রাজধানীর ঢাকা শিশু হাসপাতালের বহির্বিভাগে সাতটি কক্ষে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। ১৮৪ নম্বর কক্ষে পাঁচ মাস বয়সী মেয়েকে ‘ডাক্তার দেখিয়ে’ বের হন সাদ্দাম হোসাইন ও রোমানা আক্তার দম্পতি। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রের সঙ্গে আরেকটি রঙিন স্টিকার দিয়েছেন; যাতে একটি কোম্পানির বয়সভেদে ফর্মুলা দুধের (কৌটাজাত গুঁড়া দুধ) নামের পাশে টিক চিহ্ন রয়েছে।
ঘটনাটি এ বছরের পয়লা ফেব্রুয়ারির। শিশুটির বাবা সাদ্দাম হোসাইন জানান, মেয়ের ওজন কম, ঠাণ্ডাজনিত সমস্যায় ভুগছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এসেছেন। শিশুটির মা বলেন, ‘বুকে দুধ আছে, ডাক্তার বলছে বাবুর ওজন কম, কৌটার দুধ খাওয়ালে ভালো হবে।’
দেশে শিশুদের চিকিৎসার সবচেয়ে বড় হাসপাতালটি বর্তমানে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত। সরকারি অনুদানপুষ্ট স্বায়ত্তশাসিত এই হাসপাতালটির সেই কক্ষে ওই দিন রোগী দেখেন দুজন চিকিৎসক। তাদের একজন আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সাইয়্যেদা মাহিনূর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘দুই বছরের কম বয়সী শিশুকে ফর্মুলা দুধের পরামর্শ দিই না। তবে কর্মজীবী মা অথবা কোনো মা বেশি পীড়াপীড়ি করলে শুরুতে বুকের দুধের জন্য কাউন্সেলিং করি, না মানলে বাধ্য হয়ে ফর্মুলা দুধ দিতে হয়।’
বিদেশি একটি ফর্মুলা দুধের (রিপ্রেজেন্টেটিভ) প্রতিনিধির নির্ধারিত কর্ম-এলাকা এই হাসপাতালসহ শ্যামলী, মোহাম্মদপুর। গত পাঁচ বছর ধরে তার প্রাত্যহিক কাজ দুপুর ১২টার পর হাসপাতালটির চিকিৎসকদের ‘সালাম দেয়া’ এবং নার্সসহ অন্য স্টাফদের সঙ্গে ‘হাসি মুখে’ কুশল বিনিময়। তাদের জন্য নানান উপঢৌকনের ব্যবস্থাও করেন তিনি। প্রতিনিধির কাজের ফলাফল হিসেবে হাসপাতাল এলাকায় গত পাঁচ বছরে এই কোম্পানির ফর্মুলা দুধের বিক্রি অন্তত ছয়গুণ বেড়েছে বলে জানান এই প্রতিনিধি।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী জন্মরে প্রথম ছয় মাসে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ার হার ছিল ৬৫ শতাংশ। ২০১৭ সালে তথ্য নিয়ে জরিপটি করা হয়। অথচ নগর স্বাস্থ্য জরপি বলছে, ২০২১ সালে শহর এলাকায় এ হার ৫২ শতাংশের কম।
শিশুর বিকাশের জন্য, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে মায়ের বুকের দুধের কোনো বিকল্প নেই।
নগর স্বাস্থ্য জরিপ ২০২১ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফের তথ্য ও জরিপ বলছে, ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে কেবল বুকের দুধ খাওয়ানো গেলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করা যায়, কমে মৃত্যুঝুঁকি। কিন্তু দেশে জন্মের প্রথম ছয় মাসে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার বাড়ছে না। বরং শহর এলাকায় এ হার কমছে। বুকের দুধ খাওয়াতে চান এমন মায়েরা পাচ্ছেন না সঠিক দিকনির্দেশনা। ফর্মুলা দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ আসে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কাছ থেকে।
নিজস্ব অনুসন্ধান এবং জরিপেও ফর্মুলা দুধ ব্যবহারের একই ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। এতে দেখা যায়, কর্মজীবী মায়েরা বাধ্য হয়ে শিশুকে দেন ফরর্মুলা দুধ। ‘বাচ্চা শুকনা’ বলে আত্মীয়স্বজনের চাপেও দিতে হয়। কোনো কোনো মা অবশ্য ফর্মুলা দুধকে পুষ্টিকর ভেবে দেন। অনলাইন প্রচারেও বাড়ছে ফর্মুলা দুধের ব্যবহার।
কর্মস্থলে ফিরতে হবে বলে দুই মাস বয়সে মেয়েকে ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো শুরু করেন রুবানা আহমেদ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত এই কর্মকর্তার কথা, ‘আগেভাগে অভ্যাস না করালে হুট করে ফর্মুলা খাবে না।’ মেয়ে প্রথম ছয় মাসে ডায়রিয়া, সর্দি-কাশি ও নিউমোনিয়ায় ভুগেছে। আবার টাঙ্গাইলের মধুপুরের গৃহিণী চায়না আক্তার বলেন, ‘তোলা (গুঁড়া দুধ) খাওয়ালে শিশুর শরীর বাড়ে, তাই জন্মের পরেই দিয়েছি। বাচ্চা মোটাসোটা না হলে শ্বশুরবাড়িতে কথা শুনতে হতো।’ ইউটিউব চ্যানেলে চিকিৎসকদের ভিডিও দেখে ছেলেকে তিন মাস বয়স থেকে ফর্মুলা দিচ্ছেন বলে জানান সাভারের মোহাম্মদ রনি।
জন্মের প্রথম ছয় মাসে শিশু কী খেয়েছে, এ সময়ে শিশুর রোগে ভোগা, ফর্মুলা দুধের পরামর্শ কার কাছ থেকে এসেছেসহ সাতটি প্রশ্ন রেখে ৭০ জন মায়ের মধ্যে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে একটি জরিপ চালানো হয়েছে। সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে সরাসরি, অনলাইন, মুঠোফোনে। গ্রাম ও শহরের এই মায়েরা বিভিন্ন বয়সের, নানান পেশার।
সর্বশেষ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৯ (বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে)-এর তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে দেশে শিশুকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার ৬৫ শতাংশ। জরিপটি চালায় জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট)। নিপোর্টের ২০১১ সালের একই জরিপে এ হার ছিল ৬৪ শতাংশ। দেশের ১১টি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় নিপোর্টের ২০২১ সালের নগর স্বাস্থ্য জরিপে দেখা যায়, এ হার আরও কমে ৫২ শতাংশ হয়েছে।
বুকের দুধের গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব, চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের কাছ থেকে ফর্মুলা দুধের পরামর্শ আসা, ফর্মুলা দুধের বিপণনব্যবস্থার প্রভাব, কর্মজীবী নারীদের ছুটির ঘাটতি, স্বজনদের চাপ, অনলাইনে প্রচার, জনসমাগমস্থলে/পাবলিক প্লেসে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা না থাকার কারণে মূলত মায়েরা ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়াতে পারছেন না।
চিকিৎসকরা দিচ্ছেন ফর্মুলরা পরামর্শ
সকাল ৯টার পর থেকেই ঢাকা শিশু হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করে। চলতি বছরের ১১, ১২ জানুয়ারি এবং ১ ফেব্রুয়ারি এই প্রতিবেদক হাসপাতালটির বহির্বিভাগের সামনে সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত অবস্থান করেছেন। এ সময় দেখা যায়, সন্তানকে কোলে নিয়ে বাবা অথবা মা হন্তদন্ত হয়ে ব্যবস্থাপত্রে উল্লিখিত কক্ষে ছুটছেন। কেউ বের হন স্বস্তি নিয়ে, কেউ আরও উদ্বিগ্ন হয়ে। তারা বের হলেই ঘিরে ধরেন ওষুধ কিংবা ফর্মুলা দুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। দেখেন চিকিৎসক তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখেছেন কি না, ফর্মুলা দিয়েছেন কি না। ছবি তোলেন।
এ সময় দেখা যায়, ব্যবস্থাপত্রের সঙ্গে চিকিৎসকরা আলাদাভাবে একটা রঙিন স্টিকার দেন। এতে বয়স অনুযায়ী ফর্মুলা দুধের পাশে টিক চিহ্ন দেয়া থাকে। ঘণ্টায় কমপক্ষে ১০ জন বাবা-মায়ের কাছে এমন স্টিকার দেখা যায়। তারা জানান, চিকিৎসক এই দুধ খাওয়াতে বলেছেন। এতে সন্তানদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। কামরাঙ্গীরচর থেকে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন নুরুন নাহার। তিনি বলেন, প্রতিবার ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসক এই দুধ খাওয়াতে বলেছেন।
চিকিৎসকদের সরবরাহ করা ফর্মুলা দুধের বেশ কিছু স্টিকারের ছবি তুলেছেন এই প্রতিবেদক। এতে দেখা যায়, বহির্বিভাগের ১৮৪ ও ১৮৫ নম্বর কক্ষ থেকেই এই স্টিকার এসেছে। এই দুটি কক্ষের টেবিলের ওপরওে প্রকাশ্যেই এই স্টিকার রাখা ছিল। হাসপাতালের নথি বলছে, প্রতিটি কক্ষে দুজন করে চিকিৎসক ছিলেন। তারা সবাই হাসপাতালটির আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
বহির্বিভাগের চিকিৎসক ও আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নূর-উজ-জামান বলেন, রোগীর ডায়রিয়া হলে বা আগে থেকে ফর্মুলা দুধ খেলে তখন প্রয়োজন অনুযায়ী ফর্মুলা দুধের পরামর্শ দেয়া হয়। কিনতে যাতে ভুল না হয়, সে কারণে ব্যবস্থাপত্রে না লিখে স্টিকারে টিক দেয়া হয়। তবে এর বিনিময়ে দুধ কোম্পানির কাছ থেকে কোনো উপহার বা আর্থিক লাভ নেননি বলে জানান তিনি।
এই হাসপাতালসহ শ্যামলী, মোহাম্মদপুর এলাকায় কাজ করেন- এমন তিনজন ফর্মুলা দুধ কোম্পানির প্রতিনিধির (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে তুলনামূলক নতুন কোম্পানির প্রতিনিধি জানান, ব্যবস্থাপত্রে ফর্মুলা দুধ লেখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই চিকিৎসককে তার কোম্পানি থেকে স্টিকার সরবরাহ করা হয়। অনেক চিকিৎসক আলাদা কাগজেও লিখে দেন। তবে বেশির ভাগ সময় এ পরামর্শ থাকে মৌখিক।
কেন তার কোম্পানির দুধ এই চিকিৎসকরা লিখছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সাড়ে ১২টার পর চিকিৎসকদের সঙ্গে দেখা করি। খাওয়ার পানি, কলমসহ টুকটাক উপহারও দিতে হয়।’ এর বাইরে নিয়মিত মাসোহারার ব্যবস্থা আছে। আয়োজন করতে হয় বৈজ্ঞানিক সেমিনারের। সেখানে চিকিৎসকদের আলোচক হিসেবে রাখতে হয়, দিতে হয় সম্মানী।
ফর্মুলা দুধের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ভূমিকা দেখতে শিশুদের জন্য বিশেষায়িত সবচেয়ে বড় হাসপাতালটি নমুনা হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। এমন অভিযোগ আছে দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও।
ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফের যৌথভাবে করা ‘ফর্মুলা দুধের বিপণন কীভাবে শিশুকে খাওয়ানোর বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে’ শীর্ষক জরিপ বলছে, মা হয়েছেন এমন ৯৮ শতাংশ নারীর প্রবল ইচ্ছা ছিল ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে কেবল বুকের দুধ খাওয়ানোর। কিন্তু সঠিক পরামর্শের অভাবে তারা পারেননি। প্রসব-পরবর্তী অবস্থায় শিশুকে ফর্মুলা দুধ দেয়ার ৬০ শতাংশ পরামর্শ দেন পেশাদার স্বাস্থ্যসেবাদাতারা।
বাংলাদেশসহ আটটি দেশের ৮ হাজার ৫০০ মা-বাবা, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে জরপিটি করা হয়। জরিপের প্রকাশকাল ২০২২।
হাসপাতালে জন্ম নেয়ারা ফর্মুলা পায় বেশি
নিজস্ব জরিপে দেখা যায়, অংশগ্রহণকারীদের ৫৫ শতাংশ মা ছয় মাসের আগেই শিশুকে ফর্মুলা দুধ দিয়েছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই হাসপাতালে সন্তান প্রসব করেছেন। সরকারি জরিপেও এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তথ্য বলছে, ঘরে জন্ম নেয়া শিশুদের তুলনায় হাসপাতালে জন্ম নেয়া শিশুরা ফর্মুলা দুধ পায় ২০ শতাংশ বেশি।
স্কুলশিক্ষক সুমি আক্তার সন্তান জন্ম দেন মগবাজার কমিউনিটি হাসপাতালে। শিশু জন্মের পর কান্নাকাটি করলে চিকিৎসক ফর্মুলা দুধ খাওয়াতে বলেন। বাসায় ফিরে চেষ্টা করলেও শিশু আর মায়ের দুধ মুখে নেয়নি। হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে শিশু জন্মদানের পর চিকিৎসক ও সেবিকাদের মাধ্যমে একই ধরনের পরামর্শ পেয়েছেন মা রোকেয়া রহমান। তবে এসব পরামর্শ ছিল মৌখিক।
শিশু ও গাইনি বিশেষজ্ঞরা জানান, শিশু জন্মের প্রথম তিন দিনে মায়ের বুকে খুব কম পরিমাণে (শাল) দুধ আসে, ২৪ ঘণ্টায় ১ থেকে ২ চা-চামচ। এই দুধকে অপর্যাপ্ত মনে করেন মাসহ স্বজনরা। এ সময়ে পেটব্যথা, গরমসহ নানা কারণে কান্নাকাটি করে শিশুরা। সিজারের মাধ্যমে সন্তান হলে প্রথম দিন অনেক সময় দুধ নামে না। তখন অনেক অভিভাবক ফর্মুলা দুধ দিয়ে দেন। আবার অনেক চিকিৎসক ফর্মুলা দুধ কোম্পানির প্রলোভনের ফাঁদে আটকে ফর্মুলা দুধের পরামর্শ দেন। হাসপাতালে বিনা মূল্যে দুধের নমুনাও পান মায়েরা।
হাসপাতাল বা বাড়িতে ডেলিভারির সঙ্গে বুকের দুধ পানের কোনো সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের গর্ভবতী, প্রসূতি ও গাইনি বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন ছাবিকুন নাহার। তিনি বলেন, সি-সেকশন হলে প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে দুধ নামতে কিছুটা দেরি হতে পারে। এ সময় ধৈর্য ধরে সঠিক পজিশনে নিয়ে শিশুকে বারবার খাওয়াতে হবে। এতে দ্রুত অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসরণ হয়ে শিশু দুধ পাবে। শিশু কান্না করলেই ক্ষুধা লাগছে, এ ধারণাও দূর করা জরুরি।
বাধ্য হন কর্মজীবী মায়েরা
গর্ভকালীন অবস্থায় অসুস্থ থাকায় সন্তান জন্মদানের বেশ আগেই ছুটি নিতে হয়েছিল সরকারি কর্মকর্তা সোহানা ইসলামকে। চাকরিতে যোগদান করতে ছেলেকে তিন মাস বয়স থেকেই ফর্মুলা দুধ দিয়েছেন। এ নিয়ে তার অনেক আক্ষেপ। তিনি বলেন, ‘অনেকবার মনে হয়েছে সন্তানকে পুষ্টি থেকে বঞ্চিত করছি। কিন্তু চাকরি বাঁচাতে ফর্মুলা দুধ বেছে নিয়েছি।’ একটি স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আফরিন শাহনাজও আড়াই মাস বয়স থেকে মেয়েকে ফর্মুলা দুধ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মেয়ের বারবার ডায়রিয়া হচ্ছিল, গ্যাসের সমস্যায় ভুগেছে। তবুও ফর্মুলা চালিয়ে গিয়েছি।’ রাত জাগলে সকালে ঠিকভাবে অফিস করতে পারবেন না বলে রাতে ফর্মুলা দুধ দিয়েছেন ব্যাংকার রুমানা সরকার। একই ধরনের কথা বলেন আর কয়েকজন মা।
নিজস্ব জরিপে অংশগ্রহণকারী যেসব মা ছয় মাসের আগেই ফর্মুলা দুধ দিয়েছেন, তাদের ৮০ শতাংশ কর্মজীবী। ফর্মুলা দেয়ার পর নানা ধরনের রোগে ভোগার হারও এসব শিশুর বেশি। কিন্তু কর্মস্থলে ফেরার তাড়া থেকে দুই মাস পার হতেই ফর্মুলা দুধ দেয়া শুরু করেন বলে জানান মায়েরা। সরকারি জরিপও বলছে, শিশু জন্মের প্রথম মাসে যেখানে ৮৫ শতাংশ মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান, শিশুর তিন-চার মাসে সেই হার হয়ে যায় ৪০ শতাংশ। সরকারিভাবে মায়েরা মাতৃত্বকালীন ছুটি দুবার ছয় মাস করে ভোগ করতে পারেন। শ্রম আইন অনুযায়ী, বেসরকারিভাবে এই ছুটি চার মাস।
মায়েরা আরও বলছেন, এর পাশাপাশি শিশুকে কেবল বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য যে যত্ন ও খাবার দরকার, সে ব্যবস্থা নেই অনেক চাকরিজীবী মায়ের। তবে কোনো কোনো মা ফর্মুলা দুধকে পুষ্টিকর ভেবেও দেন। কর্মস্থলে এবং পাবলিক প্লেসে দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা না থাকার কারণেও অনেক মা শিশুকে ফর্মুলা দুধ দেন।
অনলাইন ফর্মুলা দুধের প্রচার
মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে ফর্মুলা দুধের প্রচার জোরেশোরে এখন চলছে অনলাইনে। ফর্মুলা দুধ কোম্পানির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেজ রয়েছে। চিকিৎসকরাও ইউটিউবে ফর্মুলা দুধের পরামর্শ দিয়ে কন্টেন্ট তৈরি করেন। মায়েদের বিভিন্ন গ্রুপে ফর্মুলা দুধের গুণগান করা হয়। এমন গুণগান শুনে অনেক মা-ই ফর্মুলা দুধ দেন। এমন একজন মা হচ্ছেন তাসলিমা আক্তার। তিনি ছেলের বয়স দুই মাস পার হতেই ফর্মুলা দুধ দেন। দুধ শুরু করার কয়েক দিনের মাথায় হজমের সমস্যা ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। পরে ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করাতে হয়েছে। তাসলিমা বলেন, ‘মনে হয়েছে ছেলের ওজন কম। গুঁড়া দুধ খাওয়ালে ছেলের স্বাস্থ্য ভালো হবে। গ্রুপে পোস্ট করে সবার পরামর্শ নিয়ে দুধ দিয়েছি।’ এ রকম দুটি গ্রুপের অ্যাডমিন প্যানেল ঘেঁটে দেখা যায়, তারা ফর্মুলা দুধসহ শিশুখাদ্য বিক্রি করেন। বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে ফর্মুলা দুধের গুণগান করা হয়।
মায়ের দুধ খাওয়ানো নিয়ে কাজ করে জাতিসংঘের এমন একটি সংস্থার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিদ (নাম না প্রকাশের শর্তে) বলেন, প্রকাশ্য বা অনলাইনে ফর্মুলা দুধের প্রচার নিষিদ্ধ কিন্তু চলছে। শাস্তিযোগ্য এসব ফৌজদারি অপরাধ প্রকাশ্যেই ঘটছে। পর্যবেক্ষণ নেই। শাস্তি হয় না বলেই দিন দিন ফর্মুলা দুধের আগ্রাসন বাড়ছে বলে মন্তব্য এই জ্যেষ্ঠ পুষ্টিবিদের।
করণীয় কী
জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় প্রধান (ফিল্ড) মাহবুব আরেফীন রেজানুর বলেন, ‘ফর্মুলা দুধের আধিপত্য কমাতে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিদ্যমান আইনটি সম্পর্কে অংশীদারদের সচেতনতার কাজ জোরেশোরে চলছে। লোকবলের অভাবে তদারকি করা যাচ্ছে না। তবে কোনো চিকিৎসক ফর্মুলা দুধ দিচ্ছেন, প্রমাণ পেলে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’ এখন পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধে কেউ শাস্তি পেয়েছেন বলে এই কর্মকর্তা নিশ্চিত করতে পারেননি। যদিও একদল চিকিৎসকের বিদেশ সফর বন্ধ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অধ্যাপক এস কে রায় বলেন, গুঁড়া দুধ কোম্পানি অবাধে প্রচার করছে, মায়েরা প্রভাবিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি আইন লঙ্ঘনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবার তথ্যপ্রবাহ আরও সহজ ও সুশৃঙ্খল করতে নতুন এক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সিলডক.কম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে।
সিলেট জেলায় প্রথমবারের মতো এমন একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে যেখানে এলাকার সকল ডাক্তার, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তথ্য এক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে।
সিলডক.কম–এ ব্যবহারকারীরা ডাক্তারদের নাম, চেম্বার লোকেশন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট নম্বর এবং বিশেষজ্ঞ বিভাগের ভিত্তিতে সাজানো তালিকা দেখতে পারবেন। এতে সঠিক চিকিৎসকের সন্ধান পাওয়া এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া আগের তুলনায় অনেক সহজ হবে।
এছাড়াও প্ল্যাটফর্মটিতে যুক্ত হয়েছে মেডিকেল ফাইল চেকার, যা ব্যবহারকারীদের মেডিকেল টেস্ট রিপোর্ট সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করে। ফলে সাধারণ মানুষ অজানা মেডিকেল টার্ম বুঝতে পারছে খুব সহজেই।
সিলডক.কমের উদ্যোক্তাদের মতে, সিলেটে স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত তথ্যপ্রাপ্তিকে আরও স্বচ্ছ, দ্রুত ও জনবান্ধব করাই এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য।
ওয়েবসাইট: https://syldoc.com/
দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ভূমিকম্পে আহতদের যথাযথ চিকিৎসার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।
আজ শুক্রবার (২১ নভেম্বর) দুপুরে তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পৌঁছে ভূমিকম্পে আহত চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের খোঁজখবর নেন। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জানান, “সব হাসপাতালে বলেছি, ভূমিকম্পে আহতদের চিকিৎসায় যেন কোনো ত্রুটি না হয়। সব সরকারি হাসপাতালে নির্দেশনা দেওয়া আছে।”
তিনি আরও বলেন, “যে মাত্রায় ভূমিকম্প হয়েছে, হয়তো কাছাকাছি থাকার কারণে এই মাত্রা বেশি মনে হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় মাত্রা ছিল ৫.৭ রিখটার স্কেলে। তবে আহতের সংখ্যা সেই তুলনায় বেশি হয়েছে। ঢাকার যেসব ছাত্র আহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আতঙ্কে দুই-তিন তলা থেকে লাফ দিয়েছেন। আমরা সবাই মিলে সুষ্ঠু চিকিৎসার চেষ্টা করছি।”
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এছাড়া, আরও একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে; তার বাবাও আহত এবং তাঁর অবস্থা গুরুতর। রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে তিনজন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে একজন ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষার্থী।
তিনি আরও জানান, বিভিন্ন জায়গা থেকে আহতদের খবর পাওয়া যাচ্ছে। গাজীপুরের কয়েকজন আহত এবং অনেকে প্যানিকের কারণে হাসপাতালে এসেছেন। “ডাক্তাররা তাদের চিকিৎসা দিয়েছেন। শারীরিকভাবে আহতদেরও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে,” বলেন তিনি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দুপুর পৌনে তিনটা পর্যন্ত ঢামেকে ৪১ জন চিকিৎসা নিতে আসেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ ছয়জনকে ভর্তি করা হয়েছে। বাকি সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছাড় দেওয়া হয়েছে।
গত ২৪ ঘন্টায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে শান্তি বেগম (৯০) এবং আব্দুস সালাম (৫৩) নামে দুজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। শান্তি বেগম সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার এবং আব্দুস সালাম ভালুকা উপজেলার বাসিন্দা।
তাদের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু বিভাগের ইনচার্জ ডা. এমদাদ উল্লাহ খান বলেন, শান্তি বেগম বুধবার সন্ধ্যায় এবং আব্দুস সালাম মঙ্গলবার বিকেলে হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি হন। বৃহস্পতিবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারা মারা যান।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে বর্তমানে ৭৪ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে পুরুষ রোগী ৪৪, মহিলা ২০ জন ও ১০ জন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে ৩০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৭ জনসহ চলতি বছরে এ নিয়ে ২০ জন ব্যক্তি ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মমেক হাসপাতালে মারা গেছেন।
টাকা বরাদ্দ না থাকায় এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে ময়মনসিংহের শিশু হাসপাতালের নির্মাণ কাজ। এর আগে প্রায় সাত বছর আগে ময়মনসিংহ শিশু হাসপাতাল নির্মাণের প্রশাসনিক অনুমোদন মেলে। তবে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য জমি কিনতে চলে যায় প্রায় পাঁচ বছর। এ নিয়ে শুরুতেই এক ধরণের অনিশ্চিয়তার সৃষ্টি হয়েছিল।
পরে ২০২৩ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হলেও এক বছরের বেশি সময় আগে তা টাকার অভাবে বন্ধ রয়েছে। এতে হাসপাতালটির ভবিষ্যৎ আবারও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শিশু হাসপাতালটি নির্মাণের জন্য ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ঠিকাদারকে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে হাসপাতালটি দুতলা পর্যন্ত হওয়ার কথা রয়েছে। পরবর্তীতে তা আরও বাড়ানো হবে। কাজ পাওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ শুরু করে ঠিকাদার। এ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ৩০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ৩০ জুনের পর টাকা না পাওয়ায় কাজটি বন্ধ হয়ে গেছে। সরজমিনে দেখা গেছে, প্রকল্প এলাকায় এখন কোনো কাজ হচ্ছে না। তবে ইতোমধ্যে বেজমেন্ট এর কাজ শেষ হয়ে ১ তলা পর্যন্ত কাজের দৃশ্য চোখে পড়ে।
আরও জানা যায়, এ শিশু হাসপাতালটি ময়মনসিংহ জেলাবাসীর জন্য বহুলকাঙ্ক্ষিত। প্রাচীন জেলা ও বিভাগীয় নগর হওয়ার পরও ময়মনসিংহ কোন শিশু হাসপাতাল নেই। বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছয় জেলাসহ দেশের উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলা, সুনামগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার রোগীরা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। সেখানে রয়েছে একটি নবজাতক ও শিশু ওয়ার্ড। তবে শিশু ওয়ার্ড রোগীর চাপ সামলাতে হিমসিম খায়। যে কারণে ময়মনসিংহ জেলায় একটি শিশু হাসপাতাল জরুরি হয়ে ওঠে। এ প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে সরকারের বিশেষ বরাদ্দে ময়মনসিংহে একটি আধুনিক শিশু হাসপাতালের অনুমনোদন মেলে। এ হাসপাতলের জন্য অন্তত ৩ একর জমি প্রয়োজন ছিল। পরে ওই কেনা নিয়ে চলে যায় ৫ বছরের বেশি সময়। অবশেষে ২০২৩ সালে জেলা প্রশাসন ময়মনসিংহ নগরের বাইপাস এলাকায় জমি কিনে গণপূর্ত বিভাগকে বুঝিয়ে দেয়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে হাসপাতলটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময় পার পেয়ে গেলেও এখনো তা শেষ হয়নি। উল্টো বরাদের অভাবে কাজই বন্ধ হয়ে গেছে।
হাসপাতালটি নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের দাবি দ্রুত আবারও নির্মাণ কাজ শুরু হোক। ‘ময়মনসিংহ নাগারিক সমাজ’ নামের নাগরিক সংগঠনের সদস্য সচিব শামসুদ্দোহা মাসুম বলেন, ময়মনসিংহে একটি শিশু হাসপাতাল খুবই জরুরি। শিশু হাসপাতালের নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। দ্রুত সরকারের অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে আবারো কাজটি চালু হওয়ার দাবি জানাই।
কাজটির দায়িত্বে থাকা ময়মনসিংহ গর্ণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. ইফতেখার আলম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ইতোমধ্যে কাজটির ৩০থেকে ৩৫ শতাংশ সমাপ্ত হয়েছে। ২০২৪ সালের ৩০ জুনের পর থেকে টাকা বরাদ্দ না হওয়ায় কাজটি বন্ধ রয়েছে। তবে আবার কাজ শুরু হবে বলে আশা করছি।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে প্রায় সাড়ে তিন মাসের চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরল ১০ বছর বয়সি যমজ দুই বোন সারিনাহ জাহান সায়রা ও সাইবাহ জাহান সায়মা। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এ দুই শিশু আহত হয়েছিল। এ পর্যন্ত বিমান দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ ৩৩ জন চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছে।
গতকাল বুধবার ইনস্টিটিউটের পরিচালকের কার্যালয়ে দুই শিশুকে বিদায় জানান হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
এ সময় জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘মাইলস্টোন স্কুলের বিমান দুর্ঘটনায় আহত ৫৭ জন এই ইনস্টিটিউট থেকে চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে ২০ জন। একজনকে ট্রমা ম্যানেজমেন্টের জন্য মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তিনজন এখনো চিকিৎসাধীন, তবে তারা সবাই আশঙ্কামুক্ত।’
যমজ দুই শিশুর মধ্যে সায়রা ৩০ শতাংশ এবং সায়মা ১৫ শতাংশ দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল।
পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্টাফ দগ্ধ প্রত্যেক রোগীকে আন্তরিক সেবা দিয়েছেন। তারা কঠোর পরিশ্রম করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও আমাদের প্রয়োজনীয় সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।
‘আহতদের মধ্যে যারা বাড়ি ফিরেছেন, তাদের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে এবং ফলোআপ চিকিৎসা দিচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।
এ সময় তিনি সিঙ্গাপুর, ভারত, চীন ও যুক্তরাজ্যসহ যেসব বিদেশি চিকিৎসক আহতদের চিকিৎসায় সহযোগিতা করেছেন, তাদের প্রতিও ধন্যবাদ জানান।
যমজ দুই শিশুর বাবা-মা ইয়াসিন মজুমদার ও আকলিমা আক্তার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, গত ২১ জুলাই দুপুরে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি দোতলা ভবনে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় মোট ৩৬ জন নিহত এবং ১২৪ জন আহত হয়। তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে যুদ্ধবিমানের পাইলটের উড্ডয়ন-ত্রুটি চিহ্নিত করেছে।
বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইসলামিক পাঠাগার ও সমাজ কল্যাণ পরিষদ তারাবো পৌরসভার উদ্যোগে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সুবিধাবঞ্চিত এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৮ শতাধিক মানুষকে বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়েছে। সোমবার দিনব্যাপী উপজেলার খাদুন এলাকায় হাজী আয়াত আলী ভূঁইয়া উচ্চবিদ্যালয়ে এ চক্ষুসেবা প্রদান করা হয়।
ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদের তারাব পৌর শাখার সভাপতি খন্দকার আল-আমীনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এ সেবা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ আনোয়ার হোসেন মোল্লা।
দিনব্যাপী এ মেডিকেল ক্যাম্পে আট শতাধিক রোগীকে বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এছাড়া বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ, মেডিসিন, গাইনি, শিশু ও কিশোরকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সেবাসহ ডায়াবেটিস, রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা হয়।
ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল মুগদা শাখার মেডিকেল টিমের সদস্য গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. আজরিনা আফরিনের তত্ত্বাবধানে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার গোলাম কিবরিয়া, এবং শিশু ও কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নাইমা রহমান চিকিৎসাসেবা প্রদান করেন।
ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদের সভাপতি আল-আমীন বলেন, আমরা তারাব পৌর ইসলামিক পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদ ও ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল মুগদা শাখার উদ্যোগে এ চিকিৎসাসেবা প্রদান করছি। ইতোমধ্যে উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় আমরা চক্ষুসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। এতে শত শত রোগী বিনামূল্যে সেবা গ্রহণ করে উপকৃত হয়েছেন।
তিনি বলেন, এ পর্যায়ে আমরা সুবিধাবঞ্চিত এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে মেডিসিন, গাইনি, শিশু ও কিশোর রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মাধ্যমে সেবা প্রধানম করছি। সেই সাথে বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ, ব্লাড গ্রুপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষার মাধ্যমে প্রায় আট শতাধিক মানুষকে সেবা দিতে পেরেছি। পর্যায়ক্রমে আমাদের এই স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম রূপগঞ্জের সকল পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের জনগণের মাঝে পৌঁছে দেওয়া হবে।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট ইসরাফিল হোসাইন। ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং নারায়ণগঞ্জ লিগ্যাল এইডের প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট আয়নাল হক আরও অনেকে।
সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ১৯৫ জন।
এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩১৩ জনে এবং শনাক্ত রোগী বেড়ে ৭৮ হাজার ৫৪৩ জনে দাঁড়িয়েছে।
রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৫৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩২ জন, ঢাকা বিভাগে ২৭৮ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২২০ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১১৫ জন, খুলনা বিভাগে ১১৪ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৯ জন, রাজশাহী বিভাগে ১১৩ জন ও সিলেট বিভাগে ৯জন রয়েছেন।
২৪ ঘণ্টায় যে ছয়জন মারা গেছেন তাদের মধ্যে দুজনের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে, দুজনের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ও দুজনের বরিশাল বিভাগে মৃত্যু হয়েছে।
এই সময়ে এক হাজার ১০৮ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ছাড়পত্র পেয়েছেন ৭৪ হাজার ৮৯৩ জন।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৭৮ হাজার ৫৪৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩১৩ জনের।
২০২৪ সালে দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৫৭৫ জনের। এর আগের বছর ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মারা যান সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০৫ জন এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে এক পরিবারে ৬ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা। প্রশাসনের নেই ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো কার্যক্রম। তা ছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পাচ্ছে না পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা, শুধু স্যালাইন আর নাপা দিয়ে চলছে ডেঙ্গুরোগীদের চিকিৎসা।
প্রতিদিন গড়ে প্রায় অর্ধশতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু আক্রান্ত হচ্ছেন ভয়ংকর এই জ্বরে। ইতোমধ্যে হাবিবুর রহমান নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। অথচ, মশানিধনে নেই পৌর প্রশাসনের তেমন কোনো জোরালো কার্যক্রম। ফলে ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত মানুষজন।
রোববার সকালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয় পৌর শহরের ভৈরবপুর দক্ষিণপাড়া এলাকার বাসিন্দা রাজিয়া বেগমের সাথে। তিনি বলেন, আমার ৪ ছেলে-মেয়ে নাতি ও আমি নিজে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছি। এক সপ্তাহ যাবত পরিবারের ৬ জন সদস্য ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসাপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। এখন আমাদের পরিবারে ডেঙ্গু আক্রান্তদের সেবা করার জন্য কেউ সুস্থ নেই। সে জন্যই আজকে (রোববার) সবাই হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় চলে যাব। সেখানেই সবাই এক সাথে থাকব যেন একজন আরেকজনকে সেবা করতে পারি।
ভৈরবপুর উত্তরপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্বাস মিয়া ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত তার মেয়ে সুমি বেগমকে নিয়ে দুদিন আগে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করান। কিন্তু হাসপাতালে আসার পর ডাক্তারদের দেখা মেলেনি শুধু নার্সরাই স্যালাইন আর নাপা দিয়ে চিকিৎসা করছেন। হাসপাতালে আসার পর তার মেয়ের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। আজ (রোববার) সকালে এক নার্স এসে বলল আপনার মেয়েকে কিশোরগঞ্জ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে। এইভাবে যদি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা হয় তাহলে আমরা গরিব মানুষ কোথায় যাব।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। চলতি মৌসুমে আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে এই ডেঙ্গু জ্বর। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার দুই থেকে তিনগুণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য খোলা হয়েছে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা দুটি ওয়ার্ড। তবে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, ভৈরবের সর্বত্র ডেঙ্গুর এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতেও পৌরসভা বা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিরোধমূলক কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। মশানিধন বা সচেতনতায় নেওয়া হচ্ছে না কোনো কর্মসূচি।
এ বিষয়ে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আবদুল করিম জানান, এ বছর ভৈরবে অন্যান্য বছরের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রতিদিনই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছেন। রোববার পর্যন্ত হাসপাতালে ১৭ জন ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩ জন রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতারে রেফার্ড করা হয়েছে। আক্রান্তদের মাঝে গত সেপ্টেম্বর মাসে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮০ জন। তবে, আক্রান্তদের মাঝে অধিকাংশরা নিজ বাড়ি এবং শহরের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া প্রতিদিন অসংখ্য রোগী জরুরি বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে তিনি জানান।
ভৈরব পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শবনম শারমিন জানান, পৌরসভার পক্ষ থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনামূলক কর্মসূচির পাশাপাশি প্রতিদিনই পৌর এলাকায় প্রতিটি ওয়ার্ডে জনসচেতনতা লক্ষ্যে সভা সমাবেশসহ মশা রোধে বিভিন্ন কার্যক্রম করছেন বলে তিনি জানান।
উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁ। এ জেলার সাধারণ মানুষের একমাত্র স্বাস্থ্যসেবার ভরসার স্থল নওগাঁ ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল। সেবাপ্রত্যাশীদের তুলনায় শয্যা, চিকিৎসক ও সরঞ্জাম সংকট লেগেই আছে। তবুও সাধারণ, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষরা আসেন সেবা নিতে। সরকারি এ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
সরেজমিনে গিয়ে মিলেছে তার প্রমাণও। জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে চলছে টিকিট বাণিজ্য। টিকিটের দাম ১০ টাকা নির্ধারিত হলেও রোগীর কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত।
২৫০ শয্যার এই জেনারেল হাসপাতালে নওগাঁর ১১ উপজেলা ছাড়াও বগুড়ার আদমদিঘী, জয়পুরহাটের আক্কেলপুরসহ আশেপাশের অনেক জেলা ও উপজেলা থেকেও রোগীরা আসেন সেবা নিতে।
জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার ঘাটনগর থেকে দুদিন আগে আমাশয়জনিত কারণে শয্যা না পেয়ে মেঝেতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রুপালী রানি। তার ছেলে আকাশ কুমার জানান, ‘ভর্তি ফি ২০ টাকা এবং জরুরি বিভাগে প্রথম ডাক্তার দেখানোর জন্য ১৫ টাকা নিয়েছেন কাউন্টারে।’
সদর উপজেলার বক্তারপুরের রিমু খাতুন ভর্তি হয়েছেন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে। রিমুর দুলাভাই আল আমিন হোসেন বলেন, ‘ফি ২০ টাকা নিয়েছেন। বাকি টাকা ফেরত চাইলে তারা বলেন, খুচরা নাই।’
এদিকে জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারে ভর্তি রোগীর কাছ থেকে ১০ টাকার বিপরীতে নেওয়া হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। শুধু টিকিট বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধতা নয়, এখানে পেইংবেইড ও কেবিনের জন্য রোগীদের গুণতে হয় বাড়তি টাকা। নির্ধারিত ফির বাইরে বাড়তি টাকা নিয়ে থাকেন দায়িত্বরত স্টাফরা।
সদর উপজেলার শিবপুর এলাকায় প্রফুল্ল কুমার বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে ভর্তি করালাম। প্রথমে ১০ টাকা দিয়ে টিকিটি কেটে পরে ভর্তি ফি নিয়েছেন ৩০ টাকা। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার তো নিয়ম নাই তবুও তারা নিয়েছে। কিছু বলার নাই।’
আরিফ চৌধুরিসহ হাসপাতালে আসা আরও বেশ কয়েকজন জানান, টিকিট কাউন্টারে বাণিজ্য হয়। অতিরিক্ত ফি নেওয়া হয়। দায়িত্বরতদের দৃষ্টি আকর্শন করছি যাতে বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে দেখেন।
জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারে দুজন করে ৪ জন পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন। তারা আউটসোর্সিং হিসেবে কাজ করছেন। মূলত জরুরি বিভাগ থেকে তোলা বাড়তি টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করেন নিজেরাই।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে টিকিট কাউন্টারে দায়িত্ব পালন করা মো. মুমিনুল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয় না। অনেক সময় খুচরা টাকা থাকে না। সেবাগ্রহীতারা ৫০০ বা ১০০ টাকা নোট দিলে পরবর্তীতে তারা আবার বাকি টাকা ফেরত নিয়ে যায়। গত সোমবার আমি নিজে ২০ টাকার নোট দিয়েছিলাম আপনি ১৫ টাকা ফেরত না দিয়ে দ্রুত অন্য রোগীদের টিকিট দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বলেন খুচরা নাই। এমন প্রশ্নের জবাবে এ প্রতিবেদককে বলেন, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না, মনে নাই।
এ বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরি বলেন, অভিযোগগুলোর সত্যতা রয়েছে। এক রোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে একজনের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
স্পষ্টভাবে বলা আছে জরুরি বিভাগের টিকিট ৫ টাকা, তারা কেন ১০ টাকা বা তার বেশি নেবে। বিশেষ করে ৫ টাকার সিলমোহর টিকেটের ওপর ব্যবহার করতে বলা হয়েছে তাদের। আমরা নিয়মিত বিষয়গুলো মনিটরিং করব।
কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলায় ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ছোঁয়াচে চর্মরোগ স্ক্যাবিস। দিন দিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বড় একটি অংশ এ রোগে ভুগছেন। বয়স্কদের পাশাপাশি শিশু ও কিশোরদের মধ্যেও এর প্রকোপ বেশি দেখা দিচ্ছে। এতে অভিভাবক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে চরম আতঙ্ক।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, বহির্বিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে প্রায় দুই থেকে আড়াই শতাধিক চর্মরোগে আক্রান্ত রোগী থাকে। এদিকে প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে হাসপাতালে কোনো চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। ফলে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসকরা।
আক্রান্তদের অনেকে প্রথমে গ্রামের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে ব্যবহার করছেন। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় অবস্থার অবনতি ঘটছে এবং শেষে বাধ্য হয়ে হাসপাতালে আসছেন।
চিকিৎসকদের মতে, স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হলে শরীরের আঙুলের ফাঁক, কবজি, কনুই, বগল, নাভি, নিতম্ব, যৌনাঙ্গ ও হাতের তালুতে তীব্র চুলকানি হয়- বিশেষ করে রাতে। চুলকানোর ফলে ছোট ছোট ফুসকুড়ি ও ঘা দেখা দেয়, যা থেকে তরল পদার্থ বের হয়। এটি সারকপটিস স্ক্যাবাই নামের এক ধরনের ক্ষুদ্র মাইট দ্বারা ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড়, বিছানা, তোয়ালে বা শরীরের সংস্পর্শে এলে অন্যরাও সহজেই সংক্রমিত হয়।
দেবিদ্বারের ছাত্রাবাস, হাফেজিয়া ও কওমি মাদ্রাসাগুলোতে স্ক্যাবিস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা বিছানা, বালিশ ও চাদর ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক রোগী স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়ে তীব্র চুলকানি ও ফুসকুড়ির যন্ত্রণায় ভুগছেন। স্থানীয় বাসিন্দা সফিক সরকার বলেন, ‘তিন সপ্তাহ ধরে শরীরে চুলকানি হচ্ছিল। ফার্মেসি থেকে ওষুধ ব্যবহার করেও কাজ হয়নি। অবশেষে হাসপাতালে এসে জানতে পারলাম, এটি স্ক্যাবিস।
ফতেহাবাদের জামাল হোসেন বলেন, আমার ১৮ মাস বয়সি সন্তানের শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দিলে হাসপাতালে নিয়ে আসি। ডাক্তার জানিয়েছেন, স্ক্যাবিস হয়েছে এবং পুরো পরিবারকে চিকিৎসা নিতে হবে।
হাসপাতাল এলাকার কয়েকজন ফার্মাসিস্ট জানান, অনেক রোগী স্ক্যাবিস সম্পর্কে ধারণা না থাকায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অ্যালার্জি বা চুলকানির ওষুধ কিনে ব্যবহার করেন। এতে রোগ সারে না, বরং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়ে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ না থাকাটাও একটি বড় কারণ। তাদের মতে, কয়েক মাসে চর্মরোগের ক্রিম, লোশন ও ওষুধের বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. কবীর হোসেন বলেন, শিশুদের মধ্যে স্ক্যাবিস সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। একজন আক্রান্ত হলে পরিবারের অন্যরাও সহজেই সংক্রমিত হয়। তাই আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে চিকিৎসা নিতে হবে।
ডা. কবীর হোসেন আরও বলেন, গরমকালে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। শিশুদের নিয়মিত কুসুম গরম পানিতে গোসল করাতে হবে, ধুলাবালি থেকে দূরে রাখতে হবে এবং অ্যালার্জিজনিত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। আক্রান্তের ব্যবহৃত কাপড়, চাদর, বালিশ ও তোয়ালে অন্য কেউ ব্যবহার করলে রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. মহিবুস ছালাম খান বলেন, প্রতিদিনই স্ক্যাবিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা যথাসাধ্য চিকিৎসা দিচ্ছি; কিন্তু সচেতনতার অভাবে রোগটি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়ছে। আক্রান্তদের ব্যবহৃত পোশাক, গামছা ও বিছানার চাদর নিয়মিত ধুয়ে রোদে শুকানো জরুরি। আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আলাদা বিছানায় ঘুমানো উচিত।
চট্টগ্রামের রাউজানে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন ১ হাজারের বেশি মানুষ। রাউজান সদর মুন্সিরঘাটা উপজেলা কেন্দ্রীয় মন্দির রাস বিহারী ধামে রাধাকৃষ্ণের রাস উৎসব উপলক্ষে্য বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা, বিনামূল্যে ওষুধ ও চশমা বিতরণ এবং রক্তের গ্রুপ নির্ণয় কর্মসূচী গত বুধবার পালন করা হয়। এই চিকিৎসা ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন রাউজান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. শাহাজাহান। পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন বয়সী এক হাজার নারী-পুরুষ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন। এরমধ্যে বিভিন্ন রোগের ৭০০জন, চক্ষুরোগী ৩০০জন, পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষের মাঝে ওষুধ বিতরণ, ২৫০জন মানুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হয়। চক্ষুরোগীদের এর মধ্যে চোখের ছানি পড়া ৫০জন রোগীকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হবে। চিকিৎসাসেবা প্রদান করবেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ, ফ্যাকো সার্জন অ্যান্ড নিউরো অফথালমোলজিস্ট ডা. তনিমা রায়, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অনুসেন দাশগুপ্ত, মানসিক রোগ, মনো-যৌনরোগ ও মাদকাসক্তি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ডা. হিমাদ্রী মহাজন, প্রসূতি এবং স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন ডা. চম্পা চৌধুরী, নাক, কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ও হেড-নেক সার্জন ডা. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। ‘চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন রোগাক্রান্ত মানুষ সকাল থেকে ভীড় করেন। কেয়ার ল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও রাউজান হেলথ কেয়ার সেন্টারের সহযোগিতায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা এক হাজারের বেশি মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওষুধ ও চশমা বিতরণ করা হয়েছে। চক্ষুরোগীদের মধ্যে চোখের ছানি পড়া নারী-পুরুষদের বিনামূল্যে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করা হবে। প্রসঙ্গত, রাধাকৃষ্ণের রাস উৎসব উপলক্ষ্যে গত সোমবার ৩ নভেম্বর থেকে ৬দিনব্যাপী মতহী ধর্মীয় সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লীলা প্রদর্শনী, মহা প্রসাদ বিতরণ ও ষোড়শ প্রহরব্যাপী মহানামযজ্ঞসহ নানা কর্মসূচী শুরু হয়েছে।
চলতি বছর এডিশ মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে। এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ও চলতি নভেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ও হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া জনমনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আগেই জানিয়েছিল, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ ধারণ করার কথা। সেই রেশ চলতি নভেম্বর মাসে এসেও দেখা দিয়েছে। অক্টোবরের শেষে এবং চলতি মাসের শুরুতে বৃষ্টিপাত ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে একাধিক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা করেছিলেন। এখন মাসের শুরু থেকে যে হারে রোগী বাড়ছে এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঘটছে তাতে এসব শঙ্কা এখন সত্যি হওয়ার পথে।
এদিকে দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা একদিনের হিসাবে এ বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৬৯ জন রোগী। এ নিয়ে চলতি বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৭৪ হাজার ৯৯২ জনে।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয়েছে, এদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে ৩ জন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। একজন করে মারা গেছেন বরিশাল বিভাগে ও খুলনা বিভাগে।
এদিকে চলতি বছর এর আগে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর তথ্য আসে ২১ সেপ্টেম্বর। সেদিন দেশে ৯ জনের মৃত্যু ও ৭৪০ জনের হাসপাতালে ভর্তির তথ্য দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এইডিস মশাবাহিত রোগে এ নিয়ে চলতি বছর ৩০২ জনের প্রাণ গেল। এর মধ্যে নভেম্বরের পাঁচ দিনে মৃত্যু হলো ২৪ জনের। এ সময় হাসপাতালে ভর্তি হন ৫ হাজার ১৩০ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় অক্টোবরে; ৮০ জন। এর আগে ৭৬ জনের মৃত্যু সেপ্টেম্বর মাসে।
এছাড়া অগাস্টে ৩৯ জন, জুলাইয়ে ৪১ জন, জুনে ১৯ জন, মে মাসে তিনজন, এপ্রিলে সাতজন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন ও জানুয়ারিতে ১০ জনের মৃত্যু হয়। মার্চ মাসে কোনো মৃত্যুর তথ্য দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ডেঙ্গু নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১৭৭৩ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫১ জন, অগাস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এছাড়া সেপ্টেম্বরে ১৫ হাজার ৮৬৬ জন এবং অক্টোরে হাসপাতালে ভর্তি হন ২২ হাজার ৫০ জন।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৭৫ জন। এর আগে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয় এবং ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।
বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে, সাগরের বুকে জেগে থাকা এক অনিন্দ্য সুন্দর দ্বীপ সেন্টমার্টিন। নীল সাগর, ঝলমলে প্রবাল আর শান্ত প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভরপুর এই দ্বীপে বাস করেন প্রায় ১১ হাজার মানুষ। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক কঠিন বাস্তবতা চিকিৎসা সেবার ভয়াবহ অভাব।
এই মর্মান্তিক বাস্তবতার মাঝেই জন্ম নিয়েছে আশার এক নতুন আলো দুই বোন ফাতেমা বেগম তামান্না ও সুমাইয়া আক্তার সুমি। তারা দুজনই সেন্টমার্টিনের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন, কিভাবে চিকিৎসা না পেয়ে প্রিয়জন হারিয়ে কেঁদেছেন প্রতিবেশীরা। সেই অসহায় কান্না তাদের ভেতরে জন্ম দিয়েছে এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি একদিন নিজেরাই চিকিৎসক হবেন, দ্বীপের মানুষের পাশে দাঁড়াবেন।
ফাতেমা বেগম তামান্না বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে তৃতীয় বর্ষে এবং ছোট বোন সুমাইয়া আক্তার সুমি পড়ছেন আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে। দুজনের লক্ষ্য একটাই এমবিবিএস শেষ করে ফিরে যাওয়া নিজ দ্বীপে, যেখানে আজও এক ফোঁটা চিকিৎসা সেবা পেতে মানুষকে নির্ভর করতে হয় মূল ভূখণ্ডের ওপর।
ফাতেমা বেগম তামান্না বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখেছি গর্ভবতী মায়েরা ইমার্জেন্সি চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফ যেতে তিন ঘণ্টা লাগে। মাঝপথে অনেকেই মারা যান। তখন মনে হতো আমরা যদি কিছু করতে পারতাম!’
তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় মোড় আসে করোনাকালে। সুমি আক্তার সুমি স্মৃতিচারণ করেন, ‘গত চার মাস আগে আমরা বৈরী আবহাওয়ার কারণে আমরা দ্বীপে আটকে পড়েছিলাম। তখন আমার ফুফু অসুস্থ হয়ে পড়েন। টেকনাফে নেওয়ার মতো অর্থ ছিল না। সেন্টমার্টিনের হাসপাতালে কোনো ডাক্তারও ছিল না। চিকিৎসার অভাবে আমার ফুফু মারা যান। তখন মনে হয়েছিল আমি যদি ডাক্তার হতাম, ফুফুকে বাঁচাতে পারতাম। সেই ঘটনার পরই সুমি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন, চিকিৎসক হয়েই নিজের দ্বীপের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করবেন।
দুই বোনের শিক্ষাজীবনও অনুকরণীয়। ফাতেমা বেগম তামান্না ২০১৯ সালে কক্সবাজার বাইতুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমি থেকে এসএসসি ও কক্সবাজার সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় এ+ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। সুমাইয়া আক্তার সুমি ২০২০ সালে একই স্কুল থেকে এসএসসি ও ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বাকলিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় এ+ পেয়েছেন। তাদের এই সাফল্য শুধু পারিবারিক গর্ব নয়, পুরো দ্বীপবাসীর গর্ব।
সুমাইয়া বলেন, ‘আমরা অনেকবার এমন ঘটনা দেখেছি, যখন কারো সামর্থ্য নেই চিকিৎসা নিতে। তখন বুঝেছি এই দ্বীপের মানুষ শুধু দরিদ্র নয়, চিকিৎসা বঞ্চিতও। তাই আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি, একদিন এই অভাব আমরা পূরণ করব।’
তামান্না ও সুমির বাবা মৌলভী আবদুর রহমান বলেন, ‘দ্বীপে চিকিৎসার অভাবে মানুষ মরতে দেখেই মেয়েদের ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখি। তাই তাদের মেডিকেলে পাঠিয়েছি। একদিন তারা আমার সেই আশা পূরণ করবে ইনশাআল্লাহ।’
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোছা. নাসরিন জেবিন জানান, ‘সেন্টমার্টিনে হাসপাতাল থাকলেও ডাক্তার নেই। দুই মেয়ের স্বপ্ন নিয়ে আমি গর্বিত। তারা অনেক দূর এগিয়েছে। একদিন নিজের জন্মভূমির চিকিৎসা সংকট দূর করবে এটাই আমার বিশ্বাস।’
আজ সেন্টমার্টিনের মানুষ তাদের নাম উচ্চারণ করে আশার আলো হিসেবে। কেউ বলেন, ‘ওরা আমাদের গর্ব,’ কেউ বলেন, ‘ওরা ফিরলে হয়তো আমাদের সন্তানদের আর চিকিৎসার জন্য সাগর পার হতে হবে না।’
সাগরের ঢেউয়ের মতোই প্রবল তাদের ইচ্ছাশক্তি। দারিদ্র্য, দূরত্ব কিংবা ঝড় কিছুই তাদের স্বপ্নকে থামাতে পারবে না। তারা প্রমাণ করতে চায়‘যে দ্বীপে মৃত্যু ছিল নিত্যসঙ্গী, সেখানেও একদিন জন্ম নিতে পারে জীবন বাঁচানোর গল্প।’