বৈশ্বিক কারণে অর্থনীতিতে চাপ সামলাতে বিশ্ব আর্থিক খাতের অন্যতম প্রধান মোড়ল সংস্থা আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঋণ চেয়েছিল, সংস্থাটি তার চেয়েও বেশি ঋণ দিচ্ছে। সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি (৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন) ডলার চেয়েছিল তবে আইএমএম তার চেয়ে ২০ কোটি ডলার বেশি অর্থাৎ ৪৭০ কোটি (৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন) ডলার দেবে।
গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফের সদর দপ্তরে সংকটকালে বাংলাদেশের বহুল প্রত্যাশিত এই ঋণের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদ। মঙ্গলবার দুপুরে আইএমএফের ওয়েবসাইটে এই ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে।
৪২ মাসের চুক্তিতে সরকারের নেয়া ‘অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে’ সহায়তা হিসেবে আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) থেকে ৩৩০ কোটি (৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার তাৎক্ষণিকভাবে ছাড় করা হবে বলে বিবৃতিতে জানিয়েছে আইএমএফ।
এ ছাড়া আইএমএফের নবগঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় বাংলাদেশ পাবে ১৪০ কোটি (১ দশমিক ৪ বিলিয়ন) ডলার। বাংলাদেশই প্রথম এশীয় দেশ, যারা এই তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে।
এই দুই তহবিল থেকে মোট ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ২ দশমিক ২ শতাংশ সুদে নেয়া এই ঋণ আসবে সাত কিস্তিতে। শেষ কিস্তি আসবে ২০২৬ সালে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রাসংকটে পড়া বাংলাদেশ রিজার্ভ বাড়াতে এমন অর্থের প্রত্যাশায় ছিল।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় সহায়তা করবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার যে সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নেও সহায়তা করবে এই ঋণ।
আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে আরও টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সরকারকে তার উচ্চাভিলাষী সংস্কার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে মানবসম্পদ ও অবকাঠামো খাতে আরও বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও তা জরুরি। তারা বলেছে, বাংলাদেশ সরকার এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও বাংলাদেশ অবগত।’
অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ বলেন, ‘রাজস্ব খাতে সংস্কার করলে বাংলাদেশ সামাজিক খাত, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ব্যয় বৃদ্ধি করতে পারবে। তবে সে জন্য কর নীতি ও রাজস্ব প্রশাসন- উভয় খাতেই হাত দিতে হবে। রাজস্ব সংস্কার হলে সরকারি অর্থায়ন, বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত হবে। এতে সরকারের ব্যয় সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়বে এবং শাসনব্যবস্থাও উন্নত হবে।’
আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আরও বলেন, ‘আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমলে, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা উন্নত করা হলে ও পুঁজিবাজারের উন্নতি করা গেলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা সম্ভব হবে।’
এ ছাড়া প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন আইএমএফের ডিএমডি। সে জন্য দরকার, বাণিজ্য ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ তৈরি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন।
৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ পেতে ও চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার কয়েক মাস ধরেই সংস্কার কর্মসূচি পরিচালনা করছে। চলতি জানুয়ারিতে যখন আইএমএফের ডিএমডি বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন এসব সংস্কারে সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। মৌলিক এসব সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার প্রতিও আইএমএফের ডিএমডি গুরুত্বারোপ করেন তখন।
সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কী সংস্কারে হাত দিয়েছে, যাতে আইএমএফ সমর্থন করছে- আইএমএফের ডিএমডির ঢাকা সফরের সময় এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জানা যায়, ভর্তুকি কমাতে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এরপর গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়। রিজার্ভের গণনাপদ্ধতি আইএমএফের চাওয়া অনুযায়ী করা হচ্ছে এবং জ্বালানি তেলের দাম মাসে মাসে সমন্বয় করার ঘোষণাও দিয়েছে সরকার।
আইএমএফও তাদের বিবৃতিতে বলেছে, করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল বাংলাদেশ, কিন্তু যুদ্ধের কারণে তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাতে বৈদেশিক বাণিজ্যে চলতি হিসাব ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, টাকার মান কমে গেছে এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। সাম্প্রতিক এই অর্থনৈতিক জটিলতাগুলো মোকাবিলায় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ একগুচ্ছ সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার মনে করে, প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করতে, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণে, উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং জলবায়ু সহনশীলতা তৈরি করতে হলে তাৎক্ষণিক এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার পাশাপাশি, দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সমস্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিগুলোকেও আমলে নিতে হবে।’
বাংলাদেশকে ঋণ দিতে গত বছরের নভেম্বরে ঢাকায় কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছায় আইএমএফ। সেই ঋণচুক্তির শর্তসহ খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ার মধ্যেই বাংলাদেশ সফর করেন আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ।
এরপর বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের সভায় ওঠে এবং অনুমোদন পায়।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা