তরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন। তিন ভাইয়ের মধ্যে ইকরাম সবার বড়। ২০১৯ সালে বাবা মো. খবির উদ্দিন মারা গেলে সংসারের ভার এসে পড়ে ইকরামের ওপর। সংসার ও পড়াশোনার খরচ চালাতে সুপারশপে বিক্রয়কর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন।

এই জীবন সংগ্রামের মধ্যেও সৃজনশীল কাজ চালিয়ে গেছেন তিনি। খেলাধুলায়ও ভালো ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা ছিল ইকরামের। ছোটবেলা থেকেই চাইতেন, তার নাম ও ছবি যেন পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়। গাজীপুরে ধূমপানের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করেছেন তিনি। সেখান থেকেই শুরু। তার পর ২০১০ সালে যোগ দেন পদাতিক নাট্যসংসদ বাংলাদেশে। এই নাট্যদলের হাত ধরেই তার প্রথম ভারতে যাওয়া। ‘নুরু মিয়ার কিচ্ছা’ নামে একটি নাটক লিখেছেন তিনি, তা এখন মঞ্চস্থ করছে পদাতিক।

২০১৩ সালে যোগ দেন ‘বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব’-এ। পর্বতারোহণের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন ভারত থেকে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো ২০ হাজার ২৯০ ফুট উচ্চতার কেয়াজো-রি পর্বতশৃঙ্গ জয় করতে যান এম এ মুহিতের নেতৃত্বে সাত পর্বতারোহী। তাদের একজন ইকরামুল হাসান। তবে শেষ পর্যন্ত মুহিত, ইকরাম ও কাজী বাহলুল শৃঙ্গটি জয় করেন। ২০১৭ সালে লারকে পিক জয়ের অভিযানেও ছিলেন তিনি। তবে বৈরী আবহাওয়ার কারণে খুব কাছাকাছি গিয়ে তা জয় করা হয়নি। পরের বছর ভারতের নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেইনিয়ারিং থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। প্রশিক্ষণের সময়ই তিনি জয় করেন ‘দ্রৌপদী-কা-ডান্ডা-২’ শৃঙ্গ।

২০১৯ সালে বাংলাদেশসহ পাঁচ দেশের আট পর্বতারোহী ‘হিমলুং’ জয়ের অভিযানে নামেন । সেই দলে অংশ নিয়ে তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমলুংয়ের চূড়ায় পা রাখেন।

ইকরামুলের স্বপ্ন আকাশসমান। সব সময় নিজের সেরাটাই ছুঁতে চায়। তাই তো নেমে পড়েছেন এক দুর্গম অভিযানে। এ সম্পর্কে তিনি জানান, নেপালে এর আগেও কয়েকবার পর্বত অভিযানে এসেছি। সে সময় সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। তবে এবার যে কারণে এসেছি সেটি আমার জন্য একটু বেশিই রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে। এমনকি এ কাজে সফল হতে পারলে লাল-সবুজের হয়ে প্রথমবারের মতো প্রতিনিধিত্ব করতে পারব।

হিমালয় পর্বতের পশ্চিমে নেপাল তিব্বতের সীমান্ত এলাকা হিলশা থেকে শুরু করে পূর্বের কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্প পর্যন্ত ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছি। মূলত দীর্ঘ এই পথকে ‘গ্রেট হিমালয় ট্রেইল’ বলা হয়ে থাকে। আর তাইতো একবুক স্বপ্ন নিয়ে লাল-সবুজের হয়ে প্রথমবার মতো এই অভিযান করছি।

১০ জুলাই ঢাকা থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। মূলত সেদিন থেকেই আমার ট্রেকিংয়ের পরিকল্পনা শুরু করতে হয়েছিল।

‘গ্রেট হিমালয়ান ট্রেইল’-এর আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিতে কাঠমান্ডুতে ১৫ দিন কেটে গেল। এর মাঝে সব ধরনের জটিলতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা মিটিয়ে ফেলতে হলো। ২৫ জুলাই কাঠমান্ডু শহর ছেড়ে বাসে চেপে পৌঁছালাম নেপালগঞ্জে।

হাতে বেশি সময় নেই। তাই নেপালগঞ্জ থেকে তারা এয়ারলাইনসের ছোট একটি যাত্রীবাহী বিমানে করে ৪৯ মিনিটের আকাশপথে যাত্রা শেষে পৌঁছালাম সিমিকোটে। সেখানে পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়নি। কেননা, এখানকার প্রকৃতির মেজাজ সম্পর্কে ক্ষুদ্র ধারণা ছিল। মূলত সেই অভিজ্ঞতাই আমাকে সাহস জুগিয়েছে।

জুলাইয়ের ২৮ তারিখ সকাল থেকে অভিযান শুরু করলাম। একটানা চার দিন ট্রেকিং করে পশ্চিম নেপালের তিব্বত বর্ডারে ৩ হাজার ৬৪২ মিটার উচ্চতার হিলশা গ্রামে পৌঁছাই।

আগস্টের প্রথম সকালেই হিলশা থেকে মূল অভিযান শুরু করে হোমলা জেলার ইয়ারি, তুমকোট, মোছু, তাপলুং, কেরমি, ধারাপুরি, সিমিকোট হয়ে মোগু জেলায় পৌঁছাতে হয়েছে।

এরপর খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে আবারও মোগু জেলার পিপলান, বাম, গামগাধি, রারা, মাঙরি। সেখান থেকে তিয়ার হয়ে আপার ডোলপা জেলায় প্রবেশ করি। এভাবে নেপালের উঁচু-নিচু দুর্গম বিপজ্জনক পথ ধরে টানা ৪১ দিনের ট্রেকিং শেষে বর্তমানে মুস্তাং জেলার অন্নপূর্ণা সার্কিট করে বাংলাদেশ নেপালের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ নেপাল ফ্রেন্ডশিপ অভিযানে ২টি ৬ হাজার মিটারের পর্বত অভিযানে অংশগ্রহণ করি এবং ডোলমা খাং (৬,৩৩২ মি.) পর্বত সফলভাবে আরোহণ করে ফের গ্রেট হিমালয়ান ট্রেইলের মানাসলু সার্কিট, রুবি ভ্যালি শেষ করে এখন ল্যাংটাং অঞ্চলে আছি।

তিনি আরও বলেন, নেপালের সব থেকে রিমোট (প্রত্যন্ত অঞ্চল), সীমাবদ্ধ, দুর্গম ও বিপজ্জনক এই দীর্ঘ উচ্চ হিমালয়ের পথ পাড়ি দিতে অতিক্রম করতে হয়েছে ১৮টি কঠিন পর্বতের পাস। যার মধ্যে ৯টি ৫ হাজার মিটারের ওপরে; ছারকোলা (৫১৪৯ মি.), ইয়ালা লা (৫৪১৪ মি.), নিঙমা গ্যানজেন (৫৫৬৪ মি.), নাঙলা (৫৩৮৮ মি.), মোলা লা (৫০২৭ মি.), নেওয়ার (৫৫৫৭ মি.), তুচে লা (৫১২১ মি.), থ্রঙলা পাস (৫,৪১৬ মি.), লারকে পাস (৫,১০৬ মি.) এবং ৯টি চার হাজার ও তিন হাজার মিটারের; নারা লা (৪৫৬০ মি.), অনামি (৪৪৫৮ মি.), ইয়াম বোর লা (৪৮১৩ মি.), শিমেন লা (৪৩৫৪ মি.), খোমা লা (৪৫৬৫ মি.), ভিমা লুজুঙ লা (৪৪৯৮ মি.), মানাগি পাস (৩,০৪৫ মি.), পাসাং পাস (৪,৮৫০ মি.), খুরপু পাস (৩,৭৬০ মি.) ছিল।

ট্রেইলে পাড়ি দিতে গিয়ে বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে পথ হারিয়ে প্রায় দুই দিন আটকে ছিলাম। এ সময় শরীরে শক্তি জোগাতে অনাহারে দিন-রাত কাটাতে হয়েছে। শুধু হালকা শুকনো জাতীয় খাবার পেটে গিয়েছে। এভাবেই দুর্গম পথে কয়েক দিন কাটাতে হয়েছে।

এমনকি কখনো কখনো পাথুরে পথ নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবুও স্বপ্ন জয়ের পথে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে সেখান থেকে আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছি।

‘গ্রেট হিমালয়ান ট্রেইল’-এর অসংখ্য বরফগলা খরস্রোতা ঠাণ্ডা পানির নদীতে নেমে পার হতে হয়েছে। হিমালয় পর্বতের কোল ঘেঁষে কত গ্রাম, নদী, জঙ্গল, পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য রোমাঞ্চকর বৈচিত্র্যময় সুন্দর ও ভয়ানক অভিজ্ঞতাও হয়েছে, যা কখনোই ভোলার নয়। ভয়ানক সুন্দর এই পৃথিবীর বুকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেও যেন দ্বিধা নেই।

হিলশা থেকে শুরু করে পূর্বের কাঞ্চনজঙ্ঘা বেসক্যাম্প পর্যন্ত টানা ১৭০০ কিলোমিটার পথ ১৫০ দিনে পাড়ি দিতেই আমি এখন হিমালয়ের গভীরে অবস্থান করছি। কিন্তু অর্থাভাবে সেই স্বপ্ন ধীরে ধীরে ফিকে হতে বসেছে। নিজেকে ভয়ংকর সুন্দরের সঙ্গে আলিঙ্গন ও দেশের জন্য গৌরবের কৃতিত্ব বয়ে আনতে প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা।

অভিযানটি সম্পন্ন করতে এখনো প্রায় ৬ লাখ টাকা প্রয়োজন। অভিযান শুরুর আগে দারাজ, বিএমটিসি পাশে দাঁড়ালেও এখনো সম্পূর্ণ অর্থ জোগান হয়নি। সম্পূর্ণ টাকা জোগাড় করতে না পারলে মাঝপথেই ফিরে আসতে হবে।

অত্যন্ত বিপৎসঙ্কুল এবং কষ্টসাধ্য পর্বতাভিযান এই গ্রেট হিমালয় ট্রেইল। সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত ৫০ জনেরও কম পর্বতারোহী এই অভিযান পুরোটা সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। এই অভিযানে সফল হতে পারলে ইতিহাসের পাতায় নাম উঠবে লাল-সবুজের পতাকার।


কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ

আপডেটেড ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ০৮:২৫
রাকিবুল হাসান রোকেল

কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের দানবাক্স খুললেই মেলে কোটি টাকা। প্রতি তিন মাস পর পর মসজিদের আটটি দানবাক্স খোলা হয়। বিপুল পরিমাণ টাকা ছাড়াও দানবাক্সে পাওয়া যায় বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার। দানবাক্সে কী পরিমাণ টাকা জমা পড়ল সে হিসাবের অপেক্ষায় থাকেন অনেকে। টাকা গণনা দেখতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসেন উৎসাহী মানুষ। ঠিক এ কারণেই পর্যটকদেরও পছন্দের জায়গায় পরিণত হয়েছে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি। শহরের হারুয়া এলাকায় নরসুন্দার তীরে প্রায় ১০ শতাংশ জমিতে পাগলা মসজিদ গড়ে ওঠে। বর্তমানে সেটি সম্প্রসারিত হয়ে ৩ একর ৮৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেন কবি ও লোকসংস্কৃতি গবেষক জাহাঙ্গীর আলম জাহান। তিনি জানান, এই মসজিদ সম্পর্কে বেশ কিছু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। যেমন- এক দিন দেখা গেল নদীর প্রবল স্রোতধারার মধ্যে মাদুরে আসন পেতে এক সাধক পুরুষ ভেসে আসছেন। তিনি প্রায় মাঝ নদীতে স্থির হয়ে যান। এভাবেই কয়েক দিন কেটে যায়। এরপর কয়েক দিনের মধ্যে সে স্থানটি শুকিয়ে চরে পরিণত হয়। কিন্তু সাধক তখনও ধ্যানে মগ্ন। স্থানীয় জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে এসে এই দৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়ে যান। তার পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। পাশের রাখুয়াইল এলাকার জনৈক গোয়ালার একটি গাভী দুধ দিচ্ছিল না। গোয়ালা শত চেষ্টা করেও গাভীর বাঁট (ওলান) থেকে বের করতে পারছিলেন না এক ফোঁটা দুধও। গাভীটিকে নজরে রাখা হলো পুরো একটা দিন। দেখা গেল পাল থেকে হঠাৎ গাভীটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পালাচ্ছে। তারপর নদী সাঁতরে সেই সাধকের চরায় উঠে আসে। সাধকের কাছে একটা পাত্র ছিল। গাভিটি সেই পাত্রে ওলানের সব দুধ ঢেলে দেয়। তারপর নদী সাঁতরে আবার ফিরে আসে পালে। কয়েকদিন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি লক্ষ করেন গোয়ালা। তিনি নিশ্চিত হন, এ সাধক সত্যিকারের একজন কামেল পুরুষ। গোয়ালা পরম ভক্তি নিয়ে এক দিন সেই সাধক পুরুষের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। কিছুদিনের মধ্যে গোয়ালার অবস্থা। অভাবনীয় উন্নতি হলো। তার এই উন্নতি অন্যদেরও মধ্যেও সাড়া ফেলে দেয়। রাখুয়াইলসহ আশপাশের এলাকার তাঁতি, জেলেসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ দলে দলে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে লাগল। সাধক পুরুষের অলৌকিকতার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে দিকিবিদিক। সেই শিষ্যরা সাধকের সেই চরাভূমিতে একটি হুজরাখানা তৈরি করে দেন। মৃত্যুর পর সাধককে হুজরাখানার পাশেই সমাহিত করা হয় এবং সেখানেই নির্মাণ করা হয় মসজিদ। সেটাই পরে পাগলা মসজিদ নামে পরিচিতি পায়। এই কাহিনি পুরোটাই জনশ্রুতিনির্ভর। এর পক্ষে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।

গুরুদয়াল কলেজের সাবেক অধ্যাপক ও সাহিত্যিক জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ১৯৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি তৎকালীন ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকায় এ মসজিদ নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখছিলেন। তাতে দাবি করেছিলেন, হয়বতনগরের প্রতিষ্ঠাতা দেওয়ান হৈবৎ খানের অধস্তন তৃতীয় পুরুষ জোলকরণ খানের বিবি সাহেবা মূলত এই পাগলা মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। বেগম সাহেবা ছিলেন নিঃসন্তান এবং প্রজারা তাকে ‘পাগলা বিবি’ বলে ডাকতেন। স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনি দেওয়ানবাড়ি থেকে একরশি দূরে নরসুন্দার তীরে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এই তথ্যও হয়বতনগর দেওয়ানবাড়ি থেকে পাওয়া। এর পেছনেও সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। পাগলা মসজিদের সঙ্গে এ রকম নানা জনশ্রুতি জড়িয়ে আছে।

তবে ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাচীন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই এলাকায় এক সময় বৌদ্ধ, যোগী ও নাথযোগী সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। বিশেষ করে বর্তমান কাতিয়ারচর ও সগড়াসহ আশপাশের এলাকায় একসময় নাথযোগী ও বিভিন্ন লোকধর্মে বিশ্বাসী মানুষ বসবাস করতন। তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের একটি কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। এ থেকে অনুমান করা যায়, নরসুন্দারে জেগে ওঠা চরাভূমিতে হয়তো নাথযোগী সম্প্রদায়ের কোনো সিদ্ধ পুরুষ তার সাধনপীঠ প্রতিষ্ঠা করে তাতে যুগ সাধনায় রত ছিলেন। তার শিষ্য ছিলেন স্থানীয় গোয়ালা, তাঁতি, জেলে, মাঝি ইত্যাদি সম্প্রদায়ের লোকজন। এ সময় সমগ্র বাংলাদেশেই উল্লিখিত সম্প্রদায় ও গোত্রের নর-নারী যে গোরক্ষনাথের বিশেষ অনুরাগী ও অনুসারী ছিলেন মনে করা হয়। নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই কোনটা সত্যি ইতিহাস।

পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন জেলা প্রশাসক। আর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পৌর মেয়র মো.পারভেজ মিয়া। তিনি জানান, পাগলা মসজিদের দানের টাকায় আন্তর্জাতিক মানের একটি ইসলামি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। কমপ্লেক্সটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে বানানো হবে। এ জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ থেকে ১২০ কোটি টাকা। সেখানে একসঙ্গে প্রায় ৩৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। ২০০ গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া পাঁচ হাজার নারীর জন্য নামাজের আলাদা ব্যবস্থা থাকবে।

দান করেন কারা :

কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের দানবাক্স খুললেই মিলে কোটি কোটি টাকা। দানের এই টাকার পরিমাণ প্রতিনিয়ত শুধু বেড়েই চলেছে। দিনে তো বটেই, রাতের আঁধারেও অনেকে গোপনে এসে দান করে থাকেন মসজিদের দানবাক্সগুলোতে। টাকা ছাড়াও মেলে বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার। এ ছাড়া প্রতিদিন মসজিদে দান করা হয় হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল। কারা দান করেন এসব টাকা এবং কোন খাতে ব্যয় হয় এসব অর্থ সে তথ্য জানার চেষ্টা করেছে দৈনিক বাংলা।

পাগলা মসজিদের নৈশপ্রহরী মো. মকবুল হোসেন। তিনি এই মসজিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন ২৭ বছর। তিনি বলেন, ‘শুধু মুসলিম নয়, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এখানে এসে দান করেন। টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার, বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়াও প্রচুর পরিমাণ হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলও দান করেন অনেকে। করোনার শুরুতে যখন জনসমাগম বন্ধ ছিল, তখনো অনেকে গভীর রাতে এসে দানবাক্সে দান করেছেন।’ তিনি জানান, অতীতে এই মসজিদে কেবল আশেপাশের এলাকার মানুষ দান করতেন। আর এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন এসে টাকা-পয়সা দান করেন। এ ছাড়া বিদেশিরা অনেক সময় আসেন, পুরো মসজিদ ঘুরে দেখে যাওয়ার সময় দানবাক্সে বৈদেশিক মুদ্রা দান করেন।

মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি খলিলুর রহমান জানান, প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এসে দান করছেন এই মসজিদে। যারা দান করতে আসেন তারা বলেন, এখানে দান করার পর তাদের আশা পূরণ হয়েছে। আর এ বিষয়টির কারণেই এখানে দান করেন তারা।

ব্যয় হয় যেসব খাতে :

পাগলা মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শওকত উদ্দিন ভূইয়া জানান, প্রতি মাসে পাগলা মসজিদের স্টাফ খরচ বাবদ ব্যয় হয় ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ২০২১ সালে দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত ১২৪ জন ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য এবং অসহায় ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচের জন্য ১৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও করোনাকালীন সময়ে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, পাগলা মসজিদের টাকায় ২০০২ সালে মসজিদের পাশেই একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্টা করা হয়েছে। বর্তমানে এই মাদ্রাসায় ১৩০ জন এতিম শিশু পড়াশোনা করছে। মসজিদের টাকায় তাদের যাবতীয় ভরণপোষণ ও জামাকাপড় দেওয়া হয়ে থাকে। ওয়াকফ স্টেটের অডিটর দ্বারা প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর মাসে পাগলা মসজিদের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হয়।

পাগলা মসজিদ ও ইসলামী কমপ্লেক্স পরিচালনা করার জন্য ৩১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি রয়েছে। এই কমিটিতে জেলা প্রশাসক সভাপতি এবং কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র সাধারণ সম্পাদক। এছাড়াও স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি, আইনজীবী, সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা এই কমিটিতে আছেন।

বিগত দুই বছরে যে পরিমাণ টাকা জমা পড়েছে দানবাক্সগুলোতে:
২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি দানবাক্সগুলো খুলে পাওয়া গেছে ২ কোটি ৩৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৪৫ টাকা, এরপর ১৯ জুন পাওয়া গেছে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৯৩ হাজার ৪৯৪ টাকা, একই বছরের ৬ নভেম্বর পাওয়া গেছে রেকর্ড পরিমাণ ৩ কোটি ৭ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৫ টাকা।
পরে ২০২২ সালের ১৩ মার্চ পাওয়া গিয়েছিল ৩ কোটি ৭৮ লাখ ৫৩ হাজার ২৯৫ টাকা, ৩ জুলাই পাওয়া গিয়েছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ ২৭ হাজার ৪১৫ টাকা, একই বছরের ২ অক্টোবর পাওয়া গিয়েছিল ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার ৮৮২ টাকা।

আশপাশের দর্শনীয় স্থান :

কিশোরগঞ্জ জেলার উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ স্থানের মধ্যে রয়েছে শহরের পূর্বদিকে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান, সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারীপাড়া গ্রামে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাঙালি মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর বাড়ি। করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নে অবস্থিত ঈশা খাঁর জঙ্গলবাড়ি দুর্গ, পাকুন্দিয়া উপজেলা এগারসিন্দুরে অবস্থিত ঈশা খাঁর দুর্গ, শেখ শাহ মাহমুদ মসজিদ ও বালাখানা এবং শেখ সাদী মসজিদ। জেলার হোসেনপুর উপজেলার গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি, শহরের গুরুদয়াল সরকারি কলেজের সামনের মুক্তমঞ্চ।

যেভাবে যাবেন

কিশোরগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে গুরুদয়াল সরকারি কলেজ এবং কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের খুব কাছেই ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ অবস্থিত। কিশোরগঞ্জ শহরের যেকোনো এলাকা থেকে অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে পাগলা মসজিদে যেতে পারবেন।

ঢাকা থেকে ট্রেনে কিশোরগঞ্জ
রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কিশোরগঞ্জ উদ্দেশে তিনটি আন্তনগর ট্রেন ছেড়ে যায়। এগারসিন্ধুর প্রভাতী বুধবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৭টায়, কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে ও এগারসিন্ধুর গোধূলি প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ট্রেনের শ্রেণি অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারিত রয়েছে। কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন থেকে অটোরিকশা রিজার্ভ করে পাগলা মসজিদ আসতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা খরচে যাওয়া যাবে।

ঢাকার মহাখালী থেকে বাসে করে গাজীপুর হয়ে কিশোরগঞ্জ শহরের গাইটাল বাসস্ট্যান্ড আসতে পারবেন। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৩৩০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকার গোলাপবাগ (সায়েদাবাদ) থেকে যাতায়াত ও অনন্যা সুপার বাসে করে ভৈরব হয়ে গাইটাল বাসস্ট্যান্ডে যাওয়া যায়। বাস ভাড়া জনপ্রতি ৩৫০ টাকা। মহাখালী থেকে সময় লাগবে প্রায় ৪ ঘণ্টা এবং গোলাপবাগ থেকে সময় লাগবে সাড়ে ৪ ঘণ্টা। গাইটাল বাসস্ট্যান্ড থেকে ৩০ টাকায় রিজার্ভ অটোরিকশা ভাড়ায় সরাসরি পাগলা মসজিদ আসতে পারবেন। এ ছাড়া গাইটাল বাসস্ট্যান্ড থেকে লোকাল অটোরিকশায় জনপ্রতি ১০ টাকা ভাড়ায় বটতলা মোড়ে নেমে ৫-৭ মিনিট হাঁটলেই পাগলা মসজিদে পৌঁছা যাবে।

কোথায় খাবেন :
কিশোরগঞ্জ শহরে কাঁচালংকা, গাংচিল, তাজ, পানসী, ধানসিঁড়ি, ইস্টিকুটুম, দারুচিনি, কয়লা, ময়নামতি, হোটেল খাওয়া-দাওয়া, কোহিনূর ইত্যাদি রেস্টুরেন্টে পছন্দের খাবার খেতে পারবেন। এ ছাড়া অষ্টগ্রামে বিখ্যাত পনির খেতে চাইলে সুগন্ধা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে যেতে পারেন।

কোথায় থাকবেন :

কিশোরগঞ্জ শহরে রাত্রিযাপনের জন্য হোটেল আল মোবারক ,গাংচিল, নিরালা, হোটেল শেরাটন, রিভার ভিউ, উজান ভাটিসহ বেশ কিছু ভালো মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। এ ছাড়া যোগাযোগ করে জেলা পরিষদের ডাক-বাংলোতে থাকতে পারবেন।

লেখক: প্রতিনিধি,কিশোরগঞ্জ


চকরিয়ায় নতুন আকর্ষণ ‘নিভৃতে নিসর্গ পার্ক’

আপডেটেড ২০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০৯:০৯
ইউসুফ বিন হোসাইন

নিভৃতে নিসর্গ পার্ক- কক্সবাজারের চকরিয়ায় পর্যটকদের এক নতুন আকর্ষণের নাম। মাতামুহুরী নদী ও পাহাড়ের কুল ঘেঁষে গড়ে ওঠা পার্কটি এ এলাকার পর্যটনশিল্পে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া জিদ্দাবাজার থেকে পূর্বে ১০ কিলোমিটার গেলেই মিলবে এ পার্কের দেখা।

‘নিভৃত নিসর্গ’ এলাকায় দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য বেশ কয়েকটি পাহাড়ের মাঝখানে মাটি কেটে লেক সৃষ্টি করা হয়েছে। এই লেকে রাখা হয়েছে ছোট ছোট বোট। রয়েছে কায়াকিংয়ের ব্যবস্থাও। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত নদীভ্রমণ সবার জন্য উন্মুক্ত। দুই পাশে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে গেছে মাতামুহুরী নদী। পাহাড় ও নদীর অপরূপ সান্নিধ্য এখানে। নদীতে নৌকাভ্রমণে পাহাড়, নদীর মিতালি দেখার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বন্য প্রাণী, পাহাড় বেয়ে ঝরে পড়া ঝরনা, নানা পাখির কলরবে মন পুলকিত করবে। নীল জলরাশি দিয়ে যেতে যেতে দেখা মিলবে একাধিক সুউচ্চ সাদা পাথরের পাহাড়। ‘নিভৃতে নিসর্গ’ থেকে নৌকায় করে শ্বেতপাথরে যাওয়ার জন্য ৮-১০টি নৌকা রাখা হয়েছে। প্রতিদিন হাজারও পর্যটক ভিড় করে এই পার্কে। সুরাজপুর মানিকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম জানান, প্রায় ১০০ একর জায়গা নিয়ে এ ‘নিভৃতে নিসর্গ’ পার্কটিতে সূচনালগ্নে শুধু স্থানীয় পর্যটক-দর্শনার্থী এলেও এখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটক দর্শনার্থী আসা শুরু হয়েছে। ভ্রমণে আসা অধিকাংশ পর্যটক মাতামুহুরী নদীতে নৌকায় করে পাহাড়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করে থাকেন। এ পার্ককে কেন্দ্র করে পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামা ও আলীকদম উপজেলায় যাতায়াতের সুবিধার্থে করা হয়েছে নতুন প্রশস্ত সড়ক। এতে প্রতিদিন পার্শ্ববর্তী জেলা বান্দরবান হয়ে পর্যটকদের আগমনের সুযোগ-সুবিধা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

এখানে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য টুরিস্ট পুলিশ ও সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব এ পার্ক পরিদর্শন করেছেন। পার্কটি আধুনিক মানের ও পর্যটকদের আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছেন এবং ওই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দেরও আশ্বাস দেন।

পার্কের তথ্য কর্মকর্তা এরশাদুল হক বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার ও শনিবার স্থানীয় দর্শনার্থীদের পাশাপাশি সারা দেশ থেকে ভ্রমণপিপাসুদের আগমন ঘটছে। মাতামুহুরী নদীতে নৌকাভ্রমণ পর্যটকদের নতুন মাত্রায় যোগ হয়েছে। নৌকাভ্রমণের জন্য স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন মডেলের প্রায় ৪০-৫০টি নৌকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে এ পার্কটি। পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা এই পার্কটিতে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের সড়কযোগে যাতায়াতের জন্য রয়েছে প্রশস্ত রাস্তা। রয়েছে নদীপথে পাহাড়ের কুল ঘেঁষে যাওয়ার সুযোগ।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, নিভৃতে নিসর্গ পার্কটি প্রায় ১০০ একর জুড়ে উপজেলা প্রশাসনের একটি পার্ক। এই পার্কের জন্য একটি দৃষ্টিনন্দন তোরণ, শিশুদের জন্য খেলার ব্যবস্থাসহ বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এগুলো শেষ হলে আগামী ১ বছরের মধ্যে আশা করি এটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিগণিত হবে।

যাওয়ার উপায়

ঢাকা বা অন্য যে জায়গা থেকেই আসেন কক্সবাজারগামী গাড়িতে করে গিয়ে চকরিয়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে যেতে হবে। চকরিয়া সিটি সেন্টারের সামনে থেকে সিএনজি বা জিপ রিজার্ভ করে সরাসরি এই পার্কে যেতে পারবেন। এই পদ্ধতিই সবচেয়ে সহজ উপায়। এ ছাড়া লোকাল ওয়েতে মানিকপুর হয়ে ৪০ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যায় এই পার্কে। কক্সবাজার থেকে যেতে চাইলে চকরিয়া বাসস্ট্যান্ড হয়ে উপরের পথে যেতে পারবেন অথবা কক্সবাজার থেকে চকরিয়া যাওয়ার পথে ফাঁসিয়াখালী স্টেশন থেকে বান্দরবানের লামা সড়ক ধরে ইয়াংছাবাজারে। ইয়াংছাবাজার থেকে অটোরিকশা অথবা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক নিয়ে আড়াই কিলোমিটার গেলেই ‘নিভৃতে নিসর্গ’। কক্সবাজার থেকে প্রাইভেট কারেও যাতায়াত করা যায়। এ ছাড়া চাইলে আগে এই পার্ক ঘুরে তার পর কক্সবাজার যেতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন

পার্কের আশপাশে থাকার কোনো জায়গা নেই। রাতে থাকতে চাইলে আপনাকে চকরিয়া শহরে চলে আসতে হবে। সেখানে মোটামুটি মানের হোটেল আছে। আর যদি পরিকল্পনা থাকে কক্সবাজার যাওয়ার, তাহলে চকরিয়া থেকে দেড় ঘণ্টা পথ দূরত্বে কক্সবাজার চলে যেতে পারেন।

কোথায় খাবেন

পার্কে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, তবে হালকা নাশতা খাওয়ার জন্য দোকান আছে। মানিকপুর বাজারে খাবারের জন্য দেশি হোটেল আছে। এ ছাড়া চকরিয়া বাজারে কয়েকটি মোটামুটি মানের খাবার হোটেলও আছে।

লেখক : প্রতিনিধি, চকরিয়া-পেকুয়া


এক দিনের দিনাজপুর

কান্তনগর মন্দির। ছবি : সুদীপ্ত সালাম
আপডেটেড ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৪:০৭
সুদীপ্ত সালাম

২ ডিসেম্বর ২০২২। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে বাস দিনাজপুরের কালীতলা বাসস্ট্যান্ডে থামল। একে তো অন্ধকার, তারওপর শীতকাল। সূর্য বেলা করেই জাগবে। বাস থেকে নেমে পড়লাম আমরা। আমরা মানে, আমাদের পাঁচজনের একটি দল। এসেছি কান্তনগর মন্দির দেখতে। ঢাকার কল্যাণপুর থেকে গত রাতে আমরা রওনা হয়েছি। রাত ৯টা ২২-এ ঢাকা থেকে ছেড়ে আসে আমাদের বহনকারী এসআর ট্রাভেলসের এই বাসটি। আমরা ছাড়াও বাসে আরও দু-একজন আছেন। বাকিরা আগের স্টেশনগুলোতে নেমে গেছেন। কালীতলা শেষ বাসস্ট্যান্ড।

বাস থেকে নেমে কী করব বুঝতে পারছি না। কোথাও কিছু নেই। আমরা শুধু জানি আমরা যাব কান্তনগর মন্দিরে। সেটি কোথায় বা কীভাবে যেতে হয় তা-ও অজানা। সম্বল দিনাজপুর নিয়ে কিঞ্চিৎ পড়াশোনা। পড়াশোনা করেছি বলেই এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে মনে পড়ে গেল, এই কালীতলাতেই মশানকালী নামে একটি পুরোনো কালী আছে। এর কাছেই দিনাজপুরের রাজাদের একটি বিচারালয় ছিল। কথিত আছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের এই মশানকালীর সামনেই নাকি বলি দেয়া হতো! এই ভয়াবহ তথ্যটি চেপে গেলাম। গা ছমছমে পরিবেশে সঙ্গীদের সামনে সে কথা ওঠানো ঠিক হবে না। একটু এগিয়ে একটি চায়ের দোকান মিলল। চা শেষ করতে করতে জেনে নিলাম কিছু তথ্য। চা-ওয়ালা জানালেন, একটু আলো ফুটলেই কান্তনগর মন্দিরে যেতে পাওয়া যাবে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। ততক্ষণে সকালের নাশতাটা সেরে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কোতোয়ালি থানার কাছেই একটি ছোট খাবারের দোকান। ডাল, পরোটা ও ডিমভাজা দিয়ে নাশতা সেরে হোটেলেই বসে রইলাম অনেকক্ষণ।

অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। আমরা একটি অটোরিকশায় উঠে পড়লাম। পাকা সড়ক ধরে অটোরিকশা ছুটছে শহরের উত্তর দিকে। পূর্বদিকে লাল সূর্যটা আর পশ্চিমের ঢেপা নদী আমাদের সঙ্গে দৌড়াচ্ছে। অটোরিকশার গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীত বাড়তে লাগল। চাদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বিকেএসপি, দশমাইল, ঠাকুরগাঁও রোড হয়ে পৌঁছে গেলাম তেভাগা চত্বরে। দিনাজপুর ছিল অন্যতম প্রধান তেভাগা এলাকা। তিন ভাগের দুই ভাগ ফসলের দাবিতে ১৯৪৬ সালে শুরু হওয়া তেভাগা আন্দোলন দিনাজপুর ও রংপুরে তীব্রতর হয়। অনেকের মতে দিনাজপুরেই এই আন্দোলনের সূত্রপাত। যা হোক, পরবর্তীকালে আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে অভিভক্ত বাংলার ১৯টি জেলায়। এই অবিস্মরণীয় আন্দোলনের প্রবর্তক কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশের জন্মও দিনাজপুরে। তেভাগা চত্বর পার করতে করতে কানে বাজতে লাগল কিছু স্লোগান, ‌‘আধি নয় তেভাগা চাই’, ‘জমিদারি প্রথা ধ্বংস হোক’, ‘লাঙল যার জমি তার…’।

তেভাগা চত্বর পার করলেই কাহারোল সেতু। সেতুর নিচে ঢেপা নদী। স্থানীয়রা কান্তজীর নদীও বলে। ঢেপার আরেকটি অংশের নাম ‘ছোট ঢেপা’। দিনাজপুরের কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢেপা নদীর ভূমিকা অপরিসীম। এই নদীর পশ্চিম পাড়েই নির্মাণ করা হয়েছে কান্তনগর মন্দির। শুষ্ক মৌসুম বলে কিনা জানি না, নদীটি শুকিয়ে চর হয়ে আছে। সেতু পার হলে হাতের বাঁদিকে পড়বে কান্তনগর প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। এত সকালে যে এটি বন্ধ- তা অনুমান করে গাড়ি থামালাম না।

সকাল ৭টা ৪০-এ পৌঁছলাম কান্তনগর মন্দির এলাকায়। মন্দিরটি ঘিরে রাসমেলা চলছে। দোকানপাটে ছেয়ে গেছে গোটা এলাকা। আমরা মেলা পেরিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণে পা রাখলাম। মন্দিরের প্রথম দেখায় হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। সুন্দরের সমার্থক যত শব্দ আছে সেগুলো ব্যবহার করেও এই মন্দিরের সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা যাবে না। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ লাগাতেই ভুলে গেলাম। মনের ক্যামেরায় মন্দিরের অপার সৌন্দর্য দেখছি। আমি তাজমহল দেখেছি। যে প্রত্যাশা নিয়ে তাজমহল দেখতে গিয়েছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছিলাম। আজও ঠিক তাই হলো, ছবিতে কতবার দেখেছি এই মন্দির, আজ বুঝলাম ছবির চেয়েও সুন্দর এর শরীর।

মন্দিরটি কান্তজিউ মন্দির বা কান্তজী মন্দির নামেও সুখ্যাত। প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার ‘বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ গ্রন্থে বলেছেন, টেরাকোটা শিল্পের অতুলনীয় নিদর্শন এই মন্দির। আর প্রখ্যাত ভূগোলবিদ এবং প্রাণী ও উদ্ভিদ গবেষক ফ্রান্সিস বুকানন-হ্যামিল্টন নাকি গোটা বাংলায় এরচেয়ে সুন্দর মন্দির দেখেননি। তারা যথার্থই বলেছেন। টেরাকোটার এমন মনোরম নিদর্শন আর কোথায় মিলবে! বঙ্গদেশে পাথর সুলভ ছিল না। তাই শিল্পীরা তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশে বেছে নিয়েছিলেন বাংলার কাদামাটি।

ধনঞ্জয় রায়ের ‘দিনাজপুর জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুরের জমিদার মহারাজ প্রাণনাথ রায় মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া মন্দিরের শিলালিপির বরাত দিয়ে বলেছেন, ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করেন জমিদারের পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায়। অন্যদিকে ‘বাংলায় ভ্রমণ : ‌পূর্ব্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ হইতে প্রকাশিত’ গ্রন্থ বলছে, ১৭০৪ সালে প্রাণনাথ দিল্লি থেকে কান্তজীর বিগ্রহ এনে এই মন্দিরে স্থাপন করেন। এক মিটার উঁচু বর্গাকার পাথরের বেদিতে কান্তনগর মন্দির প্রতিষ্ঠিত। বেদির প্রতিটি বাহু ৬০ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বা। আর মন্দিরের প্রত্যেক বাহু ৫১ ফুট দীর্ঘ। মন্দিরের চারদিকে ৮ ফুট প্রশস্ত টানা বারান্দা রয়েছে। এর প্রত্যেক দিকে তিনটি করে প্রবেশপথ। মন্দিরের ভেতরে কান্তজীর অর্থাৎ কৃষ্ণের মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের ছাদে মোট ৯টি চূড়া বা নবরত্ন ছিল। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে চূড়াগুলো ভেঙে পড়ে। জানা যায়, মাটি থেকে এর কেন্দ্রীয় চূড়ার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট। মন্দিরের চিত্রফলক বা টেরাকোটাগুলো এখনো অটুট ও সুরক্ষিত। চিত্রফলকগুলোর মাধ্যমে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজজীবনের নানা চিত্রসহ পৌরাণিক ঘটনাবলি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চিত্রফলকগুলো করেছেন কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা।

এই রামনাথ এবং তার পিতা প্রাণনাথ রায় নাকি অত্যাচারী রাজা ছিলেন। অত্যাচারী মানুষ কিভাবে এমন অনবদ্য শিল্পকর্ম সৃষ্টি করতে পারেন! প্রচুর ছবি তুললাম, তা-ও মন ভরে না। দুচোখ ভরে দেখি তা-ও দেখা শেষ হয় না। মন্দিরের গা থেকে মন সরালেন কৌশলা গোস্বামী ও সরলা গোস্বামী। তারা মন্দিরের একপাশে বসে গুরুতত্ত্ব গান ধরেছেন, ‘আয়রে গৌড় প্রেমানন্দে আয়/ আসিলে আনন্দ হবে/ নয়ন জলে স্নান করাব/ কেশবন্ধে মুছাইব…’। মন্দির প্রাঙ্গণে সারা দিনই পূজা, অর্চনা, নৃত্য ও কীর্তন চলে। কৃষ্ণভক্তদের মিলনমেলা এই মন্দির।

কান্তনগর মন্দিরের ১০০ মিটার উত্তর দিকে শ্যামগড়ের কাছে আরেকটি মন্দির রয়েছে। এক কক্ষের জরাজীর্ণ মন্দিরটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মন্দিরের চারপাশে প্রাচীন প্রাচীরের ভগ্নাংশ রয়েছে। গবেষকদের মতে, কান্তনগর মন্দিরের আগে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। সময় নিয়ে যত্ন করে তৈরি করা হয়েছিল মন্দিরটি। মন্দিরের মূল কক্ষটি বর্তমানে ফাঁকা, ভেতরে ঢুকা যায় না। স্থানীয়রা জানালেন, মন্দিরটির নাম ‘অর্চনা মন্দির’। মহারাজা প্রাণনাথ রায় বৃন্দাবন থেকে নৌকায় করে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি এনে এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার মতো অনেক গবেষক এই তথ্যকে সমর্থন করেছেন। এই মন্দিরের গায়েও যে চিত্রফলক ছিল, তা বোঝা যায়। এখন একটিও নেই।

ঢেপা নদীর পশ্চিম পাড়ে নয়াবাদ মসজিদ

এই দুই মন্দির দেখার পর আমরা নয়াবাদ মসজিদের দিকে রওনা হলাম। কাহারোল উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের নয়াবাদ গ্রামে ঢেপা নদীর পশ্চিম পাড়ে মসজিদটি অবস্থিত। মন্দির থেকে খুব একটা দূরে নয়, কিন্তু কাঁচা ও ভাঙা সড়ক বলে ঘুরে এবং ধীরে ধীরে যেতে হয়। একটি রিকশাভ্যানে উঠে বসলাম আমরা পাঁচজন। রিকশাভ্যানটি আমাদের নিয়ে আদিবাসীদের একাধিক বসতি এবং আমবাগান পেরিয়ে হেলতে দুলতে ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল নয়াবাদ মসজিদ প্রাঙ্গণে। ১ দশমিক ১৫ বিঘা জমির ওপর মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত। তবে মূল মসজিদটি খুব বড় নয়। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি বাইরের দিক থেকে দৈর্ঘ্যে ১২ দশমিক ৪৫ মিটার এবং প্রস্থে ৫ দশমিক ৫ মিটার। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাজেভাবে সংস্কার করে বলে কিনা জানি না, মসজিদটি খুব আকর্ষণীয় নয়। সাদামাটা। অবশ্য মসজিদের দেয়ালজুড়ে আগে বহু পোড়ামাটির চিত্রফলক ছিল। এখন বেশির ভাগই উধাও। মসজিদের পাশেই একটি পুরোনো ক্ষয়ে যাওয়া কবর রয়েছে। সেটি কেন সংস্কার করা হয়নি জানি। মসজিদের প্রবেশপথের ফারসি লিপি থেকে জানা গেছে, মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সময়, ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। লোকে বলে, কান্তনগর মন্দির নির্মাণ করতে এখানে এসেছিলেন বিদেশি মুসলমান স্থাপত্যকর্মীরা। তারাই নয়াবাদ গ্রামে বসতি স্থাপন করে মসজিদটি নির্মাণ করেন। কিন্তু কান্তনগর মন্দিরের কাজ তো ১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়ে ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হয়। মসজিদ হয়েছে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। তাহলে কি বিদেশি স্থাপত্যকর্মীরা দিনাজপুরে রয়ে গিয়েছিলেন? যদি তা-ই হয় তাহলে তাদের বংশধররা কোথায়? এই প্রশ্ন মাথায় নিয়ে বেরিয়ে গেলাম মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে।

রামনাথের রামসাগর দিঘি
রামনাথের রামসাগর দিঘি

আমাদের এবারের গন্তব্য প্রথমে দিনাজপুর শহর। তারপর সেখান থেকে রামসাগর। একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। ততক্ষণে শীত একদম হাওয়া। ঝলমলে রোদ খেলা করছে বিস্তীর্ণ পাকা ধানের খেতে। বেশির ভাগ ধান কাটা শেষ, কিছু বাকি। চাষিরা ধান কেটে খেতেই স্তূপ করছেন। কোথাও কোথাও বোনা হয়েছে ভুট্টার চারা। কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি আখ। যাহোক, আমরা আবার ফিরে এলাম শহরে। বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজশাহীতে পরিবহন ধর্মঘট চলছে, পরে যদি ঢাকার টিকিট না পাই! তাই কালীতলা বাসস্ট্যান্ডে নেমেই রাতের বাসের টিকিট কেটে নিলাম। দিনাজপুরে রাত কাটানোও ঠিক হবে না, পরদিন কী হয় কে জানে! বাসে আসন নিশ্চিত করে আমরা দুপুরের খাওয়া সেরে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কোথায় খাব? বাস কাউন্টারের একজন বললেন, একটি অটোরিকশা নিয়ে আদি মুন্সী হোটেলে চলে যেতে। তা-ই করলাম। শহরের মালদহপট্টির ‘আদি মুন্সী হোটেল’-এ পৌঁছাতে আনুমানিক ১৫ মিনিট লাগল। রেস্তোরাঁটি নব্বইয়ের দশকের, মালিকপক্ষ কেন এটিকে ‘‌ঐতিহাসিক’ বলছে বুঝিনি। তবে রেস্তোরাঁর সেবা ও খাবারের প্রশংসা না করে পারবেন না। ঘরোয়া পরিবেশে খুব মজা করে খেলাম আমরা। ভাত, মাছ, সবজি, ভর্তা, খাসির মাংস…। খাওয়া শেষে মনোরম পরিবেশের রেস্তোরাঁটিতে কাটিয়ে দিলাম ঘণ্টাখানেক।

দুপুর দেড়টার দিকে অটোরিকশায় চড়ে বসলাম আমরা। যাব রামসাগর জাতীয় উদ্যানে। সুরম্য পৌরসভা ভবন, বড় মাঠ পেছনে ফেলে ছুটছে অটোরিকশা। কিছুক্ষণ পরই শহরের দালানকোঠা নাই হয়ে গেল। সড়কের দু-পাশে অবারিত ফসলের মাঠ, মাঠের শেষে সবুজে মোড়া গ্রাম। ধানের পাকা গন্ধ নিয়ে নির্মল বাতাস ধাইধাই করে নাচছে। অনেকদিন পর গ্রামের সান্নিধ্যে আসা, বাংলার প্রাণ গ্রামকে ছুঁয়ে দেখা, গ্রামের বাতাসে মুখ ঘষা।

মালদহপট্টি থেকে রামসাগর আসতে আধ ঘণ্টার মতো লাগল। হাতে এখনো ঢের সময়। সবেমাত্র বেলা ২টা। টিকিট কেটে আমরা উদ্যানে ঢুকে পড়লাম। মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনের মতোই এই উদ্যান। তবে এর বিশেষত্ব ঐতিহাসিক রামসাগর দিঘি ও রামসাগর মন্দির। উদ্যানের ফটক দিয়ে ঢুকে কিছু দূর গেলেই হাতের ডানে, রামসাগর দিঘির উত্তর পাশে পড়বে রামসাগর মন্দির। একটি ঢিবির ওপর ঝোপঝাড়ের মধ্যে পড়ে আছে মন্দিরটি। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া এটিকে ‘দেব মন্দির’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যদিও মন্দির বলে আর কিছু নেই, মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী দেখে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ধারণা, এটি ১৭ থেকে ১৮ শতাব্দীতে নির্মিত। অন্যদিকে অনেক গবেষক মনে করেন, দিঘি খননের সময়ই (১৭৫০-১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে) দিনাজপুরের মহারাজা রামনাথ রায় মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। বর্গাকারে নির্মিত মন্দিরের দেয়ালে বহু টেরাকোটা বা চিত্রফলক ছিল। এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই। গাছের শিকড় ও লতাপাতার বাহুপাশে বিলীন হওয়ার পথে স্থাপনাটি।

রামসাগর মন্দির


মন্দির রেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। কয়েক কদম হাঁটতেই আমাদের সামনে উন্মোচিত হলো রামসাগর দিঘি। বিশাল এর দেহ, মোহনীয় এর রূপ। ঘন সবুজ গাছে ঘেরা দিঘিটি উত্তর-দক্ষিণে ১ হাজার ৭৯ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৯২ দশমিক ৬ মিটার। এর গভীরতা প্রায় সাড়ে ৯ মিটার। আমরা দিঘিপাড়ের বেঞ্চে বসলাম। গাছের ছায়া ঘন হয়ে আসছে, পাখিরা নীড়ে ফিরছে, দিঘির পানিতে ভাসছে লতাপাতা, দলবেঁধে ছোটাছুটি করছে জল স্ট্রাইডার পোকা, পাখি ও কীটপতঙ্গের ডাকাডাকি মিলেমিশে একাকার- সব মিলিয়ে এক অপরূপ অডিও-ভিজুয়াল।

দিনাজপুরে আমাদের আজকের মতো আর কিছু করার নেই। সব শেষ করেই তো এই দিঘির কাছে আসা। এখানে বিকেল পর্যন্ত থেকে শহরের দিকে ফিরব। এই দিঘির কথা অনেক শুনেছি। বুঝলাম এটিকে শুধু শুধু দেশের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট দিঘি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। পলাশী যুদ্ধের কয়েক বছর আগে মহারাজা রামনাথ রায় দিঘিটি খনন করিয়েছিলেন। প্রজাদের খরা ও দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচাতেই এই উদ্যোগ। সে সময় প্রায় ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে তিনি এই দিঘিটি করেন। দিঘিটি নিয়ে আছে নানা গালগপ্পো। একটি গল্প তো উদ্যানের সাইনবোর্ডেই লেখা আছে। দিঘি খনন করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন প্রাণনাথ রায়। পুকুর খনন করালেন। কিন্তু পুকুরে যে পানি নেই! তখন রাজা দৈববাণী পেলেন, একমাত্র পুত্র রামনাথকে দিঘিতে বলি দিলে পানি উঠবে! সে অনুযায়ী রাজা দিঘির মাঝখানে একটি ছোট মন্দির তৈরি করলেন এবং এক ভোরে রামনাথকে নামালেন সেই মন্দিরে। মন্দিরে পা রাখতেই পানি উঠতে শুরু করে। সেই পানিতে তলিয়ে যান রামনাথ। যুবরাজের স্মরণে দিঘির নাম ‘রামসাগর’। ইতিহাসের সঙ্গে এই গল্পটি একেবারেই খাপ খায় না। ইতিহাস বলে, রামনাথের আমলেই দিঘিটি নির্মিত। আরেকটি জনশ্রুতিতে দিঘি খননকারী মহারাজা রামনাথ রায়। খনন করার পরও দিঘিতে পানি নেই। তখন স্বপ্নদেশ পান, দিঘিতে কেউ প্রাণ বিসর্জন দিলেই পানি উঠবে। তখন ‘রাম’ নামের এক যুবক দিঘিতে প্রাণ বিসর্জন দেন। রাজার নির্দেশেই নাকি সেই যুবকের নামে দিঘিটির নামকরণ করা হয়। যাহোক, ২০০১ সালে এলাকাটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হলেও এর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নাজুক। উদ্যানের এবং উদ্যানে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ ভাবেন বলে মনে হয়নি।

সন্ধ্যার পরপর আমরা শহরে ফিরে এলাম। রাত ৯টা পর্যন্ত কী করব? সিদ্ধান্ত হলো, হেঁটে হেঁটে শহরটা দেখা যাক। কালীতলার একটি ক্যাফেতে নাশতা করে চারুবাবুর মোড় রোড ধরে পদযাত্রা শুরু করলাম। এই ‘চারুবাবু’ই কি নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রবর্তক এবং তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক চারু মজুমদার? নিশ্চিত হতে পারিনি। গণেশতলায় পেলাম গণেশ মন্দির। পুরোপুরি গণেশের জন্য নিবেদিত মন্দির বাংলাদেশে এই প্রথম দেখলাম। বেশি দূরে যাওয়া হয়নি, স্টেশন রোড পর্যন্ত। সেখানে একটি রেস্তোরাঁয় চা খেয়ে আবার কালীতলার দিকে হাঁটা দিলাম। ফেরার পথে গণেশতলার ‘মিষ্টি মুখ’ থেকে কয়েক পদের মিষ্টি কিনলাম বাড়ির জন্য। আর এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো আমাদের এক দিনের দিনাজপুর ভ্রমণ।

নিশ্চয়ই, এক দিনে পুরো দিনাজপুরকে দেখা কিংবা অনুধাবন করা অসম্ভব। কাহিনি, কিংবদন্তি, পুরাণ ও ইতিহাসের মোহনা যেন দিনাজপুর। প্রায় আড়াই হাজার বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির লীলাভূমি এই অঞ্চল। হিমালয় পর্বতের ভগ্নিরূপে জন্ম নেয়া বরেন্দ্র ভূমির প্রাণকেন্দ্র দিনাজপুরকে বুঝতে বারবার ছুটে যেতে হবে সেখানে।

তথ্যসূত্র:

১. বাংলায় ভ্রমণ : ‌পূর্ব্ববঙ্গ রেলপথের প্রচার বিভাগ হইতে প্রকাশিত (দ্বিতীয় খণ্ড)

২. বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ - আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া

৩. দিনাজপুর জেলার ইতিহাস - ধনঞ্জয় রায়

৪. বাংলাপিডিয়া ডট ওআরজি

৫. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন


মোগল আমলের সাত গম্বুজ মসজিদ

আপডেটেড ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৬:১৮
সুদীপ্ত সালাম

মোগল আমলে নির্মিত ঢাকার মোহাম্মাদপুরের সাত গম্বুজ মসজিদ। মসজিদটি ১৬৮০ সালে সুবাদার শায়েস্তা খাঁর পুত্র উমিদ খাঁ নির্মাণ করেন। চারটি বড় মিনার ও তিনটি ছোট মিনারের সমন্বয় তৈরি হওয়াতে এটির নামকরণ করা হয়েছে সাত গম্বুজ মসজিদ।কথিত আছে- সেখানে শায়েস্তা খাঁর মেয়ের কবরও রয়েছে। শায়েস্তা খাঁর মেয়ের কবরটি বিবির মজার বলে পরিচিত। কবরের জায়গাটি ঘিরে বেশ কিছু সবুজ গাছ বেড়ে উঠেছে; যা মসজিদটিসহ পুরো আঙিনাকে সৌন্দর্যের এক ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। মসজিদের পেছনে একটি বিশাল সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পানির চৌবাচ্চা রয়েছে।

ছাদে তিনটি বড় গম্বুজ ও চারটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটির আয়তন নামাজের স্থান থেকে বাইরের দিকে ১৭.৬৮ দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে ৮.২৩ মিটার। এটির ভেতর থেকে বাহিরে বের হতে পাঁচটি দরজা রয়েছে। দুপাশে দুইটি দরজা ও তিনটি দরজা মিম্বারের সামনের দিকে। পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি মিহরাব।

হালকা লাল ও মৃদু ব্রাউন বর্ণের দান্দনিক এ মসজিদটি কাছে কিংবা দূর থেকে অত্যন্ত রাজকীয় ও সুন্দর দেখায়। মসজিদের ভেতরে প্রায় ৯০-৯৫ জন মুসল্লির নামাজ পড়ার মতো জায়গা রয়েছে। বাইরের প্রশস্ত যেই জায়গাটি আছে সেখানেও প্রায় দুই-আড়াইশ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন একসঙ্গে।

মসজিদের সামনে একটি বড় উদ্যান রয়েছে। উদ্যানটি ঈদের সময় খুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটির দেখাশোনা করে।

মোহাম্মদপুর স্ট্যান্ড হয়ে বাঁশবাড়ী রোড দিয়ে একটু সামনে এগোলোই রাস্তার বাম পাশে মসজিদটি অবস্থিত।


টোকিও: ভালো লাগার শহর

আপডেটেড ২ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৯:২৪
আল কাছির

সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের রাজধানী টোকিও। পৃথিবীর অন্যতম ব্যয়বহুর শহর। কিন্তু সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। বরফ, ম্যাপল পাতার সৌন্দর্যে উদ্ভিসিত, ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি ফুজিয়ামার পাদদেশে গড়ে ওঠা এই শহর ঘুরে এসে লিখেছেন সাংবাদিক আল কাছির।

ট্রানজিটসহ ১৪ ঘণ্টার জার্নি শেষে টোকিওর নারিতা এয়ারপোর্টে নামলাম বিকেল সাড়ে ৫টায়। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। সূর্যোদয়ের পর শুরু হলো আমার টোকিও দেখা। শহরটা যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হয়েছি। এখানকার মানুষ থেকে শুরু করে সবকিছু একদম সেকেন্ড ধরে চলে। ঘোর লাগানো এক শহরের নাম টোকিও।

গিঞ্জা এলাকায় ছিলাম সাত দিন। এখান থেকেই ছুটেছি টোকিওর বিভিন্ন প্রান্তে। সেদিন প্রচুর ঠাণ্ডা ছিল। তার মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছিল। নাশতা শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য ছিল টোকিওর সবচেয়ে আকর্ষণীয় মন্দির ‘সেঞ্জো-জি’ যাওয়া। টোকিও মেট্রো স্টেশন থেকে আসাকুসা লাইনের মেট্রোতে চেপে বসলাম। আসাকুসা স্টেশন থেকে তিন নম্বর গেট ধরে বের হলেই হাঁটা দূরত্বে ‘সেঞ্জো-জি’ মন্দিরটি। সপ্তম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই বৌদ্ধ মন্দিরটি। এটি টোকিওর সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির ও দর্শনীয় স্থান। সেঞ্জো-জি মন্দিরে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষের ভিড় জমে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দর্শনার্থী আর পূজারিদের আনাগোনা থাকে এ মন্দিরে। এ ছাড়া বছরের পুরো সময়জুড়েই বিভিন্ন উৎসব লেগে থাকে এখানে।

‘সেঞ্জো-জি’ মন্দিরের সামনে লেখক

সেঞ্জো-জি মন্দিরের দুটি গেট, এটি প্যাগোডা ও একটি হল আছে। প্রথম গেটটির নাম ‘কামিনারিমন গেট’। আর দ্বিতীয় গেটটির নাম ‘হোজোমন গেট’। এই দুই গেটে মাঝখানের দূরত্বে রাস্তার দুই পাশে সারি সারি সব দোকান। এটিকে মূলত ‘নাগামিসো স্ট্রিট’ বলা হয়। ছবি তোলার জন্য এটি পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণের জায়গা। কেনাকাটা তো আছেই। সেঞ্জো-জি মন্দির থেকে বের হলেই আপনার চোখে পড়বে টানা রিকশা। এ রিকশায় চড়ে পুরো আসাকুসা শহরটি ঘুরে দেখতে পারবেন। যদি রিকশায় ভ্রমণ করতে চান তাহলে আপনাকে গুনতে হবে প্রতি ঘণ্টায় ১০ হাজার জাপানি ইয়েন। আমি রিকশায় না ঘুরে চলে গেলাম সেঞ্জো-জি মন্দির থেকে হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত ‘টোকিও স্কাই ট্রি’ দেখতে।

‘টোকিও স্কাই ট্রি’ জাপানে অবস্থিত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ টাওয়ার। এটির উচ্চতা ৬৩৪ মিটার। ২০০৮ সালে এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। প্রায় ৮০ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত টাওয়ারটি খুলে দেয়া হয় ২০১২ সালের ২২ মে। ৩৬ হাজার ৯০০ বর্গমিটার জায়গায় নির্মিত এ টাওয়ারটি সম্পূর্ণ ভূমিকম্প নিয়ন্ত্রিত। এটি শুধু স্যাটেলাইট সম্প্রচার কেন্দ্রই না, এটি বাণিজ্যিক টাওয়ারও। ‘টোকিও স্কাই ট্রি’র ৩১ তলা পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অ্যাকুয়ারিয়াম, রেস্টুরেন্ট ও হোটেল আছে। টাওয়ারের প্রধান আকর্ষণ দুটি মানমন্দির। প্রথমটি উচ্চতায় ৩৫০ মিটার, দ্বিতীয়টি ৪৫০ মিটার। নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে আপনি স্কাইট্রির ওপরে উঠতে পারবেন। টোকিও স্কাইট্রি ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা নেমে এল। বাহারি আলোয় টোকিও স্কাইট্রি দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। যার রেশ অনেক দূর থেকেই উপভোগ করা যাচ্ছিল।

জাপান আসার আগেই ‘টোকিও টাওয়ার’ দেখার পরিকল্পনা করেছিলাম। ‘টোকিও টাওয়ার’ শিবা জেলার মিনতো এলাকায় অবস্থিত। হিগাশি গিঞ্জা স্টেশন থেকে মেট্রো ধরে রুপপোঙ্গি স্টেশনে নামলাম। এখান থেকে গুগল ম্যাপ ধরে প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পথ। টোকিও টাওয়ারের উচ্চতা ৩৩২.৯ মিটার। এটি মূলত যোগাযোগ ও পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। টোকিও টাওয়ারটি আইফেল টাওয়ারের অনুপ্রেরণায় নির্মিত। এতে কমলা-সাদা রং ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে বিমান চলাচলে অসুবিধা না হয়। ১৯৫৩ সালে জাপান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন টেলিভিশন সম্প্রচার শুরুর পর একটি বড় সম্প্রচার টাওয়ারের প্রয়োজন দেখা দেয়। এরপর ১৯৫৮ সালে টাওয়ারটি তৈরি করা হয়। টোকিও টাওয়ার ইস্পাত দিয়ে তৈরি। তৃতীয় কোরিয়ান যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন ট্যাংক থেকে স্ক্যাপ ধাতু ব্যবহার করা হয়েছিল এতে। টোকিও টাওয়ারের নির্মাণব্যয় ২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন জাপানি ইয়েন।

টোকিও টাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষণের জন্য দুটি ডেক আছে। নির্ধারিত মূল্যের টিকিটি কেটে আপনি এখানে প্রবেশ করতে পারবেন এবং টোকিও শহরটি উপভোগ করতে পারেন। প্রতি ৫ বছর পর পর টোকিও টাওয়ার রং করা হয়। আর এটি রং করতে আনুমানিক ১ বছর সময় লাগে। সবশেষ ২০১৯ সালে এটি রং করা হয়েছিল। দিনের চেয়ে রাতের টোকিও টাওয়ার বেশ আকর্ষণীয়। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালিয়ে দেয়া হয় টাওয়ারের লাইটগুলো। আর তাতেই বুঁদ হয়ে থাকেন দর্শনার্থীরা। নির্মাণের পর থেকে এখন পর্যন্ত টোকিও টাওয়ারটি বিখ্যাত একটি ল্যান্ডমার্ক আর দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান।

এ ছাড়া টোকিও ভ্রমণকালে আরও যেতে পারেন মেইঞ্জি জিঙ্গু, ইম্পেরিয়াল প্যালেস, ওবাইডা, টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়াম, মাউন্ট মিটাকে, এডো টোকিও মিউজিয়াম, ইজু আইল্যান্ডে। সব মিলিয়ে ভালো লাগার এক শহর টোকিও। এ শহরের চাঞ্চল্য বাড়ে মূলত সন্ধ্যার পর। রাত যত বাড়ে, ততই ঘোর লাগায় টোকিও শহর। আপনি যদি জাপানে ভ্রমণে যান, রাতে টোকিও শহর ঘুরে দেখতে ভুলবেন না।

আনুমানিক খরচ: সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া আর থাইল্যান্ডে ট্রানজিট দিয়ে জাপান যেতে হয়। এয়ারলাইন্সভেদে টিকিট মূল্য কম-বেশি হতে পারে। আমি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে গিয়েছিলাম। এয়ার টিকিটের জন্য গুনতে হয়েছিল ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা হয়েও জাপান যাওয়া যায়। আপনি যদি এ রুটে আগে টিকিট কেটে রাখেন, তাহলে দেড় লাখের মধ্যে পেয়ে যাবেন। টোকিও শহরে ৬ রাতের জন্য আমাকে হোটেল ভাড়া গুনতে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। আপনি চাইলে টোকিও শহরের আশপাশে আরও কম দামে হোটেল পেয়ে যাবেন। আর টোকিওতে একজনের তিনবেলার খাবার খরচ ১০০০ টাকার মধ্যেই হয়ে যাবে।


ঘুরে এলাম সিলেট

টাঙ্গুয়ার হাওর
আপডেটেড ২৮ নভেম্বর, ২০২২ ২০:৫৩
সাইদুল ইসলাম মিঠু

চায়ের দেশ সিলেট। অপরূপ প্রকৃতি আর ইতিহাসে প্রসিদ্ধ এই অঞ্চল সব সময়ই ভ্রমণপিয়াসীদের পছন্দের তালিকায়। সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে নজরকাড়া চা-বাগানগুলোর সৌন্দর্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে স্বমহিমায়। আর আছে রাতারগুলের মতো অনিন্দ্য এক প্রকৃতির হাতছানি। আমরাও তাই ৪ বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়লাম সিলেটের উদ্দেশে। আমাদের সিলেট দেখা ও অভিজ্ঞতা জানাচ্ছি যারা সিলেট ভ্রমণে যেতে চাইছেন তাদের জন্য।

রাতারগুল

রাতের বাসে ঢাকা থেকে রওনা হলে ভোরে ভোরে পৌঁছে যাবেন সিলেটে। বাস থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে চলে যাবেন পানসী বা পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টে। সেখানে সাশ্রয়ে মুখরোচক নাশতা শেষ করে চলে যান আম্বরখানা। জিন্দাবাজার থেকে ২০ টাকা ভাড়ায় রিকশা নিয়ে আম্বরখানা গোল্ডেন টাওয়ারের সামনে নামবেন। ওখান থেকে রাতারগুলের গাড়ি যায়। লোকাল গাড়ি সরাসরি রাতারগুল যাবে না। রিজার্ভ সিএনজি নেয়া ভালো সারাদিনের জন্য। দরাদরি করে ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে নেয়া যায়। রাতারগুলে ঢুকতে ইঞ্জিনচালিত নৌকা পাবেন ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকায়। পানি থাকলে রাতারগুল যেমন সুন্দর লাগে, পানি না থাকলে তেমনি বিচ্ছিরি লাগে। তাই নৌকা নেয়ার আগে পানি আছে কি না দেখে নিন। নইলে টাকা জলে যাবে।

বিছানাকান্দি

রাতারগুল শেষ করে আমরা বিছানাকান্দি দেখতে গেলাম। বিছানাকান্দি যাওয়ার রাস্তাটা খুব খারাপ। ট্রলারে বিছানাকান্দি গিয়েছি ২৫০০ টাকায়। বিছানাকান্দি অসাধারণ সুন্দর জায়গা। ৪টার দিকে বিছানাকান্দিতে গোসল শেষে দুপুরের খাওয়াদাওয়া করি। পার মিল ১০০ টাকা করে। মোটামুটি মানের খাবার। সন্ধ্যার কিছু পর আমরা হোটেলে ফিরি। সিলেট শহর থেকে বিছানাকান্দির দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার। এটি সিলেটের পর্যটন স্বর্গ। দেশের সীমান্তঘেরা পাথরের বিছানা ও মেঘালয় পাহাড় থেকে আসে ঠাণ্ডা পানি। পাশেই পাহাড়ি সবুজের সমারোহ। ছোট-বড় পাথরের ওপর দিয়ে ছুটে আসা স্বচ্ছ পানির স্রোতধারা বিছানাকান্দিতে সৃষ্টি করেছে এক মনোরম পরিবেশ। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে খাসিয়া পাহাড়ের অনেক ধাপ দুই পাশ থেকে এক বিন্দুতে এসে মিলেছে। পাহাড়ের খাঁজে রয়েছে সুউচ্চ ঝর্ণা। তা ছাড়া বর্ষায় থোকা থোকা মেঘ আটকে থাকে পাহাড়ের গায়ে। মনে হতে পারে মেঘেরা পাহাড়ের কোলে বাসা বেঁধেছে। পূর্বদিক থেকে পিয়াইন নদীর একটি শাখা পাহাড়ের নিচ দিয়ে চলে গেছে ভোলাগঞ্জের দিকে।

টাঙ্গুয়ার হাওর

৮ অক্টোবর ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবাই রেডি হই সুনামগঞ্জ যাওয়ার জন্য। আমরা ৬ জন কষ্ট করে এক সিএনজিতেই যাই বাস কাউন্টারে। ভাড়া দেই ২০০ টাকা। বাস কাউন্টারে গিয়ে রাতের জন্য ঢাকার বাসের টিকিট করে নিই। তারপর নাশতা করে আমরা সিএনজি নিয়ে চলে যাই কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড। প্রতি সিএনজি ১৫০ টাকা করে নেয়। কুমারগাঁও থেকে সুনামগঞ্জ শহরে যেতে ১৪০ টাকা করে লোকাল বাস আছে। আর এসি বাস ১৯০ টাকা। সুনামগঞ্জ পৌঁছে সিএনজি নিয়ে তাহিরপুর যাই। সেখানে নেমে টাঙ্গুয়ার হাওরে যেতে ১০ জন ব্যবহার করা যায় এমন একটি লঞ্চ পেলাম ১৫০০ টাকায়। সঙ্গে নিলাম কিছু নাশতা। টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তম জলমহালগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলাস্থিত জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওর বাংলাদেশের ২য় রামসার এলাকা। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। শীত মৌসুমে ব্যাপক পাখির আগমন ও অবস্থানে মুখরিত হয় টাঙ্গুয়ার হাওর।

আমাদের ঝটিকা সিলেট সফরে চোখের আরাম দিয়েছে, মনকে করেছে শান্ত। আপনারাও জীবন যখন নানামাত্রিক ক্লান্তিতে বিপর্যস্ত, তখন চা, পাহাড় ও হাওরের লীলাভূমি সিলেটে ভ্রমণ করে পেতে পারেন নতুন উদ্যম।


উত্তরের পথে: একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

ছবি: সংগৃহীত
আপডেটেড ১০ নভেম্বর, ২০২২ ১৮:০৫
অবক্র (জানেআলম শাওন)

হঠাৎ ডাকা মিটিং শেষ করেই মানিক ভাইকে ফোন করে বললাম ভাই তাড়াতাড়ি চলে আসেন। মানিক ভাই আর আমি একসাথে অফিসে যাওয়া আসা করি তার গাড়ীতে। বললাম, আমার বাস রাত সাড়ে আটটায়। মানিক ভাই খুব একটা অবাক হল না। তিনি জানেন হঠাৎ করে ট্রাভেল করার বদ অভ্যাস আমার আছে। এবারের গন্তব্য উত্তরের জেলা লালমনিরহাট। ঘড়িতে তখন সোয়া ছয়টা বাজে। আমি আছি বনানীতে, গুলশান ২ এর অফিসে গিয়ে বাক্স পেটরা (ল্যাপটপ) রেখে তারপর অফিস থেকে বের হতে হবে। এই সময় অত্যধিক ট্র্যাফিক থাকে, তার উপর আজ বৃহস্পতিবার। অফিসের গাড়ীর অপেক্ষা না করে আমি বনানী থেকে গুলশানের দিকে ম্যারাথন হাঁটা হাঁটছি। আমি হাঁটছি আর ভাবছি, কেন যে এমন হয় ? যেদিনই একটু আর্লি অফিস থকে বের হতে চাই, সেইদিনই শেষ সময়ে এমন একটা কাজ একটা এসে জোটে। এদিকে বারবার গিন্নীর ফোন। শুধু বললাম আটটার ভেতরে চলে আসব ইনশাআল্লাহ্‌। তুমি রেডি থেকো। ততক্ষণে কথা বলতে বলতে আমি অফিসে পোঁছে গেলাম।

অফিস থেকে বের হয়ে দেখি মানিক ভাই নিচে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি বললাম চলেন, আমাকে একটু মাজার রোডে ড্রপ দিতে হবে। দূরত্বের সাথে সময়ের তুলনা করলে ঠিক সময়ের মধ্যে বাসায় পৌঁছানোর কথা। কিন্তু বর্তমান অবস্থার সাথে তুলনা করলে আমি অলরেডি লেট। বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা সোয়া আটটা বেজে গেল। হাতে আছে আর ১৫ মিনিট। কোন রকম নাকেমুখে কিছু দিয়ে বাসা থেকে যখন রওনা হলাম তখন আটটা পঁইত্রিশ বাজে। আমরা যখন কাউন্টারের কাছাকাছি হঠাৎ সুপারভাইজরের ফোন। আপনারা কি সাভার থেকে উঠবেন? আমি বললাম, জী। জবাবে সে বলল, আমাদের বাস সাড়ে নয়টার দিকে আসবে। রাস্তায় জ্যাম আছে। আপনারা কাউন্টার এর সামনে থাকবেন। যাক ভালই হল। ট্রাফিক জ্যামেরও ভাল দিক আছে।

বাসস্ট্যান্ডে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে অপেক্ষা করছি। প্রতিটি কাউন্টার কানায় কানায় পূর্ণ। অপেক্ষমান যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। ফেরিওয়ালাদের চোখেও একটা ফুরতি ফুরতি ভাব। কেউ বাদাম, সিগারেট, চা, বাচ্চাদের বই, আবার অনেকে নানান ধরণের খেলনা বিক্রি করছে। এক ফেরিওয়ালা, বাঁএদেমম বাঁএদেমম (বাদাম, বাদাম) বলে ডাকছে, একেবারে ছন্দময় সুর। আমিও এই বাঁএদেমম বলে তাকে কাছে ডাকলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম মামা বেচাকেনা কেমন? এই বিশসুদবার (বৃহস্পতিবার) রাইতে একটু বেচাকিনি ভালা অয়। বুজেন না মাসের পরথম সপ্তা পাবলিক এ বেতন পাইছে, আর দেশে যাওয়ার লিগা ছুটছে। ট্যাঁকা পয়সা ভাইংগা, ফিরা আইসা আবার ফকিরান্তি হালে চলব। কি দিমু? বাদাম না বুট। বাদাম খাওয়া শেষ করে, আমি পাশের চায়ের দোকান থেকে কফি আনার জন্য গেলাম। দোকানের নাম, আমু মিয়ার এস্পিশাল চা-কপি ও শিংগারা চমুছা। বিভিন্ন আইটেম ফ্লেভারের চা পাওয়া যায়। কফি চা থেকে শুরু করে কমলা চা, মালটা চা, কাঁচামরিচের চা, তেঁতুলের চা, হরলিক্স চা, তুলসি চা কিছুই বাদ নেই। কফি খেতে খেতে আমাদের বাস চলে আসল।

অবশেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসে উঠলাম। দূরে নুতুন কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য সবসময় আমার একেবারে সামনের সারির সিট পছন্দ। কেননা সব দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। আমার ছোট মেয়েটাও সর্ব সামনের সিট ছাড়া একদম জার্নি করতে চায় না। এইবারের জার্নিতে বাচ্চারা নেই। কেননা মাত্র একদিনের জন্য প্ল্যান। সকালে নেমে সারাদিন ঘুরে রাতের গাড়ীতে আবার ব্যাক করব বা বড়জোর তার পরেরদিন। উত্তরের জেলাগুলো ঘুরতে আমার বরাবরই খুব ভাল লাগে। কেমন যেন প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে আলাদা একটা সারল্য আছে। এখন নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। শীতের আলাদা একটা গন্ধ আছে। এটা শহরে বসে অনুভব করা যায় না। তাই শীতের এই আগমনীতে ঘুরতে যাওয়ার জন্য মনটা আকুল হয়ে উঠে।

আমি হেডফোন বের করলাম গান শোনার জন্য। আমার মোবাইল এ টুংটাং ম্যাসেজ, নোটিফিকেশান আসছে। হঠাৎ লক্ষ্য করে দেখলাম কাল থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট, তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে। কি করবো বুছতে পারছি না। মনে হয় ফিরে যেতে হবে। আবার ফিরে যেতেও মন চাইছেনা। দ্বিধার মধ্যে পরে গেলাম। ততক্ষণে আমরা টাঙ্গাইল পার হয়ে গেছি। রাস্তায় নামার মত কোন জায়গা পাচ্ছি না এবং এতো রাতে নামা উচিৎ হবে না। ধর্মঘট ডাকার আর সময় পেল না। নানান কিছু ভাবছি। আমি সুপারভাইজরের সাথে ব্যাপারটা রি-কনফার্ম করার জন্য কথা বললাম। উনি বললেন, ফিরে না গিয়ে আপনারা ট্রেন এ চলে আসবেন। ট্রেনের তো আর ধর্মঘট নেই। দেখলাম ভদ্রলোকের কথা মানা যায়। আমি কানে হেডফোন দিয়ে, গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি বলতে পারব না। আমার ঘুম ভাঙল সুপারভাইজরের ডাকে, রেস্টুরেন্ট এ বিরতির সময়। রেস্টুরেন্ট খেতে খেতে স্ত্রীকে ধর্মঘটের কথা বললাম। ও বলল, চল বাসায় ফেরত যাই। আমি বললাম ট্রেনে আসা যাবে। আর যদি একান্তই সমস্যা হয়, তাহলে আমরা সৈয়দপুর থেকে ফ্লাইট এ চলে আসব। শেষমেশ অর্ধ ইচ্ছা নিয়ে আমরা বাসে এসে বসলাম।

রাত্রির তৃতীয় প্রহরে আমাদের বাস বগুড়া রংপুর হাইওয়েতে ছুটে চলছে দুরন্ত গতিতে। রাস্তা সম্প্রসারনের কাজ চলছে, কুয়াশা না ধুলোবালি ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার দুই পাশে কোন গাছ পালা নেই। একটা মরুভুমি মরুভুমি ভাব। মহাসড়কের সৌন্দর্য হল দুই পাশের সারিসারি গাছ। যা একপাশ থেকে আরেক পাশে গলাগলি ধরে দাড়িয়ে থাকে। গাড়ী থেকে সামনের দিকে তাকালে মনে হবে টানেলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।

আমাদের ঘুম ভাঙল প্যাসেঞ্জারদের চলাচলের শব্দে। ততক্ষণে আমার লালমনিরহাট এসে পৌঁছেছি। আমাদের বাস কিছুক্ষণের জন্য বিরতি দিয়েছে। আমি বাস থেকে নিচে নামলাম, ফজরের নামাজ পরার জন্য। বেশ শীত অনুভূত হচ্ছে। নামায শেষে আমাদের বাস রওনা করলো বুড়িমারীর উদ্দেশে। আমাদের গন্তব্যস্থল পাটগ্রাম। সেখান থেকে যাব দহগ্রাম, তিন বিঘা করিডর। সকালের শুভ্র কুয়াশা ভেদ করে আমাদের বাস ছুটে চলছে। রাস্তার উপর শালিক, চড়ুই, ঘুঘু ,পায়রা ইত্যাদি পাখিদের বিশাল সমাগম। বেশ সতর্ক ভাবে তারা প্রাতরাশ করছে, বাস কাছাকাছি আসা মাত্রই তারা উড়ে যাচ্ছে নিরাপদে। পথের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে আমরা পাটগ্রামে পৌছলাম। সকাল প্রায় আটটা বাজে। ফ্রেশ হওয়া দরকার। আশেপাশের কোন বাসায় যেতে পারলে ভাল হতো। তাছাড়া আমাদের ব্যাগ- প্যাকটা কোথাও রাখা দরকার। আমরা মুক্তহস্তে যেতে চাচ্ছি তিন বিঘা করিডর। দূরত্ব এখান থেকে ৯ কিলোমিটার।

পাটগ্রাম বাজার থেকে একটু হাটার পরই কতগুলো বাড়ি দেখতে পেলাম। একটা বাড়ির দরজায় নক করে সাড়া না পেয়ে পরের বাড়িটিতে ঢুকলাম। সকাল সকাল অপরিচিত আগন্তক দেখে বাড়ির কত্রী একটু অপ্রস্তুত। আমরা এগিয়ে গিয়ে বললাম, আপা, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আমাদের একটু ফ্রেশ হওয়া দরকার। আপনাদের ওয়াশ রুমটা কি একটু ব্যবহার করা যাবে? ভদ্রমহিলা সাবলীলভাবে বললেন আমাদের একটা রুমে দেখিয়ে দিলেন। একটু পর বাড়ীর কর্তা এলেন। নাম হেলেনুর আলম সুমন। উনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই, আমরা এখানে কেন এসেছি তা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। সুমন ভাই আমাদের বিশ্রাম নিতে বলে, ফোন করে বেড়াতে যাবার জন্য একটা অটোর ব্যবস্থা করে দিয়ে বাইরে চলে গেলেন। আমরা ফ্রেশ হয়ে দেখি অটোচালক হাজির এবং আমাদের জন্য চা নাশতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা বেশ অপ্রস্তুত হলাম এই আতিথেয়তায়। চা নাশতা খেয়ে বের হয়ে গেলাম, তিন বিঘা করিডোরের দিকে। শুরু হল আমাদের লালমনিরহাট ভ্রমণ।

ধর্মঘটের কথা মাথায় রেখে, ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য আমার অফিসের কলিগ সারোয়ারকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু সে ফোনে জানালো কোন টেকেট পাচ্ছে না। ট্রেনের ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। কিভাবে ফিরে যাব এ নিয়ে আর বাড়তি কোন টেনশন করে বেড়ানোটার রসভঙ্গ করতে চাচ্ছি না। এখন ঘুরে বেড়ানোটাই আমার কাছে মুখ্য।

আমরা তিন বিঘা করিডোরে এসে দেখলাম, সীমান্তের কাটাতারের বেড়া। ওপারে অন্য একটি দেশ। তারপরে আবার আমার মাতৃভূমির আরও একটি অংশ, দেশের ভেতর আরও একটি দেশ। ভাবতেই শিহরণ লাগছে। আমাদের সামনেই বিজিবির চেকপোস্ট। আমরা ছবি তোলার জন্য থামলাম। কিন্তু সাইনবোর্ডে লেখা আছে ছবি তোলা ও ভিডিও করা নিষেধ। তবে বিজিবির পারমিশন নিয়ে, নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় থেকে ছবি তোলা যায়। কিন্তু করিডোরের ভেতরে ছবি তোলা ও ভিডিও করা সম্পূর্ণ নিষেধ। আমরা এখন করিডোর এ প্রবেশ করলাম, অটোরিকশা চলছে খুব ধীর গতিতে। চারিদিকে গাছ পালায় ঘেরা। নানা ধরণের ফুলের গাছ। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা পাহারা দিচ্ছে করিডোর। অটো ড্রাইভার জানালো, একসময় এখানে সবার ছবি তোলার অনুমতি ছিল। করিডোর পার হতেই ওই পারেই আবার বিজিবির ক্যাম্প। আমরা নেমে কিছু ছবি তুললাম এবং কিছু চকলেট কিনলাম বাচ্চাদের জন্য। দামও তুলনামূলকভাবে কম। বিজিবি ক্যাম্প থেকে মিনিট পাঁচেক যেতেই সামনে ছোট্ট একটি বাজারের মধ্যে আসলাম। কাঁটাতারের ওপাশে ভারতীয় গ্রামের ঘরবাড়ী দেখা যাচ্ছে, যা এপারের বাড়ীগুলোর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আমাদের যেহেতু আজকেই ফিরতে হবে তাই, সময়ের সল্পতার কারণে পুরো গ্রামটা ঘুরে দেখার সুযোগ হল না।

আমরা ফিরে এলাম পাটগ্রাম বাজারে। ততক্ষণে ঘড়িতে এগারটা। নাশতা করতে অটো ড্রাইভারকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্ট ঢুকলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে সিএনজি রিজার্ভ করে ফেললাম। তিস্তা ব্যারেজ, কাকিনা ও তুশভাণ্ডার জমিদার বাড়ি হয়ে, রংপুর যাব। সেখান থেকে বাস অথবা ট্রেন করে ঢাকা। আপাতত এই প্ল্যান।

বাঙ্গালীর ঐতিহ্য রক্ষাথে মিষ্টি কিনে সুমন ভাইয়ের বাড়ীতে গেলাম। কিন্তু আপা এবং সুমন ভাইয়ের বাবা আমাদের তখন ছাড়তেই নারাজ। পরে বাচ্চাদের কথা বলে তাদের কাছ থেকে বিদায় পেলাম। তবে দুপুরে খাওয়ার শর্তে। সাদা চালের ভাত, সালাদ, সবজি ভাজি, ছোট মাছের চচ্চরি আর মুলা দিয়ে গরুর মাংস। অসাধারণ রান্না। কিন্তু রেস্টুরেন্টে খেয়ে আমি পুরো লোডেড। আফসোস হচ্ছে। সিএনজি আসার পর পাটগ্রামকে বিদায় জানিয়ে আমরা রওনা হলাম রংপুরের দিকে।

কিন্তু তিস্তা ব্যারেজের কাছে আসার পর বাজারের মধ্যে গাড়ী থামিয়ে সিএনজি চালক জানালো, ঐপাড়ে তিস্তা ব্যারেজ। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে। গাড়ী নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। নদীর পাড়ে এসে দেখি, পায়ে হেঁটে নদী পার হতে হবে। পানি নেই, কোথাও কর্দমাক্ত এবং কোথায় স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা বালি। আবার কোথায় কোথাও পাথরের ব্লক। এ অবস্থা দেখে আমি বললাম, যাব না। আমার স্ত্রী বলল, এতো কাছে এসে ফিরে যাওয়ার কোন মানে নেই। পরে শুধু শুধু আফসোস করতে হবে। আমরা দুজনে হাঁটা শুরু করলাম। ওপার থেকে অটো নিয়ে চলে গেলাম তিস্তা ব্যারেজ। জায়গাটা সুন্দর, তবে আমার কাছে খুব একটা ভাল লাগল না। আসলে অবসন্ন ও ক্লান্তি মন নিয়ে কোন কিছু উপভোগ করা কঠিন। আমরা কিছু ছবি তূলে তিস্তা ব্যারেজ প্রস্থান করলাম। নদীর পারে নামতেই, দশ-বারো ছোট্ট একটি ছেলে আমাদেরকে বলল, নৌকা আছে আপনারা যাবেন ঐপাড়ে। বিশ টাকা লাগবে। একটু হাঁটার পরে আমরা ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকাটিতে উঠলাম। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর পানি হবে। যেতে যেতে ছেলেটি বলল, এইখানে রাস্তা ছিল। সপ্তাহ দুএক আগে বানের পানিতে ভেঙে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, এখন বন্যা হয়। বলল, সুইচ (স্লুইস) গেট খুলে দিছিল, তাই। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমরা পাড়ের কাছাকাছি নামলাম। সেই সাথে দেখা শেষ হল আমাদের তিস্তা ব্যারেজ।

আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। সেই সাথে ক্লান্তি বেড়ে যাচ্ছে। আমরা কাকিনা বাজারে পৌছালাম। কিন্তু কাকিনা জমিদার বাড়ীতে আর যেতে ইচ্ছে না করায়, সেটা আর দেখা হলো না এ যাত্রায়। রংপুর যেতে যেতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল। রংপুর-ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে পৌছে দেখলাম, দুই একটা বাস কাউন্টার খোলা দেখে, মনে ভরসা পেলাম। কিন্তু কাউন্টারগুলোতে গিয়ে জানতে পারলাম। বাস যাবে না। প্রায় এক ঘণ্টা বসেও কোথাও বাস পেলাম না। হোটেলে উঠা ছাড়া উপায় রইলো না। মোবাইল সার্ফিং করে চার-পাঁচটা মানসম্মত হোটেল খুঁজে বের করলাম। মহা দুশ্চিন্তা শুরু হল হোটেলে ফোন দেওয়ার পর থেকে। হোটেলগুলোতে রুম আছে কিন্তু ম্যারিজ সার্টিফিকেট ছাড়া কাপল অ্যালাউ করে না। আমি বললাম, আমাদের সাথে আইডি কার্ড আছে। ওপাশ থেকে বলল স্যরি, কিছু করার নেই। আমি আরও বেশ কয়েকটি হোটেলে ফোন দিলাম। কিন্তু সবার এক উত্তর। পরে রিক্সা নিয়ে খোঁজ ‍শুরু করলাম। তাতেও লাভ হলো না। হঠাৎ আমার স্ত্রী বলল, তোমার কাছে কি আমাদের পাসপোর্টের কপি আছে। আমি বললাম তাইতো, এটা দিয়ে তো কাজ হওয়ার কথা। তাই দেরি না করে পায়রা চত্বরের একটা প্রসিদ্ধ হোটেলে ফোন দিলাম এবং বললাম আমার কাছে পাসপোর্টের কপি আছে। বলল স্যার, ইমেইল করেন। ইমেইল করে কিছুক্ষণ পর ফোন দেয়ার পর লোকটি বলল, আপনারা চলে আসেন। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। রিকশাওয়ালা চাচাকে বললাম, চাচা চলেন। সে এতক্ষণের গল্পের কিছুই জানে না। তাকে নিয়ে বিভিন্ন হোটেলে ঘুরেছি। রিকশা থেকে যখন হোটেলের সামনে নামলাম। চাচা আমার স্ত্রীকে বলল, মা আপনারা চাইলে আমার বাসায় যেতে পারেন। আমার বাসায় দুইটা থাকার ঘর আছে। আমরা রীতিমত বিস্মিত। সাধারন মানুষ, কিন্তু কি অসাধারণ মন মানসিকতা। আমরা চাচাকে শুকরিয়া জানিয়ে বিদায় নিয়ে হোটেলে ঢুকলাম। পাসপোর্ট কপি দিয়ে চেক ইন করলাম। রুমে গিয়ে সস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। রাতে রেস্টুরেন্টে হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে রুমে ফিরে, পরদিন সকালে কোথায় যাব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম।

সকালে গিন্নীকে বললাম, আমরা নাশতা খেয়ে ভিন্ন জগত যাব। ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা হলাম ভিন্ন জগতের দিকে। প্রথমে রিকশা নিয়ে মেডিকেলের মোড়। ঐখান থেকে অটোরিকশা করে পাগলাপীর বাসস্ট্যান্ড। তারপরে আর একটা রিকশা নিয়ে ভিন্ন জগত। জনপ্রতি এন্ট্রি ফি একশ টাকা। কাউন্টার মাস্টার আমাকে দুইটি প্লাস্টিকের কয়েন ধরিয়ে দিলো। কয়েন নির্দিষ্ট জায়গায় ড্রপ করলে গেট খুলে যাচ্ছে। একদম ডিজিটাল ব্যবস্থা। ভেতরে ঢুকতেই আমরা অবাক। কি বিশাল আর গোছানো। লেক, বাচ্চাদের রাইডস, নানান ফুলের গাছ পরতে পরতে সাজানো। কিছুদূর হাঁটতেই একটা কালো রঙের হাতীর বিশাল স্ট্যাচু। হাতীটি তার বিশাল গজদন্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই ওয়াটার পার্ক। করোনার কারনে অনেক রাইড বন্ধ। আর একটু হাঁটতে হাঁটতে বিশাল গাছপালায় ভরা একটা জায়গায় এসে পৌঁছালাম। উপর থেকে হঠাৎ করে কয়েকটি জলপাই আমাদের পাশে এসে পড়ল। তাকিয়ে দেখি, গাছে থোকা থোকা জলপাই ঝুলছে। আমার স্ত্রী অতি উৎসাহ নিয়ে ছড়িয়ে থাকা জলপাই কুড়াচ্ছে। আমরা লেকের পাড় ধরে হাঁটছি, কিছুদুর পরপর বিভিন্ন পাখী, জলপরি, ডলফিন ইত্যাদির স্ট্যাচু সাজানো আছে। কিছুদূর যেতেই একটা ড্রাগন পার্ক, সাথে রোলার কোস্টার। এরপর ঢুকলাম তাজমহল দেখতে। এন্ট্রি ফি পঞ্চাশ টাকা। পুরো আলাদা একটা এরিয়া নিয়ে করা হয়েছে। ভেতরে তাজমহল, আইফেল টাওয়ার, মিনি চিড়িয়াখানা, পিরামিড ও মস্কোর ঘণ্টার আদলে সব বানানো। আমরা সব কিছু প্রফুল্ল মনে উপভোগ করলাম। ফেরার পথে কিছু সুভিন্যির এর দোকান থেকে বাচ্চাদের জন্য কেনাকাটা করে ভিন্ন জগত থেকে বের হলাম।

দুপরের লাঞ্চ সেরে আমরা রওনা দিলাম তাজহাট জমিদার বাড়ি দেখার জন্য। জনপ্রতি বিশ টাকা টিকেট। ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে বিশাল সাজানো বাগান। বাগানের গাছগুলো কেটে বিভিন্ন ধরণের নকশা করে ফুল বানানো হয়েছে। একরকম কিছু ছোট গাছগুলোকে কেটে এক জায়গায় একটা নৌকা আকৃতি বানানো হয়েছে। একটু ভেতরে যেতেই দেখলাম বিশাল আকৃতির জমিদার বাড়িটি সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটি দেখতে আহসান মঞ্জিলের মতো। এই জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা মান্নানলাল রায় সুদূর পাঞ্জাব হতে এসেছিল। তিনি স্বর্ণ, হিরা, জহরতের ব্যবসা করতেন। জানা যায়, এই জমিদার বাড়ীর কল্যাণেই, আজ বংপুর হাড়িভাঙ্গা আমের জন্য প্রসিদ্ধ। আমরা বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করলাম। বিশাল বিশাল রুম। পুরো বাড়ীতে সৌখিনতার ছাপ এখনও স্পষ্ট। একসময় এই বাড়ীটি কোলাহল ও জাঁকজমক পূর্ণ ছিল।

জমিদার বাড়ি দেখা শেষ করে আমরা যাচ্ছি কারমাইকেল কলেজে। উত্তরবঙ্গের তো বটেই দেশের অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এটি। ১৯১৬ সালে রংপুরে স্থাপিত কলেজটি এবং এর নামকরণ করা হয় লর্ড ব্যারন কারমাইকেলের নামানুসারে। সৃষ্টিলগ্ন থেকেই বৃহত্তর রংপুরের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক অবদান রেখে আসছে এই প্রতিষ্ঠানটি। দেশের অনেক গুণীজন এই কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়ন্ত বিকেল আমরা কলেজ ক্যাম্পাস এ প্রবেশ করলাম। গাছপালায় ঘেরা সুন্দর ক্যাম্পাস। এখানে আছে আফ্রিকান এক গাছ। নাম কাইজেলিয়া ট্রি। গাছটির সামনে একটি সাইনবোর্ডে লেখা আছে “দাঁড়াও পথিকবর -আমার নাম কাইজেলিয়া। আমার বাস আফ্রিকা হলেও কতিপয় বৃক্ষ প্রেমিক আমাকে আনুমানিক ১৯২০ সালের দিকে এখানে রোপণ করেছিলেন। কারমাইকেল কলেজ ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও আমাকে দেখতে পাবে না।” গাছটি মাঝামাঝির চেয়ে একটু বড় এবং ছড়ানো। গাছে অনেক ফল ধরে আছে অনেকটা মেহগনি ফলের মতো দেখতে। তবে এই ফল বিষাক্ত। ক্যাম্পাস ঘোরা শেষ করে আমরা ফিরে যাচ্ছি রংপুর শহরে।

বাসস্ট্যান্ডে এসে জানতে পারলাম আজকেও বাস চলবে না। বাচ্চাদের জন্য মন ছটফট করছে। কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এর মধ্যে আমার ওয়াইফের এক কাজিন ফোন দিল খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। আমি আমাদের বর্তমান অবস্থান এবং সমস্যার কথা বললাম। ও তখন জানালো, পরিচিত একটা রেন্ট-এ-কারের গাড়ী রংপুর গেছে। কালকে সকালে ঢাকা ফিরবে। আপনাদের পিক করে নিয়ে আসবে। সাড়ে তিন হাজার ভাড়া। ড্রাইভারের নাম্বার নিয়ে তাড়াতাড়ি কনফার্ম করে ফেললাম। বললাম সকাল আটটার মধ্যে আমাদের পিক করতে। এখন অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছি। একেবারে চিন্তামুক্ত। আমার স্ত্রী বলল, যাক গাড়ীর ব্যবস্থা যেহেতু হয়েছে, তাহলে একটু কেনাকাটা করা যায়। কেনাকাটা সেরে রাতের খাবার খেয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আর আমি ভাবছি, যেহেতু গাড়ী নিয়েছি, তাই যাওয়ার সময়, পায়রাবন্ধ ও গাইবান্ধাটা ঘুরে যেতে পারলে ভাল হতো। সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে হোটেল এ নাশতা করলাম। এরপর চেক আউট করে বের হয়ে গেলাম। আমাদের গাড়ী ততক্ষণে চলে এসেছে। আমি সঙ্গত কারনেই গাড়ীর সামনে বসেছি। দুরের পথ, ড্রাইভারের সাথে কথা বলতে বলতে যেতে হবে আরকি। প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যেই আমরা পায়রাবন্দ পৌঁছে গেলাম। মিনিট বিশেকের মধ্যে আমার বেগম রোকেয়ার বাড়ির অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ ও বাড়ি সংলগ্ন বিশাল বেগম রোকেয় স্মৃতিকেন্দ্র ঘুরে দেখলাম। কিন্তু রাস্তায় আমার স্ত্রী কিছুটা অসুস্থ্য বোধ করায় এবার আর গাইবান্ধায় যাওয়া হলো না। তবে বগুড়া থেকে দই-মিষ্টি কিনে আমাদের স্বল্প সময়ের ট্যুর হিসেবে দেশের উত্তর জনপদ ঘোরার সমাপ্তি করলাম।


banner close