শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

গম উৎপাদন বৃদ্ধিতে আধুনিক প্রযুক্তি

আপডেটেড
৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৫:০৩
মো: আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি
প্রকাশিত
মো: আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি
প্রকাশিত : ৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৫:০৩

বিশ্বের অন্যতম দানাদার খাদ্যশস্য গমের অবস্থান বাংলাদেশে দ্বিতীয়। স্বাধীনতার পর ধানের মতো গম উৎপাদন আশানুরূপ বাড়েনি। দেশে বছরে গমের চাহিদা কম-বেশি ৭০ লাখ টন। আর দেশে উৎপাদিত গমের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে শীতের স্থায়িত্ব কমে যাচ্ছে বলে গবেষকদের মতামত। আর এ কারণে গম আবাদও কমে যাচ্ছে। তবে গম আবাদ বৃদ্ধির জন্য উন্নত জাত, শ্রমিক সংকট, ইঁদুরের উপদ্রব, মাড়াইয়ের সমস্যা, গমের ব্লাস্ট রোগ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এসব বিষয়ে দৃষ্টি দিলে গম আবাদে আবারো সুদিন ফিরে আসবে বলে আশা করা যায়।

গমের আধুনিক জাত :

বারিগম-২৮, বারিগম-২৯, বারিগম-৩০, বারিগম-৩১, বারিগম-৩২, বারিগম-৩৩, ডব্লিউএমআরআই গম ১, ডব্লিউএমআরআই গম ২, ডব্লিউএমআরআই ইত্যাদি গমের আধুনিক বা উন্নত জাত।

ডব্লিউএমআরআই গম-২ জাতটি উপর্যুক্ত পরিবেশে হেক্টর প্রতি ফলন ৪৫০০-৫৮০০ কেজি। আর ডব্লিউএমআরআই গম-৩ জাত উপযুক্ত পরিবেশে হেক্টরপ্রতি ফলন হয় ৪০০০-৪৫০০ কেজি। এছাড়া গমের উভয় জাতগুলি তাপসহিষ্ণু, ব্লাস্ট রোগ, পাতার দাগ রোগ এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধী। আর উভয় জাত গুলি খাটো হওয়ায় সহজে হেলে পড়ে না। বারি গম ৩৩ জাতটি গমের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী। এছাড়া জাতটি পাতার দাগ রোগ সহনশীল এবং মরিচা রোগ প্রতিরোধী। জাতটি স্বল্প মেয়াদী এবং তাপ সহনশীল হওয়ায় দেরিতে বপনের জন্য খুবই উপযোগী।

বপনের সময়:

জাতগুলি বপনের উপযুক্ত সময় নভেম্বর মাসের ১৫ থেকে ৩০ পর্যন্ত (অগ্রহায়ণ মাসের ১ম থেকে ২য় সপ্তাহ পর্যন্ত) । তবে বারি গম ৩৩ জাতটি মধ্যম মাত্রার তাপসহনশীল হওয়ায় ডিসেম্বর মাসের ৫-১০ তারিখ পর্যন্ত বুনলেও অন্যান্য জাতের তুলনায় বেশী ফলন দেয়। তবে উত্তরাঞ্চলে আরোও ৭ দিন পর অর্থাৎ ২২ শে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত বপন করা যাবে।

বীজ শোধন:

গম ছত্রাকজনিত ব্লাস্ট, পাতার মরিচা ও দাগ রোগ এবং অন্যান্য বীজ বাহিত রোগ আক্রান্ত হয়ে থাকে। গমের চারা অবস্থা থেকে শীষ বের হওয়া এবং ফুল ফোটার সময় পর্যন্ত তুলনামূলক গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এসকল রোগের আক্রমণ ঘটে থাকে। গমের বীজ শোধন করে বপন করা হলে এসকল রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব।

বীজ হার ও সেচ প্রয়োগ:

সেচযুক্ত চাষের জন্য বিঘা প্রতি ১৬ কেজি এবং সেচবিহীন চাষের জন্য বিঘা প্রতি ১৩ কেজি বীজ বপন করতে হবে। ভালো বীজ উৎপাদনের জন্য পরিমিত সেচ দেওয়া প্রয়োজন। মাটির প্রকার ভেদে গম আবাদে ২-৩টি সেচের প্রয়োজন হয়।

প্রথম সেচ - ৩ সপ্তাহ পর উপরি সার ইউরিয়া দিয়ে (বপনের ১৭-২১ দিন পর)

দ্বিতীয় সেচ - শীষ বের হওয়ার আগে (বপনের ৫০-৫৫ দিন পর)

তৃতীয় সেচ - দানা গঠনের সময় (বপনের ৭৫-৮০ দিন পর) দিতে হবে।

তবে শুষ্ক আবহাওয়ায় ভালো ফলনের জন্য অতিরিক্ত এক বা দুটি সেচ প্রয়োজন হয়। প্রথম সেচটি খুবই হালকাভাবে দিতে হবে। তা না হলে অতিরিক্ত পানিতে চারার পাতা হলুদ হতে পারে বা চারা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেজন্য সেচের পরপরই জমি থেকে অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে। তাই বপনের পর জমির ঢাল বুঝে ২০-২৫ ফুট অন্তর অন্তর নালা কেটে রাখতে হবে।

বেডপ্লান্টারের সাহায্যে বীজ বপন:

বেড প্লান্টার, আধুনিক কৃষি যন্ত্র বাঁচাবে শ্রম সময়, যোগাবে অর্থ। প্লান্টার হলো সিডারের উন্নত ভার্সন। এর সুবিধা হলো বেডে ফসল চাষ করলে সেচ খরচ ও সময় ২৫% কম হয় এবং এক্ষেত্রে শ্রমের সাশ্রয় হয়। সিডার যন্ত্রে শুধু সারি থেকে সারির দূরত্ব নির্ধারিত থাকে। কিন্ত বেড প্লান্টার যন্ত্রে সারি থেকে সারির দূরত্বের পাশা-পাশি সারিতে বীজ থেকে বীজের নির্ধারিত দূরত্ব ও বজায় রাখে।এ যন্ত্রের সাহায্যে ঘন্টায় ২৫-২৭ শতাংশ জমিতে বীজ বপন করা যায়। যন্ত্রটি দিয়ে গম, ভূট্টা, মুগ, তিলসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি বীজ সফলভাবে বপন করা যায়। যন্ত্রটি দিয়ে ১-২ চাষে বেড তৈরি, সার প্রয়োগ ও বীজ বপনের কাজ একই সাথে করা যায়।

বীজ সংরক্ষণ :

সংরক্ষণের পূর্বে মাড়াইকৃত বীজ পরপর ২-৩ দিন রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে বীজের আর্দ্রতা শতকরা ১২ ভাগ বা তার নিচে নামিয়ে নিয়ে আসতে হবে। শুকনা গম দাঁতে চিবানোর সময় ‘কট’ করে শব্দ করে ভেঙে গেলে বুঝতে হবে ওই বীজ সংরক্ষণের উপযুক্ত হয়েছে। সংরক্ষণের পূর্বে ঝেড়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করার পর চালনি দিয়ে চেলে পুষ্ট বীজ বাছাই করে নিতে হবে। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে বীজের সুস্থতা ও অংকুরোদগম ক্ষমতা বজায় থাকবে।

গমের ব্লাস্ট রোগ :

আক্রান্ত বীজের মাধ্যমে গমের ব্লাস্ট রোগ ছড়ায়। গমের শীষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময় তুলনামূলক গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় থাকলে এ রোগের আক্রমণ ঘটতে পারে। পাতায় চোখের ন্যায় ধূসর বর্ণের ছোট ছোট দাগ পড়ে। শীষের আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ পড়ে। আক্রান্ত স্থানের উপরের অংশ সাদা হয়ে যায়। শীষের গোড়ায় আক্রমণ হলে পুরো শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়। আক্রান্ত শীষের দানা অপুষ্ট হয় এবং কুঁচকে যায় এবং দানা ধূসর বর্ণের হয়। পাতায় ও এ রোগের আক্রমণ হতে পারে এবং এক্ষেত্রে পাতায় চোখের মত ধূসর বর্ণের ছোট ছোট দাগ পড়ে।

রোগের প্রতিকার

  • মাড়াইয়ের পর আক্রান্ত গম ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলতে হবে;
  • উপযুক্ত সময়ে বীজ বপন করতে হবে যাতে শীষ বের হওয়ার সময়ে বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা পরিহার করা যায়;
  • বপনের পূর্বে বীজ শোধন করলে গমের ব্লাস্ট রোগের পাশাপাশি অন্যান্য বীজবাহিত রোগও দমন হবে এবং ফলন বৃদ্ধি পাবে;
  • গমের ক্ষেত ও আইল আগাছামুক্ত রাখতে হবে;
  • টেবুকোনাজল ও ট্রাইফ্লক্সিবিন গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ০.৮ গ্রাম অথবা ডাইফেনোকোনাজল ও এ্যাজোক্সিস্ট্রবিন গ্রুপের ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে শীষ বের হওয়ার সময় একবার এবং তার ১২ থেকে ১৫ দিন পর আর একবার স্প্রে করলে গমের পাতা ঝলসানো রোগ, বীজের কালো দাগ রোগ এবং মরিচা রোগ ইত্যাদিও দমন হবে।

ইঁদুর দমনে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করাঃ

১. বপন পদ্ধতির ওপর ইঁদুরের আক্রমণ কমবেশি হয়ে থকে। যেমন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, সারিতে বপন ছিটিয়ে বপনের চেয়ে ইঁদুরের আক্রমণ কিছুটা কম হয় আবার বেড পদ্ধতিতে গম আবাদ করলে ইঁদুরের আক্রমণ কম হয়।

২. বিষটোপ দিয়ে দমনঃ মাঠে যেখানে ইঁদুরের উপস্থিতি বুঝা যায় সেখানে বা ইঁদুর চলাচলের রাস্তায় বা সতেজ গর্তের আশপাশে জিংক ফসফাইড বিষটোপ কোনো পাত্রে রেখে দিতে হবে। বিষটোপ প্রয়োগের সুবিধা হলো - এই বিষটোপ ইঁদুর বেশি খায় ,অন্য কোন প্রাণী যেমন পাখি, বিড়াল, কুকুর বা অন্যান্য পোষা প্রাণী এই বিষটোপ খেতে পারেনা। এতে অপ্রত্যাশিত প্রাণির মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকেনা। তাছাড়া পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনাও খুব কম। এই পদ্ধতির সফলতা প্রায় ২৫% বেশি। তাছাড়া কৃষক ভাইদের তেমন কোনো বাড়তি খরচ নেই। তাই গর্তের ভিতরের ইঁদুর সফলভাবে দমনের জন্য এই পদ্ধতি বেশ লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা সহজেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন।

৩. বহুমাত্রা বা দীর্ঘমেয়াদি বিষ। যেমন- লানির্যাট, স্টর্ম, ব্রোমাপয়েন্ট, ক্লেরাট। এসব ইঁদুরনাশক খাওয়ার ৬/৭ দিনের মধ্যেই ইঁদুর মারা যায়। এ পদ্ধতির সফলতার হার অনেক বেশি।

৪. গ্যাসবড়ি দিয়ে ইঁদুর দমন : বিষটোপ ছাড়া এক প্রকার গ্যাস বড়ি দিয়েও ইঁদুর দমন করা যায়।

অন্যান্য পরিচর্যা:

বপনের ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে ১ম সেচের পর একটি নিড়ানী দিলে ফলন প্রায় ১০ থেকে ১২ ভাগ বৃদ্ধি পায়। বীজ বপনের পর ১০-১২ দিন পর্যন্ত পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। জমিতে ‘জো’ অবস্থায় আগাছা দমনের জন্য নিড়ানী দিতে হবে। চওড়া পাতা বিশিষ্ট আগাছা (বথুয়া ও কাকরি) দমনের জন্য বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে এফিনিটি নামক আগাছানাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে একবার স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। সময়মতো আগাছা দমন করলে ফলন শতকরা ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পায়।

লেখক: আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার,

কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী


অসময়ে শিম চাষে লাভবান কৃষকরা, ৫ হেক্টরে আয় হবে ৮০ লাখ টাকা

অসময়ে শিম চাষ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। সম্প্রতি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের আশিদ্রোন ইউনিয়নের ডেংগারবন গ্রামে। ছবি: দৈনিক বাংলা
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার

অসময়ে শিম চাষ করে লাভবান হচ্ছেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের আশিদ্রোন ইউনিয়নের ডেংগারবন গ্রামের কৃষকরা। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকৃবি-১ জাতের গ্রীষ্মকালীন আগাম ফলন দেয়া শিম গাছ লাগিয়ে তারা ভালো মুনাফা অর্জন করেছেন। এ বছর গ্রামের প্রায় ২৫ জন কৃষক পাঁচ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন এই শিম চাষ করেছেন। এই আবাদ থেকে কৃষকরা প্রায় ৮০ লাখ টাকা উপার্জন করবেন বলে ধারণা করছে উপজেলা কৃষি অফিস।

ডেংগারবন গ্রামে প্রথম দিকে এই উফশী (হাইব্রিড নয়) শিম আবাদ শুরু করেন আহসান হাবিব। তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালের দিকে আমি কৃষি অফিস থেকে মাত্র ১২টি শিমের বীজ পেয়ে বাড়ির আঙিনায় লাগাই। সেই গাছগুলোর ফলন থেকে বীজ সংগ্রহ করে পরে বড় জায়গা নিয়ে গ্রীষ্মকালীন শিমের চাষ শুরু করি। গত বছর এক বিঘা জমিতে এই শিম চাষে খরচ হয়েছিল ১৮ হাজার টাকা। সেখান থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকার শিম বিক্রি করেছিলাম।’

আহসান হাবিব জানান, এ বছর আড়াই বিঘা জমিতে শিম আবাদে তার প্রায় ৩৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ পর্যন্ত ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকার শিম বিক্রি করেছেন, আরও প্রায় ৩ লাখ টাকার শিম গাছে আছে।

কৃষকরা জানান, গ্রামের প্রায় ২৫ জন কৃষক এই জাতের শিম আবাদ করছেন। প্রতি কেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকেই তাদের কাছ থেকে শিমের বীজ কিনে নেন।

ওই গ্রামের বাসিন্দা নাসির উদ্দীন বলেন, ‘আমি এবার ২০ শতক জায়গায় শিমের চাষ করছি। আমার বাড়ির পাশের আহসান হাবিব চাচা প্রথম দিকে এই শিমের চাষ শুরু করেন। তার কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে আমি নিজেও চাষাবাদ শুরু করি। এটি খুবই লাভজনক।’

শিমের খেতে কাজ করতে আসা ইউনুস মিয়া বলেন, ‘আমি শিমের খেতে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরিতে কাজ করি। এ দিয়ে আমার সংসার চলে। আমার মতো অনেকেই এখন এই গ্রামে শিম গাছের খেতে কাজ করে টাকা উপার্জন করছে। আগামী বছর আমি নিজেও এই শিমের চাষ করব।’

শ্রীমঙ্গল কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শহিদুল ইসলামের কাছ থেকে পাওয়া সিকৃবি-১ জাতের এই শিমের ফলন গ্রীষ্মকালেই বেশি। একটি গাছ লাগানোর ৪০ দিনে ফুল ও ফল আসে, ৫০ দিন থেকে বিক্রির উপযোগী হয়। একটি গাছ প্রায় দুই বছর পর্যন্ত বাঁচে। এই শিম গাছ থেকে সহজে বীজ সংগ্রহ করা যায়।

শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমরা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রীষ্মকালীন শিমের সিকৃবি-১ জাতটির বীজ সংগ্রহ করে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করেছি। কৃষকদের এই গ্রীষ্মকালীন শিম চাষের ওপরে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য উপকরণও সরবরাহ করা হয়েছে। শ্রীমঙ্গলের প্রায় ৫ হেক্টর জমিতে এই গ্রীষ্মকালীন শিমের চাষাবাদ হয়েছে। বাজারে এই সময়ে শিম না থাকায় কৃষকরা ভালো দাম পাচ্ছেন। আশা করা যায়, মাত্র পাঁচ হেক্টর জমি থেকে কৃষকরা ৮০ থেকে ৮৫ লাখ টাকার শিম বিক্রি করতে পারবেন।’

মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা পরীক্ষামূলকভাবে জেলা সদর উপজেলা ও শ্রীমঙ্গলে প্রদর্শনী আকারে করেছি। অনেক কৃষক আগে শিম বীজ সংগ্রহ করেছেন। তারা এখন নিজের জমিতে আবাদ করছেন। আমরা আগামীতে অন্য উপজেলাগুলোতেও পরীক্ষামূলকভাবে এই শিমের আবাদ শুরু করব।’


পাহাড়ে কফি চাষ

আপডেটেড ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১৯:৫৮
মইনুল হক রোজ

জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে পানীয় হিসেবে চায়ের পরেই কফির স্থান। কফি ফলের পরিপক্ব বীজ ভেজে গুঁড়া করে কফি তৈরি করা হয়। বিশ্বের প্রধান কফি উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ভারত, ইন্দেনেশিয়া, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, গুয়েতেমালা প্রভৃতি। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে বিগত কয়েক বছর যাবৎ বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষ হয়ে আসছে। বর্তমানে দেশে পাওয়া অধিকাংশ কফিই আমদানি করা। সেই জায়গা থেকে সরে নিজেরাই কফির চাহিদা মেটানোর সুযোগ নিয়ে এসেছে দেশের পার্বত্যাঞ্চলগুলো।

ভালো দাম পাওয়ায় পার্বত্যাঞ্চলে অনেকেই জুমচাষের পরিবর্তে করছেন কফির আবাদ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সফলতা এসেছে বান্দরবান জেলায়। এর বাইরে খাগড়াছড়িতে অবস্থিত পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষামূলকভাবে কফি উৎপাদিত হচ্ছে, যা গুণগতভাবে আন্তর্জাতিক মানের। রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে রাঙামাটি জেলায় বিভিন্ন স্থানে কফির প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে। তা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় বেশ কিছু কফি বাগান গড়ে উঠেছে। পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের এক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে কফির চাষ লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এ ছাড়া বান্দরবানে কফির কারখানা স্থাপনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, বান্দরবানে জুমচাষের জমি দিন দিন কমে যাওয়ায় অনেক চাষিই এখন ঝুঁকছেন ফলদ ও অর্থকরী ফসলের দিকে। সেখান থেকেই এসেছে কফি চাষের ধারণা। কারণ বান্দরবানের পরিবেশ কফি চাষের জন্য উপযোগী।

কফির চারা বর্ষা মৌসুমে রোপণ করতে হয়। গাছের ছায়া ও মাটির আর্দ্রতা লাগে। আবার বেশি ছায়া হলেও ফলন কম হয়। সে জন্য রোদও লাগে। ফলদ গাছের সঙ্গে কফিগাছের জন্য উপযোগী রোদ-ছায়ার পরিবেশ পাওয়া যায়। সাধারণত কফির চারা লাগানোর দুই বছর থেকে ফলন দেয়া শুরু করে। তৃতীয় বছর থেকে পুরোদমে ফল দেয়। প্রতিটি গাছ ৭০ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। সাধারণত জানুয়ারিতে ফুল আসে, সপ্তাহখানেক পর ফলে পরিণত হয়। নভেম্বরের শেষ দিকে কফি ফল পাকা শুরু করে। এর পরই কফিচাষিরা ফল সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত শুরু করেন। একটি গাছে বছরে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ কেজি পর্যন্ত কফি ফল পাওয়া যায়। একবার ফলন দেয়া শুরু করলে একটানা ৪০ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত কফি পাওয়া যায়। যে কারণে এই এলাকার কৃষকদের কাছে কফি চাষের প্রতি আগ্রহ বেশ বেড়েছে।

দেশে এখন রোবাস্টা ও অ্যারাবিক নামের দুই ধরনের কফি চাষ হচ্ছে। এসব কফির একটি গাছ থেকে বছরে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ কেজি পর্যন্ত কফি ফল পাওয়া যায়। একবার ফলন দেয়া শুরু করলে একটানা ৪০-৫০ বছর পর্যন্ত কফি পাওয়া যায়। এসব উৎপাদিত কফি প্রতি কেজি ৩০০-৩২০ টাকা দরে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় কফিশপ ‘নর্থ অ্যান্ড বা নর্দান অ্যান্ড কফি রোস্ট কোম্পানি’ কিনে নিচ্ছে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে।

এ প্রসঙ্গে বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলবায়ু ও মাটির কারণে পাহাড়ি এলাকা কফি চাষের উপযোগী। বিশেষ করে পরিকল্পিতভাবে লাগানো পুরোনো আমবাগানে কফি চাষের জন্য খুবই উপযোগী। কারণ কফিগাছের ছায়ায় ভালো হয়। বর্তমানে বান্দরবানে কফির ৭৮৮টি জাত ও প্রযুক্তি বাগান এবং ৭৩টি বাণিজ্যিক বাগান রয়েছে। এই বাগানগুলো ছাড়া আগে থেকেই প্রায় ৫৮টি ব্যক্তিমালিকানাধীন কফি বাগান আছে। সেই পুরোনো বাগানগুলো থেকে গেল দুই বছরে, অর্থাৎ ২০২১ ও ২০২২ সালের অগাস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ২৯ টন ‘র’ কফি বিক্রি হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা আরও জানালেন, ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন অব ইউনাইটেড নেশনসের (ফাও) এক রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে উৎপাদিত কফির গুণগত মান সারা বিশ্বে কফি উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়।

বর্তমানে দেশে কফির চাহিদা প্রতি তিন মাসে পাঁচ-ছয় টন। দেশে চাহিদার তুলনায় কফি উৎপাদন হয় খুবই কম। এ জন্য ইথিওপিয়া, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কফি আমদানি করা হয়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে বিগত কয়েক বছর যাবৎ বাণিজ্যিকভাবে যে কফি চাষ হয়ে আসছে, তাতে সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আরও বৃদ্ধি করা গেলে বিদেশ থেকে কফি আমদানি যেমন কমবে, তেমনি একই সঙ্গে দেশীয় কফির বাজার ও উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। আর সেই উৎপাদিত কফি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করার পাশাপাশি নতুন করে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হবে।

বিষয়:

থাই সরপুঁটি চাষ

আপডেটেড ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১৮:১৫
বাংলার কৃষি ডেস্ক

এ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পুকুর-ডোবা-জলাশয়। বেশির ভাগ নিম্নবিত্ত চাষির বাড়ির আশপাশেই রয়েছে একটি বা দুটি মাঝারি আকারের পুকুর কিংবা ডোবা। এসব পুকুর-ডোবায় বছরের অধিকাংশ সময়ই পানি থাকে না। গ্রামাঞ্চলের পতিত এ পুকুর-ডোবাগুলো সামান্য সংস্কার করে অতি সহজেই চাষোপযোগী করা যায়।

এ দেশের গরিব প্রান্তিক চাষিরা স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে এ ধরনের জলাশয়ে থাই সরপুঁটি মাছের চাষ করে পরিবারের প্রয়োজনীয় মাছ তথা আমিষের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি আয়ের একটি নির্ভযোগ্য উৎসের সন্ধান পেতে পারেন।

থাই সরপুঁটি চাষের কিছু সুবিধাজনক দিকও রয়েছে। রুইজাতীয় মাছের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম খরচে, কম সময়েও সহজতর ব্যবস্থাপনায় সরপুঁটি মাছের চাষে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বেশি উৎপাদন পাওয়া সম্ভব। মিশ্র চাষ পদ্ধতি অর্থাৎ রুইসহ অন্যান্য উন্নত প্রজাতির মাছের সঙ্গেও অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে এ মাছ চাষ করা যায়। ছয় মাসে একটি থাই সরপুঁটির পোনা গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম ওজনে উন্নীত হয়ে থাকে। একই পুকুরে বছরে দুইবার এ মাছের চাষ করা যায়।

চাষ পদ্ধতি

এ মাছ চাষের জন্য পুকুরের আয়তন ৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ হতে পারে। এরচেয়ে বেশি হলেও ক্ষতি নেই। তবে এক একরের ঊর্ধ্বে না হলেই ভালো। পুকুরের গভীরতা হবে ১.৫ মিটার থেকে ২ মিটার অর্থাৎ তিন থেকে চার হাত। পোনা ছাড়ার আগে পুকুর ভালোভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। শুকনা মৌসুমে পুকুরের সম্পূর্ণ পানি নিষ্কাশন করে তলার মাটি ১০-১৫ দিন ধরে রোদে শুকাতে হয়। অতঃপর লাঙল দিয়ে কর্ষণ করে নিতে হবে। পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে রাক্ষুসে মাছ ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণী মেরে ফেলার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ পর্যায়ে পুকুর প্রস্তুতির জন্য প্রতি শতাংশে এক কেজি হারে পাথুরে চুন প্রয়োগ করা একান্তই অপরিহার্য।

চুন প্রয়োগের সাত দিন পর প্রতি শতাংশে ৪ কেজি গোবর, ১৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়।

সার পুকুরের তলার মাটির ওপর ছড়িয়ে দিয়ে কোদালের সাহায্যে ভালোভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পর শিগগিরই পুকুরে পানি দিয়ে ভরে দেয়া অতীব জরুরি।

মাছের খাদ্য

প্রস্তুতকৃত পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য প্লাঙ্কটনের পর্যাপ্ত মজুত সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে প্রতি শতাংশে ১.৫ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি সাইজের ৬০-৬৫টি থাই সরপুঁটির পোনা ছাড়া যেতে পারে। পুকুরে যে পরিমাণ মাছ আছে, সে মাছের মোট ওজনের শতকরা চার থেকে ছয় ভাগ হারে চালের কুঁড়া বা গমের ভুসি সম্পূরক খাদ্য হিসেবে প্রতিদিন সকাল ও বিকালে দুইবার পুকুরের সর্বত্র ছিটিয়ে দিতে হবে। প্রতি মাসে একবার জাল টেনে মাছের গড় ওজন নির্ধারণ করে খাবার পরিমাণ ক্রমশ বাড়াতে হবে। পুকুরে মাছের খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতি শতাংশে ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ওই পরিমাণ টিএসপি সার প্রয়োগ করা অত্যাবশ্যক। থাই সরপুঁটি সাধারণত নরম ঘাস পছন্দ করে। তাই এ মাছের জন্য ক্ষুদে পানা, টোপা পানা, নেপিয়ার ঘাস, কলাপাতা ইত্যাদি প্রতিদিন সামান্য পরিমাণে হলেও সরবরাহ করা গেলে আনুপাতিক উৎপাদনও সন্তোষজনকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

ওই প্রক্রিয়ায় পাঁচ-ছয় মাস পালনের পর এক একটি মাছের ওজন দাঁড়াবে গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম। এ সময় মাছ বাজারজাত করার পুরোপুরি উপযোগী হয়। সুস্বাদু মাছ হিসেবে বাজারে এ মাছের চাহিদাও থাকে প্রচুর।

তথ্যসূত্র : কৃষি বাতায়ন


কলমাকান্দায় কুমড়া চাষে স্বাবলম্বী কৃষক

আপডেটেড ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১৫:৩৬
সালাহ উদ্দীন খান রুবেল

নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার সদর ইউনিয়নে কুমড়া চাষে স্বাবলম্বী হচ্ছেন কৃষকরা। তারা বলেছেন, ধানের চেয়ে কুমড়াতে খরচ কম আর লাভ হয় প্রায় তিন গুণ বেশি।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ধানের পরিবর্তে কুমড়া চাষ করেছেন অনেকেই। ধান চাষের চেয়ে কুমড়া চাষে খরচ কম। তাই কৃষকদের কুমড়া চাষে আগ্রহ বেড়েছে। আর এ সবজি জাতের ফসল চাষে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেকে। চলতি মৌসুমে কলমাকান্দা উপজেলায় ২০০ হেক্টর জমিতে কুমড়া চাষ করা হয়। এসব জমিতে মিষ্টি কুমড়া ও চাল কুমড়া চাষ করছেন তারা। চাল কুমড়া তরকারি হিসেবে বেশি বিক্রি হয় পাশাপাশি মিষ্টি কুমড়া তরকারিসহ অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করা হয়।

জানা গেছে, কলমাকান্দা উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে ২০০ হেক্টর কৃষিজমিতে চাল কুমড়া চাষ করা হয়েছে, এতে কৃষকদের কৃষিকাজে উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে আসছে কলমাকান্দা উপজেলা কৃষি বিভাগ।

রহিমপুর গ্রামের কৃষক জামাল উদ্দিন জানান, কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় তিনিও ৩০ শতক জমিতে কুমড়া চাষ করেছেন। ফলন ভালো হওয়ায় আগামীতে দ্বিগুণ কুমড়া চাষ করবেন। প্রতি শতক কুমড়া চাষে খরচ হয়েছে ৩০০ টাকা। প্রতি শতকের কুমড়া বিক্রি করেছেন ১ হাজার টাকায়। এতে খরচ মিটিয়ে ৭০০ টাকা করে লাভ হয়েছে। কুমড়া বিক্রি করার পর ওই জমিতে আউশ ধান চাষ করবেন।

কলমাকান্দা উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, কৃষকরা তাদের জন্য কৃষিকাজে পানি সেচের জন্য ৫০ ফুটের একটি করে পাইপ ও মোটর ব্যবহার করছেন। তাতে করে পানির কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

অপরদিকে উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের নাজিরপুর এলাকায় এ বছর চাল কুমড়ার বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা। আগামীতে কুমড়া চাষের ফলন আরও বৃদ্ধি পাবে বলে জানিয়েছে উপজেলা কৃষি বিভাগ।

উপজেলার রহিমপুর এলাকায় ব্যাপক হারে এসব কুমড়ার আবাদ হয়েছে। ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল কৃষিজমিতে এ বছর কুমড়া চাষ এনে দিয়েছে কৃষকদের নতুন গতি। এই উপজেলার উৎপাদিত কুমড়া জেলা শহর নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রির জন্য নেয়া হয়।

উপজেলার সদর ইউনিয়নের রহিমপুর গ্রামের চাষি হানিফ জানান, তিনি এ বছর মাত্র ৩০ শতক জমিতে চাল কুমড়ার চাষ করেন। এতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। কুমড়া বিক্রি করে তার প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা লাভ হতে পারে। এর আগে একই জমিতে আলু চাষ করেও তার ভালো লাভ হয়েছে।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মো. মেহেদী হাসান তরফদার জানান, উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় এবার চাল কুমড়ার বাম্পার ফলন হয়েছে। নিয়মিত কৃষি অফিস থেকে তাদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আগামীতে এর ফলন আরও বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। কৃষকদের উন্নত মানের বীজও দেয়া হবে।

কলমাকান্দা উপজেলা কৃষি অফিসার মো. ফারুক আহমদ জনান, ধান চাষের চেয়ে কুমড়া চাষে খরচ কম। তাই কৃষকদের কুমড়া চাষে আগ্রহ বেড়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে তাদের নিয়মিত বিভিন্ন পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।

লেখক: নেত্রকোনা প্রতিনিধি


শাকসবজি হোক নিরাপদ

আপডেটেড ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১৫:৩৬
কৃষিবিদ তাপস কুমার ঘোষ ও মোছা: সাবিহা সুলতানা

শাকসবজি মানবদেহের প্রয়োজনীয় জৈবরাসায়নিক পুষ্টি উপাদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এতে রয়েছে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম ও আয়রনসহ মানবদেহের জন্য অপরিহার্য খনিজ পদার্থ। উন্নয়নশীল দেশের জন্য শাকসবজি শক্তির মৌলিক উৎস হিসেবে কাজ করে। এটি স্বাস্থ্যের জন্য যেমন অত্যন্ত উপকারী, তেমনি খাদ্য ও আর্থিক নিরাপত্তার জন্যও অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। শাকসবজি সুষ্ঠুভাবে সংগ্রহের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি গুণগত মানও ভালো থাকে। এতে করে কৃষকদের শাকসবজির সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হয় না। তা ছাড়া জলবায়ুগত কারণে কৃষকরা মানসম্মত শাকসবজির ফলন বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের ওপর ভালো লাভ পেতে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ব্যবহার করেন।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে কৃষকরা ব্যাপকভাবে কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন এবং সর্বশেষ স্প্রে ও ফসল তোলার মধ্যে সময়ের উপযুক্ত ব্যবধান মেনে চলেন না। যার ফলে বাজারের শাকসবজিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ থেকে যায়। কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ মানবদেহের সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। ভোক্তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক প্রযুক্তি অনুসরণ করে ফসল সংগ্রহ করে বাজারজাত করা প্রয়োজন। ভোক্তা নিরাপদ সবজি গ্রহণের নিমিত্তে বাজার থেকে কেনা শাকসবজি থেকে বালাইনাশকের অবশিষ্টাংশ অপসারণ জরুরি।

শাকসবজির ধরনভেদে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফসল সংগ্রহের নিয়ম

টমেটো, বেগুন, শসা, কুমড়া এসব সবজিকে বোঁটা থেকে ধারালো ছুরি দিয়ে গাছ থেকে আলাদা করে নিতে হবে। চারাগাছ পাতলা করার সময় ছোট গাছ হিসেবে লালশাক, পালংশাক এসবের শাককে সংগ্রহ করে নিতে হবে। পালংশাক, লালশাক, মুলাশাক সংগ্রহের সময় সম্পূর্ণ গাছটি শিকড়সহ উপড়ে ফেলে সংগ্রহ করতে হয়। শাক হিসেবে ব্যবহারের জন্য পুঁইশাক ও লাউয়ের ডগা প্রুনিং বা গাছের অংশ কেটে সংগ্রহ করে নিতে হবে। আবার বিভিন্ন সবজি সংগ্রহের উপযোগী সময় ও উপযুক্ত অবস্থাভেদে সংগ্রহ করতে হবে। যেমন:

বেগুন: ফল যথেষ্ট কচি অবস্থায় তবে পরিপূর্ণ আকার এবং রং-প্রাপ্তির পর সংগ্রহ করতে হবে।

চারা লাগানোর ৫০-৬০ দিন পরই ফসল সংগ্রহের সময় হয়। ফুল ফোটার ৭-১০ দিন পরই বেগুন সংগ্রহ করা যায়।

লাউ: ফলের ত্বকের লোমশ ভাগ পরিপক্বতার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে, ফলের লোমশ ঘনত্ব দেখেও এর সংগ্রহ উপযোগিতা নির্ণয় করা যায় এবং সংগ্রহ করতে হয়।

শিম: শিম ফুল ফোটার ২০-২৫ দিন পর সংগ্রহ করা যায়। শুঁটি পরিপূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলে এর বীজের অংশ কিছুটা স্ফীত হওয়ার পরপরই সংগ্রহ করতে হবে। অতিরিক্ত পরিপক্ব শুঁটিতে আঁশ জন্মালে কোমলতা ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। বরবটির শুঁটি পরিপূর্ণ লম্বা ও মোটা হলে এবং বীজের অংশ সামান্য স্ফীত হতে শুরু করলে বরবটি তোলা যাবে।

মুলার বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর থেকে সংগ্রহ করা যায় শাকের জন্য ঘন করে বপন করলে ফসল ২০ দিন পর এবং মুলার জন্য ৪০ দিন পর থেকে ফুল ফোটা পর্যন্ত সংগ্রহ করা যাবে।

ধুন্দল গাছে ফল ধরার ৮ থেকে ১০ দিন পরেই সংগ্রহ উপযোগী হয়। ফল কচি অবস্থায় সংগ্রহ করা উচিত এতে পুষ্টিমান বজায় থাকে। বেশি পরিপক্ব হলে ফলের স্বাদ ও পুষ্টিমান দুটোই কমে যায়।

ঢেঁড়স কোমল ও কচি অবস্থায় ঢেঁড়সের ফল তুলতে হবে। ফল বের হওয়ার ৩ থেকে ৫ দিন পর ঢেঁড়স খাওয়ার উপযোগী হয়।

টমেটো জাত ও লাগানোর সময়ের ওপর নির্ভর করে ২-৪ মাসের মধ্যেই ফসল তোলার সময় হয়। ফলের নিচের ফুল ঝরে যাওয়ার পর যে দাগ থাকে ওই স্থান থেকে লালচে ভাব শুরু হলেই বাজারজাতকরণের জন্য ফল সংগ্রহ করতে হবে।

এভাবে ফল সংগ্রহ করলে অনেক দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

সবজি সংগ্রহে সতর্কতা

হাত দিয়ে মুচড়িয়ে সবজি ফসল সংগ্রহ করা যাবে না, এতে মাতৃগাছের ক্ষতি হয়। মোচড়ানোর ফলে গাছে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, সেখান দিয়ে রোগজীবাণুর আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ক্ষতি এড়ানোর জন্য ধারালো ছুরি বা ক্লিপার দিয়ে সংগ্রহ করা উচিত। ফসল সংগ্রহ করে ফসল তোলার পাত্রে রাখতে হবে। আর যেসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে সংগ্রহ কার্যক্রম সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করে শাকসবজির সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমাপকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। যেমন:

মাঠে থাকা অবস্থায় সংগ্রহের সময় সবজির গায়ে ধুলাবালু লাগতে পারে। এ জন্য সংগ্রহের পরপরই পরিষ্কার পানিতে সবজি ধুয়ে নিতে হবে, এতে সবজি ফসল টাটকা ও সুন্দর দেখায় এবং নেতিয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

এরপর আকর্ষণ ও মূল্য বাড়ানোর প্রয়োজনে গুণগত মান অনুযায়ী ভাগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সবজিভেদে আকার-আকৃতি, বর্ণ, ব্যত্তি, পরিপক্বতা অনুসারে মান অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে নিতে হবে।

রান্নাঘরে সহজলভ্য কিছু উপাদান দ্বারা কয়েক পদ্ধতিতে সহজেই শাকসবজি থেকে বালাইনাশক অবশিষ্টাংশ অপসারণ তথা সংক্রমণ মুক্তকরণ করা যেতে পারে। উপাদানগুলো হলো- খাবার লবণ, গুঁড়া সাবান, হলুদ গুঁড়া ও ভিনেগার। বেগুন, শিম, টমেটো এবং খোসা ছাড়ানোর মাধ্যমে শসা হতে অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের যথা- ডাইমেথয়েড, ক্লোরপাইরিফস, কুইনালফস, ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন এবং ফেনিট্রোথিয়নের অবশিষ্টাংশ অপসারণ করা যায়, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো।

খাবার লবণ

বাজার থেকে কিনে আনা সবজি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে লবণ যোগ করে লবণপানি তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত লবণ পানিতে সবজি ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে ও পরিমিত তাপে রান্না করতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ অপসারণ হয়।

হলুদ গুঁড়া

বাজার থেকে কিনে আনা সবজি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ১০ গ্রাম হারে হলুদ গুঁড়া যোগ করে দ্রবণ তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত হলুদ দ্রবণে সবজি ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করতে হবে। পানিতে ১৫ মিনিট রান্না করতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৭১ শতাংশ পর্যন্ত অর্গানোফসফরাস কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ অপসারণ হয়।

খাবার লবণ ব্যবহার ও খোসা ছাড়ানো

বাজার থেকে কিনে আনা শসা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম হারে লবণ যোগ করে লবণপানি তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত লবণপানিতে শসা ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। চাকু দিয়ে শসার খোসা ছাড়াতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে খোসা ছাড়ানো শসা ধুয়ে ফেলতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্লোরপাইরিফস, কুইনালফস, ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন এবং ফেনিট্রোথিয়নের অবশিষ্টাংশ অপসারণ করা সম্ভব।

ভিনেগার

বাজার থেকে কিনে আনা কাঁকরোল ও টমেটো পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ২০ মিলি হারে অ্যাসিটিক অ্যাসিড বা ভিনেগার যোগ করে ভিনেগার-পানি তৈরি করতে হবে। তৈরিকৃত ভিনেগার-পানিতে কাঁকরোল ও টমেটো ১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। পরিষ্কার পানি দিয়ে কাঁকরোল ও টমেটো ধুয়ে নিতে হবে। পানিতে ১৫ মিনিট রান্না করতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ডাইমেথয়েড, ক্লোরপাইরিফস, কুইনালফস, ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন এবং ফেনিট্রোথিয়নের অবশিষ্টাংশ অপসারণ করা সম্ভব।

শাকসবজির সুষ্ঠু সংগ্রহ ও কীটনাশক সংক্রমণ মুক্তকরণ ব্যবস্থা যদি নিয়মিতভাবে করা হয় তবে উৎপাদনকারীর অপচয় রোধ হবে এবং কৃষক অধিক মুনাফা লাভ করতে পারবেন। আর দেশের শাকসবজির উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথ হবে সুগম। উপরোক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাজার থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন সবজি কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ সংক্রমণ মুক্তকরণের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি সহজলভ্য করা সম্ভব।

লেখক: প্রকল্প পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ প্রকল্প ও প্রোগ্রাম কমিউনিকেটর, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ী


ঈশ্বরদীতে আখের সঙ্গে ‘সাথি ফসল’ চাষে সম্ভাবনা

আপডেটেড ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০৮:৩৯
মিশুক প্রধান

আখ একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল। তাৎক্ষণিক অর্থ না আসায় কৃষকরা তাই দিন দিন আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছিলেন। কৃষকদের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের সহায়তাকল্পে ঈশ্বরদীর বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট গত ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে শুরু করেছে একটি প্রকল্পের কার্যক্রম। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের নাম ‘আখের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে ডাল, মসলা ও সবজিজাতীয় ফসল উৎপাদন প্রকল্প।’ এই প্রকল্পের কারণে কৃষকরা সাথি ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে পাশাপাশি আখ শিল্পকে নিয়ে আবার নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। কৃষকদের মাঝে প্রকল্পটি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।

সুগার ক্রপ রিসার্চ ইনস্টিটিউটসংশ্লিষ্টরা জানান, আখ বাংলাদেশের খাদ্য ও শিল্পে ব্যবহার্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থকরী ফসল, যা জমিতে প্রায় ১৩-১৪ মাস থাকে। উপরন্তু তুলনামূলকভাবে আখের মূল্য না বাড়ার কারণে কৃষকরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ফলে দিন দিন আখ চাষের জমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে সার্বিকভাবে দেশের চিনিশিল্পের ওপরে। তাই আখ ফসলকে এ বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য আখের সঙ্গে আরেকটি স্বল্পমেয়াদি ফসল চাষ করে কৃষক ও এই শিল্পকে রক্ষা করার জন্য এই প্রকল্প গঠন করা হয়েছে। আখের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে মটরশুঁটি, ছোলা, মসুর, মুগ, আলু, কপি, মসলাজাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ, রসুন চাষ করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ড. আবু তাহের সোহেল বলেন, ১৫টি সুগার মিল এলাকায় এই প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে । ২০২২-২৩ মৌসুমে প্রায় এক হাজার কৃষকের জমিতে প্রদর্শনী প্লট করা হয়েছে। প্লটগুলোতে কৃষকরা যথেষ্ট সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। আগামীতেও এই প্রকল্পের ধারাবাহিকতা রাখার চেষ্টা করব।

প্রতি প্লটে কেমন খরচ হয় এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রকল্প পরিচালক জানান, এলাকা অনুযায়ী আবহাওয়া ও কৃষকের চাহিদা মোতাবেক তার জমিতে সাথি ফসল আবাদের ব্যবস্থা করা হয়। ভিন্নতা বুঝে কোথাও ডাল, কোথাও সবজি, কোথাও মসলাজাতীয় ফসল চাষের ব্যবস্থা করা হয়। বীজের মূল্যের ওঠানামা বা কমবেশি থাকায় একেক প্লটে একেক বাজেট হয়। এক বিঘা জমি চাষের জন্য একজন কৃষককে এই সহায়তা দেয়া হয়ে থাকে। কৃষকদের নগদ টাকা দেয়া হয় না। তবে যদি সে নিজে সেচ দিতে চায় সে ক্ষেত্রে তাকে সেচের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থটি আমরা দিয়ে দিই। সার, কীটনাশক, বীজ, মসলাসহ চাষাবাদ সামগ্রী আলাদা আলাদাভাবে ক্রয় করে কৃষককে সরবরাহ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে কৃষক নিজেই শ্রমিকের কাজটা করতে চান। সে ক্ষেত্রে কীটনাশক প্রয়োগ, সার প্রয়োগ, নালা তৈরি, ফসল সংগ্রহে শ্রমিকের মজুরি বাবদ যেই অর্থটি বরাদ্দ করা হয় সেটি কৃষককে দিয়ে দিই। সাথি ফসল চাষে কৃষককে সব সামগ্রী সরবরাহ করা এই প্রকল্পের কাজ। নেট, বাঁশ, সাইনবোর্ডসহ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সব কিছুই কৃষককে সরবরাহ করতে হয়। বিএসআরআই বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে প্রতিটি প্লটের পৃথক কমিটি রয়েছে। তারা নিজ নিজ প্লটে অর্পিত দায়িত্ব পালন ও খরচাদি করে থাকেন।

উপকারভোগী কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা এই প্রকল্পে যথেষ্ট উপকারী হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের চকশ্রীরামপুর গ্রামের কৃষক আবু মোস্তফা বলেন, ‘আমি ১ বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে আখের সঙ্গে সাথি ফসল রসুন ও মুগডাল চাষ করেছি। গত বছর আমার এক পরিচিত জন এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছিলেন। তার ৩০ মণ রসুন হয়েছিল, বিক্রি করেছিলেন ৫৫ হাজার টাকা। এবার তার চেয়ে আমি বেশি লাভবান হতে পারব বলে আশা করছি।’

দাশুড়িয়া ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের কৃষক রহিমা খাতুন বলেন, এ বছর আমি আখের সঙ্গে পেঁয়াজ ও মুগডাল করেছি। সব খরচ এই প্রকল্প থেকে দেয়া হয়েছে। ফসলও ভালো হয়েছে। আমি এবার ভালোই লাভবান হতে পারব।

মুলাডুলি ইউনিয়নের কৃষক নুরুজ্জামান ফারুক বলেন, ‘আমি ১ বিঘা জমিতে বিএসআরআই আখ-৪৬ জাতের সঙ্গে পেঁয়াজ ও মুগডাল চাষ করেছি। গত বছর আমার এক ভাই এই সুবিধা পেয়েছিলেন। তিনি ৮০০০টি চিবিয়ে খাওয়া আখ ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করেছিল। সাথি ফসলে শুধু রসুন করলেও সেখান থেকেও প্রায় ৪৫ হাজার টাকা এসেছিল। এ বছর আমি সেই সুযোগ পেয়েছি। দেখা যাক কী হয়। তবে তার চাইতে আমি বেশি লাভ আশা করছি।

দাশুড়িয়া ইউনিয়নের মাড়মী গ্রামের কৃষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি আখের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে আলু ও মুগডাল করেছি। গত বছরই এই প্রকল্প শুরু হয়েছে। এখানকার একজন পেঁয়াজ চাষ করে প্রায় ৫০ মণ পেঁয়াজ পেয়েছিলেন। হাজার টাকা মণ বাজারমূল্য ছিল। প্রায় অর্ধ লাথ টাকার উপরে বিক্রি হয়েছিল। ইনশাল্লাহ আমার এরচেয়ে বেশি লাভ হবে। এ বছর আখেরও বাজার ভালো, সেখান থেকেও আমার ভালো লাভ হবে বলে আমি আশা করি।

বিএসআরআইর মহাপরিচালক ড. মো. ওমর আলী বলেন, আখ চাষে দুই সারির মধ্যবর্তী স্থানের ফাঁকা জমি অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকে। ওই ফাঁকা জমিতে সাথি ফসল হিসেবে ডাল, মসলা, সবজি চাষ করিয়ে কৃষকদের আর্থিকভাবে লাভবান করানো হচ্ছে এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। প্রথম বছর সফলতার সঙ্গে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়ায় দ্বিতীয় বছরে তারই ধারাবাহিকতায় প্লট স্থাপনের কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়লে কৃষকরা অধিকতর উপকৃত হতেন।

লেখক: প্রতিনিধি, ঈশ্বরদী (পাবনা)


সাইলেজ : গোখাদ্যসংকটে সমাধান

আপডেটেড ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০৮:৩৯
প্রতিবেদক, দৈনিক বাংলা

দেশের চারণভূমির পরিমাণ দিন দিন ক্রমেই কমছে। দানাদার খাদ্যের দামও ক্রমাগত বাড়ছে। এমন অবস্থায় খামারিদের প্রাণিখাদ্য বিশেষ করে ঘাস খাওয়ানোর জন্য ঘাস সংরক্ষণ করার প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষাকালে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ঘাসের অভাব পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে সাইলেজ।

সাইলেজ আধুনিক খামারিদের কাছে খুবই পরিচিত পদ্ধতি। সাইলেজ মূলত সবুজ ঘাস সংরক্ষণ করার একটি পদ্ধতি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সবুজ ঘাসের পুষ্টি উপাদান সঠিক রেখে বায়ুশূন্য অবস্থায় সবুজ ঘাসকে ভবিষ্যতের জন্য প্রক্রিয়াজাত করে রাখার প্রক্রিয়াকে সাইলেজ বলা হয়।

সাইলেজের উপকারিতা

সাইলেজ পুষ্টিকর একটি গোখাদ্য প্রস্তুত প্রক্রিয়া, যার বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। ভালোভাবে পচন করা হলে সাইলেজের শর্করা খাবার পরিপাকযোগ্য এসিডে পরিণত হয়, যা গরুর খাদ্যের পুষ্টিগুণ বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি সাইলেজে ব্যবহৃত সব পুষ্টি উপাদান খাবারকে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে। প্রাকৃতিকভাবে চরে যাওয়া ঘাসের চেয়ে অনেক বেশি খাদ্য উপাদান পাওয়া যায়। এতে শক্তির অপচয় অনেক কম হবে। দুগ্ধবতী গাভির শারীরিক এবং দুধ উৎপাদনের প্রয়োজনে প্রচুর পরিমাণে শক্তি, আমিষ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন। ভালো মানসম্পন্ন সাইলেজের মধ্যে প্রচুর পরিমাণ শক্তি, প্রোটিন, ভিটামিন, ফাইবার রয়েছে, যা গাভির দুধ উৎপাদন অনেকাংশে বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক ও ভালো রাখে।

সাইলেজের মধ্যে এনার্জি, আমিষ ও প্রয়োজনীয় ফ্যাট বিদ্যমান থাকায় গাভির পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক ও দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সাইলেজ সঠিক মাত্রায় খাওয়ানো হলে প্রজনন প্রক্রিয়া ভালো থাকে। বর্ষা মৌসুমে সবুজ ঘাসে ময়েশ্চার বেশি থাকার কারণে শুকাতে সমস্যা হয়, আর শুকনো হলে পুষ্টিমান কমে যায়। তাই সারা বছর সঠিক পুষ্টিমানসমৃদ্ধ ঘাস গরুকে খাওয়াতে সাইলেজ হতে পারে উত্তম প্রক্রিয়া। কাঁচা ঘাসের তুলনায় এই প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করে রাখা ঘাসের গুণগত ও খাদ্যমান বেশি। দেশীয় ঘাস যেমন: দূর্বা, বাকসা, আরাইল, সেচি, দল ইত্যাদি গাছের পাতা যেমন: ধৈঞ্চা, ইপিল-ইপিল উন্নত জাতের ঘাস যেমন: নেপিয়ার, পাকচং, জার্মান, ভুট্টা, সুদান, পারা, সরগম ইত্যাদি সাইলেজ তৈরি করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

সাইলেজ তৈরি

সাইলেজ তৈরি হয় একটি পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতি অনুসরণ করে। প্রতিটি ধাপ সতর্ক থেকে সাইলেজ উৎপাদন করলে তার গুণগত মান অনেক ভালো হয় এবং বেশি দিন সংরক্ষণ করে খাওয়ানো যায়।

ফুল আসার আগে একই পরিপক্বতার ঘাসগুলো কেটে নিতে হবে। সবুজ ঘাসের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সাইলেজ হয় ভুট্টার। কারণ এই সাইলেজে কাণ্ড, পাতার সঙ্গে ভুট্টাও থাকে, যার ফলে দানাদার খাদ্যের চাহিদাও পূরণ হয়। এ জন্য আধা কাঁচা ভুট্টা থাকার সময় সংগ্রহ করা ভালো।

ঘাসগুলোকে এক দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে, যেন ভেজা ভাবটা না থাকে।

ঘাস ১ থেকে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে। বেশি পরিমাণে কাটার জন্য বাজারে মেশিন আছে, যাকে চপার মেশিন বলে।

ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করার জন্য চিনিজাতীয় উপাদান যুক্ত করতে হবে। এ জন্য লালিগুড় বা মোলাসেস ব্যবহার করা যেতে পারে। তা ছাড়া লাল চিনিও ব্যবহার করা যায়। (বি.দ্র. ভুট্টা ও জার্মান ঘাসে পর্যাপ্ত পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট থাকার কারণে মোলাসেস প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে না)।

এবার সংরক্ষণের জন্য সিলো বা পাত্র ঠিক করতে হবে। এ জন্য স্টিক ব্যাগ বা বস্তা ও ড্রাম ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া মাটিতে পুঁতেও সংরক্ষণ করা যায়।

স্টিক ব্যাগ বা ড্রামে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যাগটি যেন কোনো রকম ছেঁড়া না হয়। প্রথমে মোলাসেস এবং পানিমিশ্রিত দ্রবণের অর্ধেক পরিমাণ ঘাসে প্রয়োগ করতে হবে। তারপর সেই ঘাস ব্যাগে কয়েক ধাপে ভরতে হবে। এক ধাপ ভরার পর ভালোভাবে চাপ দিতে হবে, যেন ঘাসগুলোর মাঝে ফাঁকা না থাকে। ফাঁকা থাকলে সেখানে বাতাস থেকে যাবে, যার ফলে সাইলেজ ভালো না হওয়ার কারণে বেশি দিন ঠিক থাকবে না। তারপর মোলাসেস মিশ্রিত পানি আবার খানিকটা প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে কয়েক ধাপে ব্যাগ কিংবা ড্রামে ভালোভাবে ভরে শক্তভাবে মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে যেন বাতাস প্রবেশ না করতে পারে।

মাটিতে পুঁতেও সাইলেজ করা যায়। এ জন্য উঁচু স্থান নির্বাচন করে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গর্ত করে কয়েক ধাপে সমপরিমাণে মোলাসেস এবং পানিমিশ্রিত ঘাস পা দিয়ে ভালোভাবে চাপ দিয়ে কমপেক্ট করতে হবে। তারপর উপরে আবার পলিথিন দিয়ে শক্ত করে বেঁধে মাটি চাপা দিতে হবে।

উক্ত প্রক্রিয়াটি ১-২ দিনের মাঝে শেষ করতে হবে। সাইলেজ আরও পুষ্টিসমৃদ্ধ করার জন্য অব্যবহৃত কলা, কলার খোসা, মিষ্টি আলু, আখের খোসা ও যুক্ত করা যায়। ভালোভাবে সাইলেজ তৈরি করলে সর্বোচ্চ ১০-১২ বছর সংরক্ষণ করা যায় এবং পুষ্টিগুণাগুণ অক্ষুণ্ন থাকে।

সবুজ ঘাসের সাইলেজ বানানোর ক্ষেত্রে ঘাসের শতকরা ৩-৪ ভাগ চিটাগুড় মেপে একটি চারিতে নিতে হবে। তারপর ঘন চিটাগুড়ের মধ্যে ১:১ অথবা ৪:৩ পরিমাণে পানি মিশালে এটি ঘাসের ওপর ছিটানো উপযোগী হবে। ঝরনা বা হাত দ্বারা ছিটিয়ে এ মিশ্রণ ঘাসে সমভাবে মিশাতে হবে।

সাইলোর তলায় পলিথিন দিলে আগে বিছিয়ে নিতে হবে। পলিথিন না দিলে পুরু করে খড় বিছাতে হবে। এরপর দু-পাশে পলিথিন না দিলে ঘাস সাজানোর সঙ্গে সঙ্গে খড়ের আস্তরণ দিতে হবে। স্তরে স্তরে সবুজ ঘাস এবং শুকনো খড় দিতে হবে। সম্পূর্ণ ঘাস এক দিনেই সাজানো যায়। তবে বৃষ্টি না থাকলে প্রতিদিন কিছু কিছু করেও কয়েক দিনব্যাপী সাইলেজ তৈরি করা যায়। নিচু জায়গায় সাইলো করা যাবে না। তাতে পানি জমে সাইলেজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

সাইলেজ ব্যবহারের নিয়ম

সাইলেজ স্বভাবিক ঘাসের মতোই প্রাণীকে খাওয়ানো যায়। সাইলেজ সবুজ ঘাসের চাহিদা পূরণ করে। সব বয়সের প্রাণীকে সহজে খাওয়ানো যায়। অল্প করে অভ্যাস করিয়ে বেশি করে খাওয়ানো যায়। সঠিকভাবে পরিচর্যার পাশাপাশি নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ সাইলেজ খাওয়ানো হলে গরুর মাংস উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত ঠিকাদান, কৃমিমুক্ত রাখা এবং দানাদার খাবারের সঙ্গে সাইলেজ খাওয়ানোর ফলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

সাইলেজের পুষ্টি এবং উপকারিতা জেনে খামারিরা নিজেরা এটি উৎপাদনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া দেশের কিছু কোম্পানি আধুনিক নিয়মে সাইলেজ উৎপাদন করে খামারিদের প্রয়োজনে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছে। সাইলেজ অন্য খাবারের তুলনায় অনেকটা সাশ্রয়ী, বিশেষ করে শুকনো খড় খাওয়ানোর চেয়ে সাইলেজ খাওয়ানো অনেক ভালো এবং খামারিরা এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে লাভবান হচ্ছে।

লেখক: প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল, গোমস্তাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।


চিয়া সিড চাষে সিরাজগঞ্জে আশা

আপডেটেড ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৬:১২
গোলাম মোস্তফা রুবেল

সিরাজগঞ্জে জেলা সবজি চাষের জন্য বেশ পরিচিত। এবার ওষধি ও পুষ্টি গুন সম্পন্ন সুপার ফুড হিসেবে খ্যাত চিয়া সীড চাষ হচ্ছে এ জেলায়। । দানাদার এ ফসল মানবদেহে বিভিন্ন রোগের কার্যকরী ঔষধ হিসেবে কাজ করায় এর চাষাবাদ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে অন্য ফসলের চেয়ে এ চাষাবাদে লাভের স্বপ্ন বুনছেন কৃষক। জেলার উল্লাপাড়ার কয়ড়া সরাতলা গ্রামের মাটিতে এর পরীক্ষামূলকভাবে চাষ শুরু হলেও এখন সফলতা দেখছেন সিরাজগঞ্জের মানুষ।

উল্লাপাড়ার কয়ড়া সরাতলা গ্রামের গোলাম হোসেন ২০২১ সালে শখের বশে নিজের ২৫ শতক জমিতে চিয়া সীড চাষাবাদ করেন। তাতে প্রথম বছরেই প্রায় ১৩৫ কেজি বীজ পান। বিক্রি শেষে ৪০ কেজি বীজ তিনি চাষাবাদের জন্য রাখেন। কিন্তু সেই বীজে চাষাবাদে ভাল ফলন মেলেনি। তবে তিনি হাল ছেড়ে দেননি। চলতি বছর বিদেশ থেকে চাষাবাদের জন্য তিনি ৯০ কেজি মেক্সিক্যান হাইব্রীড চিয়া সীড বীজ আমদানি করেন। এই বীজ তিনি জেলার উল্লাপাড়া, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, রংপুর সদর, শরিয়তপুরের জাজিরার কৃষকের মাধ্যমে ১৭০ বিঘা জমিতে চিয়া সীড চাষাবাদ করিয়েছেন।

উল্লাপাড়া কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উল্লাপাড়া উপজেলার কয়ড়া সরতলা, রতদিয়ার, হরিশপুর গ্রামের মাঠে চিয়াসীড চাষাবাদের উদ্যোক্তা গোলাম হোসেন ২১ বিঘা, সাবেক ইউপি সদস্য ঠান্ডু মিয়া ২৯ বিঘা, হেলাল উদ্দিন ৩০ বিঘা জমিতে এর চাষাবাদ করেছেন। ইতোমধ্যে এসব জমিতে চিয়া সীডের গাছ বড় হয়ে ফুল ও ফল ধরেছে। প্রতিটি গাছের সাথে অসংখ্য ফুল ও ফল ধরেছে। লম্বা আকৃতির চিয়া সীডের গাছগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া চিয়া চাষে উপযোগী হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে।

উল্লাপাড়ার চিয়াসীড চাষাবাদের উদ্যোক্তা গোলাম হোসেন বলেন, এই শস্যে দুধের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ক্যালসিয়াম, কমলালেবুর চেয়ে সাতগুণ বেশি ভিটামিন সি, পালংশাকের চেয়ে তিনগুণ বেশি আয়রন ও সামুদ্রিক মাছের চেয়ে তিনগুণ বেশি ওমেগা-৩ আছে, এই কারণে এই শস্যকে সুপারফুড বলা হয়। দৈনিক এক আউন্স চিয়া বীজ খেলে শতকরা ১৮ ভাগ ক্যালসিয়ামের চাহিদা, ২৭ ভাগ ভিটামিন সি চাহিদা এবং ৩০ ভাগ ওমেগা-৩ চাহিদা পূরণ হতে পারে। যা মানবদেহের ক্ষতিকারক কোলেস্টরল (এলডিল) হ্রাস করে এবং উপকারী এইচডিএল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এছাড়া ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে চিয়া বীজ।

চাষী হেলাল উদ্দিন বলেন, এই শস্যে কোনো রোগ নেই। তাই কোনো কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। উৎপাদনে খরচ খুব কম। বিঘাতে ১০ হাজার টাকা মাত্র। বিঘাতে ১০০ থেকে ১২০ কেজি চিয়া বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। এই শস্য বীজ থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত ১০০ থেকে ১২০ দিন লাগে।

আরেক চাষী ঠান্ডু মিয়া বলেন, খাবার গুণের পাশাপাশি পুষ্টি চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে উল্লাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে সুপার ফুড চিয়া সিড চাষ শুরু করি। প্রথম অবস্থায় বাজারজাত নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু এখন জমি থেকেই বিক্রি হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। প্রতি কেজি চিয়া সিড প্রায় হাজার টাকায় বিক্রি করা যাবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারন অফিস সূত্রে জানা যায়, আমেরিকা ও মেক্সিকোর মরুভূমি দেশে চিয়া সীডের চাষাবাদ হয়। এতে রয়েছে ওমেগা—৩, ফাইবার, ম্যাংগানিজ, ফসফরাস, প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেটসহ পাশাপাশি এতে রয়েছে ভিটামিন বি, থায়ামিন, নিয়াসিন, আয়রণ, দস্তা, ফ্যাটিক এসিড, ম্যাগনেসিয়াম। নানা উপায়ে এ বীজ খাওয়া যায়। এতে মানুষের শারিরীক অনেক উপকার হয়। প্রচার- প্রচারণা ও চাহিদার কারণে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বাজারে প্রকার ভেদে ১৩শ’ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা দরে কেজি দরে চিয়া সীড বীজ বিক্রি হচ্ছে। যা সাধারণত বিদেশে থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। সম্ভাবনাময়ী এ চাষাবাদ দেশে ছড়িয়ে দেয়া গেলে আমদানী ব্যয় কমানোর পাশাপাশি কৃষকরা বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।

উল্লাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকতা সুর্বনা ইয়াসমিন সুমি জানান, উপজেলার কয়ড়া ইউনিয়নে প্রায় ১০ হেক্টর জমিতে চিয়াসীড চাষাবাদ হয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে আমরা এই চাষাবাদে সার্বক্ষনিক মনিটরিংসহ কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছি। এ বীজের অনেক দাম। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় মাঠে গাছের ফুল ও ফল ভাল দেখা যাচ্ছে। আশা করছি এ চাষাবাদে কৃষকরা ভাল লাভবান হতে পারবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বাবলু চন্দ্র সুত্রধর বলেন, বর্তমানে চিয়া সিড শুধু ওজন কমানোর জন্য বা ডায়েটের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে না, নিরপেক্ষ স্বাদের কারণে চিয়া সিড সব ধরনের খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ার উপযুক্ত। সব ধরনের আবহাওয়ায় জন্মানো চিয়া বীজ দেখতে সাদা ও কালো রঙের তিলের মতো ছোট হয়ে থাকে। অনেকেই চিয়া সিডকে তোকমা বলে ভুল করে থাকে। দেখতে প্রায় একই রকম হলেও জন্মস্থান ও পুষ্টিগুণের দিক থেকে রয়েছে কিছু পার্থক্য। চিয়া সাধারণত তিন মাসের ফসল। এর আয়ুকাল ৯০ থেকে ১০০ দিন। অক্টোবর মাসে বীজ বপন করতে হয়। ৩৩ শতকের বিঘায় মাত্র তিন শ গ্রাম বীজ লাগে। চাষের পদ্ধতি খুব সহজ। রোগবালাইও কম হয়। তাই ধীরে ধীরে সিরাজগঞ্জে এই চিয়া সিডের চাষ বেড়েই চলছে। আমরা কৃষি অধিদপ্তর থেকে কৃষককে সবধরনের সহযোগীতা করে যাচ্ছি।

লেখক : প্রতিনিধি,সিরাজগঞ্জ

বিষয়:

ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিতে নিরাপদ ফল উৎপাদন

আপডেটেড ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৬:২১
ড. মো. শরফ উদ্দিন

সারা পৃথিবীতে উত্তম কৃষি পদ্ধতির আলোকে নিরাপদ ফল উৎপাদনের অনেকগুলো পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে এবং ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি এগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ প্রযুক্তিটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে অনেক আগে থেকে ব্যবহৃত হলেও বাংলাদেশে শুরু হয়েছে ৩-৪ যুগ পূর্ব থেকে। আমরা যদি ৩০ বছর আগের কথা একটু চিন্তা করি, সে সময়ে দেখা যেত অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ পেয়ারা ও ডালিম ফল রোগ ও পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নরম, পাতলা কাপড় ব্যবহার করতেন, যে কাপড়গুলো পূর্বে অন্য কাজে ব্যবহৃত হতো। যার ফলে ফলগুলোকে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেত এবং দেখতেও অনেক আকর্ষণীয় হতো। কিন্তু কেউ এটিকে ফ্রুট ব্যাগিং বলতেন না বরং ফল ঢেকে রাখা হিসেবেই পরিচিত ছিল। প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশে এভাবেই ফল আবৃত করে ব্যাগিং শুরু হয়েছিল।

মূলত এক যুগ আগে এ দেশে আধুনিক ব্যাগিং নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। তবে সংকরায়ণের কাজে বাটার পেপার অনেক আগে থেকেই গবেষণার কাজে ব্যবহার হয়ে আসছিল এবং এখনো ব্যবহার হয়। এ দেশে পলিথিন ব্যাগ সহজলভ্য হওয়ার পর কোনো কোনো ফলের ক্ষেত্রে বাটার পেপার, পলিব্যাগ, কাপড়ের তৈরি ব্যাগ, কাগজের ব্যাগের পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হয়। তবে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য শুধু পলিব্যাগের ব্যবহার শুরু হয় পেয়ারাতে এবং এখন পর্যন্ত তা চলমান আছে। কাগজের তৈরি বিশেষ ধরনের ব্যাগ পেয়ারার বাণিজ্যিক উৎপাদনেও ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে কাগজের ব্যাগ তুলনামূলকভাবে দামি হওয়ায় পেয়ারার বাণিজ্যিক উৎপাদনে কাগজের তৈরি ব্যাগ কম পরিমাণ ব্যবহার হয়। তবে পেয়ার রং, ব্যবহৃত বালাইনাশকের ঝুঁকি, ক্ষতির পরিমাণ (প্রখর সূর্যের তাপে নষ্ট, অতিরিক্ত আর্দ্রতার কারণে অ্যানথ্রাকনোজ), পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ইত্যাদি বিবেচনায় পেয়ারার বাণিজ্যিক উৎপাদনেও কাগজের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার করা লাভজনক এবং এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মত পেয়ারা উৎপাদন সম্ভব।

আমকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা মাঠপর্যায়ে লক্ষ করা গেছে। কখনো বাটার পেপারের ব্যাগ ও বিভিন্ন আকার ও রঙের পলিবাগ। কখনো কাপড়ের তৈরি বিশেষ ধরনের থলে, কখনো নেটের তৈরি ব্যাগ, সব গাছকে মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত ফিল্টার নেট এবং ধানের খড় ব্যবহারের নজির পাওয়া গেছে। তবে আমের ক্ষেত্রে এগুলোর কোনোটিই বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়নি। যেমন- আমে পলিব্যাগ ব্যবহারের ফলে প্রখর রৌদ্রে পলিব্যাগের ভেতরের অংশে পানি জমে এবং এই পানি আমের খোসার সঙ্গে লেগে থাকে। আবার কখনো কখনো ব্যাগের ভেতরও পানি জমে থাকতে দেখা যায়। ফলে ওই সব আমে ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে অ্যানথ্রাকনোজে রোগের কারণে পচন শুরু হয় এবং আমে পলিব্যাগ পরানোর ১ মাসের মধ্যেই আম ঝরে পড়ে। ফলে দামে সস্তা হলেও পলিব্যাগ আমে ব্যবহার করা যাবে না। যদিও একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছিল আমে পলিব্যাগের ব্যবহার লাভজনক কিন্তু মাঠপর্যায়ে এখন এর ব্যবহার চোখে পড়ে না।

এরপর কোনো কোনো গবেষক আম ফলকে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে রক্ষা করার জন্য কাপড়ের তৈরি বিশেষ ব্যাগ ব্যবহার করেন। কিন্তু এ ব্যাগ ব্যবহার করেও আমে স্যুটিমোল্ড, মিলিবাগের আক্রমণ এবং আমে পচন দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত ভালোমানের আম উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। এরপর আমে নেটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহারের চিন্তা এবং এর ব্যাগ ব্যবহার করেও আমকে রোগ ও পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। আমের মাছি পোকার উপদ্রুব বেড়ে গেলে একজন গবেষক সব গাছ ফিল্টার নেট দ্বারা ঢেকে দেয়ার চিন্তা করেন। পরে সব গাছকে মাছ ধরার ফিল্টার নেট দ্বারা সব গাছ ঢেকে দেন। পরে দেখা যায়, প্রবল ঝড়ে আম গাছটিই ভেঙে যায়। সুতরাং এ নেট ব্যবহার করেও আমকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ফিল্টার নেট দামি হওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যবহার লাভজনক নয়।

আমে কাগজের তৈরি বিশেষ ফ্রুট ব্যাগ ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে ২০১৪ সালে ফল বিভাগ, উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে এক বিশেষ ধরনের ব্যাগের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং সেই বছরই আম, পেয়ারা, লিচু, কলা, ডালিম ফলে এ আধুনিক ব্যাগ ব্যবহার পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়। প্রায় সব ফলেই ভালো ফলাফল পাওয়ায় ২০১৭ সালে ব্যাগিং প্রযুক্তিটি এ দেশে ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দেয়া হয়।

এই প্রযুক্তিতে আম বিশেষ ধরনের ব্যাগের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। এ ব্যাগের উপরের প্রান্তে একটি তারের লক সংযুক্ত থাকে যার মাধ্যমে ব্যাগকে আমের বোটার সঙ্গে ভালোভাবে আটকিয়ে রাখা হয়। আমাদের দেশে জন্মানো জাতগুলোর ক্ষেত্রে ৪২-১৪০ দিন পর্যন্ত ব্যাগের মধ্যে আমকে রাখা হয়। প্রতিটি ব্যাগে দুটি স্তর থাকে। বাইরের দিকে বাদামি এবং ভিতরের দিকে কালো রঙের। এই ব্যাগগুলো একাধিকবার ব্যবহার করা যায়। ব্যাগের মান ভালো হলে ২-৩ বার পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। তবে নিম্নমানের ব্যাগ একবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু পুরাতন ব্যাগ ব্যবহার করে গুণগত মানসম্পন্ন আম উৎপাদন করা সম্ভব নয়। এই ফ্রুট ব্যাগ ব্যবহারের ফলে আমের সব ধরনের রোগবালাই, পোকামাকড় দমন করা সম্ভব হয়েছে। অধিকন্তু, আমের আকর্ষণীয় রং বজায় রেখে সংগ্রহকাল বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে এই প্রযুক্তিটি প্রায় সব আম উৎপাদনকারী অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং প্রতিবছর ১৩-১৪ কোটি আমে এ প্রযুক্তিটি ব্যবহার হয়।

প্রযুক্তিটি উদ্ভাবনের ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আমে বহুল ব্যবহৃত ফ্রুট ব্যাগ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। দেশীয় চাহিদার ৯০-৯৫ ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় বাকি ৫-১০ ভাগ এ দেশে তৈরি হয়। দেশের তৈরি ফ্রুট ব্যাগ তুলনামূলকভাবে একটু নিম্নমানের হওয়ায় আমদানিকৃত ব্যাগের চাহিদা মাঠপর্যায়ে বেশি লক্ষ্ করা গেছে। এ দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিবেচনায় ভালোমানের নিরাপদ ও বিষমুক্ত এবং রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের বিকল্প নেই। এ দেশে জন্মানো অন্যান্য ফলেও ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে। যেমন- কলা, লিচু, মাল্টা, কমলা, ড্রগন ফ্রুট, ডালিম/বেদানা ইত্যাদি। সুতরাং সারা দেশে ভালোমানের নিরাপদ, বিষমুক্ত এবং রপ্তানিযোগ্য ফলের উৎপাদন বাড়াতে হলে দেশে ভালোমানের ব্যাগ উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমদানিকৃত ব্যাগকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা করলে চাষিরা কম মূল্যে ফলে ব্যবহৃত এ ব্যাগগুলো ক্রয় করতে পারবেন এবং বেশি পরিমাণে ব্যবহার করবেন। ফলশ্রুতিতে দেশে গুণগত মানসম্পন্ন আমের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। আম বিজ্ঞানীদের আশাবাদ, দেশীয় মৌসুমি পছন্দনীয় ফলগুলোর উৎপাদন প্রতিবছর বৃদ্ধি পাবে এবং ভোক্তারা বেশি পরিমাণে এই ফলগুলো গ্রহণ করবেন, যা জনগণের পুষ্টিচাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিদেশি ফলের ওপর আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়ী হবে।

লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ফল বিভাগ)
উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বারি, গাজীপুর।


বেকার থেকে সফল কৃষি উদ্যোক্তা

আপডেটেড ২ জানুয়ারি, ২০২৩ ০৮:৫২
মো.সবুজ হোসেন

পড়াশোনা শেষ করে প্রায়ই ৬ বছর ঘুরেছেন চাকুরীর পেছনে। কিন্তু সেই চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে একসময় সিদ্বান্ত নেন গ্রামে ফিরে কৃষি উদ্যোক্তা হবার। আর সেই সিদ্ধান্তই জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে নওগাঁর সাইদুল হোসেনের। জেলার ধামইরহাট উপজেলার আগ্রাদিগুন ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের সাইদুল হোসেন ২০১২ সালে নওগাঁ সরকারি কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করে প্রায় ৬ বছর বেকার থাকার পর উদ্যোক্তা হবেন বলে সিন্ধান্ত নেন। এরপর ২০১৮ সালের মার্চ মাসে নিজের ৫বিঘা জমিতে শুরু করে কৃষি মিশ্র খামার। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে সেই খামার বর্তমানে আয়তন প্রায় ১৮ বিঘা।

সরেজমিনে সাইদুলের খামারে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার আগ্রাদিগুন ইউনিয়নের স্থানীয় হয়রতপুর গ্রামের পাশে ১৮ বিঘা জমিতে কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। সেখানে ১ বিঘা জমিতে দার্জিলিং জাতের কমলা, ৩ বিঘা জমিতে বারি ১ জাতের মালটা, ৩ বিঘা জমিতে বারো মাসি জাতের মালটা, ২ বিঘা জমিতে বল সুন্দরি ও বারি কুল জাতের বড়ই। চাষ চলছে। এর বাইরে বাকি জমিতে আবাদ করেছেন আম, পেয়ারা, মাশকালাই, সরিষা, বেগুনসহ নানা জাতের সবজির।

কৃষি উদ্যোক্তা সাইদুল হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন,'আমি মাষ্টার্স শেষ করার পর ঢাকা চলে গিয়েছিলাম। ভালো কোন চাকুরি পাইনি। তাই গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসি। বেশ কয়েক বছর বেকার ছিলাম। সে সময় টিভিতে দেখতাম কৃষি খামার নিয়ে নানা সংবাদ। তখন মাথায় আসলো যদি আমিও এমন কিছু করতে পারি তাহলে আর বেকার থাকতে হবেনা। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে নিজের ৫বিঘা জমিতে বড়ই, আম ও পেয়ারার বাগান গড়ে তুলি। বর্তমানে মালটা, কমলা,মাসকালাই,সরিষা,বেগুনসহ ১৫-২০জাতের ফসল আবাদ করছি। এখন প্রায় প্রতিদিনই অনেকেই আসে আমার বাগান দেখতে। অনেকেই এমন বাগান করতে চায়। আমিও তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকি। স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে আমাকে নানা পরামর্শ দিয়ে থাকে। আগামীতে আরো বড় পরিসরে বাগান করার পরিকল্পনা রয়েছে।'

এ প্রসঙ্গে সাইদুল আরো জানান,১৮বিঘা জমিতে তিনি এই কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন। নিজের ৫বিঘা জমির বাইরে বাকি ১৩বিঘা জমি লিজ নেওয়া। এ পর্যন্ত প্রায় ২০লাখ টাকার মত ব্যয় হয়েছে খামারে। কিছু কৃষি ঋণ ও তার নিজের টাকা এখানে ব্যয় করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ খামার থেকে সব খরচ বাদ দিয়ে এ পর্যন্ত ১৫লাখ টাকার লাভ করেছেন তিনি। এছাড়াও আশা করছেন প্রতি বছর বাগানের উৎপাদিত পণ্যগুলো বিক্রি করে ৭থেকে ৮লাখ টাকার লাভ করতে পারবেন বলে।

সাইদুলের কৃষি খামারে ঘুরতে আসা হজরতপুর গ্রামের মাকসুদুল হাসান বলেন,'আমি সাইদুল ভাইয়ের কৃষি খামারে ঘুরতে এসেছি। বিশাল বাগান গড়ে তুলেছেন তিনি। দেখে খুবই ভালো লাগলো। আমিও বর্তমানে বেকার। এমন একটি কৃষি খামার আমিও গড়ে তুলবো ভাবছি।'

ফিরোজ ইসলাম নামের আরেক যুবক বলেন,'সাইদুল ভাইয়ের এই বিশাল বাগানে কমলা,মালটা,পেয়ারা, বেগুন, মাসকালাইসহ বেশ কিছু ফসল আবাদ করেছেন। যদি কৃষি অফিসের পরামর্শ ও সহায়তা পাওয়া যায়, তবে আমিও এমন একটি বাগান করবো।'

স্থানীয় ধামইরহাট উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবু সাঈদ বলেন,'সাইদুল ইসলাম একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে ইতিমধ্যে এলাকায় পরিচিতি পেয়েছেন। আমরা তার বাগানে মাঝে মধ্যেই গিয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকি। এছাড়া কৃষি প্রণোদনাসহ নানা ধরনের সহায়তা করা হয় তাকে। বিশেষ করে তার বাগানে কমলা চাষ করে সফল হয়েছেন তিনি। যদি কেউ এমন বাগান করতে চায় তবে কৃষি বিভাগ থেকে আমরা পরামর্শ ও সহায়তা করবো।'

লেখক : প্রতিনিধি, নওগাঁ।

বিষয়:

উপকূলীয় অঞ্চলে ফল চাষে সম্ভাবনা

আপডেটেড ২ জানুয়ারি, ২০২৩ ০৮:৪৯
মৃত্যুঞ্জয় রায়

বাংলাদেশের দক্ষিণে সাগর সংলগ্ন অঞ্চলকে বলা হয় উপকূলীয় অঞ্চল। এ দেশের আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ ভূমি এই অঞ্চলে। মোট আবাদী জমির প্রায় ৩০ শতাংশ রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে। এ অঞ্চল নানারকম প্রাকৃতি দূর্যোগে মোকাবেলা করে টিকে আছে ও ফসল উৎপাদনের নতুন সম্ভাবনাময় অঞ্চল হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। দেশের আগামি দিনের কৃষিতে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে উপকূলীয় অঞ্চল। এ অঞ্চলের উপযোগী কিছু ফলচাষের ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয়েছে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। বিশেষ করে পেয়ারা, আমড়া, নারিকেল, সফেদা, কুল, জাম্বুরা, মাল্টা প্রভৃতি ফল অনেক চাষির ভাগ্য বদলে সহায়ক হয়েছে।

গুরুত্ব ও চাষ পদ্ধতি :

এ দেশের প্রায় ২৮% মানুষ উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করে। এসব অঞ্চলে জমি থাকলেও সেসব জমিতে লবণাক্তার প্রভাবে সারা বছর বহুমূখী ফসল চাষ করা কঠিন, বিশেষ করে ফল। প্রধান ফসল আমন ধান ছাড়া অন্য ফসল দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানে আবাদ হয় না। আবার লবণাক্ততা ও নিচু জমির কারণে ফলচাষ করাও কঠিন। তাই ফল উৎপাদনের প্রধান সুযোগ বা উৎস হলো হলো এ অঞ্চলের বসতবাড়ির আঙ্গিনাসমূহ। উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা সহ্য করে দামি ফল সফেদা ভালো হয়, সম্প্রতি মাল্টাও ভালো ফলন দিচ্ছে। তাই এ অঞ্চলের বসতবাড়ির জন্য উপযুক্ত ফলগাছ নির্বাচন করে আধুনিক নিয়ম মেনে চাষ করতে পারলে বহু রকমের ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

এজন্য এ অঞ্চলে যেসব ফল ভালো হয়, স্থানীয়ভাবে সেসব ফলের পরিকল্পিত চাষের ওপর গুরুত্ব অবশ্যই দিতে হবে। ফল উৎপাদন করে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য প্রথমে বসতবাড়ির বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিতভাবে ফল চাষের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

  • যেসব নিচু জমিগুলোতে মাছের ঘের গড়ে উঠেছে, সেসব ঘেরের পাড়ে কুল, পেয়ারা, কলা, নারিকেল ইত্যাদি ফলের বাগান করে ফল উৎপাদন বাড়াতে হবে।
  • কাঠের গাছ লাগানো হচ্ছে যেসব জমিতে - সেখানে কাঠের গাছের সাথে ফলের গাছ লাগিয়ে এগ্রো ফরেস্ট্রি করতে হবে।
  • মাঝারি নিচু ধানের জমিতেও বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে 'পিরামিড রেইজড বেড' পদ্ধতিতে ক্ষেতের মাঝে মাঝে মাটির ঢিবি তৈরি করে সেখানে ফলগাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
  • নিচু জমি, যেখানে প্রতিনিয়ত জোয়ার ভাটা চলে সেখানে নালা কেটে তার মাটি পাশে স্তুপ করে উঁচু বেড করে 'সরজন' পদ্ধতিতে ফলগাছের নার্সারি ও ফলবাগান করা যেতে পারে।
  • এসব উদ্যোগ নেয়ার আগে দেখতে হবে যে উপকূলীয় অঞ্চলে আসলে কোন কোন ফল ভালো হয়।

উপকূলীয় অঞ্চলে ফল চাষ সম্প্রসারণে করণীয় :

উপকূলীয় অঞ্চলে ফল উৎপাদনে বসতবাড়ির অঙ্গিনাকে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। প্রতিটি বসতবাড়ির বাগান থেকে শুধু সুপারি নয়, বারো মাস পাওয়া যায় এমন ফলগাছ নির্বাচন করতে হবে।

যে ফলের যে জাত এ অঞ্চলের বসতবাড়িতে ভালো হয় সেসব জাত নির্বাচন করতে হবে।

পরীক্ষামূলকভাবে কিছু নতুন ফল নিয়ে এ অঞ্চলে সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে গবেষণা করা যেতে পারে। যেমন ড্রাগন ফল।

এ অঞ্চলের বসতবাড়িতে কাঠ ও ফলগাছের বর্তমান গড় অনুপাত ৫ঃ১। অর্থাৎ এখনো এ অঞ্চলের মানুষ ফলের চেয়ে কাঠের গাছ লাগাতেই বেশি আগ্রহী। অনেকেরই ধারণা, কাঠের গাছ ঝড়—ঝাপটা থেকে বাড়িকে রক্ষা করবে। এ ধারণা থেকে তাদের বের করে আনতে হবে ও ফলগাছ রোপণের বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি বা প্রণোদনা দিয়ে হলেও ফলগাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

বহুস্তরী ফলগাছ মডেল বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

এগ্রো ফরেস্ট্রি বা ফসলের জমিতে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে কিছু ফলগাছ লাগাতে হবে।

ফলচাষের কিছু বিশেষ কৌশলের প্রবর্তন বা সম্প্রসারণে জোর দিতে হবে। বিশেষ করে নিচু জমিতে সরজন পদ্ধতিতে ফল চাষ, ডোয়ার্ফ হাইব্রিড নারিকেল চাষ, পিরামিড বেডে ফল চাষ, ঘেরের পাড়ে ফল চাষ, রাস্তার ধারে নারিকেল, আমলকি, হরিতকি, বহেড়া ইত্যাদি ফল চাষ করার কথা ভাবতে হবে।

এ অঞ্চলের কোনো বসতবাড়ির ফলগাছে সাধারণত কোনো পরিচর্যা করা হয় না, সার—সেচ দেয়া হয় না। বসতবাড়িতে বিদ্যমান ফলগাছসমূহের সঠিক পরিচর্যা নিশ্চিত করতে হবে।

কিছু কিছু ফলকে বাণিজ্যিক গুরুত্ব দিয়ে চাষের ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন— কুল, সফেদা, পেয়ারা, আমড়া, নারিকেল, মাল্টা, আম ইত্যাদি। সম্ভব হলে ছোট আকারে এসব ফলের প্রদর্শনী স্থাপন করে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

উপকূলীয় অঞ্চলে ফলগাছে ও ফলে উত্তরাঞ্চলের চেয়ে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। সেজন্য কৃষক প্রশিক্ষণসহ সেসব বালাই ব্যবস্থাপনার কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।

উপকূলীয় অঞ্চলে ফলচাষ সম্প্রসারণে স্থানীয়ভাবে মানসম্মত চারাকলমের উৎপাদন করা দরকার। ফলের চারা কলম উৎপাদনের জন্য এ অঞ্চলে কিছু উপজেলায় ইতোমধ্যে নার্সারি ব্যবসা রীতিমত শিল্পে রূপ নিয়েছে (স্বরূপকাঠী দৃষ্টান্ত)। তবে সেখানে মানের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে নার্সারি কমীর্দের প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। সরকারি হর্টিকালচার সেন্টারসমূহে মাতৃবাগান করে সেখান থেকে উন্নত জাতের সায়ন বা কলমদ্রব্য স্থানীয় নার্সারি কমীর্দের কাছে সরবরাহ করা যেতে পারে।

ফলভিত্তিক শিল্প স্থাপন করে এ অঞ্চলের মানুষের আয় বাড়ানো সম্ভব। বিশেষ করে নারিকেলভিত্তিক বহুমুখী শিল্প (পিরোজপুরের নেছারাবাদের দৃষ্টান্ত), পেয়ারার জ্যাম—জেলী, অরবরই, বরই, কেওড়া, কাউফল ইত্যাদির আচার তৈরির কারখানা স্থাপন করা যায়।

সর্বোপরি উপকূলীয় অঞ্চলে চাষের উপযোগী ফলগাছ বাছাই ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফলের জাত উদ্ভাবনে গবেষণা কার্যক্রম করতে হবে সুপরিকল্পিতভাবে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর আরও অনেক দেশেই আমাদের দেশের মতো উপকূলীয় অঞ্চল রয়েছে। সমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় সেসব দেশে উপকূলীয় অঞ্চলে ফলচাষের অগ্রসরমান অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগানো যেতে পারে।

উপকূলীয় অঞ্চলের ফল ও সম্ভাবনা :

উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি ও জলবায়ুতে এখন অনেক ফলই ভালো হচ্ছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো ফলের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি, লতাচাপালী, ভোলার চর ফ্যাশন ইত্যাদি স্থানে এখন প্রচুর পরিমাণে তরমুজের চাষ হচ্ছে। এ অঞ্চলের বসতবাড়িতে কি কি ফল ভালো হয় তা এসব অঞ্চলের বসতবাড়ি ও ঘেরগুলো ঘুরে একটু জরিপ চালালেই বুঝা যায়। এর জন্য খুব বেশি গবেষণার দরকার হয় না। তারপরও নতুন ফল বা নতুন জাতের ফল চাষ সম্প্রসারণে অবশ্যই স্থানপযোগী বিশেষ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। দ্বীপসমূহের বসতবাড়িতে ফলগাছ কম রয়েছে। দ্বীপসমূহে নারিকেলগাছের প্রাধান্য বেশি। এ তালিকার বাইরেও কিছু ফল উপকূলীয় অঞ্চলের বসতবাড়িসমূহে চাষ হচ্ছে বা চাষ করা যেতে পারে। যেমন - পেঁপে, স্ট্রবেরি, কলা, অরবরই বা নোয়াল, বিলিম্বি, জংলিবাদাম, পানিফল, আমরুল, বৈঁচি, লুকলুকি, বাঙ্গি, মরমা ইত্যাদি। ঘেরের পাড়ে কুল, কলা ও আম্রপালি আম চাষে বেশ সাফল্য দেখা যাচ্ছে। বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরার ঘেরগুলোর পাড়ে নারিকেল চাষেও সফলতা পাওয়া দেখা গেছে। কক্সবাজার, বাগেরহাট, নোয়াখালী, বাগেরহাটে সুপারি খুব ভাল হচ্ছে। পিরোজপুর, বরিশাল ও ঝালকাঠীতে বিলাতি গাব ভাল হচ্ছে। খুলনায় নোয়াল ও বিলিম্বি চাষে ভাল ফল দেখা গেছে। পিরোজপুরে মাল্টার বাণিজ্যিক বাগান গড়ে উঠেছে। সাতক্ষীরায় বাণিজ্যিকভাবে এখন পানিফলের চাষ হচ্ছে।

উপকূলীয় অঞ্চল আমচাষের জন্য উপযোগী নয়, এমন ধারণাই এতকাল ছিল। বিশেষ করে জলমগ্নতা, জোয়ারভাটার প্লাবন, লবণাক্ততা, আমের মুকুল আসার সময় গরম আবহাওয়া, অধিক ঝড়বাতাস, আমের পোকা ইত্যাদি কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে অতীতে আম উৎপাদন ভালো হতো না। কিন্তু এখন কিছু কিছু জাতের আম বিশেষ প্রযুক্তি মেনে চাষ করে সাফল্য পাওয়া গেছে। সাতক্ষীরার আম এখন ইউরোপের বাজারে রপ্তানী হচ্ছে। সেখানকার গোবিন্দভোগ, বোম্বাই, আম্রপালি, লতাবোম্বাই, নীলাম্বরী ইত্যাদি জাতগুলো বেশ ভালো ফলন দিচ্ছে। উপকূলের বসতবাড়িসমূহে ইতোমধ্যে আম্রপালি জাতটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ও ভালো ফল দিচ্ছে। বারি আম ৪ জাতটিও এ অঞ্চলে সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। থাই পেয়ারা চাষের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বিশেষ করে পুকুরপাড়ে ও ঘেরের পাড়ে থাই পেয়ারা, পেঁপে, ডোয়ার্ফ নারিকেল ইত্যাদি চাষ করা যায়। ঘেরের পাড়ে কলা, কুল, তরমুজ ইত্যাদি ভালভাবে জন্মে। সম্ভাবনাময় সফেদা ফল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বসতবাড়িতে চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি বিভাগের গবেষকবৃন্দ লবণাক্ততা সইতে পারে কোন কোন ফলের গাছ তা নিয়ে গবেষণা করে সফলতা পেয়েছেন বলে জানা গেছে। তারা পেয়ারা, কাঁঠাল, স্যাপোডিলা বা সফেদা, কুল, জাম্বুরা— এই পাঁচটি ফল নিয়ে গবেষণা করে এসব ফলের কিছু নতুন জাত উদ্ভাবনের পথে রয়েছেন। তারা আশা করছেন, হয়তো আগামি তিন বছরের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা এসব নতুন জাতের ফল চাষ শুরু করতে পারবেন। সেসব ফলের স্বাদও যাতে ভালো হয় সেজন্য তারা গবেষণায় সে বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ অঞ্চলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা কাজুবাদাম চাষের সম্ভাবনা নিয়েও গবেষণা করছেন।

লেখক : কৃষি বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশন

অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর


মাসুদের সবুজরাজ্য

আপডেটেড ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৯:১৭
রাসেল আহমেদ

চারপাশে ইট-পাথরের দালান। মাঝখানের সাদা দালানে সবুজের রাজ্য। সেখানে থোকায় থোকায় ঝুলছে মাল্টা-কমলা, মাচায় ঝুলছে লাউ-শিম, টবে রয়েছে টমেটো-বেগুন। রয়েছে বাঁধাকপি, ফুলকপির সমাহারও। না এত কোনো বাণিজ্যিক নার্সারি বা বাগান নয়। শখ আর স্বজন-প্রতিবেশীদের উদ্বুদ্ধ করতে নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকার মঞ্জুরুল ইসলাম মাসুদ নিজের ছাদে গড়ে তুলেছেন এই বাগান। ব্যবসায়িক কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে তার বেশির ভাগ সময় কাটে ছাদকৃষিতে পরিচর্যা করে। এরই মধ্যে তার বাগান দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সেই এলাকায় বেশ কয়েকজন গড়ে তুলেছেন বাড়ির ছাদে বাগান।

মঞ্জুরুল ইসলাম মাসুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ছাত্রজীবন থেকেই মাসুদের বাগানের প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল। ওই সময় থেকেই মাসুদের ইচ্ছা ছিল এ ধরনের একটি বাগান করার। সেই স্বপ্নকে সঙ্গী করেই মাসুদের পথচলা। পরবর্তী সময়ে স্ত্রী শারমীন আক্তারের অনুপ্রেরণা ও নিজের ইচ্ছাকে সঙ্গী করে ২০১৫ সালে ছোট আকারে শুরু করেন ছাদবাগান। সেই বাগানে এখন রয়েছে কমলা, মাল্টা, ডালিম, হিমসাগর, হাঁড়িভাঙা, লেবু, পেয়ারা, আমড়া, ড্রাগন, শরিফা, জাম্বুরা, আপেল কুল, তিনফলসহ ১৫ প্রকার ফলের গাছ। সঙ্গে আছে করলা, কাঁচা মরিচ, শিম, ক্যাপসিকাম, পুদিনা পাতা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, লাউসহ বিভিন্ন প্রকারের সবজি গাছ। এ ছাড়া বাগানে বারোমাসি বেশ কিছু ফলগাছ আছে, যা বছরের পুরো সময়ই ফল দেয়। বর্তমানে বাগানে বিভিন্ন প্রকার ফল ও সবজির সমারোহ রয়েছে। বিভিন্ন গাছের ডালে ঝুলছে নানান ফল। চলতি মৌসুমে ছাদবাগানের গাছে ধরেছে মাল্টা, কমলা, তিন ফল, আপেলকুল, পেয়ারাসহ বিভিন্ন প্রকারের মৌসুমী ফল ও সবজি।

এ প্রসঙ্গে শৌখিন ছাদ বাগানি মাসুদ বলেন, ‘কৃষির প্রতি ভালোবাসা থেকে বাগান করেছি। পরিবারের বাড়তি পুষ্টির চাহিদাও মিটছে। বর্তমানে অধিকাংশ গাছের ডালে ফল শোভা পাচ্ছে। অন্যান্য প্রজাতির গাছগুলোয়ও মৌসুম অনুযায়ী ফল ধরবে। ব্যবসায়িক কাজের ফাঁকে বাগানের পরিচর্যা করছি। নিজস্ব বাগানে উৎপাদিত কীটনাশক ও ফরমালিনবিহীন অর্গানিক ফল-তরকারি দিয়ে পরিবারের চাহিদা মিটিয়েও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের মাঝে বিলি করছি। এতে যেমন মানসিক তৃপ্তি পাচ্ছি, তেমনি এই নির্ভেজাল অক্সিজেনও পাচ্ছি। এই বাগানের মাধ্যমে আমি আসলে সবার কাছে একটা বার্তাই পৌঁছে দিতে চাই। আর তা হলো- ‘সবুজেই সুখ’। বর্তমানে এলাকার অনেক বাড়ির মালিক আমার বাড়ির ছাদবাগান দেখছেন এবং ছাদবাগান তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার ফাতেহা নূর দৈনিক বাংলাকে বলেন, এটা একটা ভালো উদ্যোগ। মাসুদ যেটা করছেন, সেটা যদি ধীরে ধীরে সবাই করেন তাহলে সবুজায়ন হবে আমাদের দেশে। পাশাপাশি ভেজালমুক্ত ফল-তরকারি খেতে পারবে। পাশাপাশি পরিবারের অভাবও ঘুচবে।

লেখক: প্রতিনিধি, রূপগঞ্জ


banner close