আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০৯:৩৩
বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে বিশেষ সতর্কতা পুলিশের
নুরুজ্জামান লাবু

বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে বিশেষ সতর্কতা পুলিশের

ছবি: দৈনিক বাংলা

আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে রাজনৈতিক উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো নিয়মিত তাদের কর্মসূচি পালন করছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচির বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছে পুলিশ। এ জন্য নিজেদের আত্মরক্ষায় বিশেষ সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।

সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত পৃথক দুটি নির্দেশনায় ব্যক্তি নিরাপত্তার পাশাপাশি থানা ও ফাঁড়িগুলোতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এমনকি পুলিশ রেগুলেশন্স অব বেঙ্গল- পিআরবি প্রবিধান ৬৯৫(২২) মোতাবেক প্রত্যেক থানায় অ্যালার্ম প্যারেড করারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘জঙ্গি-টঙ্গিরা আক্রমণ করতে পারে এ জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। সতর্ক থাকার জন্য।’ রাজনৈতিক কর্মসূচির সময় পুলিশের ওপর আক্রমণ হওয়ার শঙ্কা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এ রকম কিছু নাই।’

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে রাজনৈতিক কর্মসূচির সময় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হয়েছিল। সে সময় দুষ্কৃতকারীদের হাতে একাধিক পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হন। এ কারণে আসছে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগেভাগেই বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সম্প্রতি মালিবাগ ও মিরপুর এলাকায় জামায়াত কর্মীদের হাতে পুলিশ সদস্যরা আক্রান্ত হওয়ার পর এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মনোবল ভাঙার জন্য পুলিশের ওপর আক্রমণ করতে পারে দুষ্কৃতকারীরা। এ ছাড়া সব সময় জঙ্গিরা পুলিশকেই টার্গেট করে। নির্বাচনের বছরে সেই শঙ্কা থেকেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

‘কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তি নিরাপত্তার পাশাপাশি যানবাহন, লজিস্টিকস, পুলিশি স্থাপনাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদারকরণ প্রসঙ্গে’ শিরোনামে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে- যথাযথ রায়ট গিয়ার (হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, বুট, লেগগার্ড) পরিধানপূর্বক পুলিশ সদস্যদের কর্তব্যস্থলে মোতায়েন নিশ্চিত করতে হবে। মোতায়েনের আগে পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যথাযথ ব্রিফিং করতে হবে। তদারককারী কর্মকর্তাদের মাঠপর্যায়ে মোতায়েনকৃত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক অবস্থান করে তদারকি নিশ্চিতের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করার পাশাপাশি সরকারি যানবাহন, অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

ডিএমপি কমিশনারের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, মোতায়েনকৃত অফিসার ও ফোর্সদের বিচ্ছিন্নভাবে না থেকে দলবদ্ধভাবে সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তি নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা প্রত্যেকের দৃষ্টিসীমার মধ্যে অবস্থান করবেন। যাতে করে পুলিশের ওপর কোনো ধরনের আক্রমণ হলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিহত করা যায়। পুলিশ কর্মকর্তা/সদস্যদের বহনকারী যানবাহন, ব্যবহৃত লজিস্টিকস অনাকাঙ্ক্ষিত হামলা থেকে রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ব্রিফিং প্রদানপূর্বক যানবাহন ও লজিস্টিকসের ক্ষয়ক্ষতি রোধে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের অহেতুক মোবাইল ফোনে কথা বলা থেকে বিরত রাখতে হবে। মোবাইলে কথা বলার সময় পুলিশ সদস্যরা অসতর্ক থাকেন। সন্ত্রাসীরা যেকোনো সময় এ সুযোগ গ্রহণ করে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ওপর অতর্কিত হামলা করতে পারে। প্রয়োজন হলে কোনো পুলিশ সদস্য মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারেন, তবে সে সময় বাকি সদস্যরা যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য খুব সতর্কতার সঙ্গে কর্তব্যে নিয়োজিত থাকবেন।

নির্দেশনায় বলা হয়েছে- পুলিশ সদস্যদের পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত গাড়ির জানালা সব সময় বন্ধ থাকবে। তবে পুলিশ সদস্যবাহী খোলা পিকআপ, ট্রাক, মিনিট্রাক ইত্যাদির পেছনে এবং চালকের পাশে পুলিশ সদস্যরা অনগার্ড অবস্থায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কর্তব্যে নিয়োজিত থাকবেন, যাতে যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করা যায়।

‘থানা-ফাঁড়িসহ সব পুলিশ স্থাপনায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং অ্যালার্ম স্কিম প্রণয়ন প্রসঙ্গে’ শিরোনামে পুলিশ কমিশনার স্বাক্ষরিত পৃথক আরেকটি চিঠিতে বলা হয়েছে- ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের থানা/ফাঁড়িসহ সব পুলিশ স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারসহ পুলিশ প্যাট্রল পার্টির অস্ত্র-গোলাবারুদের নিরাপত্তা জোরদার করতে নির্দেশনাবলি যথাযথভাবে অনুসরণ ও প্রতিপালন করতে হবে।

ওই নির্দেশনায় বলা হয়, প্রত্যেক থানায় কমপক্ষে তিনটি স্থায়ী সেন্ট্রি পোস্ট নির্মাণ করতে হবে। তবে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে। রাতের বেলায় ডাবল সেন্ট্রি ডিউটি মোতায়েন করতে হবে। এক পালার সেন্ট্রি ডিউটি করাকালীন অন্য দুই পালার সেন্ট্রিও সর্বদা থানা/ফাঁড়িতে সতর্ক অবস্থায় থাকবেন এবং তাদের অস্ত্রগুলো নিজ হেফাজতে রাখবেন, যাতে পুলিশ ইউনিট আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবিলা করা যায়। অতিরিক্তসংখ্যক পুলিশ সদস্য একই সঙ্গে যাতে ছুটি বা অন্যান্য ডিউটিতে নিয়োজিত না হন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

চিঠিতে বলা হয়, বাইরের কারও দেয়া খাবার যাতে পুলিশ সদস্যরা গ্রহণ না করেন তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। কোনো পুলিশ ইউনিট যাতে আন্ডার স্ট্রেংথ না থাকে উপপুলিশ কমিশনাররা সে বিষয়ে নিশ্চয়তা বিধান করবেন। অস্ত্রাগার এবং বেতার যোগাযোগব্যবস্থার নিরাপত্তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। রাতের বেলায় ডিউটি অফিসার এবং তিনজন ইন্সপেক্টরের মধ্যে যেকোনো একজনকে থানায় উপস্থিত থাকতে হবে। প্যাট্রল পার্টিগুলো টহল ডিউটির পাশাপাশি সতর্কতার সঙ্গে নিজেদের নিরাপত্তার প্রতি খেয়াল রেখে ডিউটি করবে। প্রতিটি প্যাট্রল পার্টি তাদের সদস্যদের ব্যক্তি এবং সামষ্টিক নিরাপত্তার প্রতি খেয়াল রাখবে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, একটি প্যাট্রল পার্টি থানা বা ইউনিটের আশপাশের এলাকায় ডিউটিতে থাকবে, যাতে জরুরি মুহূর্তে থানায় আসতে পারে। অনুরূপভাবে একটি ফুট প্যাট্রল পার্টি থানার সীমান্তবর্তী এলাকায় ডিউটিতে থাকতে হবে। ডিভিশন অনুযায়ী ডিসি/এডিসি/এসিদের যেকোনো একজনকে সারা রাত এলাকার টহল ডিউটি তদারক করতে হবে। রাত ১২টার পর কোনো দর্শনার্থীকে থানায় প্রবেশের ক্ষেত্রে অবশ্যই থানার সম্পূর্ণ নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে চেকিংয়ের মাধ্যমে এবং সতর্কতার সঙ্গে থানায় প্রবেশ করতে দিতে হবে।

অ্যালার্ম স্কিম পরিচালনার নির্দেশ

ডিএমপি কমিশনার প্রতিটি থানা বা পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়মিত অ্যালার্ম স্কিম পরিচালনা করার নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনায় বলা হয়েছে- প্রতিটি থানা ও ফাঁড়িসহ সব পুলিশ স্থাপনায় অ্যালার্ম স্কিম প্রস্তুত বা হালনাগাদ করতে হবে। প্রস্তুতকৃত অ্যালার্ম স্কিমে নিয়মিত সেন্ট্রি পোস্ট এবং বিপদকালীন সেন্ট্রি পোস্ট আলাদা আলাদা কালিতে চিহ্নিত করতে হবে। আক্রান্ত হলে ওই পুলিশ ইউনিটে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের কে কোথায় অবস্থান করবেন, তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। যাতে বিপদকালে ইউনিটে কর্তব্যরত প্রত্যেক সদস্য আড়ালে থেকে নিজের নিরাপত্তা রক্ষাসহ সন্ত্রাসীদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে।

স্বাভাবিক সময়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য থানা/ফাঁড়িসহ সব পুলিশ স্থাপনায় স্থায়ী সেন্ট্রি পোস্টে সেন্ট্রি ডিউটি নিয়োজিত হবে। অস্ত্রসহ সতর্কভাবে সেন্ট্রিকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেন্ট্রি কোনোভাবেই অন্য কোনো কাজে নিয়োজিত হবেন না। দর্শনার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ অথবা তল্লাশি বা অন্য কোনো কারণে কথা বলার প্রয়োজন হলে সেন্ট্রি ব্যতীত অন্য অফিসার বা কনস্টেবল কথা বলবেন। সেন্ট্রি সতর্ক অবস্থায় থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন এবং আগত লোকজনের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখবেন। অ্যালার্ম পোস্টে এসআই/এএসআই ও একজন কনস্টেবল ফরমেশনে নিয়োজিত হবেন। কোনো হুমকি আসামাত্র তারা যার যার অ্যালার্ম পোস্টে দ্রুততম সময়ে অস্ত্র-গুলিসহ নিয়োজিত হবেন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে- অস্ত্র-গোলাবারুদ ইস্যু ও অস্ত্রাগারের নিরাপত্তা এবং অস্ত্রাগারের চাবি ডিউটি অফিসারের কাছে থাকবে। অ্যালার্ম ঘণ্টা বাজার সঙ্গে উপস্থিত কর্মকর্তা বা ডিউটি অফিসার অস্ত্রাগারের চাবিসহ অস্ত্রাগারের সম্মুখে উপস্থিত হবেন এবং সব অফিসার ও ফোর্সকে গোলাবারুদ সরবরাহ করে অ্যালার্ম পোস্টে প্রেরণ নিশ্চিত করবেন। অতঃপর তিনি নিজে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ অস্ত্রাগারের দরজায় অবস্থান গ্রহণ করবেন এবং শত্রুর আক্রমণ মোকাবিলা করবেন। আপদকালে অস্ত্রাগারের ফটকে অতিরিক্ত অফিসার/ফোর্স মোতায়েন হবে।

বেতারচালকের দায়িত্ব প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- স্বাভাবিক সময়ে বেতারচালক সব মোবাইল প্যাট্রল পার্টির সঙ্গে নিয়মিতভাবে বেতারযোগে যোগাযোগ রক্ষা করবেন। থানা/ফাঁড়িসহ যেকোনো পুলিশ স্থাপনা আক্রান্ত হলে ডিউটি অফিসার ও ওয়্যারলেস অপারেটর বেতারযোগে তাৎক্ষণিকভাবে কন্ট্রোল রুমসহ অন্যান্য ইউনিটকে অবহিত করবেন এবং সহযোগিতা চাইবেন। পুলিশ কন্ট্রোল রুম নিয়মিত বিরতিতে ডিএমপির সব ইউনিটের সঙ্গে বেতারযোগে যোগাযোগ রাখবে এবং সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে অবগত হবে। ডিএমপির কোনো ইউনিট আক্রান্ত হলে পুলিশ কন্ট্রোল রুম আশপাশের অন্যান্য ইউনিটের সব মোবাইল পার্টিকে আক্রান্ত ইউনিটে প্রেরণের ব্যবস্থা করবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে কন্ট্রোল রুম থেকে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনের ব্যবস্থা করবে।