আপডেট : ২ মার্চ, ২০২৩ ০৮:৫৪
ধান চাষে লোকসান, ভুট্টায় ঝুঁকছেন কৃষক
মাসুদ রানা, রৌমারী (কুড়িগ্রাম)

ধান চাষে লোকসান, ভুট্টায় ঝুঁকছেন কৃষক

জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে ধান চাষের খরচ। তাই ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার কৃষকরা। এর পরিবর্তে তারা ভুট্টা চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। কৃষকরা বলছেন, আগের বছর ধান চাষ করে লোকসান গুনেছেন তারা। অন্যদিকে আবাদে অপেক্ষাকৃত কম খরচ হওয়ায় ভুট্টা চাষে লাভ ধানের চেয়ে বেশি। সে কারণেই গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবার তারা ধান চাষের উপযোগী জমিতেও ভুট্টা লাগিয়েছেন।

সরেজমিনে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিস্তৃত মাঠজুড়ে ধানের পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে ভুট্টাগাছ। খেতে ফসলের পরিচর্যা করছেন কৃষকরা। অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে ভুট্টার চাষ করা হয়েছে। অথচ গত বছরের এই সময়ে এখানকার জমিগুলোতে শুধুই ধানের চাষ করা হয়েছিল।

কৃষকরা জানান, সেচ পাম্পের যন্ত্রাংশ, জ্বালানি তেল ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ধান চাষে খরচ এখন অনেক বেড়ে গেছে। এখানে এক বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করতে বীজতলা তৈরি, বীজ রোপণ, শ্রমিকের মজুরি, হালচাষ, সার, কীটনাশক ও মাড়াইসহ খরচ ২৭ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অন্যদিকে ধান বিক্রির সময় ন্যায্য দাম না পাওয়ায় লাভ তো দূরের কথা, খরচের টাকা তুলতেই তাদের হিমশিম খেতে হয়।

কৃষকদের অভিযোগ, সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহের মৌসুমে তারা সরাসরি খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে ধান বিক্রি করতে পারেন না। কার্যালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা সিন্ডিকেট তৈরি করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধান কিনে থাকেন। ধান কাটা মৌসুমে কৃষকদের যখন টাকার অভাব চরমে, তখন সরকারের কাছে বিক্রি করতে না পেরে ওই ব্যবসায়ীদের কাছে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ব্যবসায়ীরা তাদের জিম্মি করে সরকার নির্ধারিত দরের চেয়েও কম টাকায় ধান কিনে নেন। ফলে লোকসান গুনতে হয় কৃষকদের। এ কারণেই তারা ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

ফলুয়ারচর গ্রামের ধানচাষি মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর ধান চাষ করে লোকসান হয়েছে। তাই এবার বোরোর সব জমিতে ভুট্টা লাগিয়েছি। শুধু আমি না, এ গ্রামের অনেকেই বোরোর আবাদ ছেড়ে এ বছর ভুট্টার আবাদ করেছেন।’

মাইদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বাজারে ধানের দাম কম ছিল। তাই ধান দিতে রৌমারী খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। আমার শুকনো ধানকে ভেজা ও চিটা বলে আমাকে ফেরত পাঠায়। আমরা গরিব মানুষ, আমাদের এভাবে ঘোরানোর দরকার কী।’

সরকারি দামে ধান বিক্রি করতে না পারার আক্ষেপ জানালেন চরশৌলমারী গ্রামের জয়নাল আবেদীনও। তিনি বলেন, ‘ধান বিক্রি করতে গেয়েছিলাম। ৮৫০ টাকা করে দেবে বললে ফেরত নিয়ে আসছি।’

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসের একাধিক সূত্রও অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ব্যবসায়ীদের গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের তথ্য স্বীকার করে নিয়েছে। তবে অফিসের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। ব্যবসায়ীরা অবশ্য কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করছেন। ব্যবসায়ী মো. ময়নাল হক বলেন, ‘সরকারিভাবে ধান নেয়ার মালিক উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তারা। কিন্তু কৃষকরা তাদের ধান দিতে পারে না। তাই আমরা ধান দিয়ে থাকি।’

ধান আবাদ নিয়ে যখন কৃষকরা এমন নাকাল, তখন তারা ভুট্টা আবাদে আশার আলো খুঁজে পেয়েছেন। তারা বলছেন, প্রতি বিঘায় ভুট্টা চাষে খরচ হয় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। ফলন হয় প্রতি বিঘায় ৮০ থেকে ৯০ মণ। জমি থেকে মণপ্রতি কাঁচা ভুট্টা বিক্রি হয় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। আর শুকনো ভুট্টা বিক্রি হয় ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। সে হিসাবে ধানের তুলনায় ভুট্টার আবাদ আর্থিক দিক থেকে অনেক বেশি নিরাপদ।

ভুট্টাচাষি আবু সাইদ বলেন, ‘তেলের দাম বেশি হওয়ায় ধান চাষ করিনি। এবার আমি দুই বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করছি। ভুট্টা চাষে খরচ কম। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে গত বছরের চেয়ে এবার ভুট্টা চাষে বেশি লাভ হবে।’

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন কারণে গত বছরের তুলনায় এ বছর ২০০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ কম হয়েছে। অন্যদিকে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে ভুট্টার আবাদ।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বোরো ধানের আবাদ অনেক কম হয়েছে। বিপরীতে ব্যাপক হারে বেড়েছে ভুট্টার আবাদ। গত বছর ভুট্টার আবাদ হয়েছিল ৩ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে। চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে প্রায় ৪ হাজার ৮২৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে।