পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক পরিদর্শক খুনের মামলার পলাতক আসামি তিনি। নিজেকে বাঁচাতে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অর্থের বিনিময়ে আরেকজনকে আদালতে আত্মসমর্পণ করিয়েছিলেন। কিন্তু জেলে থাকা সেই তরুণ একপর্যায়ে সত্য প্রকাশ করে দেয়। এরপর আদালত বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি)।
ডিবির অনুসন্ধানেও নিজের বদলে অন্যকে আসামি বানিয়ে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি প্রমাণিত হয়। পরে সেই ব্যক্তি পালিয়ে চলে যান ভারতে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভারত থেকে বানিয়ে নেন একটি পাসপোর্ট। ভারতীয় নাগরিক পরিচয়েই বসবাস শুরু করেন দুবাইতে। সেখানে আরাভ নামে একটি জুয়েলারি নেন। সেই দোকানের উদ্বোধন করতেই দুবাই গিয়েছেন ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান। শুধু সাকিব নয়, বাংলাদেশের শোবিজ অঙ্গনের অনেক তারকাই সেই জাঁকালো উদ্বোধনে অংশ নেয়ার কথা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতেই চলছে তোলপাড়। তাদের বিস্ময়, খুনের মামলার এক আসামি কীভাবে দুবাই গিয়ে এত সম্পদের মালিক হলো!
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৮ জুলাই রাতে নিখোঁজ হন এসবির পরিদর্শক মামুন ইমরান খাঁন। পরিবারের সদস্যরা তার খোঁজ না পেয়ে পরদিন সবুজবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেই জিডির তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিম জানতে পারে, রহমত নামে এক বন্ধুর সঙ্গে মামুন ইমরান বনানীর একটি বাসায় আফরিন নামে এক কথিত মডেলের জন্মদিনের পার্টিতে গিয়েছিলেন। সেখানে আফরিনের সহযোগীরা তাকে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে করা হয়। সেই মরদেহ উদ্ধার করা হয় গাজীপুরের একটি বাঁশঝাড় থেকে।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ পুলিশ রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয় ওরফে হৃদিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এ সময় রবিউল ইসলাম ওরফে আপন পলাতক ছিলেন। আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর রবিউল ইসলাম ওরফে আপন নামে ওই ব্যক্তি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
সূত্র জানায়, পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খাঁন হত্যাকাণ্ডে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপনের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার আশুতিয়ায়। তার বাবার নাম মতিউর রহমান মোল্লা। আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর আপন নিজেকে বাঁচানোর জন্য ফন্দি আঁটেন। কৌশলে চাঁদপুরের কচুয়া থানাধীন সিংআড্ডা এলাকার নুরুজ্জামানের ছেলে আবু ইউসুফকে অর্থের প্রলোভনে তার বদলে আদালতে আত্মসমর্পণ করাতে রাজি করেন। অর্থের লোভে আবু ইউসুফ নিজেকে রবিউল ইসলাম ওরফে আপন পরিচয় দিয়ে আত্মসমপর্ণ করেন। আদালত আবু ইউসুফকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। পরে আপন তার পরিবারকে অর্থ দেয়া বন্ধ করে দিলে ইউসুফ বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষকে জানান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মহানগর দায়রা জজ ফয়সল আতিক বিন কাদির ২০২১ সালের ২ মার্চ বিষয়টি তদন্ত করার জন্য মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে আদেশ দেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে রবিউল ইসলাম ওরফে আপনের নামে আবু ইউসুফের কারাবন্দি থাকার বিষয়টির প্রমাণ পায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিজের বদলে আবু ইউসুফকে কারাগারে পাঠানোর আগেই আপন ভারতে পালিয়ে যায়। ২০২০ সালের ২৮ জুলাই তিনি পশ্চিমবঙ্গের নরেন্দ্রপুর উদয় সংঘ ক্লাব এলাকার বাসিন্দা হিসেবে একটি ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। জালিয়াতি করে বানানো ওই পাসপোর্টে তার বাবার নাম হিসেবে ব্যবহার করেন জাকির খান, মায়ের নাম দেন রেহানা বিবি খান এবং স্ত্রীর নাম সাজিমা নাসরিন। তার ভারতীয় পাসপোর্ট নম্বার ইউ ৪৯৮৫৩৮৯।
সূত্র জানায়, ভারতীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করে আপন আরাভ নাম নিয়ে দুবাই যাতায়াত শুরু করেন। তার পাসপোর্টে শেনজেন ভিসাও রয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, রবিউল ইসলাম ওরফে আপনের বাংলাদেশি একটি পাসপোর্টও তারা পেয়েছিলেন। হৃদি শেখ নামে ওই পাসপোর্টের (নম্বর এনও ০৩৮৫১৮৮) সূত্র ধরে পুলিশের বিশেষ শাখায় চিঠি দিয়ে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়। কিন্তু তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশত্যাগ করেননি।
এত টাকা পেলেন কোথায়?
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে শোবিজ তারকাদের সঙ্গে ওঠাবসা করা রবিউল ওরফে আপন ওরফে আরাভ উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণদের টার্গেট করতেন। তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে নিজের সিন্ডিকেটের কথিত মডেলদের সঙ্গে মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করতেন। সেই দৃশ্য ভিডিও করে বিত্তবান ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করাই ছিল তার মূল কাজ। পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খাঁনকেও ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেন রবিউল ওরফে আপন। কিন্তু প্রতিবাদ করায় মামুনকে বনানীর একটি ফ্ল্যাটে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
সূত্র জানায়, মামুন হত্যাকাণ্ডের পর ডিবির একটি দল রবিউল ওরফে আপনকে আটক করেছিল। তৎকালীন একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) হস্তক্ষেপে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। একটি সূত্র জানিয়েছে, রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে আরাভ পুলিশের সাবেক ওই কর্মকর্তার অবৈধ অর্থ দিয়েই দুবাইয়ে জুয়েলারির দোকান খুলেছেন। নেপথ্যে থেকে ওই পুলিশ কর্মকর্তাই এর উদ্বোধনের জন্য সাকিব আল হাসানসহ শোবিজ তারকাদের দুবাই নিয়ে গিয়ে সেই দোকান উদ্বোধনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, খুনের মামলার ফেরারি আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আপন ওরফে আরাভের দুবাইয়ে জুয়েলারি ব্যবসার বিষয়টি তাদের নজরে এসেছে। এ বিষয়ে তারাও আনুষ্ঠানিকভাবে খোঁজখবর শুরু করেছেন। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে তাকে গ্রেপ্তারের জন্য সহযোগিতা চাওয়া হবে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা