চা শ্রমিকদের অবহেলিত জীবনে অন্যতম উৎসব রং পরব বা ফাগুয়া উৎসব। এ উৎসবের আবেদন সীমানা ভেঙে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছে। এই উৎসব ঘিরে মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে চা বাগান।
শনিবার মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ফুলছড়া চা বাগান মাঠে নানা বয়সী হাজারও নারী-পুরুষ আবির নিয়ে রঙের খেলায় মেতে ওঠে ফাগুয়া উৎসবে। অনুষ্ঠান শেষ হয় রাত সাড়ে ১১টায়।
বাংলাদেশের চা বাগানগুলোতে বসবাস নানা জাতিগোষ্ঠীর। চা শ্রমিকদের নিজেদের পৃথক ভাষা, সংস্কৃতিও পৃথক। ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে একেকটি চা বাগান যেন একেকটি দেশ। তবে ফাল্গুনের ফাগুয়া উৎসবে সবাই এক হয়ে মেতে ওঠেন রঙের উৎসবে।
দরিদ্র তবে প্ররিশ্রমী চা জনগোষ্ঠীকে উৎসবের রঙে আরও রঙিন করে তুলতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ফাগুয়া উৎসবের আয়োজন করে ফাগুয়া উৎসব উদ্যাপন পরিষদ। আয়োজক কমিটির সদস্যসচিব প্রাণেশ গোয়ালা জানান, চা জনগোষ্ঠী থেকে জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতৃত্বে উঠে আসা ব্যক্তিদের সম্মিলনে শ্রীমঙ্গল শহরের অদূরে ফুলছড়া চা বাগানের মাঠে আয়োজন করা হয় এই ফাগুয়া উৎসব।

উৎসবে কেবল রঙের হোলিই নয়, ছিল ভিন্ন সংস্কৃতির অন্তত ৩০টি পরিবেশনা। পত্রসওরা, নৃত্যযোগী, চড়াইয়া নৃত্য, ঝুমর নৃত্য, লাঠিনৃত্য, হাড়িনৃত্য,পালা নৃত্য, ডং ও নাগরে, ভজনা, মঙ্গলা নৃত্য, হোলিগীত, নিরহা ও করমগীত একসঙ্গে উপভোগ করতে পেরে যেমন আনন্দে ভেসেছেন চা শ্রমিকরা, তেমন অভিভূত হয়েছে উৎসবে আসা নাগরিক সমাজও।
ফাগুয়া উৎসব ঘণ্টা বাজিয়ে উদ্বোধন করেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান। তিনি বলেন, ফাগুয়া উৎসবটি ব্যতিক্রম। একসঙ্গে এত নৃত্যগীতের এত বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজন দেখে অন্য সবার মতো আমিও অভিভূত। আমার বিশ্বাস, চা বাগানের সংস্কৃতি এই অঞ্চল তথা দেশের একটি সম্পদ। এটি চর্চা ও সুরক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। এই উৎসব অব্যাহত রাখতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন শ্রীমঙ্গল উপজলা চেয়ারম্যান ভানুলাল রায়, শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অর্ধেন্দু কুমার দেব।
সিলেট থেকে উৎসবে যোগ দিতে আসা উষা সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়ের প্রধান চা জনগোষ্ঠীর তরুণী তমির্শা তিথি বলেন, চা বাগানেই যে এত নৃত্যগীতের সমাহার, এখানে না এলে আমার জানা হতো না। বীরহা, করমগীত আমি প্রথমবার দেখলাম।

ফাগুয়া উৎসবে গেস্ট অব অনার হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাইকমিশনার নীরাজ কুমার জায়সওয়াল। তিনি বলেন, চা বাগানে পৌঁছাতেই কানে বাজল পাহাড়িয়া মাদলের সুর। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, মধ্যবয়সী সবাই নাচছে, গাইছে, আনন্দ করছে। অনেক আয়োজন দেখেছি। তবে এমন আয়োজন প্রথম দেখলাম। চা বাগানের মানুষের কৃষ্টি সংস্কৃতি এত সুন্দর, না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
দেউন্ডি চা বাগান থেকে আসা প্রতীক থিয়েটারের সভাপতি সুনিল বিশ্বাস বলেন, শত দুঃখ-কষ্ট, শত অভাব-অনটনের মধ্যেও উৎসবের কয়েকটি দিন তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দে কাটানোর চেষ্টা করেন। শ্রমিকরা এই আনন্দ ভাগাভাগি করেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে। দূর-দূরান্তের চা-বাগান থেকে মেয়েরা নাইওর আসে জামাইসহ।
আয়োজক কমিটির সদস্যসচিব কালিগাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রাণেশ গোয়ালা বলেন, তৃতীয়বারের মতো এই আয়োজন হলেও আয়োজনটি জাতির জনককে উৎসর্গ করা হয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে চা শ্রমিকদের এটি একটি বিশেষ আয়োজন। আশা করি পরবর্তী বছর আরও বড় পরিসরে ফাগুয়া উৎসব করা হবে।
মৌলভীবাজার জেলার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, চা বাগানের কৃষ্টি-সংস্কৃতি যেন কোনোভাবে বিলুপ্ত না হয়, সেজন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। ফাগুয়া উৎসব যেন বন্ধ না হয়, সেজন্য আমরা কিছু সহযোগিতাও করেছি। এই সুন্দর সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব সবার। এটি যেন প্রত্যেকবার করা যায়, তার পরিকল্পনা করছি।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা