আপডেট : ২৪ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৬:০৮
ওদের একজন রুবেল বন্ধু আছে
শাকিব হুসাইন

ওদের একজন রুবেল বন্ধু আছে

পাশে সারি সারি নৌকা। তার পাশেই আপন মনে বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছে ছোট ছোট শিশুরা। এই ছোট ছোট শিশুরাই আগে মাছ ধরে বেড়াত। কিন্তু তারা আজ বইয়ের ঘ্রাণ নিচ্ছে, বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছে। আবার মনোযোগ দিয়ে পড়ছেও। তাদের এই বইমুখী করার জন্য শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কাজ করে চলেছেন এক উদ্যমী ও স্বপ্নবাজ তরুণ। নাম রুবেল মিয়া নাহিদ। সালটা ২০১৭। তড়িৎ প্রকৌশলে স্নাতক পাস করেন রুবেল। পড়াশোনা শেষে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার বাড়িতে গিয়ে নদীর তীরে বেড়াতে যেত। একসময় তার নজরে আসে জেলেপল্লি। জেলেপল্লির শিশুরা মাছ ধরছে। তারা বিদ্যালয় না গিয়ে এই বয়সেই শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। ওদের কানে কেন পৌঁছায় না স্কুলের ঘণ্টা? যে বয়সে ওদের হাতে থাকবে বই, কাঁধে থাকবে স্কুল ব্যাগ, সে বয়সে ওরা নদীর উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাছ ধরছে। যে বয়সে হাসি-আনন্দে বেড়ে ওঠার কথা। সে বয়সে ওরা মাথায় বহন করছে মাছের ঝুড়ি? এমনি হাজারও প্রশ্ন ঘুরপাক খায় রুবেলের মনে। জেলে শিশুদের এ রকম অবস্থা দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি। তার পর তাদের নিয়ে ভাবলেন এবং তাদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে উদ্যমী হলেন। বন্ধু সজীব মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুললেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাতেখড়ি ফাউন্ডেশন। হাতেখড়ি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি রুবেলের। ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ হাতেখড়ি ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে এখন আমার জেলেপল্লির শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছেন রুবেলসহ কয়েকজন স্বপ্নবাজ তরুণ। জেলেশিশুদের জীবনমান উন্নয়ন, বিদ্যালয়মুখীকরণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণ, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ অনগ্রসর শিশুর জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে কাজ করে যাচ্ছেন। দক্ষিণাঞ্চলের বলেশ্বর নদী তীরবর্তী জেলেদের সন্তানদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করছে হাতেখড়ি ফাউন্ডেশন। নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ করতে বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টি করাসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষা, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার আওতায় নিয়ে আসতে চেষ্টা করে যাচ্ছে সংগঠনটি। এ ছাড়াও বাল্যবিবাহ রোধ, ইভটিজিং প্রতিরোধে, বিনা মূল্যে রক্তদানসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজেও রয়েছে হাতেখড়ি ফাউন্ডেশনের বিচরণ। যে শিশুরা আগে মাছ ধরত। এখন তারাই কম্পিউটার চালাচ্ছে। শিখছে ব্রাউজিং। খেলছে বিভিন্ন গেইম। যে অভিভাবকরা আগে সন্তানদের মাছ ধরতে নিয়ে যেত, এখন তারাই তাদের সন্তানদের পাঠাচ্ছে বিদ্যালয়ে। পুরো গ্রাম যেন ডিজিটাল ভিলেজে পরিণত হচ্ছে। পড়াশোনার পাশাপাশি আরও বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম করে চলছে হাতেখড়ি ফাউন্ডেশন। বর্ষায় শিশুদের মাঝে রঙিন ছাতা বিতরণ করছে। এই কার্যক্রমের নাম দিয়েছে প্রজেক্ট স্বপ্নপূরণ। পাঁচ শতাধিক শিশুকে রঙিন ছাতা দিয়েছে সংগঠনটি। এ ছাড়াও জেলেশিশুদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ যেমন- খাতা, কলম, ব্যাগ ইত্যাদি তুলে দেয় প্রজেক্ট হাসি। প্রজেক্ট উৎসবের মাধ্যমে তারা ধর্মীয় উৎসবগুলোতে জেলেশিশুদের নিয়ে বিভিন্ন উৎসব পালনসহ, তাদের মাঝে উপহারসামগ্রী তুলে দিচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনা মূল্যে পড়ানোর জন্য কাজ করছে তাদের হাতেখড়ি ফ্রাইডে স্কুল। এ ছাড়া বর্তমানে তারা পরিচালনা করছে প্রজেক্ট জল ও জীবন। এক টাকার মিনি মার্কেট। যেখানে এক টাকার বিনিময়ে দেয়া হয় টিফিন বক্স, পানির বোতল, রং-পেনসিল, ড্রইং বুক, স্কেল, পেনসিল, রাবার, কাটার, কলম, খাতা ইত্যাদি। উপকূলীয় শিশুদের জন্য চারটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পড়া থেকে বঞ্চিত শিশু-কিশোরদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে পাঠাগারগুলো।

হাতেখড়ি ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগের স্বীকৃতিস্বরূপ তারা পেয়েছেন জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২০। তা ছাড়া ইন্সপায়ারিং উইমেন ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড-২০২২’ও পেয়েছেন।

রুবেল মিয়া বলেন, অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান না। তারা মনে করেন, পড়াশোনার চেয়ে সন্তান অর্থ উপার্জন করলেই সংসারের ভালো। আমরা সেসব অভিভাবককে নিয়ে কর্মশালা করি এবং তাদের পড়ালেখার গুরুত্ব বোঝাই।

তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত ৫০-এর অধিক শিশুদের বিদ্যালয়ের মুখীকরণ করতে পেরেছে সংগঠনটি। যারা বাবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরত, তাদেরই একজন নয়ন পাল। আগে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যেত, এখন পড়াশোনা করতে স্কুলে যায়। ওরা এখন স্কুল মাঠে বিজ্ঞান মেলা দেখতে পারে। শুরুতে পরিবারকে বোঝানো খুব কঠিন ছিল কিন্তু এখন পরিবারের সদস্যরাই আগ্রহ করে বলেন নিয়মিত ওরা স্কুলে যাচ্ছে। আমরা চাই প্রতিটি শিশু আপন আলোয় আলোকিত হোক।