সাধারণত আমাদের দেশে ভুল-ত্রুটি ও অন্যায়ের দায় স্বীকার করতে পারতপক্ষে কেউই চায় না। সেই অস্বীকারের সংস্কৃতি ভেঙে এবং কোনো প্রকার জজ মিয়া তত্ত্ব হাজির না করে অধ্যাপক জাফর ইকবাল যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তার প্রশংসা করার মানসিকতাও আমাদের মাঝে জন্মায়নি।
সমাজের একটি পক্ষ খুবই মজা করছে এই ভেবে, যাক তরুণ প্রজন্মের আদর্শ পুরুষ এবার ফাঁদে পড়েছে। এই পক্ষটি নানা রকম ব্যাঙ্গাত্মক উক্তি, কার্টুন দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করছে কোনো প্রকার রাখঢাক না করে। আর এরই সুবাদে আমাদের আলেম সমাজ ডারউইনের বিবর্তনবাদ পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়ার আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছে।
কোনো কোনো পক্ষ বলছে, অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও তার দল রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষতি করেছেন। এতে বিপুল পরিমাণ পুস্তক এখন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। অধ্যাপক জাফর ইকবাল গুরুত্বপূর্ণ নকলের বিষয়টিকে হালকা করে দেখেছেন। তিনি ও তার দল এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ পরীক্ষামূলক বলে চালিয়ে দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো: এভাবে শিশুদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা করা যায় কী? এই পরীক্ষার অনুমতি তাদের কে দিলেন এবং কোন নিয়মের মাধ্যমে দিলেন?
বিগত বছরগুলোতে প্রশ্ন ফাঁস ও পাঠ্যপুস্তকের বিষয় নির্বাচন নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। একটি পক্ষ মনে করে, এখানে ক্ষুদ্র রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কেউ বলছেন, এখানে ধর্মীয় ভূত অনুপ্রবেশ করেছে। আবার কেউ বলছেন, এখানে নাস্তিকরা নিয়ন্ত্রণ করছে। এসবের পেছনে উদাহরণও দিতে সক্ষম হচ্ছেন সমালোচকরা। সুতরাং সমালোচকরা যে একেবারেই ভিত্তিহীন সমালোচনা করছেন তা বলা যাবে না।
আমরা আসলে চাই, আমাদের সন্তানরা বিজ্ঞানমনস্ক হোক। আবার আমরা চাই, সে ধর্ম-কর্ম, নাচ, গান, বাজনা করবে। আমরা তাদের স্বাধীনতাকে অভিভাবকের অধিকার নিয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছি যে, শিক্ষার্থীরা একটি যন্ত্রে পরিণত হয়েছে আমাদের স্বপ্ন পূরণে। সরকার তার স্বপ্ন পূরণ করতে চায়, সমাজ তার স্বপ্ন করতে পূরণ চায়, আর যারা এখানে সিদ্ধান্ত নেন তারাও তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে চান। আধুনিক সমাজব্যবস্থায় শিক্ষার কারিকুলাম ও পাঠ্যসূচি নির্মাণে শিক্ষার্থীর ভূমিকাকে বিবেচনায় নেয়া হয়। সে রকম সুযোগ আমাদের সমাজে পরিলক্ষিত হয় না। সুতরাং আমরা উন্নত সমাজব্যবস্থা থেকে এখনো যোজন-যোজন দূরে।
আমাদের কোথায় থামতে হবে, কোথায় বদলাতে হবে সেটা জানা জরুরি। আবার চুরি করা বিদ্যা শিক্ষার্থীকে শেখানোর সুযোগ যেমন নেই, তেমনি চুরি করার পর চোর প্রমাণিত হলে তাকে ক্ষমা করার নজির সৃষ্টি করা সমীচীন নয়। আমরা বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখেছি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা চুরি নিয়ে। যে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বোচ্চ শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সর্বোচ্চ মেধাবীদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিগণিত। সেই প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা আমরা নানাভাবে কলঙ্কিত করছি। আমরা বলি বিদ্যাপীঠ পবিত্র স্থান। এখানে সত্যের চর্চা হয়ে থাকে। এভাবে দেখলে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় যা কিনা মেধা ও মননের বিকাশের সেগুলো পবিত্র স্থান। সেখানে অপবিত্র পেতাত্মা যে ঘিরে রেখেছে তা আমাদের অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
আমাদের শিক্ষাঙ্গন, আমাদের পাঠ্যপুস্তক সেই অশুভ পেতাত্মা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে চোর, সন্ত্রাসী বুক ফুলিয়ে চলে বিভিন্ন ব্যানারে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষাকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, তিনি তিনজন শিক্ষাবিদকে সচিব এবং বরেণ্য ব্যক্তিদের উপাচার্য, অধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমাদের সর্বনাশ হয় গেছে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর অন্ধকার ট্র্যাজেডিতে। জাতির পিতাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে আমরা যে অশুভ শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছি তার থেকে আমাদের আজও মুক্তি মেলেনি। আদৌ মুক্তি মিলবে কী? তবে ‘আশা তার একমাত্র ভেলা’। আর সেই আশা জাগিয়েছেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল দায় স্বীকারের মধ্য দিয়ে। আমাদের আশা, আগামীতে এভাবে আরও অনেকেই দায় স্বীকার করবেন। তাকিয়ে দেখুন নিউজিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন কীভাবে পরিবারের কথা চিন্তা করে চলে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে। আমরা কবে সেরকম উন্নত হব? আমার যা পারি না তার বোঝা কেন নেব? আমাদের বিবেক কবে জাগরিত হবে! আমরা চুরিকে চুরি বলতে সক্ষম হব এবং নিষ্ঠাবান ব্যক্তির অবদানকে সম্মান করব? কথায় আছে, নৈতিকতা ওপর থেকে আসে। অধ্যাপক জাফর ইকবাল সেই কাজটি করেছেন। আমরা তাকে ধন্যবাদ দিতে যেন কার্পণ্য না করি। আমরা যেন আমাদের সক্ষমতার বাইরে গিয়ে কোনো কাজ না করি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়া অজানা বিষয়ের ওপর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হয়ে যান। আমরা তাই গবেষক চুরি করল কি না ধরতেই পারি না। আমাদের সক্ষমতা বিবেচনা করে পথ চলা উচিত।
আমাদের বিশ্বাস যারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ তারা সুশাসন বাস্তবায়নের পথের কাঁটা না হয়ে সরে যাবেন। হার্ভার্ড বিজিনেস রিভিউতে প্রকাশিত প্রবন্ধে মাইকেল টিমস লিখেছেন, ‘দোষারোপ করা সুন্দর জবাবদিহি ও সুস্থ কর্মক্ষেত্র তৈরিতে অন্তরায়।’ সুতরাং আমাদের উচিত দায় স্বীকৃতির সংস্কৃতি বিকাশে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করা এবং তাদের ব্যর্থতাকে অতিমাত্রায় সমালোচনা থেকে বিরত থাকা। আমরা যারা বুঝে বা না বুঝে আজ যেসব সমালোচনা করছি তা আসলে আগামীতে দায় স্বীকার করার মনোভাবকে ধ্বংস করবে। ফলে আবার চালু হবে blame game যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। জজ মিয়া তত্ত্ব নয় শুদ্ধাচার হোক আমাদের পাথেয়। আমরা যদি জবাবদিহির সংস্কৃতি পছন্দ করি তবে আমাদের উচিত অধ্যাপক জাফর ইকবালকে স্বাগত জানানো। জবাবদিহির যে বীজ তিনি রোপণ করলেন সমাজে, তা যেন আরও বিকশিত হয়।
লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা