সংস্কৃতি এবং রাজনীতি জনজীবনের প্রবহমান ধারায় এক অসাধারণ বলয়। এই বলয় ছাড়া মানুষের জীবনচর্চা পরিশুদ্ধ হয় না। সংস্কৃতি জীবনকে পরিস্ফুটিত করে। রাজনীতি জীবনকে গতিময় করে। স্বৈরাচারী শাসন যেমন জনজীবনের কাম্য নয়, তেমনি অপরিশীলিত সংস্কৃতির চর্চা জনজীবনের কাম্য নয়। স্বৈরাচারী শাসন রুদ্ধ করে মানবিক অধিকারের খোলা প্রান্তর। অপরিশীলিত সংস্কৃতি ঘটায় মূল্যবোধের অবক্ষয়। সংস্কৃতি যেকোনো জাতির শিকড়ের গভীরতা। আত্মপরিচয়ের গভীরতম উৎস। সংস্কৃতির কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যের মাধ্যমে বাঙালির গৌরবকে সাহসের সঙ্গে একটি অসাধারণ পঙ্ক্তি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’।
১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। দেশে তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিপাগল মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছে। নজরুলই একমাত্র কবি, যিনি স্বাধীনতার পক্ষে লড়াকু সৈনিক হয়ে উঠেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে জেলে ঢুকিয়েছিল। তিনি তার ‘ধূমকেতুর পথ’ নিবন্ধে লিখেছিলেন, “সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লি করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছে, তাঁদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার, এই ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে। পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল কিছু নিয়ম-কানুন, বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।” শুধু কবিতা লিখে নয়, পত্রিকা প্রকাশ করেও অনবরত মানুষকে বিদ্রোহ করার পক্ষে উজ্জীবিত করেছেন কবি। তিনি ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির হাতে থাকবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা।
এভাবেই তৈরি হয় সংস্কৃতি ও রাজনীতির বন্ধন। একজন সৃজনশীল মানুষ তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে তার গণমানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিস্থিতি নিজের প্রজ্ঞায় বিশ্লেষণ করেন। তা আপন সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে পৌঁছে দেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে। একজন রাজনীতিবিদও সৃজনশীল মানুষ, যখন তিনি গণমানুষের মর্যাদার বোধকে আলোয় নিয়ে আসেন। তাকে বুঝিয়েছেন কী তার অধিকার, কোথায় তার লড়াই। তবে এ লড়াইয়ের প্রসঙ্গে ভাষার প্রসঙ্গটি গভীর শেকড়ের সঙ্গে জড়িত।
এ বছরের তো একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির শহীদ দিবসের ৭১ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এটা পৃথিবীতে প্রথম ভাষার জন্য জীবনদানকারী ঘটনা। ইউনেসকো কর্তৃক ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। বলা যাবে বিশ্বজোড়া অর্জনের এটি একটি যাত্রা। কথা ছিল এই ভাষা নিজ দেশে পরবাসী হবে না। কথা ছিল দীর্ঘ সময় ধরে প্রবাহিত ভাষার পূর্ণতা অর্জন হবে। হয়েছে কি? জোর গলায় বলা যাবে কি বাংলা আমার অহংকার? উত্তরটা গলা উঁচিয়ে বলা যাবে, না।
বলা হয়ে থাকে, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১- স্বাধীনতা অর্জন। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছে বাঙালি। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
আমরা এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২তম গৌরবের বিজয় দিবস পালন করেছি। আর ভাষাকেন্দ্রিক বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র, যে সাংবিধানিকভাবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। কিন্তু জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সম্মানজনক ব্যবহার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। মানুষের আচরণেও নিজ মাতৃভাষার প্রতি জীবনদানকারী একটি জাতির মাতৃভাষার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব অত্যন্ত দুঃখজনক।
ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পরিচালিত স্কুলগুলো মাতৃভাষার জন্য শিক্ষার্থীদের কতটা অনুপ্রাণিত করে তা প্রশ্নবিদ্ধ। তার পরও বলা যায়, গত কয়েক বছরে স্কুলগুলো নিজেদের আগের অবস্থান থেকে খানিকটা সরে এসেছে। এটা তো সত্যি যে, শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত করলে প্রজন্মের আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি হয় না। তাদের শিকড়ের মাটি থাকে না। বিদেশে পড়াশোনা বা চাকরি করতে গেলে উদ্বাস্তু মানুষে পরিণত হয়।
দুঃখজনকভাবে ডিজুস নামে এক বিকৃত ভাষা বিনা বাধায় বাণিজ্যিক মুনাফার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দেখার কেউ নেই। রাস্তার বিজ্ঞাপন বোর্ড, বিলবোর্ড বাংলা ভাষাকে ঝেড়ে ফেলেছে। যে অল্প কিছুসংখ্যক বিজ্ঞাপনে বাংলা ব্যবহার করা হয়, তা দিয়ে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খুশি হওয়ার কারণ নেই। জনগোষ্ঠী ক্রমাগত নিজ মাতৃভাষা নিয়ে শঙ্কিত।
দেশের সব ক্ষেত্রে ভাষার অবমাননা চলছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগের জন্য ইংরেজি ভাষার বিকল্প নেই। এটি নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না। সবাই বুঝে গেছে যে, ইংরেজি ভাষা লাগবে। কিন্তু কোথাও কোথাও বোঝাটা বেশি হয়ে যায়। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ইংরেজি নাম রেখে অনুষ্ঠান করার প্রয়োজন আছে কি? কার স্বার্থে? যদি বিদেশিদের জন্য অনুষ্ঠান করতে চান কিংবা শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো অনুষ্ঠানের দরকার হয়, তাহলে সুন্দরভাবে ইংরেজি ভাষায় অনুষ্ঠান করুন। শিক্ষার্থীরা যেন বুঝতে ও শিখতে পারে সেটি দেখুন। কিন্তু বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে জগাখিচুড়ি বানানোর অর্থ কী? ছেলেমেয়েরা উচ্চারণ করে হ্যালো ভিউয়ার কিংবা হ্যালো লিসেনার্স- এর ফলে কি খুব স্মার্ট হয়ে যায় ওরা! উল্টো না শেখে ইংরেজি, না শেখে মাতৃভাষা। সুপ্রিয় দর্শক, সুপ্রিয় শ্রোতা কি খুব খারাপ সম্বোধন? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে বাংলা ভাষা শিখতে ও পড়তে পারে না। আইনজীবীদের মুখেই শোনা যায় বাদী বা বিবাদীর পক্ষে লিখিত বক্তব্য দাখিল বা পেশ করার জন্য বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এ অবস্থা দেশের অন্য অনেক ক্ষেত্রে চলছে।
আমরা বলে থাকি, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ। আমরা যুদ্ধ করে, জীবন দিয়ে স্বাধীন দেশ লাভ করেছি। এখন প্রশ্ন, বাংলাকে আমরা কতটা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে পেরেছি? আমাদের অমর একুশে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার পরও দেশের ভেতরে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অন্য কথায়, প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এ কথা অনেকেই জানে, উন্নয়নশীল ছোট দেশের মাতৃভাষা অর্থনৈতিক কারণে বিশ্বের দরবারে পৌঁছতে পারে না।
বাইরের বিশ্বে না হোক, অত লম্বা প্রতিযোগিতা কঠিন জায়গা কিন্তু দেশের ক্ষমতাবানরা ভাষার মর্যাদার স্বরূপটি বুঝতে পারবেন না কেন? এমনকি দেশের সচেতন নাগরিকও বুঝে না বুঝে শিশুদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠানোর চেষ্টায় পিছিয়ে নেই।
ইংরেজি একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। ছেলেমেয়েরা শিখুক কিন্তু কোনোভাবেই নিজের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়। অসংখ্য পরিবারে ছেলেমেয়েদের বাংলা বলার চর্চা করানো হয় না। লিখতে-পড়তে তো জানেই না। এমনকি বুধসমাজের জ্ঞানী-গুণীরাও সেমিনারের মাইকে ইংরেজি ভাষা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সেখানে একজন বিদেশি না থাকলেও। বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে তারা মাতৃভাষাকে পদদলিত করেন।
দুঃখ, ফেব্রুয়ারি মাস এলেই এসব কথা লিখব, অন্য সময় স্রোত আপন নিয়মে গড়াবে। এভাবে আমরা যদি গড্ডলিকা স্রোতে ভেসে যাই। তাহলে আমাদের গৌরবের অর্জন অনবরত কালিমালিপ্ত হতে থাকবে।
আমি বাংলা একাডেমিতে ১৯৭০ সালের ২ জুলাই গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগদান করি। ৩৪ বছর চাকরি করে ২০০৪ সালে অবসর নিই। তারপর বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের পর এখন আমি বাংলা একাডেমির সভাপতি। সে ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা প্রতিদিন দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। নিজের লেখালেখির সূত্র ধরে ভেবেছিলাম, এ আমার অস্তিত্বের মেলা। পরে দেখলাম, লেখক-পাঠক নির্বিশেষে বইমেলা অগণিত মানুষের প্রাণের মেলা হয়েছে। আমার ৩৪ বছরের চাকরিজীবনের এই আবহ এখনো আমার কাছে পর্যন্ত অনুপ্রেরণার উৎস। মেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশের এমন গভীর আনন্দ পৃথিবীর আর কোথায় পাব!
এ মেলাকে আস্তে আস্তে বড় হতে দেখেছি। স্টল তৈরি হতে দেখেছি। ছোট পরিসরে মেলার আয়োজন দেখেছি। এসব সত্তর দশকের কথা। তখন মানুষের ভিড় এবং স্টলের সংখ্যাও কম ছিল।
আশির দশকে বড় পরিবর্তন হয়। ১৯৮৪ সালে বইমেলার আনুষ্ঠানিক নাম রাখা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। এ সময় মেলার আয়তন যেমন বাড়ে, তেমনি সময়ও বৃদ্ধি পায় ৭ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ সময় বইমেলা উদ্বোধন করতেন দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা। মেলার এমন পরিবেশে বিশ্বাস করতাম, মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনাকে পরিশীলিত করতে এমন মেলার বড় ভূমিকা আছে। তাই বইমেলা আমাদের অহংকার, বাংলা ভাষা আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির প্রদীপ। আমরা যেন তা জাতীয় জীবনে ও রাজনৈতিকভাবে ভুলে না যাই।
লেখক: কথাশিল্পী ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা