আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার এক বছর হতে চলেছে। এই যুদ্ধে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব এক জোট হয়ে বিরোধিতা করলেও অনেকের জোরালো সুরই এখন নরম হয়ে এসেছে। বিশ্বের এমন এক পরাশক্তির সঙ্গে সরাসরি কোনো দ্বন্দ্বে জড়াতে না চাওয়ার অনিচ্ছাও এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।
জার্মানির মিউনিখে গত শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া নিরাপত্তা সম্মেলেন রাশিয়া প্রশ্নে নিজ নিজ অবস্থানকে আরও একবার স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন বিশ্ব নেতারা। তবে এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এখনো রাশিয়ার প্রতি কট্টর অবস্থানে থাকলেও ইউরোপের দিকে থেকে তেমন বিরোধী আওয়াজ তোলেননি কেউ।
বিবিসি জানায়, এবারের মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে সমবেত বিশ্ব নেতাদের বক্তব্যে প্রাধান্য পাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক। সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী থেকে শুরু করে কূটনীতিক ও গুপ্তচররা ছিলেন। প্রায় ৩০ জন ছিলেন ইউরোপীয় সরকারপ্রধান। তবে এতে রাশিয়ার কোনো কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
সম্মেলনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলছেন, তিনি রাশিয়ার ধ্বংস চান না। গত শনিবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে মাখোঁ অবশ্য বলেছেন, তিনি চান রাশিয়া এই যুদ্ধে পরাজয় বরণ করুক।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনে দীর্ঘায়িত যুদ্ধের জন্য ফ্রান্স প্রস্তুত ছিল উল্লেখ করে ইমানুয়েল মাখোঁ বলেন, ‘আমি রাশিয়াকে ইউক্রেনে পরাজিত অবস্থায় দেখতে চাই। আমি চাই, ইউক্রেন নিজের অবস্থান রক্ষায় সক্ষম হয়ে উঠুক।’
তবে যারা দীর্ঘায়িত একটি যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়ার ধ্বংস কামনা করে, তাদের কড়া সমালোচনা করে মাখোঁ বলেন, ‘অন্যদের মতো আমি মনে করি না যে রাশিয়ার সম্পূর্ণ পরাজয়ের জন্য রাশিয়ার মাটিতে আক্রমণ চালাতে হবে। এ ধরনের লোকজন রাশিয়াকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে চায়। এটি কখনোই ফ্রান্সের অবস্থান ছিল না এবং কখনোই আমাদের অবস্থান হবে না।’
যখন বিশ্বের নেতারা নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিতে জার্মানির মিউনিখে সমবেত হয়েছেন ঠিক তখন মাখোঁ এ মন্তব্য করলেন। সম্মেলনে পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা ইউক্রেনকে আরও অস্ত্র সহায়তা এবং রাশিয়ার ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপে একমত হয়েছেন।
গত শুক্রবার মিউনিখে সম্মেলনের ভাষণে মাখোঁ জোর দিয়ে বলেন, ‘এখন মস্কোর সঙ্গে সংলাপের উপযুক্ত সময় নয়।’ তবে শান্তি আলোচনাকে এই সংকট সমাধানে চূড়ান্ত উপায় হিসেবে উল্লেখ করতেও পিছপা হননি তিনি।
রাশিয়া মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে: যুক্তরাষ্ট্র
এদিকে ইউক্রেনে যুদ্ধ বাধিয়ে রাশিয়া মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে বলে অভিযোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জার্মানিতে মিউনিখের সম্মেলনে যোগ দিয়ে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ভাষণে বলেন, ‘ইউক্রেনে রাশিয়া মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে বলে সুনিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনে রাশিয়ার হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও মানুষজনকে বিতাড়নের ভয়াবহ সব কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব অপরাধের হোতাদের জবাবদিহি করতে হবে। তাদের কর্মকাণ্ড আমাদের সাধারণ মূল্যবোধ এবং মানবতার ওপর আক্রমণ।’
তবে রাশিয়া বরাবরই ইউক্রেন আগ্রাসনে কোনো ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করার কথা অস্বীকার করে আসছে। ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবাও কমলা হ্যারিসের কথায় সায় দিয়ে রাশিয়া সম্পর্কে একই রকম অভিযোগ করেছেন। সম্মেলনে উপস্থিত নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মস্কো গণহত্যার যুদ্ধ চালিয়েছে। কারণ সার্বভৌম দেশ হিসেবে ইউক্রেনিয়দের অস্তিত্ব থাকার বিষয়টি তারা চিন্তাই করেনি।’
রাশিয়াকে সহায়তা না করতে চীনকে হুঁশিয়ারি
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তার বিষয়ে চীনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শনিবার মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের পাশাপাশি এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে শীর্ষ চীনা কূটনীতিক ওয়াং ইকে সতর্ক বার্তা দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে চীন বস্তুগত সহায়তা দিলে দেশটিকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনা কূটনীতিক ওয়াং ইকে সতর্ক করে দিয়েছেন।
ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠকের পর দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেন, ‘ইউক্রেনে আগ্রাসনে সহায়তা করতে চীন রাশিয়াকে প্রাণঘাতী অস্ত্র সহায়তা দেয়ার কথা বিবেচনা করছে এবং এতে ওয়াশিংটন অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে তা আমাদের সম্পর্কে গুরুতর পরিণতি ডেকে আনবে।’
ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতা দ্বিগুণ করতে হবে: ঋষি সুনাক
ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় রাশিয়া প্রশ্নে যুক্তরাজ্য এখনো বেশ শক্ত অবস্থানে বলে স্পষ্ট করলেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে এখনই সেখানে সবচেয়ে উন্নত অস্ত্র পাঠাতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।
মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে সুনাক বলেন, ‘মিত্র দেশগুলোকে অবশ্যই ইউক্রেনকে উন্নত ও ন্যাটো-মান সক্ষমতা দিতে হবে। তাদের আরও আর্টিলারি, সাঁজোয়া যান এবং বিমান প্রতিরক্ষা প্রয়োজন। তাই সামরিক সক্ষমতাকে দ্বিগুণ করার এখন সময় এসেছে।’
রাশিয়ার আক্রমণের এক বছর পূর্তির আগে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার জন্য তিন দিনের সমাবেশে আগামী বসন্তে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে কিয়েভকে পশ্চিমা সহায়তা বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া হয়।
সুনাক আরও বলেন, ‘পুতিন ভেবেছিলেন, এই যুদ্ধে আমাদের আগ্রহ থাকবে না। তিনি এখন বাজি ধরেছেন, এই যুদ্ধে আমরা কিছুই করতে পারব না। তবে আমরা তাকে ভুল প্রমাণ করেছি এবং আমরা এখন তাকে ভুল প্রমাণ করব। রাশিয়াকে জবাবদিহি করতে আন্তর্জাতিক আইন বহাল রাখা দরকার।’
সমাবেশে ইউক্রেনের মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানায় এবং রুশ সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে তারা এখনই হাল ছেড়ে দেবে না, এমনকি সামনের মাসগুলোতে আরও বেশি রক্তপাত ও ধন-সম্পদের ব্যয় বাড়লেও।
ইউক্রেনকে দীর্ঘমেয়াদি সমর্থনের আশ্বাস দেয়ার জন্য একটি নতুন ন্যাটো চার্টারের আহ্বান জানিয়ে সুনাক বলেন, ‘মিত্রদের অবশ্যই দেখাতে হবে যে আমরা তাদের পাশে থাকব, তাদের দেশ রক্ষায় বারবার সাহায্য করতে ইচ্ছুক এবং সক্ষম।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা