আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০৮:৪৫
মিরাকলস ফ্রম হেভেন
আফরোজা সোমা

মিরাকলস ফ্রম হেভেন

আফরোজা সোমা

সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্র্যাটিচিউড জার্নাল লেখার কথা অনেক দিন, বলতে গেলে বছরেরও অধিক সময় ধরে ভাবছিলাম। লিখব, লিখছি করতে-করতে সময় গড়িয়ে গেল।

জীবন অনেক মানুষের ভালোবাসা, উপকার, মমতা ও মায়ার সংকলন। আমার জীবনে আসা তেমনি মানুষের কথা ক্রমেই এই জার্নালে আসবে। প্রশ্ন আসতে পারে, গ্র্যাটিচিউড জার্নাল পাবলিকলি লেখার কারণ বা উদ্দেশ্য কী? কারণ বিশেষ নেই। তবে, উদ্দেশ্য আছে! একসময় নিয়মিত ডায়েরি লিখতাম, রোজ। ডায়েরি লেখা শুধু দিনলিপির খতিয়ান নয়। এতে হিলিং হয়। এতে অনেক চিন্তার রিএনফোর্সমেন্টও হয়।

অনেক সময়ই অবিশ্বাস, প্রতারণা ও ক্রুরতা আমাদের গিলে ফেলে। গ্রহণ লাগা সূর্যের মতো তখন ঢাকা পড়ে যায় আমাদের শান্ত, সুস্থির আমি। মানুষের ভেঙে পড়া, মানুষের সেরে ওঠা, মানুষের পাশে পরম বন্ধুর মতো আরেক মানুষের দাঁড়ানোর ঘটনাগুলো ব্যক্তিগত। কিন্তু ব্যক্তিগত সেই ঘটনাগুলো শুধুই ব্যক্তিগত নয়। এর একটি বৃহত্তর দিক রয়েছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে পার্সোনাল ইজ পাবলিক। এই কারণেই পাবলিকলি গ্র্যাটিচিউড জার্নাল লিখবার সিদ্ধান্ত।

এতক্ষণ যা লিখলাম তা গ্র্যাটিচিউড জার্নালের মুখবন্ধ। মূল জার্নালের প্রথম কিস্তি গত ৬ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায় ছাপা হয়েছে। আজ শুরু করলাম দ্বিতীয়টি-

মিরাকলস ফ্রম হেভেন

৯৬ সালে আমার লেখার শুরু। তখন পড়ি ক্লাস সেভেনে। প্রথম লেখা কবিতা স্কুল ম্যাগাজিনে দিয়েছিলাম। বিদ্যালয়ের বার্ষিক সাহিত্য সাময়িকীতে ছাপার জন্য। ছাপা হয়নি। কবিতার নাম ছিল ‘দুঃখ’।

ক্লাস সেভেনে দুই বছর ছিলাম। ৯৬ সাল ছিল সেভেনে আমার দ্বিতীয় বছর। ক্লাস সিক্সেও ফেল করে দুই বছর ছিলাম। পরপর দুই ক্লাসে ফেল। পরিবারের কাছে, ক্লাসের সহপাঠীদের কাছে খুব খারাপ ইমেজ। হয়তো এই বিষয়গুলোই ছিল আমার অবচেতনের দুঃখ। তবে, পড়ালেখা বা পরীক্ষায় ফেল জাতীয় কোনো কথা সরাসরি সেই কবিতায় আসেনি। প্রথম কবিতার কোনো পঙ্‌ক্তি অবশ্য আজ আর মনে নেই। সেই থেকে শুরু। ১৯৯৭ সাল থেকে বলতে গেলে রোজ কবিতা লিখি। হোয়াইট প্রিন্টের ছোটো ছোটো খাতায়। আমার পড়ার টেবিলে থাকে কবিতার খাতা। স্কুল ব্যাগে থাকে কবিতা। কেউ তা জানে না।

সেসব দিনে কী করে যেন বাবুল ভাই একদিন জানতে পারেন আমি কবিতা লিখি! বাবুল ভাই। সম্পর্কে আমাদের আত্মীয়। তখন প্রায় সময়ই আসতেন আমাদের বাড়িতে। বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়। বাবুল ভাই মাঝেমধ্যে আমার কবিতা দেখেন। আমিও পড়ে শোনাই।

একদিন বাবুল ভাই বলেন, ‘আমার এক বন্ধু আছে। তার নাম খায়রুল। সেও কবি। তোর কবিতা দেখানোর লাইগ্যা তারে একদিন নিয়ে আসব। তারপর একদিন সত্যিই একজনকে নিয়ে আসেন বাবুল ভাই। তার নাম খায়রুল। সে কবি। তার হাতে কাগজের ঠোঙায় মোড়ানো অনেক লজেন্স। সে এসে বলে, কোথায়! কবি কোথায়? দেখি, কবিতা দেখতে এলাম।’

সেটা সম্ভবত ১৯৯৮ সাল। সেই প্রথম আমার কেমন বোধ হলো। মনে হলো, আমার ভেতরে কোথাও অনেক প্রজাপতি উড়ছে। খায়রুল ভাইকে দেখালাম বেশ কয়েকটি খাতা। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ। নানান রঙের। হোয়াইট প্রিন্টের ছোটো খাতা। রোল টানা বাংলা খাতা, রোল টানা ছাড়া গণিত খাতা।

হরেক খাতা। অনেক কবিতা। তখন রোজ লিখি, রোজ। স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে, সন্ধ্যায় পড়তে বসে, রাতে শোবার আগে হারিকেনের আলো খানিক কমিয়ে। তখনো আমাদের বাসায় বিদ্যুৎ ছিল না। সারা সন্ধ্যা ভরে অনেক কবিতা বাবুল ভাইয়ের সঙ্গে আসা খায়রুল ভাই দেখেন হারিকেনের আলোয়।

তারপর খায়রুল ভাই বলেন, আমাদের একটা সাহিত্যের আসর আছে। প্রতি সপ্তাহে শুক্রবারে আমরা বসি। তুমিও এস। আমার কাছে এসব স্বপ্ন, দূরের বিষয় আর অবাস্তব মনে হয়। তবুও আমার ভেতর কোথায় যেন প্রজাপতি ওড়ে। এর ভেতর দিয়েই, সম্ভবত, কয়েক মাস গড়িয়ে যায়। তারপর আবার একদিন বাবুল ভাই কথা তোলেন, কি রে, আমার ওই কবি বন্ধুর লগে দেখা হয়েছিল। তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল! তোরে শুক্রবারে সাহিত্য আসরে যেতে বলছে।

শুক্রবার সকালে আড্ডা বসে। শিল্পকলার পাশেই। একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে।

এক শুক্রবারে যাব বলে দিনক্ষণ ঠিক হয়। আমাদের এক প্রতিবেশী, নয়ন ভাই, সম্পর্কে দুলাভাই হন, সাহিত্য আসরে যাব শুনে বললেন, ‘আমি যাব সকালে ওই দিকে। চল, তোমারে নামিয়ে দেব।’

১৯৯৯ সাল। ক্লাস টেনে পড়ি। এক শুভ শুক্রবারে নয়ন ভাই আমাকে নামিয়ে দেন সেই কিন্ডারগার্টেনের গেটে। নিশ্চিত হয়ে সিঁড়িতে উঠি। তিন তলা নাকি দুই তলায় ছিল রুমটা, মনে নেই। একটা রুমে ঢুকে দেখি ঘর ভরা নানান বয়সী মানুষ। তাদের মধ্যে বয়সে আমি সবচেয়ে নবীন। তারা হাসি মুখে আমাকে স্বাগত জানান।

প্রথম দিনের আড্ডায় খায়রুল ভাই ছিলেন কি না মনে নেই। সেখানে ধীরে ধীরে পরিচয় হতে থাকে সবুজ ভাই, জোনাকী আপু, ঝুনু আপু, বাশির ভাই, আব্দুল বারী মাস্টার, উচ্ছ্বাস ভাই, শরীফ ভাই... আরও কত মানুষের সঙ্গে। তারা সবাই কবি।

সেই দিয়ে শুরু। তারপর ক্রমেই আমার একটা নিজস্ব পৃথিবী হয়ে ওঠে। ক্রমে কবিতা আমাকে তুলে নেয় তার জাদুর ঝোলায়। কবিতার সোনার কাঠি রূপার কাঠি আমাকে জাগায়। কবিতার ঝোলায় বন্দি হয়ে এসব হারিয়ে যাবার খোঁজ, কবিতার সোনার কাঠি রূপার কাঠির পরশে জেগে ওঠার খবর বাবুল ভাইয়ের আর জানা হয় না।

খায়রুল ভাইয়ের সঙ্গে ৯৯ বা ২০০০ সালের পরে আর দেখা হয়নি। তিনি মনে হয়, প্রবাসে গিয়েছিলেন। তাকে দেখলে আজ হয়তো আর চিনতে পারব না। তিনিও পারবেন না। এমনকি আমার কথা তার মনে না থাকাই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে বাবুল ভাইয়ের যোগাযোগ আছে কি নেই, তাইবা কে জানে! রিকশায় করে আমাকে সেই আড্ডায় পৌঁছে দেয়া নয়ন ভাই মারা গেছেন, অনেক বছর।

বাবুল ভাইয়ের সঙ্গে কয়েক বছরেও দেখা বা কথা হয় না। তবে নিজের কাছে আসা-যাওয়ার রাস্তা ধরে হাঁটতে-হাঁটতে আমার প্রায়ই বাবুল ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় মন ছেয়ে যায়। সেদিন যদি বাবুল ভাই এভাবে খায়রুল ভাইকে আমার কবিতা দেখাতে নিয়ে না আসতেন তাহলে আমার জীবনের গল্পটা কেমন হতো?

মিরাকলস ফ্রম হেভেন বলে একটা সিনেমা আছে। সিনেমাটায় বলে: ‘এভরি ডে ইজ আ মিরাকল।’

আরও বলে: ‘মিরাকলস আর এভরি হোয়ার। মিরাকলস আর গুডনেস। মিরাকলস আর লাভ।’

সেদিন আমাকে কবি বলে সাব্যস্ত করা বাবুল ভাই-ই কী ছিল মিরাকলস ফ্রম হেভেন? ছিল কিশোরীর দুনিয়ায় এক স্বর্গীয় দূত?