আপডেট : ১২ জানুয়ারি, ২০২৩ ০৯:১৩
ঠাকুরগাঁওয়ে গমের অর্ধেক আবাদ কমেছে ৬ বছরে
এম এস রানা, ঠাকুরগাঁও

ঠাকুরগাঁওয়ে গমের অর্ধেক আবাদ কমেছে ৬ বছরে

দেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ গম একসময় উৎপাদন হতো ঠাকুরগাঁওয়ে। জেলার চাহিদা পূরণ করে গম চলে যেত দেশের বিভিন্ন জেলায়। তবে বীজসংকট, বীজ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে আলু-ভুট্টার মতো ফসলের তুলনায় ফলন ও লাভ কম হওয়াসহ নানা সংকটের কারণে গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলে কমছে গমের আবাদ। ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ছয় বছরের ব্যবধানে জেলায় গম আবাদের জমির পরিমাণ কমে গেছে ৪৫ শতাংশেরও বেশি। বলা যায়, এই সময়ে গমের আবাদ নেমে এসেছে অর্ধেক জমিতে।

গম চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া অন্তত ২০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়েছে দৈনিক বাংলার। তারা জানাচ্ছেন, প্রতি মৌসুমেই গম বীজের সংকট নিয়মিত চিত্র। বীজ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকায় বীজের দাম থাকে বাড়তি, বীজ পেতেই ভোগান্তি পোহাতে হয়। অন্যদিকে গম ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে গম বিক্রিতেও ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এদিকে গমের চেয়ে ভুট্টা, সরিষা ও আলুর ফলন বেশি। এসব কারণেই গমের বদলে চাষিরা ঝুঁকে পড়ছেন আলু, আগাম ভুট্টা ও সরিষা চাষে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৬-১৭ মৌসুমে জেলায় গম চাষ হয়েছিল ৬৭ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে। পরের মৌসুমে (২০১৭-১৮) কমে গিয়ে আবাদ হয় ৬১ হাজার হেক্টর জমিতে। এরপর ২০১৮-১৯ মৌসুমে ৫০ হাজার ২২০ হেক্টর, ২০১৯-২০ মৌসুমে ৫০ হাজার ৬৫০ হেক্টর, ২০২০-২১ চাষ মৌসুমে ৪৭ হাজার ৪৫০ হেক্টর ও ২০২১-২২ চাষ মৌসুমে ৪৫ হাজার ১৯২ হেক্টর জমিতে গম চাষ হয়।

গমের আবাদ কমে যাওয়ার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে চলতি মৌসুমেও। এ মৌসুমে জেলায় গমের আবাদ হচ্ছে ৩৬ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমিতে। অথচ চলতি মৌসুমে গম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমি। ফলে এ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮ হাজার ৪২ হেক্টর কম জমিতে হচ্ছে গমের চাষ।

২০১৬-১৭ মৌসুম থেকে চলতি মৌসুম পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ছয় বছরের ব্যবধানে ঠাকুরগাঁওয়ে গম চাষের জমি কমেছে ৩১ হাজার ১২১ হেক্টর। সে হিসাবে ২০১৬-১৭ মৌসুমের চেয়ে ৪৫ শতাংশ কম জমিতে গম চাষ হচ্ছে চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কার্যালয়ের বীজ বিক্রয় ও বিতরণ কর্মকর্তা এনামুল হক জানালেন, জেলাতে বিএডিসির ১৬১ জন বীজ পরিবেশক রয়েছেন। তাদের এ বছর ৫৫৭ টন বীজ বরাদ্দসহ বিএডিসির বুথ থেকে ৪০ টন বীজ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে কৃষি অফিসের গম চাষের জমির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বীজের চাহিদা হেক্টরপ্রতি ১২০ কেজি হলেও দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৬৪ টনে। ফলে বীজের বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় অনেক কম। কৃষকরা বলছেন, এই চাহিদার সুযোগ নিয়েই বীজ ব্যবসায়ীরা একাট্টা হয়ে বীজসংকট তৈরি করেন।

রানীশংকৈলের গোগর এলাকার কৃষক ইয়াসিন আলী বলেন, ‘যেসব জমি আগে গমে ভরে থাকত সেসব জমিতে এখন ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসল হচ্ছে। আমি এ বছর পাঁচ বিঘা জমিতে গম আবাদ করছি। সরকার গম বীজের দাম করেছে ৫৮ টাকা, সেই বীজ ডিলারের কাছ থেকে কিনতে হয়েছে ৭৫ থেকে ৭৯ টাকায়। বীজ কিনতে যে ভোগান্তিতে পড়েছি, আগামী বছর আর গম চাষের ইচ্ছা নাই।’

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বছরে জেলায় গমের চাহিদা ৪ হাজার ৮০০ টন। গত বছর সরকার প্রতি কেজি গমের দাম নির্ধারণ করে ২৮ টাকা। সে সময় বাজারে গমের দাম ছিল প্রতি কেজি ৪২ টাকা। ফলে কৃষকরা সরকারের কাছে গম বিক্রি করেননি। ওই সময় মাত্র চার টন গম কিনতে পারে সরকার।

গম চাষে অনাগ্রহের কারণ জানিয়ে সদর উপজেলার আকচা মুন্সিপাড়া গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে গম উৎপাদন খরচ প্রায় ১০ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি ৩০ মণের বেশি গম পাওয়া যায় না। সরকারও অনেক কম দাম দেয়। লাভ কম হয়। তাই আলু তোলার পরপরই আগাম ভুট্টা চাষ করেছি। ভুট্টায় একই খরচে বেশি ফলন পাওয়া যায়, দামও ভালো।’

তবে অন্য ফসলগুলোর সঙ্গেই গম চাষ করে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানাচ্ছেন ঠাকুরগাঁওয়ে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘একজন কৃষক আলু তোলার পরই জমিতে গম চাষ করতে পারেন। গম কাটার পর আবার ভুট্টা চাষ করতে পারেন। একই জমিতে বোরো ধানও চাষ করা যায়। এতে কৃষক বেশি লাভবান হতে পারেন। আমরা কৃষকদের এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছি এবং বীজ উৎপাদনে তাদের সহযোগিতা করছি।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. আব্দুল আজিজও গম চাষ কমে যাওয়ার তথ্য স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। আর তারা যে ফসলই আবাদ করুক, অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সহযোগিতা থাকবে।’