নদীর পাড়ে শুকলাল বৈরাগীর বাড়ি। নদীর নাম ইছামতী। বৈরাগী বাড়িটাকে ঘিরেই মেলা বসে। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা।
অনেক দূর থেকে লোকজন ছুটে আসে মেলায়।
মেলা যখন শুরু হয়, দূর থেকে মেলার গমগমে আওয়াজ শোনা যায়। মেলায় প্রতিবার থাকে একটি সার্কাসের দল। সেই সার্কাসের দলে থাকে একটি বড় হাতি।
থাকে নাগরদোলা। মেলার এক কোনায় দেখানো হয় পুতুল নাচ। মাটির নানা রকম খেলনা, নানা রকম বাঁশি আরও কত কী পাওয়া যায় মেলায়!
ভরা মেলায় মানুষের পা ফেলানোর জায়গা থাকে না। মানুষে গিজগিজ করে।
বাবা-মার হাত ধরে পিউ এসেছে মেলায়। তারা এসেছে দূরের একটি গ্রাম থেকে। মেলা দেখে পিউ অবাক। একবার নাগরদোলায় চড়ে তো আরেকবার সার্কাস দেখতে ঢোকে। কী অবাক কাণ্ড। বিশাল হাতিটা একটি বড় তিন চাকার সাইকেল চালাচ্ছে। সাইকেলে পা রাখতেই সব দর্শক আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। হাততালি দেয়।
এক ঘণ্টা পরই সার্কাস দেখানো শেষ হয়ে যায়। হুড়মুড় করে লোকজন বাইরে বের হতে শুরু করে। বের হওয়ার একটাই গেট। হঠাৎ পিউ দেখে সে একজন ভদ্রলোকের হাত ধরে আছে। তিনি তার বাবা নন। পিউ ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। বাবা, মা বলে ডাকতে থাকে।
লোকটি বলে, ‘ভয় পেয়ো না তুমি। বাইরে বের হলেই তোমার বাবা-মাকে পেয়ে যাবে।’
পিউ রাইরে বের হয়ে দেখে তার বাবা-মা নেই। এবার সে কাঁদতে শুরু করে। লোকটি পিউর মাথায় হাত রেখে বলে, ‘ছি মেলায় এসে কাঁদতে নেই।’
পিউ কান্না থামিয়ে চোখ মুছতে থাকে। পাশ দিয়ে যাছিল একটি ছোট ছেলে। সে তার মাকে বলে, ‘দেখো মা, বড় একটা আপু কাঁদছে। আমার বেলুন বাঁশিটা ওকে দিয়ে দিই?’ এ কথা বলেই ছেলেটা তার বেলুন বাঁশিতে ফুঁ দেয়। একই সঙ্গে তার গাল ও বেলুন দুটোই ফুলতে থাকে। পঁ পঁ শব্দ হয়। বাঁশিটা নিয়ে ছেলেটা পিউর কাছে যায়। ‘নাও। এটা আমি তোমাকে দিলাম। না নিলে আমি খুব মন খারাপ করব।’
পিউ কী করবে বুঝতে পারে না। সঙ্গের লোকটি বলে, ‘নাও। নিয়ে নাও। ছোট বাচ্চা দিতে চাচ্ছে। না নিলে মন খারাপ করবে।’
পিউ বেলুনটা হাতে নেয়। লোকটি বলে, ‘চল, এবার তোমার বাবা-মাকে খুঁজে বের করি।’
লোকটির হাত ধরে সারা মেলা ঘুরতে থাকে পিউ। মেলার মাঝখানে একজন জাদু দেখাছিল। তার সঙ্গে একটি ছোট মেয়েও ছিল। লোকটি বলল, ‘এই কে দেখছেন মেয়েটা, এ আমার মেয়ে। আর এই যে দেখছেন ধারালো ছুরি, এটা দিয়ে এক্ষুনি ওকে আমি কেটে ফেলব। কিছুক্ষণ পরই আবার সে জীবিত হয়ে উঠবে।’
পিউ কিছুতেই এই জাদু দেখবে না। ভিড়ের মধ্য থেকে সে বের হতে চায়। যতই সে বের হতে চায় ততই লোকটি পিউর হাত শক্ত করে ধরে রাখে।
জাদুকর লোকটি বলে, ‘যাদের বেশি ভয়, প্লিজ তারা চোখ বন্ধ করে থাকবেন।’
পিউ সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে। শুধু জাদুকরের কথাগুলো তার কানে আসে।
জাদু শেষ হওয়ার পর লোকটি বলে, ‘দেখলে তো। সব জাদুকরের চালাকি। মেয়েটার আসলে কিছুই হয়নি। চল, এবার পুতুল নাচ দেখি।’
পিউ বলে, ‘আমি আর কিছুই দেখব না। বাবা-মাকে খুঁজব।’
লোকটি বলে, ‘তাহলে তুমি যাও। আমি আমার কাজে যাই।’ লোকটি পিউর হাত ছেড়ে দেয়। হাত ছেড়ে দেয়ার পর পিউ লোকটির হাত শক্ত করে ধরে। বলে, ‘সত্যি করে বলুন তো আপনি কে। আপনি ছেলেধরা না তো?’
কথা শুনে, লোকটি হো হো করে হেসে উঠেন, অমনি তার মুখের বাঁধানো দাঁত খুলে মাটিতে পড়ে যায়। তখনো তিনি হাসছেন। দাঁতের পাটি কুড়িয়ে তোলেন। কী অদ্ভুত হাসি তার। দেখে পিলে চমকে যায় পিউর।
লোকটি অনেক লম্বা। ছয় ফিট তো হবেই। মাথায় লম্বা বাবরি চুল। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। মেলায় লোকজন মাঝে মাঝে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। পিউকে লোকটির সঙ্গে কথা বলতে হয় মাথা উঁচু করে।
এদিকে পিউর বাবা-মা পাগলের মতো ছুটে বেড়াছে মেলায়। লোকজনকে বলছে, ‘আপনারা একটি ছোট মেয়েকে দেখেছেন। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। দেখতে শ্যামলা। লাল জামা পরেছে।’
তাদের কথা শুনে সবাই মাথা নাড়ায়। না, তারা কেউ তাকে দেখেনি।
লোকটি শুকলাল বৈরাগীর বাড়িতে ঢোকে। ঠাকুর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কী যেন মন্ত্র পড়ে। লোকটি তখন পিউর হাত ছেড়ে দিয়েছে। এই ফাঁকে সে এক দৌড়ে ছুটে পালিয়ে যায় সেখান থেকে। অনেক মানুষের মধ্যে হারিয়ে যায়।
লোকটি ঘুরে দাঁড়িয়েই দেখে মেয়েটি নেই। তিনিও ছুটতে থাকেন। মেলায় খুঁজতে থাকেন পিউকে। পিউর বাবা-মা লোকটির সামনে এসে পড়ে। জানতে চান, তিনি তাদের মেয়েকে দেখেছেন কি না।
লোকটি বলে, ‘হ্যাঁ, দেখেছি। এমন একটি মেয়েতো আমার সঙ্গে সঙ্গে ছিল। আমরা একসঙ্গে মেলা দেখছিলাম। চলুন, আমরা একসঙ্গে তাকে খুঁজি।’
এবার তিনজন মিলে পিউকে খুঁজতে থাকে। এদিকে পিউ ছুটতে ছুটতে সার্কাসের প্যান্ডেলের কাছে চলে আসে। হাতিটা তখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। একটা লোক হাতিটাকে কলাগাছের টুকরো খাওয়াচ্ছিল। পিউ তার কাছে গিয়ে বলে, ‘শুনুন, আমি না হারিয়ে গেছি। আমার বাবা-মাকে খুঁজে পাচ্ছি না।’
লোকটি কথা শুনে পিউর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কী যেন ভাবে। বেশ কিছুক্ষণ পরে বলে, ‘তুমি কি হাতিতে চড়ে বসে থাকতে পারবে?’
পিউ বলে, ‘না না। পারব না।’
লোকটি হেসে বলে, ‘পারবে। পারবে। আমি তোমাকে হাতিতে চড়িয়ে দেব। আমি তোমাকে ধরে রাখব।’
পিউ জানতে চায়, হাতির পিঠে চড়তে হবে কেন?
তখন লোকটি পিউকে বুঝিয়ে বলে সব। বলে, ‘হাতিতে তোমাকে চড়িয়ে আমরা মেলায় ঘুরব। সবাই কিন্তু হাতির দিকে তাকায়। তোমার বাবা-মা নিশ্চয়ই মেলায় আছে। তারাও হাতির দিকে তাকাবে। আর অমনি তোমাকে দেখে ফেলবে...।’
আইডিয়াটা পছন্দ হয় পিউর। সে হাতির পিঠে চড়ে পুরো মেলা ঘুরতে থাকে। খুব মজা লাগছে তার। পুরো মেলা সে হাতির পিঠে চড়ে ঘুরছে। খুব আনন্দ হচ্ছে তার।
হঠাৎ দূর থেকে দৌড়ে ছুটে আসে পিউর বাবা-মা আর সেই লোকটি। লোকটি হাতির সামনে দাঁড়িয়ে দু-হাত বাড়ায় পিউর দিকে। পিউ তার গলা জড়িয়ে ধরে হাতির পিঠ থেকে নামে। পিউর বাবা-মা পিউকে পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন।
বাবা রেগে বলেন, ‘আমরা তোকে পাগলের মতো খুঁজছি, আর তুই হাতির পিঠে চড়ে মজা করছিস?’ সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে পিউ হাসে। লোকটিও হাসে। ঠিক ওই সময়ই হাতিটা শুঁড় উপরে তুলে বিরাট একটা আওয়াজ করে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা