আপডেট : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১০:০৬
স্থিতিশীলতা ও বাণিজ্যে জোর

স্থিতিশীলতা ও বাণিজ্যে জোর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে পৌঁছলে তাকে স্বাগত জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: ফোকাস বাংলা

মোটা দাগে বড় কোনো চুক্তি নেই। বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হবে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা জোরদারে পারস্পরিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। সর্বোপরি বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরও দৃঢ় হবে যৌথ পদক্ষেপ। এমন বার্তাই দিচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের নয়াদিল্লি সফর।

গতকাল মঙ্গলবার ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একান্ত ও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দুই নেতা দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা ও আঞ্চলিক সম্পর্ক জোরদারের কথা বলেন।

সহযোগিতা আর সমঝোতার ভিত্তিতে সুখী ও সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল দেশ গড়ার কথা বলেন দুই প্রধানমন্ত্রী। দুই দেশের পাশাপাশি এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন তারা। তিন বছর পরে নয়াদিল্লি সফরে নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি তিস্তার মতো অমীমাংসিত বিষয় নিষ্পত্তির বিষয়েও জোর দেন শেখ হাসিনা। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সেপা) সইয়ের ঘোষণা দেন নরেন্দ্র মোদি।

প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে কুশিয়ারা নদীর পানি প্রত্যাহার, রেলের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মহাকাশ গবেষণাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিষয়ে সাতটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। এ ছাড়া দুই প্রধানমন্ত্রী খুলনার রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের মৈত্রী পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট-১-সহ পাঁচটি প্রকল্প উদ্বোধন করেন।

জ্বালানিতে বড় সহযোগিতার ইঙ্গিত দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ক্রমবর্ধমান জ্বালানির দাম বর্তমানে সমস্ত উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সংযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা চলছে। এছাড়া মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের কাজ সম্পন্নের ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সাশ্রয়ী বিদ্যুতের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করবে।

নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক ‘ফলপ্রসূ’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আলোচনায় দুই দেশের মধ্যকার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এবং পারস্পরিক অগ্রাধিকারমূলক বিষয় প্রাধান্য পায়। সংযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, সীমান্ত এবং ঋণসুবিধার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। এই বৈঠকের ফল দুই দেশের জনগণকেই উপকৃত করবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৫০ বছরে একটি শক্তিশালী অংশীদারত্ব তৈরির মাধ্যমে দুই দেশ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ করছে। যদি বাংলাদেশ এবং ভারত অংশীদার হিসেবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। তবে তা শুধু দুই দেশের জন্যই নয়, সমগ্র অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।

আঞ্চলিক সম্পর্কে জোর দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখা এবং দুই দেশ ও এ অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমি ও প্রধানমন্ত্রী মোদি একমত হয়েছি।’

নরেন্দ্র মোদি তার বক্তৃতায় বলেন, ‘আগামী ২৫ বছরের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যাবে। বৈঠকে সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সহযোগিতার বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। ১৯৭১ সালের আদর্শকে জীবন্ত রেখে এ ধরনের শক্তিকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা জরুরি, যারা আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাসকে আঘাত করতে চায়।’ তিনি বলেন, ‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যে শক্তি আমাদের শত্রু, তাদের যেন আমরা একসঙ্গে মোকাবিলা করতে পারি।’

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে গতি সঞ্চার করার ক্ষেত্রে মোদি নেতৃত্বের প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী ভারত। প্রতিবেশীদের মধ্যে কূটনীতির ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক রোল মডেল।

সবচেয়ে বড় ‍উন্নয়ন সহযোগী

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট- সেপা) সইয়ের ঘোষণা দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।

নরেন্দ্র মোদি বলেন, এশিয়ার মধ্যে ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার বাংলাদেশ। এই অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করতে দ্বিপক্ষীয় সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি করার আলোচনা দ্রুত সময়ের মধ্যে শুরু করতে চান তারা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুই দেশের মানুষে মানুষে সংযোগের ক্ষেত্রে অব্যাহত উন্নতি হচ্ছে। গত কয়েক বছরে আমাদের সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমি বহু দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছি। কোভিড মহামারি ও সাম্প্রতিক বৈশ্বিক পরিস্থিতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া এবং আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা দরকার।’

মোদি বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্রুত বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ ও পারমাণবিক খাতে সহযোগিতা বিস্তৃত করার আলোচনা আমরা করেছি। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন করার বিষয়েও আলোচনা চলমান আছে। বন্যা মোকাবিলায় সহযোগিতার ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা বিস্তৃত করেছি। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে বন্যার তাৎক্ষণিক তথ্য বিনিময় করছি।’

তিস্তা চুক্তির তাগিদ শেখ হাসিনার

কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে সমঝোতায় সই হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে স্মরণ করিয়ে দেন দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তিসহ অমীমসাংসিত বিভিন্ন ইস্যুর কথা।

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে অনেক অনিষ্পন্ন সমস্যার সমাধান ইতিমধ্যে করেছি। আমি আশা করি, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিসহ অন্য অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো শিগগিরই সম্পন্ন করতে পারব। আমি জানি, যতক্ষণ পর্যন্ত মোদি আছেন, বাংলাদেশ-ভারত আমরা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলব।’

২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে এই চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় তা আটকে যায়।

এদিকে কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে সমঝোতাকে স্বাগত জানালেও তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ টানেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়েছে ৫৪টি নদী এবং এগুলো শত শত বছর ধরে দুই দেশের মানুষের জীবিকার সঙ্গে সংযুক্ত থেকেছে। এসব নদী, এগুলোকে জড়িয়ে থাকা লোকগাঁথা ও লোকসংগীত আমাদের একীভূত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছে।

কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন ভারতের দক্ষিণ আসাম ও বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলকে উপকৃত করবে বলেও মন্তব্য করেন মোদি।

বরাবরের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত সরকার এবং দেশটির জনগণের ত্যাগের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার পর ছয় বছর ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটানোর কথাও উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, ‘আমি ছয় বছর ভারতে ছিলাম। যখন বাবা ও পরিবারের অন্যদের মারা হয়েছিল, তখন আমাকে ও আমার বোনকে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। দুঃখের সময় ভারত পাশে থেকেছে।’

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সফরে গত সোমবার দুপুরে নয়াদিল্লি পৌঁছান। সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল সকালে নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছলে সেখানে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দুই প্রধানমন্ত্রী এ সময় করমর্দন করেন। পরে সেখানে গার্ড অব অনার দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানানো হয়।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছে। এতে শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মানুষই নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ উন্নত জীবন পেতে পারে। এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।’

এদিন শেখ হাসিনা সকালে ভারতের জাতির পিতা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর (মহাত্মা গান্ধী) সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। বেলা সাড়ে ১১টার পর হায়দরাবাদ হাউসে পৌঁছলে সেখানেও তাকে অভ্যর্থনা জানান নরেন্দ্র মোদি। পরে দুই প্রধানমন্ত্রী প্রথমে একান্ত ও পরে দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। তার সম্মানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া মধ্যাহ্নভোজেও অংশ নেন শেখ হাসিনা।

বিকেলে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশটির উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখরের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন তিনি।

আজ বুধবার ভারতের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ বা গুরুতর আহত ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বংশধরদের ‘মুজিব বৃত্তি’ প্রদানের একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। সফরের শেষ দিন ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ফেরার আগে রাজস্থানের খাজা গরিবে নওয়াজ দরগাহ শরিফ ও আজমির শরিফ দরগাহ পরিদর্শন করবেন শেখ হাসিনা।