আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০৯:৫৯
একসময়ের বন্ধু তালেবান এখন শত্রু
জিয়াউদ্দীন আহমেদ

একসময়ের বন্ধু তালেবান এখন শত্রু

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বছরের শুরুতে ৩০ জানুয়ারি পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ খাইবার পাখতুনখোয়ার পেশোয়ারের মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা শতাধিক। পেশোয়ার পুলিশের সদর দপ্তরের মসজিদে চালানো এই হামলায় দেশটির জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও সংগঠনটি হামলার দায় ইতিমধ্যে অস্বীকার করে বলেছে, মসজিদে হামলা তাদের নীতিবিরোধী। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই পুলিশ বাহিনীর সদস্য। হামলার সময় তারা মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করছিলেন। এর এক দিন পরই পাঞ্জাব প্রদেশে পুলিশ স্টেশনে ঢুকে আবার হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। টিটিপি আক্রমণ চালানোর জন্য আফগান অঞ্চলকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করছে।

পাঠান মাদ্রাসাছাত্রদের ১৩টি সংগঠন মিলে ২০০৭ সালে বাইতুল্লাহ্ মেহ্সুদের নেতৃত্বে টিটিপি গঠিত হয়। টিটিপি আফগানিস্তানের তালেবানদের মতো পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারকে উচ্ছেদ করে তালেবানি সরকার গঠন করতে চায়। আধুনিক শিক্ষাবিরোধী এই জঙ্গি সংগঠনটি ২০১৪ সালে পেশোয়ারের একটি স্কুলে হামলা চালিয়ে ১৫০ শিক্ষার্থীকে হত্যা করে।

আফগানিস্তানের মতো পাকিস্তানেও কট্টর শরিয়াহ আইন চালু করতে চায় টিটিপি। মালালা ইউসুফজাইকে গুলি করে রাতারাতি পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিতি পায় এই গোষ্ঠীটি। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের সফলতায় টিটিপি বা তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বেশ উদ্দীপ্ত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে তালেবানদের সুসম্পর্ক ছিল, তাকে ‘মিস্টার তালেবান’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। সম্ভবত এ কারণেই ইমরান খান আমাদের দেশে একশ্রেণির লোকের কাছে বেশ জনপ্রিয়। ইমরান খানের আমলে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের মধ্যস্থতায় টিটিপির সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি হয়। ইমরান খানের এই শান্তিচুক্তি টিটিপিকে সন্ত্রাসবাদে উৎসাহিত করেছে বলে অনেকের ধারণা। এই ধারণার কারণে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির পর বর্তমান সরকার ও সামরিক বাহিনী পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে দেয়।

পাকিস্তানি তালেবানরা যুদ্ধবিরতি থেকে বেরিয়ে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্যবস্তু বানাতে শুরু করেছে। এই গোষ্ঠীটি আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সমর্থন পাচ্ছে। বর্তমান তালেবান সরকার পূর্ববর্তী আফগান সরকারের হাতে বন্দি টিটিপির নেতা ও যোদ্ধাদের মুক্তি দিয়েছে। আফগান সরকারের সমর্থনে টিটিপি আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি তৎপর। পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী তালেবানদের দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর আগস্ট ২০২১ থেকে আগস্ট ২০২২- এই এক বছরে পাকিস্তানে ২৫০টি সশস্ত্র আক্রমণে ৪৩৩ জন মারা গেছেন, ৭১৯ জন আহত হয়েছেন। পাকিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। পাকিস্তানি এই তালেবান গোষ্ঠী দেশটির এক সেনাসদস্যকে আটক করে জনসমক্ষে তার শিরশ্ছেদ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা প্রচার করেছে।

আমেরিকার আশীর্বাদ এবং পাকিস্তানের সহযোগিতায় ১৯৯৬ সালে তালেবানরা প্রথম কাবুল দখল করে এবং তখন থেকে পাকিস্তান আফগান-তালেবানদের বন্ধু। পাকিস্তানের সমর্থনে প্রায় ২০ বছর পর ২০২১ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে তালেবানরা। তালেবানদের বিজয়ের প্রহর গুনছিল পাকিস্তান, বিজয়ের পর উল্লাসও করেছিল তারা। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তালেবানদের কাবুল দখলকে ‘দাসত্বের শিকল’ ভাঙার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।

পাকিস্তানের ধারণা ছিল, তালেবান সরকার পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল থাকবে, পাকিস্তানের পরামর্শে আফগান পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তালেবানদের উত্থানকে স্বাগত জানিয়ে পাকিস্তান মূলত সন্ত্রাসবাদ আলিঙ্গন করেছে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করার পর আফগান সরকারের ওপর পাকিস্তানের প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ হয়েছে।

আফগানিস্তানের তালেবানদের এখন প্রতিবেশী দেশগুলো ভয় করছে, সব দেশ তালেবানি বিপ্লব রপ্তানি হওয়ার আতঙ্কে আছে। তালেবানদের ক্ষমতায় আসার পর প্রতিবেশী উজেবিস্তান, তার্কিস্তান, খোরাসান প্রভৃতি মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলের উগ্রপন্থি ইসলামিক গ্রুপগুলোর ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়েছে আফগানিস্তানে। শুধু প্রতিবেশী দেশ নয়, উন্নত বিশ্বের জন্য আতঙ্ক সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোরও আফগানিস্তানের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আফগানিস্তানে আল-কায়েদা ঘাঁটি করেছে বহু আগে। পাকিস্তানে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের জন্য যে দলটিকে বেশি দায়ী করা হয় সেই টিটিপির ঘাঁটি রয়েছে আফগানিস্তানে। আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে চীন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। কারণ উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে চীনও শঙ্কিত, তারাও তালেবানদের সমর্থনে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।

তালেবান সরকারও শান্তিতে নেই, তাদের শাসনকেও চ্যালেঞ্জ করে নিয়মিত আফগানিস্তানে শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যাচ্ছে আইএস গ্রুপ। আইএস গ্রুপ মনে করে তালেবানরা ক্ষমতায় এসেছে আমেরিকার সঙ্গে সমঝোতা করে, ইসলামিক বিপ্লবের মাধ্যমে নয়। এ ছাড়া আফগানিস্তানের ভূখণ্ড অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না মর্মে তালেবানরা আমেরিকার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় আইএস তালেবানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

অন্যদিকে তালেবানবিরোধী আফগানদের মধ্যে সৃষ্ট আতঙ্ক পাকিস্তানে শরণার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রায় তিন লাখ আফগান শরণার্থী পাকিস্তানে পাড়ি দেয়, এরা আর কখনো আফগানিস্তানে ফেরত যেতে চাইবে বলে মনে হয় না। স্বেচ্ছায় না গেলে কোনো শরণার্থীকে জোর করে ফেরত পাঠানো আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক নিষিদ্ধ। তাই পাকিস্তানকে এই শরণার্থীর বোঝা অনন্তকাল বহন করতে হবে।

আফগান ভূখণ্ডে তেহরিক-ই-তালেবান বা টিটিপি গোষ্ঠীর পুনরুজ্জীবিত হওয়ার কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে আফগানিস্তানের বিরোধের সূত্রপাত। পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সীমান্ত বিরোধও রয়েছে, ডুরান্ড লাইনে আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব সেই ১৮৯৩ সাল থেকে। সীমানাবিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তান-আফগানিস্তান দুই দেশকে ভাগ করার জন্য যে সীমানা টেনে দেয় তা ডুরান্ড লাইন নামে পরিচিত। কিন্তু এই লাইনটি বাঙালি ও পাঞ্জাবিদের মতো লাখ লাখ বালুচ এবং পশতুনদের বিভক্ত করে স্থায়ী বিরোধ সৃষ্টি করে দিয়েছে। তালেবান সরকার ডুরান্ড লাইনকে আন্তর্জাতিক সীমানা হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না। এ ছাড়া টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার পর পাকিস্তান আমেরিকাকে তাদের ঘাঁটি ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছিল- এই ক্ষোভ তালেবানদের রয়েই গেছে।

গত আগস্টে কাবুলে মার্কিন ড্রোন হামলায় আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরিকে হত্যা করা হয়। মনে করা হয়, হামলাটি আমেরিকা করেছিল পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করে। তালেবানদের ক্ষোভ জাওয়াহিরির হত্যা ঘটনায় আক্রোশে পরিণত হয়েছে।

পাকিস্তানে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল বেলুচিস্তানেই, স্বাধীনতার মাত্র এক বছর পর ১৯৪৮ সালেই। এই প্রদেশের প্রধান জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে বালুচ ও পশতুন। অর্থনৈতিকভাবে বেলুচিস্তান এখনো পাকিস্তানের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। পাকিস্তানের সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের বিরদ্ধে বালুচদের বৈষম্যের ব্যাপক অভিযোগ আছে। তাই তারা স্বায়ত্তশাসন চায়, স্বাধীনতা চায় এবং এই লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে বালুচ লিবারেশন আর্মি বা বিএলএ।

টিটিপির সঙ্গে বালুচ লিবারেশন আর্মির সাংগঠনিক যোগসূত্র রয়েছে। বিএলএ শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আক্রমণ চালাচ্ছে না, পাকিস্তানে বাস্তবায়নাধীন চীনা প্রকল্প এবং প্রকল্পে নিয়োজিত চীনা শ্রমিকদের ওপরও আক্রমণ করছে। ছয় হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে যে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর প্রকল্পের কাজ চলছে, সেখানে কর্মরত চীনা শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য কয়েক হাজার সামরিক কর্মী নিয়োগ করতে হয়েছে। কিন্তু তার পরও বিএলএর হামলা ঠেকানো যাচ্ছে না। পাকিস্তান বারবার তালেবানকে আফগানিস্তানে টিটিপি এবং বিএলএর ঘাঁটি বন্ধ করতে বলেছে, কিন্তু আফগানিস্তানের তালেবান সরকার পাকিস্তানের অনুরোধ আমলে নিচ্ছে না। ফলে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত অঞ্চলে উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময়ে তালেবান সরকার বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ওই সময় পাকিস্তানসহ মাত্র তিনটি দেশ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এখন সেই পাকিস্তানই তালেবানদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।

লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও কলাম লেখক