আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০৮:১৫
তৃতীয় প্রজন্মে এসে ছন্নছাড়া ইলিয়াস ব্রাদার্স
ফারহান ফেরদৌস

তৃতীয় প্রজন্মে এসে ছন্নছাড়া ইলিয়াস ব্রাদার্স

ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছাড়ার আগে ব্যবসা শুরু করেছিলেন মোহাম্মদ ইলিয়াস। মাত্র এক যুগ আগেও দেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ ভোজ্যতেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার প্রতিষ্ঠান ইলিয়াস ব্রাদার্স লিমিটেডের হাতে।

কিন্তু এখন সরকারের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি তালিকার ৫ নম্বরে আছে এ প্রতিষ্ঠানটির নাম। ইলিয়াস ব্রাদার্সের ঋণের স্থিতি ৯৬৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। খেলাপির পরিমাণও ৯৬৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অর্থাৎ আলোচিত এই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকগুলো থেকে যে ঋণ নিয়েছিল তার পুরোটাই খেলাপি হয়েছে। ফলে ডুবতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ইলিয়াস ব্রাদার্সের মূল উদ্যোক্তা মারা গেছেন অনেক আগেই। ছেলেদের হাত ঘুরে ব্যবসা এখন নাতিদের হাতে। ছেলেদের মধ্যে একজন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। নাতিরা ব্যবসায় খেই হরিয়ে ফেলেছেন।

চলতি মাসের ৯ তারিখেও ঋণে জর্জরিত ইলিয়াস ব্রাদার্সের ১৩ পরিচালকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত।

সংসদে শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বলা হয়, শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে মোট ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। দেশে মোট ঋণখেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো গ্রুপের কোনো ঋণ খেলাপি হলে পুরো ঋণই খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়। সেই গ্রুপের ঋণ নেয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তাই পুরো ঋণকে খেলাপি ধরে হিসাব করা হয়েছে।

কীভাবে উত্থান

মোহাম্মদ ইলিয়াস ১৯৪৬ সালে ব্যবসা শুরু করেন। সঙ্গে ছিলেন তার ভাই। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠানটির মূল বিনিয়োগ ছিল ভোগ্যপণ্যে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভারের প্রধান পরিবেশক হয়ে ব্যবসা করে প্রায় তিন যুগ। পরে ইউনিলিভারের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ইলিয়াস ব্রাদার্সের নামের পাশে একে একে যুক্ত হতে থাকে জিপি/সিআই শিট, গ্যাস শিট, সয়াবিন তেল, কাগজ ও বোর্ড, তৈরি পোশাক, ব্রিকফিল্ড। তবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে ‘দাদা’ ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল ও মিনারেল ওয়াটারে। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৬ ও ২০০৭ সালে ভোজ্যতেলের বাজারে দেশের মোট আমদানির ১৮ শতাংশ তেল এককভাবে আমদানি করে। বাজারজাত করে এমইবি গ্রুপের দাদা ব্র্যান্ডের নামে।

কীভাবে পতন

‘দাদা’ ব্র্যান্ডে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল ইলিয়াস ব্রাদার্স। কিন্তু তার সেই অর্জন ধরে রাখতে পারেননি ইলিয়াসের ছেলে ও নাতিরা। মূলত নব্বইয়ের দশকে ইলিয়াসের মৃত্যুর পর শুরু লোকসানের গল্পের।

ইলিয়াসের মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে আসেন তার ছেলে সামসুল আলম। ব্যবসা সম্প্রসারণে নিতে থাকেন একের পর এক ব্যাংকঋণ। কিন্তু তখন ব্যবসায় চলছে ভাটার টান। নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় আসে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পগ্রুপটির নাম।

শেষ দিকে প্রতিষ্ঠানের হাল ধরার চেষ্টা করেন ইলিয়াসের নাতি শোয়েব রিয়াদ। নতুন কিছু প্রকল্পে বিনিয়োগও করেন তিনি। কিন্তু এতে এতটুকুও কমেনি ঋণের বোঝা। সব মিলিয়ে লোকসানের ধাক্কায় এখন অস্তিত্বসংকটে ‘ইলিয়াস ব্রাদার্স’।

কী পরিমাণ ঋণখেলাপি?

জাতীয় সংসদে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের শীর্ষ ২০ খেলাপির মধ্যে ৫ নম্বরে আছে ইলিয়াস ব্রাদার্সের নাম।

মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স (প্রা.) লিমিটেডের ঋণের স্থিতি ৯৬৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তাদের পুরোটাই খেলাপি ঋণ।

ইলিয়াস ব্রাদার্স প্রায় ১৫টি ব্যাংক থেকে এই ঋণ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০০ কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া এবি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইস্টার্ন ব্যাংকের কাছেও আছে ঋণ। ন্যাশনাল, ওয়ান, পূবালী, স্ট্যান্ডার্ড, দ্য সিটি, এনসিসি, মার্কেন্টাইল ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ঋণ পাওনা রয়েছে, যা সুদাসলে আরও বেড়েছে।

মালিকদের মাথায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

ঋণের টাকা ফেরত না দেয়ায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে ইলিয়াস ব্রাদার্সের মালিকদের বিরুদ্ধে। বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিও হয়েছে।

সর্বশেষ ইস্টার্ন ব্যাংকের ১৬৫ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ না করায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি ইলিয়াস ব্রাদার্স (প্রা.) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল আলমসহ পরিবারের ১২ সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত।

ইলিয়াস ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে ৭৯ কোটি ২৩ লাখ ১৩ হাজার ৫৯২ টাকা এবং এ টাকার ওপর ১২ শতাংশ সুদ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড।

আসামিরা হলেন মোহম্মদ শামসুল আলম, নুরুল আবছার, নুরুল আলম, কামরুন নাহার বেগম, তাহমিনা বেগম, মোহাম্মদ খোরশেদুল আলম, মোহাম্মদ মোরশেদুল আলম, মোহাম্মদ জানে আলম, মোহাম্মদ জাকারিয়া আলম, মোহাম্মদ রেজাউল করিম, মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম ও মোহাম্মদ সাইদুল করিম।

বক্তব্য পাওয়া যায়নি

ইলিয়াস ব্রাদার্সের সর্বশেষ অবস্থা জানতে ইলিয়াসের নাতি প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্ণধার শোয়েব রিয়াদের মোবাইল নাম্বারে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার এক নিকটাত্মীয় দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ইলিয়াস ব্রাদার্স মূলত ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করে বাজারজাত করত। কিন্তু এখন বড় আকারে কোনো পণ্য আমদানি করে না। সামান্য কিছু আমদানি করে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে মাত্র।’

তিনি আরও জানান, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রয়াত ইলিয়াসের ছেলে শামসুল আলম আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে তিনি চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি-বাকলিয়া আসন থেকে বিএনপি থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন। এরপর কিছুদিন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতিও হয়েছিলেন। মূলত তখন থেকেই ইলিয়াস ব্রাদার্সের পতন শুরু হয়।