আপডেট : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ২২:৪৩
হিমবাহ হ্রদ গলে বন্যার  ঝুঁকি, হুমকিতে দেড় কোটি মানুষ
দৈনিক বাংলা ডেস্ক

হিমবাহ হ্রদ গলে বন্যার  ঝুঁকি, হুমকিতে দেড় কোটি মানুষ

ভুটানের জমলহারি পর্বতের কাছে তৈরি হিমবাহী হ্রদ। ছবি: বিবিসি

পৃথিবীর বিভিন্ন পর্বমালায় ছড়িয়ে থাকা হিমবাহী হ্রদগুলো বর্তমানে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে। যেকোনো সময় সেগুলোর প্রাকৃতিক বাঁধ ভেঙে গিয়ে পর্বতের পাদদেশের জনবসতি বিপর্যস্ত হতে পারে। এ ধরনের প্রবল এই বন্যার হুমকির মুখে রয়েছেন বিশ্বের অন্তত দেড় কোটি মানুষ।

যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের বরাতে গত মঙ্গলবার এ খবর দিয়েছে বিবিসি। হিমবাহ হৃদের কারণে বিশ্বব্যাপী বন্যার সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর একটি মানচিত্র তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে ওই গবেষণায়।

মূলত, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি কারণে হিমবাহ গলে যাচ্ছে। ফলে সম্প্রসারিত হচ্ছে এসব হ্রদ। ফলে ভূপৃষ্ঠের তুলনামূলক নিচু এলাকার দেশগুলোতে ভয়াবহ বন্যাসহ মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এশিয়ার হিন্দুকুশ-হিমালয় অঞ্চলকে পৃথিবীর তৃতীয় মেরু বা থার্ডপোল বলা হয়ে থাকে। কারণ, এই অঞ্চলে পৃথিবীর অন্য দুটি মেরুর পরেই সবচেয়ে বেশি বরফ স্থায়ীভাবে জমাটকৃত অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে এই বরফ আশঙ্কাজনভাবে গলতে শুরু করেছে। যেহেতু বরফ গলে জলে রূপান্তরিত হয়, তাই এখানকার হিমবাহ গলে ধীরে ধীরে হ্রদ বা জলাধারে পরিণত হচ্ছে।

চাইনিজ একাডেমি অব সায়ন্সেসের ইনস্টিটিউট অব টিবেটান প্লেটোরিসার্সের গবেষকরা বিষয়টি নিয়ে পামির, হিন্দুকুশের কারাকোরাম, হিমালয় এবং তিব্বতীয় প্লেটো এলাকায় ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছেন। এতে দেখা যায়, থার্ডপোলে ১৯৯০ সালে হিমবাহ (গ্লেসিয়ার) হৃদের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৬০২টি, যা ২০০০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৯৮১টিতে। আর ২০১০ সালে এই লেকের সংখ্যা গিয়ে পৌঁছেছে পাঁচ হাজার ৭০১টিতে। আর এসব হ্রদ গড়ে প্রতিবছর ৩১ সেন্টিমিটার করে সম্প্রসারিত হচ্ছে। ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এক জরিপে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

হিমবাহ হ্রদ সম্প্রসারণের কারণ হিসেবে বরফগলন এবং অতিবৃষ্টিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া এখানকার স্থায়ী জমাটকৃত ভূমি, যাকে বলা হয় পারমাফ্রস্ট, তা ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়ে বরফে পরিণত হচ্ছে। লেক সম্প্রসারণের নেপথ্যে এটি অপর কারণ হতে পারে। সবচেয়ে বেশি হ্রদ সম্প্রসারণের ঘটনা দেখা যাচ্ছে হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ ভুটান, এভারেস্ট পর্বত ও তার চারপাশে এবং নেপালের পশ্চিমাংশে। এখানে বরফ গলনের হার অত্যন্ত বেশি। ২০২২ সালের প্রথম দিকে প্রকাশিত চীনের সেকেন্ড গ্লেসিয়ার ইনভেন্টরির তথ্য অনুযায়ী, থার্ডপোলে ১৯৭০ সালের পর থেকে হিমবাহ হ্রাস পাওয়ার হার ১৮ শতাংশ।

নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির গবেষণায় বলা হয়, পেরু, পাকিস্তান, ভারত ও চীন সীমান্ত এলাকায়ও এসব লেকের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। এর মধ্যে এশিয়ায় প্রায় এক কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী পর্বতের হিমবাহী হ্রদগুলো থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করে।

নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, হিমবাহ বিশেষজ্ঞ এবং এই গবেষণাপত্রের একজন অন্যতম গবেষক ড. রেচেল কার বলেন, ‘এটি যেকোনো সময়ে ঘটতে পারে। এটিই এই দুর্যোগকে বিশেষভাবে বিপজ্জনক করে তোলে। কারণ এটি কখন ঘটবে তা নিয়ে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন।’

হিমবাহী হ্রদ ভেঙে পড়ার অর্থ অত্যন্ত ভয়াবহ। হৃদের দেয়াল ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড গতিতে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়বে। এর ফলে ধেয়ে আসবে বন্যা, সেই সঙ্গে হৃদের পানির সঙ্গে যুক্ত হতে পারে কাদা মাটি, পাথর ও বরফখণ্ড, যা ছড়িয়ে যেতে পারে ৯০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত। এর ফলে বিস্তীর্ণ এলাকার বাড়িঘর ও ফসলি জমি জল আর কাদা মাটির নিচে প্রায় ১৫ মিটার পর্যন্ত তলিয়ে যেতে পারে। এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ, একটি সম্পূর্ণ প্রজন্ম হারাতে পারে ফসলি জমি। পর্বতের বরফ গলনের যে গতি অব্যাহত রয়েছে, তাতে এখন একটি প্রশ্নই আমাদের মাথায় রেখে ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করা উচিত। আর সেটা হচ্ছে, কখন ঘটবে এই মহাবিপর্যয়?