আপডেট : ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ০৯:২২
নতুন উচ্চতায় চিনির দাম
মৌসুমী ইসলাম

নতুন উচ্চতায় চিনির দাম

দুই মাস না যেতেই আবারও বাড়ানো হলো চিনির দাম। এবার কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ এক কেজি খোলা চিনি কিনতে গুনতে হবে ১০৭ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি কিনতে লাগবে ১১২ টাকা। যদিও বাজারে আগে থেকেই বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। কাগজে-কলমে নতুন করে দাম বৃদ্ধিতে বাজারে চিনির দাম আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

অনেকে বলছেন, দুই মাস পর শুরু হবে পবিত্র রমজান মাস। এই মাস সামনে রেখে এমনিতেই নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন ধরে। এবার রোজার প্রভাব বাজারে পড়ার আগেই বাড়ল চিনির দাম।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গত বুধবার বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠকে চিনির নতুন এই দাম নির্ধারণ করা হয়। ঘোষণা দেয়া হয় গত বৃহস্পতিবার। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন দাম কার্যকর হবে। মূল্য সমন্বয়ের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘দাম না বাড়িয়ে উপায় ছিল না।’

কেজিতে বাড়ল ৫ টাকা

খোলা এক কেজি চিনির ভোক্তাপর্যায়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৭ টাকা, আগে যা ছিল ১০২ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১১২ টাকা, যা আগে ছিল ১০৮ টাকা।

বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন দাম বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছে, অপরিশোধিত চিনির আন্তর্জাতিক বাজারদর বৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও স্থানীয় পরিশোধনকারী মিলগুলোর উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন এ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

দফায় দফায় দাম বাড়ছে

এর আগে গত ১৭ নভেম্বর খুচরা পর্যায়ে চিনির দাম বাড়ানো হয়েছিল। সেবার প্যাকেটজাত চিনির দাম ৯৫ টাকা থেকে ১২ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ১০৭ টাকা। আর প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম বাড়িয়ে করা হয় ১০২ টাকা। তার আগে গত বছরের ৬ অক্টোবর খোলা প্রতি কেজি চিনির দাম বেঁধে দেয়া হয় ৯০ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনির কেজি নির্ধারণ করা হয় ৯৫ টাকা।

এর আগে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর প্যাকেটজাত চিনির সর্বোচ্চ দর ৮৯ টাকা, আর খোলা চিনি প্রতি কেজি ৮৪ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

বলা যায়, প্রতি দু-এক মাস পরই চিনির দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মূল্য পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। কিন্তু দাম পর্যালোচনা করা অবস্থাতেই বাজারে চিনির সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধির অভিযোগ রয়েছে।

নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে চিনি বিক্রি

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল, মিরপুরসহ বিভিন্ন বাজারে গতকাল বৃহস্পতিবারও নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে চিনি বিক্রি হতে দেখা গেছে। বাজারে খোলা চিনির কেজি এখন ১১০ টাকা। প্যাকেটজাত চিনির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকায়।

কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী জিন্নাত হোসেন বলেন, প্যাকেটজাত চিনির গায়ের দামে বিক্রি করা সম্ভব নয়। কারণ এর চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। তিনি বলেন, চাহিদামতো সরবরাহ করা হচ্ছে না। ফলে দাম বেড়ে যাচ্ছে।

হাতিরপুল বাজারের ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন বলেন, অল্প পরিমাণে চিনি পাওয়া যায়। ক্রেতার চাহিদামতো চিনি সরবরাহ করা যায় না। কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, উৎপাদন হচ্ছে কম। তাই সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না।

বছরের ব্যবধানে ৫০ শতাংশ দাম বেড়েছে

চিনি স্বাস্থ্যের জন্য সার্বিকভাবে উপকারী নয়, কখনো কখনো তা ক্ষতিকর- এ কথা এখন প্রায় সবার জানা। তার পরও এই পণ্যের চাহিদা কখনো কমেনি। বরং বেড়েছে। আর এ সুযোগে দামও বেড়েছে। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, এক বছরে কেজিতে চিনির দাম বেড়েছে ৫০ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

গতকাল এক কেজি চিনি সর্বনিম্ন ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে দর ছিল ১০৭ থেকে ১১৫ টাকা। এক মাস আগে এক কেজি চিনি ছিল ১১৫ টাকা, এক বছর আগে ২০২২ সালের একই সময়ে যা ছিল ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা।

ক্রেতার নাভিশ্বাস

নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখীর কারণে এমনিতেই সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। চাল, আটা, ডিম, পেঁয়াজ, চিনি, মসুর ডাল থেকে শুরু করে ভোগ্য এবং নিত্যব্যবহার্য প্রায় সব পণ্যের গায়েই আগুন। এরই মধ্যে আরেক দফা চিনির দাম বাড়ার ঘোষণা এল। এদিকে চিনি নিয়ে সংকটও দীর্ঘ হচ্ছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে এ-সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা পরিচালনা। বাসাবাড়িতেও চিনির শূন্যতা স্পষ্ট। কিন্তু সরবরাহ নিশ্চিতে নেয়া হচ্ছে না কোনো পদক্ষেপ।

রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাজারে বিভিন্ন ধরনের পিঠা বিক্রি করেন মোশাররফ হোসেন। দিনে এই ব্যবসায়ীর দরকার হয় অন্তত ছয় থেকে সাত কেজি চিনি। কিন্তু একে তো দাম বেশি, অন্যদিকে পাওয়া যায় না। তাই চিনির পরিবর্তে এখন গুড়ই ভরসা তার। মোশাররফ বলেন, চিনি না পাওয়ায় বিক্রি কমিয়ে দিতে হয়েছে। চিনি পেলেও দাম বেশি। গুড়ই এখন লাভজনক।

চা-বিক্রেতা বিল্লাল মিয়া বলেন, ‘প্রতিদিন তিন কেজি চিনি প্রয়োজন। কিন্তু চিনিই নেই বাজারে। চিনির দাম বাড়লে চায়ের দামও বাড়াতে হয়। এতে ক্রেতাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয়।’

বাণিজ্যমন্ত্রীর যুক্তি

চিনির দাম বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘দাম বাড়ানো না হলে বাজারে চিনি পাওয়াই যাবে না। সব হিসাব-নিকাশ করে চিনির দাম যতটুকু বাড়ানো দরকার, ততটুকু বাড়ানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে চাহিদার ১ শতাংশ চিনিও উৎপাদন হয় না। আমাদের ২০ লাখ টন চিনি দরকার, উৎপাদন ৫০ হাজার টনও না। আমাদের নির্ভর করতে হয় আমদানির ওপর। গ্লোবাল মার্কেটে চিনির দাম বেড়েছে, যার জন্য সমস্যাটা হয়েছে। পাশাপাশি আমরা চেষ্টা করছি যাতে ডিউটি কমিয়ে দেয়া হয়।’

বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো এলসি খুলতে পারছে না- এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, ‘জাহাজে কিছু পণ্য ছিল, সেগুলো রিলিজ করা শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চারটি সরকারি ব্যাংকে এলসি খোলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বড় গ্রুপগুলো এলসি ওপেন করতে পারছে। আর ছোট গ্রুপগুলোর বিষয়ে ব্যাংকগুলো গ্রাহক বুঝে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’

চিনির আমদানি কমেছে

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে বার্ষিক চিনির মোট চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে আখ থেকে ৩০-৩৫ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদিত হয়। চাহিদার বাকিটা আমদানি করেই মেটানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২২ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ২৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের চিনি আমদানি করা হয়েছে। ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ৪১ কোটি ২৮ লাখ ডলারের চিনি। অর্থাৎ আমদানি কমেছে ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ।

কাস্টমসের হিসাবে, ২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে দেশে মোট ৭ লাখ ৩৩ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে। ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৪১ হাজার টন। আমদানি কমেছে ২২ শতাংশ।