দেশের একেক বেসরকারি হাসপাতাল ও অন্যান্য সেবা খাতের একেক রকমের চার্জ, টেস্ট ফি সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সরকারিভাবে একটি গাইডলাইন তৈরি করে হাসপাতালগুলোর মান অনুযায়ী ক্যাটাগরি তৈরি হচ্ছে। সেই ক্যাটাগরি মান অনুযায়ী ফি নির্ধারণ করে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে রোববার সারা দেশের বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিক/ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ক্যাটাগরি নির্ধারণ বিষয়ে পর্যালোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, একটি কমিটি করা হবে। আগামী এক মাসের মধ্যে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি পাবে, যত্রতত্র ফি দিয়ে দেশের জনগণের অযাচিত অর্থ ব্যয় হবে না।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ক্যাটাগরি নির্ধারণের ধরন প্রসঙ্গে জাহিদ মালেক জানান, হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা, যন্ত্রপাতি, অবস্থান, লোকবল, সুযোগ-সুবিধা ভেদে বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ, বি, সি এবং ডি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হবে। এই ক্যাটাগরির মান ভেদে এবং সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী সরকার তাদের নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করে দেবে। এতে মানুষ আগে থেকেই জানতে পারবে কোন হাসপাতালে গেলে কী সুবিধা পাওয়া যাবে এবং চিকিৎসা বাবদ কত ব্যয় হবে।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সারা দেশে বর্তমানে অলিগলিতে ক্লিনিক হয়ে গেছে। কিছু ক্লিনিক মানসম্মত সেবা দিলেও অধিকাংশেরই সেবার মান ভালো না। ফি ও নেয়া হয় ইচ্ছেমতো। স্ট্যান্ডার্ড ও নিয়ম অনুযায়ী যন্ত্রপাতি নাই। যেসব মেশিন আছে, সেগুলোও ঠিকমতো কাজ করে না। মানসম্পন্ন চিকিৎসক থাকে না। অথচ ফি নেয়া হয় অনেক বেশি। এসব অনিয়ম আর চলতে পারবে না।
সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী, মহাসচিব অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান মিলন, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুবিন খান, মহাসচিব আনোয়ার হোসেন খান।
সরকারি চিকিৎসকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাকটিস আগামী বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ১২ জেলা সদর হাসপাতাল এবং ৩৯টি উপজেলা হাসপাতালে এ কার্যক্রম শুরু হবে। কার্যক্রমের আওতায় দ্বিতীয় শিফটে বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রোগী দেখবেন চিকিৎসকরা। সপ্তাহে দুইদিন এই সেবা দেয়া হবে।
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক এই পাইলট প্রকল্প উদ্বোধন করবেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে 'ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস' বিষয়ে বিস্তারিত জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে মন্ত্রী জানান, সবার সঙ্গে আলোচনা করে আগামী ৩০ মার্চ থেকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস শুরু করবো। চিকিৎসকরা প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাকটিস এখানে করবেন সরকারি হাসপাতালে। প্রথমে আমরা কয়েকটি জেলা হাসপাতালে এই কার্যক্রম শুরু করবো।
জাহিদ মালেক আরও বলেন, ‘আমরা দেখবো, সেখানে কেমন কার্যক্রম চলছে। সেখানে যদি কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকে, আমরা সেটা সংশোধন করে পর্যায়ক্রমে ৫০০টি উপজেলা এবং ৬৪ জেলায় তা বাস্তবায়ন করবো। বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে চেম্বার করবেন। সপ্তাহে দুই দিন আপাতত এই কার্যক্রম চলবে। তাদের এই সেবা দেয়ার জন্য সম্মানি নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সম্মানির একটি অংশ চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী এবং আরেকটি অংশ হাসপাতাল পাবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে দেশের ১২ জেলা সদর হাসপাতাল এবং ৩৯ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই ব্যবস্থা চালু হচ্ছে বৃহস্পতিবার।
হাসপাতালগুলো হচ্ছে— ঢাকা বিভাগের মানিকগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতাল, রাজবাড়ী জেলা সদর হাসপাতাল। চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী জেলা সদর হাসপাতাল, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল, খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতাল। ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর জেলা সদর হাসপাতাল, খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ জেলা সদর হাসপাতাল, রাজশাহীর নওগাঁ জেলা সদর হাসপাতাল, রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও জেলা সদর হাসপাতাল, কুড়িগ্রাম জেলা সদর হাসপাতাল, বরিশাল বিভাগের ভোলা জেলা সদর হাসপাতাল, সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতাল।
এছাড়া ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, শরীয়তপুর ভেদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
চট্টগ্রামের নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কক্সবাজার পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বান্দরবান লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
ময়মনসিংহের জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, শেরপুরের নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, গফরগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
খুলনার যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, যশোরের কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
রাজশাহীর নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রাজশাহী পবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নওগাঁর সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
রংপুর বিভাগের দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, নীলফামারীর ডোমার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
বরিশাল বিভাগের বরগুনার আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
এদিকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের আওতায় রোগী দেখার ফি নির্ধারণ করেছে মন্ত্রণালয়। সে হিসেবে অধ্যাপক পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা। এরমধ্যে ৪০০ টাকা চিকিৎসক পাবেন, সেবার সহায়তাকারী পাবেন ৫০ টাকা এবং হাসপাতাল পাবে ৫০ টাকা।
এছাড়া সহযোগী অধ্যাপক বা সিনিয়র কনসালটেন্টের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০০ টাকা, যার ৩০০ টাকা চিকিৎসক পাবেন। সহকারী অধ্যাপক বা জুনিয়র কনসালটেন্ট বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা, যার ২০০ টাকা চিকিৎসক পাবেন। এমবিবিএস বা বিডিএস বা সমমনা ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের ফি ২০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, এরমধ্যে ১৫০ টাকা চিকিৎসক পাবেন।
এছাড়া লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগে ছোট সার্জারির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ফি ৮০০ টাকা এবং সার্জারির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ফি ১ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, দেশের মানুষকে চিকিৎসা নিতে হলে অনেক টাকা নিজ পকেট থেকে দিতে হয়, এটি কমানো উচিত। তবে এই খরচের ভেতরে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ হয় ওষুধের পেছনে। আর তাই চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনের দিকে নজর দেয়া দরকার।
রাজধানীর একটি হোটেলে বুধবার আয়োজিত পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) খসড়া স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান শীর্ষক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এ কথা বলেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, চিকিৎসা খাতে সাধারণ মানুষের অনেক টাকা নিজ পকেট থেকে যায়। এটি কমানো উচিত। এই খরচ ওষুধের পেছনে বেশি। আমাদের দেশে ওষুধের দাম কম, তারপরও এতো বেশি খরচ হচ্ছে কেন এটি দেখতে হবে। অনেকেই বলেন, প্রেসক্রিপশনে বেশি ওষুধ লেখা হয়। যতটুকু ওষুধ প্রয়োজন তার থেকে বেশি প্রেস্ক্রাইব করা হয়। এদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। প্রেসক্রিপশন যেন যথাযথ হয়, প্রয়োজন অনুযায়ী হয়। এখানে যেন কোনো বিজনেস ইন্টেশন কাজ না করে। সেদিকে আমাদের খেয়াল করতে হবে। যেটা দরকার সেটাই আমাদের দিতে হবে। যে সেবা দরকার সেটি আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের স্বাস্থ্যখাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা জনবল উল্লেখ করে জাহিদ মালেক বলেন, আমাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। এটি আমাদের স্বাস্থ্য খাতের এক নম্বর সমস্যা। যদি সবিস্তরে প্রশিক্ষিত জনবল থাকে তাহলে স্বাস্থ্য খাত যথাযথভাবে কাজ করবে। তিনি বলেন, প্রতিটি জেলা-উপজেলা হাসপাতালে শয্যা দুই-তিন গুণ বেড়েছে। ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশে তৈরি হচ্ছে। ভ্যাকসিন তৈরি করছি। এগুলো বাইরের মানুষ বুঝতে পারে না।
কীভাবে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়, করোনা আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছে মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, আমাদের চিকিৎসকরা বড় একটা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। করোনায় ১০ হাজার ডাক্তার, ১৫ হাজার নার্স নিয়োগ হয়েছে। তারপরও উন্নতির কোনও শেষ নেই। তিনি বলেন, মেডিকেলে সিট বেড়েছে, নার্সিংয়ে সিট বেড়েছে। আমাদের ১৭ কোটি জনসংখ্যা। যতই শয্যা বাড়াই, কম পড়ে যাচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, মেন্টাল হাসপাতালে শয্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, তারপরও আমরা জায়গা দিতে পারছি না। কারণ স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের আস্থা বাড়ছে, তারা হাসপাতালে আসছে।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা এ বি এম খুরশিদ আলমসহ অন্যরা।
মাসে বেতন ২০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে আর কিচ্ছু নেই। নেই কোনো উৎসব ভাতা কিংবা অন্য কোনো ভাতা। সেই বেতনও পাওয়া যায় দুই-তিন মাস পরপর। নামে আবাসিক থাকলেও প্রতিষ্ঠানে থেকে-খেয়ে কাজ করার সুযোগ পান খুবই কম। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় বড় একটি বিষয়। কাজেই ওই ২০ হাজার টাকা বেতনেই থাকা-খাওয়া, পরিবারকে সহযোগিতা। সে বেতনও কখনো কখনো বন্ধ হয়ে যায়। তখন উল্টো সঞ্চয়ের টাকা ভাঙতে হয়, নতুবা পরিবার থেকে আনতে হয়। যার এসব বিকল্প থাকে না, তাকে করতে হয় ঋণ। আর যার কোনো উপায় থাকে না, তাকে বাধ্য হয়ে যুদ্ধে ক্ষান্তি দিতে হয়।
এই মানবেতর জীবন কোনো প্রান্তিক বা শোষিত শ্রমিকশ্রেণির নয়, রোগীর জীবন বাঁচাতে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে যাওয়া এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকদের। আজকাল দেশে শুধু এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকের ওপর আস্থা রাখতে চান না বেশির ভাগ রোগী ও তার স্বজন। তা ছাড়া শুধু এমবিবিএস পাস করলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়াও যায় না। এ কারণে নতুন করে ভর্তি যুদ্ধে নেমে এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসকদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালসহ পোস্টগ্র্যাজুয়েশন দেয়া মেডিকেল কলেজগুলোয় উচ্চতর শিক্ষার জন্য চান্স পেতে হয়। সেই চিকিৎসকদেরই এই মানবেতর জীবন। তাদের বলা হয়, রেসিড্যান্ট ডাক্তার বা বেসরকারি আবাসিক চিকিৎসক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসকদের ৭০ শতাংশই আবাসিক চিকিৎসক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হতে পাঠ নেয়ার সুযোগ পেতে ভর্তিযুদ্ধে লড়তে হয় হাজার হাজার এমবিবিএস পাস চিকিৎসকের সঙ্গে। তাদের মধ্যে ১ হাজার বা তার কিছু বেশি চিকিৎসক পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের সুযোগ পান। এই সুযোগের পুরস্কার দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা অন-ডিউটিতে থেকে মাসিক বেতন ২০ হাজার টাকা। নেই ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখার অনুমতি। কোনো পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে বেতন বন্ধ হয়ে যায়। ছয় মাস পর আবার পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হলেই কেবল আবার বেতন পাওয়া শুরু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালসহ বিভিন্ন মেডিকেল আবাসিক চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বয়স ত্রিশের কোটায়। তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা, কারও স্ত্রী-সন্তানও রয়েছে। কেউবা আবার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। তাদের না আছে ঈদ-বোনাস, না আছে বৈশাখী ভাতা, নেই চিকিৎসা ভাতাও। একই বেতনে পাঁচ বছর ধরে তারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার আশায় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
ক্ষুব্ধ চিকিৎসকরা বলছেন, এই পাঁচ বছর ধরে কী পরিমাণ অমানবিক এবং শারীরিক ও মানসিক কষ্ট করেন চিকিৎসকরা, তার খবর কতজন জানেন? অথচ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা চালিয়ে নেন এই চিকিৎসকরাই। তারা বলছেন, ২০২৩ সালে এমন অকল্পনীয় অমানবিক নীতি কেন ও কীভাবে চলে, সেটা একেবারেই বোধগম্য নয়। একজন চিকিৎসক বিশেষজ্ঞ হওয়ার চেষ্টার সময় যে সেবা দিচ্ছেন, তার মূল্যায়ন এমন হলে তিনি কেমন সেবা দেবেন?
চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে যাদের টাকা রয়েছে, তারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। যাদের টাকা নেই তারা বিকল্প পথ খোঁজেন। কেবল এমবিবিএস পাস করার পর একজন চিকিৎসক আসলে চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি পান না। যারা কারণে অনেকেই কোনো রকমে পোস্টগ্র্যাজুয়েশনটা করতে চান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘রাষ্ট্র কীভাবে তার মেধাবীদের সঙ্গে এত বড় অন্যায় করে? কী পরিমাণ বৈষম্য আর অমানবিকতার শিকার হতে হয় রেসিডেন্টদের (আবাসিক চিকিৎসক), সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।’ তারা বলছেন, বেসরকারি আবাসিক চিকিৎসকদের সঙ্গে এই কাতারে আরও রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্সের চিকিৎসকরাও। কয়েক বছর আগে তাদের কিছু টাকা দেয়া হলেও বর্তমানে সেই ভাতাও বন্ধ রয়েছে।
ওই চিকিৎসকরা বলেন, এসব কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকায় পোস্টগ্র্যাজুয়েশনে ভর্তি হওয়া অনেক চিকিৎসকই কোর্স ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ ঢাকা শহরে সব খরচ মিলিয়ে তাদের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। অপরদিকে, বেসরকারি আবাসিক চিকিৎসকদের ফেজ-এ এবং ফেজ-বি পরীক্ষার ফি বাড়ানো হয়েছে। কয়েক বছর আগেও যে পরীক্ষার ফি ছিল ১০ হাজার টাকা, সেটা এখন ২০ হাজার টাকা। ফি বাড়ানো হলেও বাড়েনি এই চিকিৎসকদের বেতন। ফি কেন বাড়ল, তারও কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
চিকিৎসকরা বলছেন, বেসরকারি রেসিডেন্ট চিকিৎসক মানে তাদের থাকা-খাওয়ার সব দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তাও নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কয়েকজন আবাসিক চিকিৎসক বলেন, ‘আমাদের হোস্টেল নেই, খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ব্লকের কেবিন ব্লকে কিছু চিকিৎসকের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকলেই কেবল সে সুবিধা পাওয়া যায়। সাধারণ চিকিৎসকরা আবেদন করেও সিট পায় না। কেউ ভাগ্যগুণে পেলেও ‘বড় ভাইদের’ নিয়ম অনুযায়ী চলতে হবে। বেশির ভাগ চিকিৎসক বাইরে থাকেন। বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে বর্তমান দ্রব্যমূল্য বিবেচনায় কোনোভাবেই ২০ হাজারে টেকা সম্ভব নয়। অথচ সরকার থেকে কোনো উদ্যোগ নেই, পোস্টগ্র্যাজুয়েশন দেয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তরফ থেকেও কোনো চেষ্টা নেই। বরং এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কেউ কেউ কর্তৃপক্ষের রোষানলেও পড়েছেন।
একজন আবাসিক চিকিৎসক বলেন, ‘কেবলমাত্র মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে আছি। কোনোরকমে কোর্স শেষ করে বের হতে পারলে জীবন স্বার্থক হবে- এভাবেই ভাবতে বাধ্য হচ্ছি।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আবাসিক চিকিৎসকদের ভাতা খুবই অপ্রতুল। অপরদিকে তারা সবাই যে একবারেই পরীক্ষায় পাস করে যাচ্ছেন, তাও নয়। যেভাবে মানবেতর জীবনযাপন করে তারা পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করছেন, তাতে তাদের দেখলেই আমি অস্বস্তি আর বিব্রত অবস্থায় পড়ি।’ তিনি বলেন, ‘আবাসিক চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখার সুযোগ নেই। তারা নিয়মিতভাবে ভাতাও পান না। দুই-তিন মাস পর টাকাটা পান। সব মিলিয়ে খুবই বিব্রতকর অবস্থা।’
ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমি এ নিয়ে কথা বলব। বিএমএর পক্ষ থেকে এ নিয়ে রিভিউ করার অনুরোধ জানাব আমরা। আমি সরকারসহ বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করব, কারণ তারা (আবাসিক চিকিৎসক) সবাই স্বচ্ছল পরিবারের নয়। আর এই আবাসিক চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগ হয়েছে ইন্টার্ন চিকিৎসকরাও। তাদের ভাতাও খুবই কম। আমি লিখিতভাবে প্রস্তাব দেব এ বিষয়ে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আবাসিক চিকিৎসকদের এ ভাতা খুবই কম। এ ভাতা আসলে কিছুই নয়। তাই আমরা চেষ্টা করছি আরও অন্তত ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিতে।’
সরকারি চিকিৎসকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাকটিস আগামী ৩০ মার্চ থেকে শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
সরকারি চিকিৎসকদের বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সোমবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ তথ্য জানান।
মন্ত্রী বলেন, সরকারি চিকিৎসকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্র্যাকটিস আগামী ৩০ মার্চ থেকে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে শুরু করা হবে।
আরও পড়ুন: সেবা ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা, বাড়তে পারে বৈষম্যও
প্রাথমিকভাবে ১০টি জেলা হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা হাসপাতালে এ কার্যক্রম শুরু হবে। কার্যক্রমের আওতায় বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা দেবেন চিকিৎসকরা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, চিকিৎসকরা সপ্তাহে দুইদিন করে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের আওতায় রোগী দেখবেন।
প্রাইভেট প্র্যাকটিসের আওতায় রোগী দেখাতে অধ্যাপককে ৫০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপককে ৪০০ টাকা, সহকারী অধ্যাপককে ৩০০ টাকা এবং অন্য চিকিৎসককে ২০০ টাকা করে ফি দিতে হবে।
এসব ফি থেকে অধ্যাপকরা ৪০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপক ৩০০ টাকা সহকারী অধ্যাপক ২০০ টাকা এবং অন্যান্য চিকিৎসকরা ১৫০ টাকা করে পাবেন। বাকি টাকা সার্ভিস চার্জ বাবদ কাটা হবে এবং চিকিৎসকদের সহায়তাকরীরা পাবেন।
প্রতি বছরের মতো এই বছর ২৪ মার্চ পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। ১৮৮২ সালের এই দিনে বিজ্ঞানী রবার্ট কচ যুগান্তকারী যক্ষ্মার জীবাণু মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস আবিষ্কার করেন। এই দিনটি স্মরণ রেখে প্রাণঘাতী যক্ষ্মার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও এই রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পালন করতে যাচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। এ বছর প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে – ‘হ্যাঁ! আমরা টিবি শেষ করতে পারি!’
এখন পর্যন্ত ভয়াবহ প্রাণঘাতী রোগ হিসেবে যক্ষ্মা বিশ্বের দশটি মৃত্যুজনিত কারণের মধ্যে অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল টিউবারকুলোসিস রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তার ভেতর প্রায় ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন রোগী মৃত্যুবরণ করেছেন। বিশেষ করে দারিদ্র্যপীড়িত এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোতে এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
কী এই যক্ষ্মা রোগ
যক্ষ্মা ফুসফুসের সংক্রমণজনিত রোগ। ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে এই রোগ হলেও ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ রক্ত প্রবাহের সঙ্গে মিশে ফুসফুসসহ শরীরে অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। মস্তিষ্ক, হাড়, হাড়ের সংযোগ, লসিকাগ্রন্থি, পরিপাকতন্ত্র, মূত্র ও প্রজননতন্ত্র, ত্বক ইত্যাদি স্থানে যক্ষ্মারোগ হতে পারে। শুরুর দিকে সঠিক চিকিৎসা না করালে যক্ষ্মার ফলে প্রাণহানিও ঘটতে পারে।
যক্ষ্মা যেভাবে ছড়াতে পারে
শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। কোনো রোগীর কাশি, হাঁচি, থুতু ও বড় মুখ খুলে কথা বলার ফলে শরীরে প্রবেশ করতে পারে যক্ষ্মা। এতে যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীর লালা, মিউকাস, থুতু মিশে থাকে। আবার সংক্রমিত পানি ও খাবার থেকেও এটি শরীরে প্রবেশ করতে পারে। কাজেই যেখানে-সেখানে থুতু ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
যক্ষ্মার কারণ
যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে এই রোগ হতে পারে। স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, এ ছাড়া শরীরের কোনো অংশ ট্রান্সপ্লান্টের পর যেসব ওষুধ খাওয়া হয়, তার কারণেও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ডায়াবেটিসের রোগীদের মধ্যে এবং ক্যানসার আক্রান্তদের যক্ষ্মা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব ও ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে বসবাস এবং অধিক ধূমপান, মাদকাসক্তি ও মদপান যক্ষ্মার আরেকটি কারণ।
লক্ষণ
৩ সপ্তাহের বেশি কাশি, বিশেষত কফযুক্ত কাশি। এই কাশিতে রক্তও উঠে আসতে পারে।
ক্ষুধামান্দ্য, ক্লান্তি ও রাতের দিকে মাঝেমধ্যে ঘামসহ হালকা জ্বর হতে পারে।
এ ছাড়া শরীরের যে স্থানে যক্ষ্মা হয়েছে তার লক্ষণ প্রকাশিত হতে পারে।
একসময় মনে করা হতো যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই। সময়ের সঙ্গে যক্ষ্মা রোগের এখন যুগান্তকারী অনেক চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়েছে। নিয়মিত ওষুধ সেবনে যক্ষ্মা ভালো হয়। কাজেই অযথা ভয় বা আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে সঠিক সময় পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। বিশেষত ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা প্রতিরোধ এখন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যক্ষ্মা নির্মূলের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও সমাজের সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। সবার মিলিত প্রয়াসই পারে যক্ষ্মা পরিস্থিতি উত্তরণের।
লেখক: বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা।
বিশ্বের যে ৮ থেকে ১০ দেশে যক্ষ্মার প্রকোপ বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। যক্ষ্মায় প্রতি ১২ মিনিটে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। সে হিসাবে দিনে মৃত্যু হচ্ছে ১০০ জনের। অথচ যক্ষ্মার চিকিৎসা রয়েছে দেশে। সরকার বিনা মূল্যে যক্ষ্মার ওষুধ দিচ্ছে। তার পরও এত মৃত্যুর নেপথ্য কারণ হলো, যক্ষ্মা নিয়ে মানুষের অসচেতনতা এবং রোগী শনাক্ত না হওয়া।
গ্লোবাল টিবি রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ২ লাখ ৯২ হাজার ৯৪২ জন যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয়েছে। প্রতি লাখে ২২১ জন নতুন যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয় এবং প্রতি লাখে ২৪ জন মৃত্যুবরণ করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিবি-এল এবং এএসপি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. মাহফুজার রহমান জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে যেখানে প্রতি ১ লাখ যক্ষ্মা রোগীর মধ্যে ৪৫ জনের মৃত্যু হতো, সেখানে ২০২১ সালে মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের।
তবে এ সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো যক্ষ্মার উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখানে প্রতি মিনিটে একজন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে। ২০২১ সালে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে ৪২ হাজারের। অর্থাৎ প্রতি ১২ মিনিটে যক্ষ্মায় একজনের মৃত্যু হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুবাহিত এই রোগটি সাধারণত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বেশি আক্রমণ করে। সেই সঙ্গে দারিদ্র্যপ্রবণ অঞ্চলে এর প্রকোপ বেশি।
তাদের বক্তব্য, দেশে যক্ষ্মা নির্মূলে এখনো কিছু সংকট আর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। আবার দেশে এমন কিছু ‘হার্ড টু রিচ’ এলাকা রয়েছে, যেখানে এখনো স্বাস্থ্যসেবা ঠিকমতো পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এসব কারণে রোগী শনাক্ত একটি কঠিন বিষয়। যার কারণে এখনো দেশ থেকে যক্ষ্মা নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।
চিকিৎসকরা বলছেন, একজন যক্ষ্মারোগী থেকে কমপক্ষে ছয়জনে রোগটি ছড়াতে পারে। তাই কোথাও একজন যক্ষ্মারোগী পাওয়া গেলে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত কমপক্ষে ছয়জনকেই পরীক্ষা করাতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম ‘দেশ থেকে টিবি নির্মূল করতে চাই’ মন্তব্য করে বলেন, কিন্তু দিনকে দিন এর জটিলতা বাড়ছে। বিশেষ করে হাড়, অন্ত্র, জরায়ু এবং অস্ত্রোপচারস্থলে যক্ষ্মার সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে বেশি, যা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই এটি নিয়ন্ত্রণ করতে অস্ত্রোপচারসংক্রান্ত যক্ষ্মা নির্ণয় ও প্রতিরোধে গুরুত্ব দিতে হবে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এই কিছুদিন আগেও যক্ষ্মা কেবল বড়দের রোগ হিসেবে চিহ্নিত হতো। ধারণা করা হতো শিশুরা যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় না। কিন্তু শিশুরাও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা পরিবারের বড়দের কাছ থেকেই এতে সংক্রমিত হচ্ছে।
যক্ষ্মা নির্মূলে কিছু ক্ষেত্রে এগোলেও শতভাগ রোগী শনাক্ত করতে না পারায় বাংলাদেশ এখনো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
তিনি বলেন, পৃথিবীর যেসব দেশে ৭০ শতাংশ যক্ষ্মারোগী রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বাংলাদেশ যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বেশ সফল হলেও কিছু ক্ষেত্রে এখনো কাজ করতে হবে।
যক্ষ্মা রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, যক্ষ্মা একেবারে নির্মূল না করতে পারার পেছনে রোগী শনাক্ত না করতে পারা অন্যতম কারণ। কারণ, যক্ষ্মা হলে মানুষ তাকে প্রকাশ করতে চায় না। এর পেছনে রয়েছে কুসংস্কার এবং সামাজিক স্টিগমা।
একজন যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর পরিবারকে সমাজে একঘরে করার উদাহরণও রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকে যক্ষ্মার লক্ষণ থাকলেও সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে রোগটি লুকিয়ে রাখে। এ কারণে রোগটি শতভাগ নির্মূল করা যাচ্ছে না।
যক্ষ্মা রোগ নিয়ে সরকারের সঙ্গে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী সংস্থা ইউএসএআইডি। ইউএসএআইডির বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. সামিনা চৌধুরী। তিনি ১৮ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে সঠিক সময়ে শনাক্ত ও চিকিৎসা নিতে পেরেছিলেন তিনি। সে কথা জানিয়ে ড. সামিনা চৌধুরী বলেন, ‘আমার রোগটি সঠিক সময়ে শনাক্ত হয়েছিল বলে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছি। এ জন্য রোগটি শনাক্তে জোর দিতে হবে। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিন্তু একে নির্মূল করতে হবে।’
দেশে যক্ষ্মা নিয়ে অনেক কাজ হলেও ২০৩০ সালের মধ্যে নির্মূল করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ মানুষ সচেতন যেমন নয়, তেমিন রোগীও ঠিকমতো শনাক্ত হচ্ছে না বলে দৈনিক বাংলাকে বলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার।
তিনি বলেন, ‘সব রোগীকে স্ক্রিনিং বা শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না দেশে। দেশের অনেক এলাকায় আমরা ঠিকমতো স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে পারছি না। আর রোগী শনাক্ত না করতে পারার কারণে তাদের চিকিৎসাও সম্ভব হচ্ছে না।’
ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের কিছু সংকট রয়েছে, রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জ। অনেক উপজেলায় যন্ত্রপাতি নেই, যন্ত্রপাতি খারাপ রয়েছে, এমনও আছে। সেসব জায়গায় যন্ত্রপাতি পুনঃস্থাপন করার চেষ্টা করছি আমরা। এসব সীমাবদ্ধতা যদি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূল করা অসম্ভব হবে না।’
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা রোজা রেখেও রক্তের সুগার পরিমাপ করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুসারে প্রমাণিত এবং মুসলিম ধর্ম অনুসারে সেটা স্বীকৃতিও বলে জানিয়েছেন অ্যান্ডোক্রাইনোলজিস্টরা।
বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ডিএমসি) ডা. মিলন অডিটোরিয়ামে ‘রমজানে ডায়বেটিস ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে এ তথ্য জানানো হয়।
হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সার্বিক সহযোগিতায় ডিএমসি’র অ্যান্ডোক্রাইন বিভাগ ও শিক্ষক সমিতি’র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত চিকিৎসকদের নির্দেশনামূলক এ সেমিনারে বক্তারা বলেন, এ বিষয়ে দেশের কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব ও মিশরের কায়রোতে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইসলামী চিন্তাবিদদের মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে তারা এর স্বপক্ষে ধর্মীয় যুক্তিগুলো উপস্থাপনের মাধ্যমে বলেছেন রক্তে সুগারের পরিমাণ পরিমাপ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধর্মীয় বাধা নেই। কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে এই বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করার আহ্বান জানিয়েছেন ডিএমসির অ্যান্ডোক্রাইনোলজিস্টরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অ্যান্ডোক্রাইন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদের সভাপতিত্বে সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল আলম চৌধুরী, ডিএমসির অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম সাইফউদ্দিন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা দেবেশ চন্দ্র তালুকদারসহ অন্যরা।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, রোজা রাখতে ডায়বেটিস রোগীদের কোনো বাধা নেই। রোজা রাখার কারণে যে দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকা হয় কিংবা যে ফাস্টিং হয়, তাতে ডায়াবেটিস রোগীদের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যার কারণে এ ক্ষেত্রে নিয়মিত ডায়াবেটিস পরিমাপ করার বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন চিকিৎসকরা।
গর্ভবতী নারীদের জন্য রমজানের নির্দেশনামূলক তথ্য জানিয়ে তারা বলেন, রোজা রেখে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় না খেয়ে থাকার কারণে ফিটাসের বা গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হয়। এ ক্ষেত্রে রোজা না রাখার পরামর্শ থাকলেও নিয়মিত চিকিৎসকদের পরামর্শের মাধ্যমে এবং শারীরিক কোনো সমস্যা না থাকলে রোজা রাখতে কোনো সমস্যা নেই বলে জানান তারা। এ ক্ষেত্রে আধুনিক ইনসুলিন ব্যবহারের মাধ্যমে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দেন তারা।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, দেশের ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ডিএমসির এন্ডোক্রাইনোলজিস্টরা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তবে দেশের ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত হারে বেড়ে চলছে বলে চিকিৎসাসেবা সম্পূর্ণরূপে প্রদান করতে চিকিৎসকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
দেশের প্রায় দেড় কোটি বা প্রতি ১৫ জনের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিন্তু তাদের একটি বড় অংশই জানে না, তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
বাংলাদেশ এখন করোনামুক্ত বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবেও পরিচিত হয়ে বলে দাবি করেন তিনি।
বুধবার দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে জাহিদ মালেক বলেন, ‘বাংলাদেশ সংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণে ভালোভাবে করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ এখন করোনামুক্ত। টিকা প্রদান কার্যক্রমেও দেশের সফলতা রয়েছে, প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকা দেয়া হয়েছে।’
বর্তমানে এখন আর করোনাতে মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘দেশে করোনা সংক্রমণের সংখ্যাও কম।’
দেশে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষে তুলে ধরে জাহিদ মালেক বলেন, ‘দেশে অসংক্রামক রোগ ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনির মতো রোগ বাড়ছে। এরজন্য দেশের আট বিভাগে ৮টি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেখানে খরচ হবে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়াও রাজধানী ঢাকা ছাড়া বাকি ৭ বিভাগে বার্ন ইউনিট করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন চারজন। তাদের নিয়ে সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত মোট শনাক্ত হলেন ২০ লাখ ৩৭ হাজার ৯৮২ জন। এ সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা যায়নি। ফলে এ নিয়ে দেশে টানা ৩৭ দিন করোনায় মৃত্যুহীন।
এর আগে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি অধিদপ্তর একজনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ২৯ হাজার ৪৪৫ জন।
অধিদপ্তরের হিসাবে, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ০ দশমিক ২৭ শতাংশ আর এখন পর্যন্ত রোগী শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ আর শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুহার ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তিন রোগী শনাক্ত হবার কথা জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। এর ঠিক ১০ দিন পর ১৮ মার্চে করোনাতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম রোগীর মৃত্যুর কথাও জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
করোনার বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডবে দেশে একদিনে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই রেকর্ড সংখ্যা ১৬ হাজার ২৩০ জন রোগী শনাক্ত হয়। আর ২০২১ সালের পাঁচ ও ১০ আগস্ট একদিনে ২৬৪ জনের মৃত্যুর খবর আসে। যা কিনা দেশে মহামারিতে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু।
দেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন ১০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এর মূল কারণ হিসেবে তিনি সচেতনতার অভাব এবং ট্যাবুকে (সামাজিক বেড়াজাল) দায়ী করেছেন।
বুধবার দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। আগামী ২৪ মার্চ বিশ্বজুড়ে যক্ষ্মা দিবস পালন করা হবে। দিবসটিতে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘ইয়েস, উই ক্যান এন্ড টিবি।’ বাংলায় যাকে বলা হচ্ছে, ‘হ্যাঁ, আমরা যক্ষ্মা নির্মূল করতে পারি।’
বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস উপলক্ষে যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও আইসিডিডিআর,বি পরিচালিত ইউএসএআইডির অ্যালায়েন্স ফর কমব্যাটিং টিবি ইন বাংলাদেশ (এসিটিবি)।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘যক্ষ্মার ওষুধ এখন বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে। দেশের প্রায় উপজেলা, জেলা হাসপাতালে এ রোগের চিকিৎসা হচ্ছে এবং ওষুধসহ সবকিছু বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এরপরও সচেতনতা ও যথাসময়ে চিকিৎসা গ্রহণের অভাবে প্রতিদিন দেশে প্রায় ১০০ জন যক্ষ্মা রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “যক্ষ্মা একটি বায়ুবাহিত রোগ। আগে মনে করা হতো শিশুদের টিবি হয় না, কিন্তু এখন অনেক শিশুও এতে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে আগে ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই’র বদলে এখন আমরা বলতে পারি, যক্ষ্মাকেও জয় করা যায়। তার জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী শনাক্ত করে তার চিকিৎসা শুরু করা।”
বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি মানুষের শরীরে টিবি বা যক্ষ্মা আছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘যক্ষ্মায় বছরে ১৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। আমাদের দেশে যক্ষ্মা শনাক্তের হার প্রায় ৮০ শতাংশ আর সুস্থতার হার প্রায় ৯৫ শতাংশ। তবে এখনো প্রায় ২০ শতাংশ রোগী শনাক্তের বাইরে থাকছে এবং তারা চিকিৎসার আওতায় আসছে না।’
জাহিদ মালেক বলেন, ‘বিশ্বে আট থেকে দশ দেশের মধ্যে ৭০ শতাংশ রোগী। সেই তালিকায় ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়ার মতো বাংলাদেশও রয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে ২০০২ সালে যেখানে প্রতি লাখে ৫৪ জনের মৃত্যু হতো সেখানে এখন মৃত্যু হচ্ছে ২৪ জনের। প্রতি বছর দেশে ২ লাখ ৯০ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হয়, আর বছরে মারা যায় ৪০ হাজার।’
তবে সরকারের একার পক্ষে এই সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় জানিয়ে মন্ত্রী সরকারি-বেসরকারি সব পক্ষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সবাই এগিয়ে এলে যক্ষ্মা নির্মূল আগামী ২০৩০ সালের মধ্যেই সম্ভব হবে।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ডা. তাহমিদ আহমেদ, ইউএসআইডির ইনফেকশাস ডিজিজ টিম লিডার ডা. শামীমা চৌধুরী, জাতীয় টিবি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. মাহফুজুর রহমান সরকারসহ অন্যরা।
স্থগিত করা ২০১৩ ও ২০২০ সালের মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ প্রক্রিয়া অবিলম্বে শেষ করার দাবি জানিয়েছে বেকার অ্যান্ড প্রাইভেট সার্ভিসেস মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএসএমটিএ)।
সোমবার অ্যাসোসিয়েশনের এক প্রতিনিধি সভায় বক্তারা বলেন, ২০০৮ সালের পর মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ না হওয়ায় রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে নিয়োগ না হওয়ার কারণে বেকার মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
এ পরিস্থিতির জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, ব্যর্থতা ও উদাসীনতাকে দায়ী করেন সংশ্লিস্টরা। তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চিকিৎসক ও নার্সদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও ব্যতিক্রম কেবল মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের বেলায়।
২০১৩ সালে স্থগিত করা মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা না থাকার পরও কর্তৃপক্ষের নীরব ভূমিকায় ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট বলেও জানান বক্তারা। তারা বলছেন, ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পর ১২০০ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা হয়। এরপর নানা অনিয়মের কারণে সে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। সম্প্রতি ওইসব পদে যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছতার সঙ্গে করার দাবি জানিয়ে বিপিএসএমটিএর সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, আগের বারের মতো অনিয়ম হলে তা প্রতিহত করা হবে।
দেশের হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘ দিন ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত থাকায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ঘাটতি ছিল। করোনা প্রাদুর্ভাবের পর থেকে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের বিষয়টি আবার সামনে আসে। করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ ও ল্যাবরেটরি বাড়ানোর ফলে সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের দাবি জোরালো হয়। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের নির্দেশ দেন।
সে অনুযায়ী ২০২০ সালের ২৯ জুন মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ৮৮৯টি, মেডিকেল টেকনিশিয়ানদের ১৬৫০টি, কার্ডিওগ্রাফার পদে ১৫০টিসহ মোট ২৬৮৯টি পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তদর। পরে লিখিত পরীক্ষায় ২৩ হাজার ৫২২ জন অংশ নিয়ে উত্তীর্ণের মধ্যে থেকে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় পরের বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেই নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম ও ঘুষের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ২৮০০ পদের সেই নিয়োগ বাতিল করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এরপর ২০ সেপ্টেম্বরের নির্দেশনার আলোকে ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর নতুন এক অফিস নির্দেশনায় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফার পদে চলমান জনবল নিয়োগের কার্যক্রম বাতিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অফিস আদেশে বলা হয়, স্বল্প সময়ের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। এর আগে যারা আবেদন করেছেন, তাদের নতুনভাবে আবেদনের প্রয়োজন নেই। তারা নতুন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। পরে সে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল চেয়ে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পর পুরুষের তুলনায় নারীর জটিলতা দেড় থেকে চার গুণ বেশি। অপরদিকে, যারা করোনাতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তাদের জটিলতা হাসপাতালে যাদের ভর্তি হতে হয়নি তাদের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি। সেইসঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের পরবর্তীতে ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট এবং হৃদযন্ত্রের জটিলতার ঝুঁকিতে থাকতে হয়েছে।
মঙ্গলবার আইসিডিডিআর,বি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) যৌথভাবে ‘লং টার্ম সিকুয়েল অব কোভিড-১৯: অ্যা লংগিটুডিনাল ফলো-আপ স্টাডি ইন ঢাকা, বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি সেমিনারে এক গবেষণার ফলাফলে এ তথ্য জানায়।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার প্রথম পাঁচ মাসের ফলো-আপের ফলাফল সম্প্রতি গবেষণা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট রিজিওনাল হেলথ সাউথইস্ট এশিয়ায় প্রকাশিত হয়। এশিয়ার মধ্যে এটি প্রথম গবেষণা যেখানে দেখা যায়, কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা রোগীরা পরবর্তীতে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে, যাকে পোস্ট কোভিড-১৯ সিনড্রোম (পিসিএস) বা লং কোভিড হিসেবেও অভিহিত করা হয়। ওই সেমিনারে ‘লং কোভিড ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন ফর ফিজিশিয়ানস’ শীর্ষক একটি নির্দেশিকাও উপস্থাপন করা হয়। গবেষণাটি পরিচালিত হয় ইউএসএআইডির অর্থায়নে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ বছরের কম বয়সীদের তুলনায় ৬০ বছরের বেশি বয়সী, যারা করোনা থেকে সেরে উঠেছেন তাদের কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদযন্ত্রের জটিলতা (উচ্চ রক্তচাপ, দ্রুত হৃদকম্পন বা পা ফুলে যাওয়া) এবং স্নায়বিক (পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বা হাত ও পায়ে অসাড়তা, ঝিম ঝিম করা ও ব্যথা, স্বাদ ও গন্ধের অস্বাভাবিকতা) জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ। এই রোগের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলোও নারী-পুরুষ ভেদে আবার পৃথক; পুরুষের তুলনায় নারীদের এই জটিলতার প্রকোপ দেড় থেকে চার গুণ বেশি। আবার যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যাদের আইসিইউ দরকার হয়েছিল তাদের, যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়নি তাদের তুলনায় দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার সম্ভাবনা দুই থেকে তিন গুণ বেশি।
বিএসএমএমইউ-এর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত, কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. চৌধুরী মেশকাত আহমেদ এবং আইসিডিডিআর,বি-র নিউট্রিশন ও ক্লিনিক্যাল সার্ভিস বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী ও প্রধান গবেষক ডা. ফারজানা আফরোজ গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন।
তারা জানান, ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবরের মধ্যে ঢাকার দুইটি করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া ১৮ বছরের বেশি বয়সী ৩৬২ জনকে নিয়ে এই গবেষণা করা হয়। তাদের করোনা পরবর্তী জটিলতা নির্ণয় করার জন্য সেরে ওঠার ১ মাস, ৩ মাস এবং ৫ মাস পর ফলো-আপ করা হয়। এসব নারীদের স্নায়বিক, হৃদযন্ত্র, শ্বাসযন্ত্র এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তাদের গত দুই বছর ধরে ফলো-আপে রাখা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত করোনা রোগী সুস্থ হওয়ার পর এবং নিয়মিত ওষুধ খাবার পরও তাদের রক্তে অনিয়ন্ত্রিত শর্করার (ব্লাড সুগার) সম্ভাবনা ছিল যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়নি তাদের তুলনায় ৯ থেকে ১১ গুণ বেশি। তাই যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তাদের ইনসুলিন প্রয়োজন হয়েছিল বেশি।
এটি শঙ্কার বিষয় মন্তব্য করে অনুষ্ঠানে জানানো হয়, হাসপাতালে ভর্তি না হওয়া রোগীদের তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার হার ছিল প্রতি ১ হাজার জনে ১০ জন। একইভাবে, করোনা থেকে সেরে ওঠার পর নতুন করে কিডনি জটিলতা (হাই ক্রিয়েটিনিন এবং প্রোটিনিউরিয়া) এবং লিভার জটিলতা (বর্ধিত লিভার এনজাইম) উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল। তবে এখানে স্বস্তির যে তাদের জটিলতাগুলো কমানো গেছে।
তবে শ্বাসকষ্ট, দ্রুত হৃদকম্পন, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, উদ্বেগ, বিষণ্ণতার মতো কিছু বিষয় করোনা থেকে সেরে ওঠার ৫ মাস পরও সেভাবে কমানো যায়নি।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, করোনা থেকে সেরে ওঠাদের প্রয়োজনীয় ফলো-আপ এবং চিকিৎসা নিতে হবে। উচ্চ ঝুঁকির কারণে বয়স্ক এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের হৃদরোগ জটিলতার জন্য নিয়মিত ফলো-আপে থাকতে হবে।
আবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের নতুন করে ডায়াবেটিস-এ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। কারণ এটি দেশে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত এই গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসকদের জন্য লং কোভিড চিকিৎসায় ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, ‘একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনের অভাবে সহজে নির্ণয় করা যায় না এমন কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলোর চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আর তাই প্রস্তাবিত গাইডলাইন চিকিৎসকদের সর্বাধিক সাফল্যের সঙ্গে রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনে সহায়তা করবে।’
আইসিডিডিআর,বি’র নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘করোনার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব এবং তার ধরন নির্ণয়ে এই গবেষণার ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
এটি প্রমাণিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘করোনায় যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়।’
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বিএসএমএমইউয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আইসিডিডিআর,বি ও বিএসএমএমইউ যৌথভাবে আরও নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম।
ইউএসএআইডির হেলথ এক্সপার্ট ডা. সামিনা অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বাংলাদেশে ২০ লাখের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কী ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিয়েছে এবং তার ব্যাপ্তি কেমন ছিল সেটা অজানা ছিল। কিন্তু এই গবেষণা সে বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। লবণাক্ত পানি স্থানীয়দের স্বাস্থ্যে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এসব পানি পান করায় বাড়ছে রক্তচাপ, কিডনি রোগ ও গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ।
সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে অসংক্রামক রোগ এবং পরিবেশগত পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক স্বাস্থ্য গবেষণা নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে এ তথ্য জানায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, আইসিডিডিআর,বি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি) যৌথ সমন্বয়ে সম্প্রতি গবেষণাকেন্দ্র উদ্বোধন হয়। এই গবেষণা কেন্দ্র অসংক্রামক রোগের দ্রুত ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় বৈশ্বিক পরিবেশগত পরিবর্তনের হুমকির দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার নীতিনির্ধারণ-সংক্রান্ত গবেষণা, গবেষণার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন নিয়ে কাজ করবে।
সেন্টারটি যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন এবং ভারতের দ্য জর্জ ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল হেলথসহ শ্রী রামচন্দ্র ইনস্টিটিউট অব হায়ার এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, ইন্দোনেশিয়ার ব্রাউইজায়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইসিডিডিআর,বির যৌথ সহযোগিতায় স্থাপিত হয়। বাংলাদেশে আইসিডিডিআর,বির ড. আলিয়া নাহিদের তত্ত্বাবধানে এনআইএইচআর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ সেন্টারটি পরিচালিত হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডব্লিউডিবি) সেন্টারটির পরিচালনায় সহায়তা করবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডন, ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথ, যুক্তরাজ্য কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে।
সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এসব প্রভাবের মধ্যে রয়েছে রক্তচাপ বৃদ্ধি, কিডনি রোগ এবং গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপের হার বৃদ্ধি।
এই গবেষণা সেন্টারটি সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার ক্ষতি কমিয়ে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ মোকাবিলায় সাশ্রয়ী, টেকসই সমাধান বের করা ও পরীক্ষা করার জন্য কাজ করবে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক দেশে অসংক্রামক রোগ মোকাবিলায় প্রতিটি বিভাগে একটি করে আধুনিক হাসপাতাল করার কথা বলেন। তিনি বলেন, এনআইএইচআর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ সেন্টার গবেষণার মাধ্যমে অসংক্রামক রোগ মোকাবিলায় নীতিনির্ধারণ সহায়ক তথ্য ও প্রমাণ সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে কাজে লাগবে।
অনুষ্ঠানে ড. আলিয়া নাহিদ গ্রামীণ বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘কোবরা-বিপিএস কৌশল’ নামের একটি মাল্টি-কম্পোনেন্ট ইন্টারভেনশন মডেল উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন।
আমাদের শরীরের জলীয় অংশকে পুরো শরীরে সমানভাবে প্রবাহিত করতে ‘লিম্ফনোড’ বলে কিছু ক্ষুদ্রাকার অঙ্গ আছে, যা অতিরিক্ত পানিকে শোষণ করতে সহায়তা করে। এই ক্ষুদ্রকায় লিম্ফনোডগুলো শরীরের ভেতরে থেকে এই অতিরিক্ত পানিকে কোনো স্থানে জমাট না বাঁধতে সহায়তা করে। অর্থাৎ পুরো বাহ্যিক শরীরে পানির সুষম বণ্টন।
লিম্ফইডিমা কেন হয়?
১. চিকিৎসা-পরবর্তী কারণে অথবা ক্যানসার ছড়িয়ে গেলে (উদাহরণ: স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় আক্রান্ত লিম্ফনোড সরিয়ে ফেলতে হয়, এ ছাড়া যেকোনো ধরনের ক্যানসার লিম্ফনোডে ছাড়িয়ে পরলে অথবা ক্যানসারের চিকিৎসায় রেডিয়েশনের কারণে।)
২. এক প্রকার পরজীবী দ্বারা গোদ রোগ বা ফাইলেরিয়াসিস এক প্রকার পরজীবী ঘটিত রোগ। এটি ক্রান্তীয় অঞ্চলের সংক্রামক রোগ যা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে দেখা যায়।
৩. নিরাময় অযোগ্য কোনো রোগে লিম্ফনোড কাজ করা বন্ধ করে দিলে লিম্ফইডিমা রোগ দেখা দেয়।
লক্ষণ
শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ (হাত বা পা) ব্যথা ও ভারী হয়ে যাওয়া, স্বাভাবিক চলাফেরায় সমস্যা হওয়া, চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে ইনফেকশন তৈরি হওয়া, চামড়া শক্ত, মোটা ও আঁটসাঁট হয়ে যাওয়া, চামড়াতে পানি জমে অবাঞ্ছিত ভাঁজের তৈরি হওয়া, চামড়ার ভেতর থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়া।
এটি একটি নিরাময় অযোগ্য রোগ অর্থাৎ এর কোনো ধরনের চিকিৎসা নেই। তবে আছে প্রতিকার ও পরিচর্যা, যা এই রোগের লক্ষণগুলোকে কমিয়ে আনতে পারে আর জীবনকে স্বাভাবিক ও উপভোগ্য করতে পারে।
আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্ত মানুষের জন্য এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটি কথা বলে, তা হলো ‘আর কিছু করার নাই বাড়ি নিয়ে যান।’ কিন্তু এই কথা শুনতে আমরা প্রস্তুত নই। পৃথিবীজুড়ে প্রতি ১ লাখ নারীর মাঝে একজন ও ৪ লাখ পুরুষের মাঝে একজনের এই রোগ হয়। কিন্তু যার হয় তার জন্য কিন্তু ১০০ ভাগ ভোগান্তি। কিন্তু একটু সচেতনতা আমাদের এই ভোগান্তি থেকে ভালো রাখতে পারে। স্তন ক্যানসারের অপারেশনের পরে বা উপরিউল্লিখিত কারণে যদি সঠিক পরিচর্যা, ব্যায়াম ও বিজ্ঞানসম্মত জীবনযাপন করতে পারা যায়, এই কষ্ট ও ভোগান্তি অনেক কমে যেতে পারে।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আছে সব বিভাগগুলোর ব্যর্থতার ওপর। তাই সবাই যখন বলে আর কিছু করার নেই, তখন আমরা বলি ‘পাশে আছি’। বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভোগান্তি ও কষ্ট কমানো সম্ভব। গত ২০০৭ সাল থেকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিভাগ এমন ভোগান্তিতে থাকা মানুষদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এই বিভাগে প্রতি সোমবার লিম্ফইডিমায় আক্রান্ত রোগীদের এককালীন ৩০ টাকার বিনিময়ে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। এ ছাড়া ঢাকা শহরে যারা হাসপাতালে আসতে পারেন না তাদের বাসায় গিয়ে এই সেবা দেয়া হয়।
চিকিৎসা বিষয়ে যোগাযোগের ঠিকানা: প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ, ই-ব্লক, ৪র্থ তলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (৫১১ নং রুম, মেডিসিন আউট ডোর)
লেখক: পিএইচডি ফেলো (প্যালিয়েটিভ কেয়ার, ব্রাইটন সাসেক্স মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইউকে)