সোনার ফসল নয়। ফসলি জমির উর্বর মাটিতে এখন তৈরি হচ্ছে ইট। আর জমিগুলো হয়ে পড়ছে অনাবাদি। এ দৃশ্য লক্ষ্মীপুর জেলার। পুরো জেলায় এখন ইটভাটার সংখ্যা ১২২। আর এই ১২২ ইটভাটায় বছরে যাচ্ছে প্রায় ১১ কোটি ঘনফুট (সিএফটি) মাটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমির ওপরের অংশ বা টপ সয়েল কেটে নেয়ায় মাটিতে যে জিপসাম বা দস্তা থাকে তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে মাটির উর্বরাশক্তি।
কৃষিবিদ আসিফুজ্জামান বলেন, উর্বর মাটি তৈরি হতে অনেক বছর সময় লাগে। একটি উদ্ভিদের ১৬ প্রকার খাদ্যের মধ্যে মাটিতে ১৩ প্রকার খাদ্য উপাদান রয়েছে। ফসলি জমির উপরিভাগের ৪-৬ ইঞ্চি মাটি বেশি উর্বর। কিন্তু এভাবে উর্বর মাটি ভাটায় চলে গেলে ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদন কমে যাবে ২০-৩০ শতাংশ।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়, জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে জেলায় ইটভাটা ছিল ৭৫টি। ২০২২-২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী জেলায় বৈধ ইটভাটা ৭৫টি, অবৈধ ৪৭টি।
সরেজমিনে দেখা যায়, সদর উপজেলার তেয়ারিগঞ্জ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আন্ধারমানিক
গ্রামেই একসঙ্গে ১১টি ইটভাটার অবস্থান। এ ইউনিয়নে মোট ভাটা রয়েছে ২১টি। অথচ পুরো ইউনিয়ন কৃষিভিত্তিক এলাকা।
এ ছাড়া জেলার ভবানীগঞ্জ, মান্দারী, ভোলাকোট, দরবেশপুর এবং চর রমিজ এ ইউনিয়নগুলোতে ইটভাটা ছাড়া আর কিছু চোখেই পড়ে না।
গ্রামবাসী জানায়, কয়েক বছর আগেও ওই ইউনিয়নগুলোতে অনাবাদি কোনো জমি ছিল না। অথচ এখন ভাটার আশপাশে বিরাট এলাকাজুড়ে চোখে পড়ে অনাবাদি জমি।
সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের বাসিন্দা আফজাল খান বলেন, ইটভাটার পাশে জমি থাকলে তা ভেঙে যায়, ফসল হয় না। ফলে ভাটার মালিকদের কাছে বাধ্য হয়ে জমির মাটি বিক্রি করেন কৃষক। আর ইটভাটার মালিকরা প্রশাসনকে হাতে রেখে তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন নির্বিঘ্নে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের আরেক সহসভাপতি আশরাফ আলী চৌধুরী বলেন, ‘রামগতি উপজেলার চর রমিজ নামের একটি ইউনিয়নে রয়েছে ২৮টি ইটভাটা। এরমধ্যে ৫ নম্বর ওয়ার্ডেই রয়েছে ১৪টি ভাটা। রামগঞ্জে বর্তমানে রয়েছে ২৮টি ইটভাটা। আর ভোলাকোট ইউনিয়নে রয়েছে ১১টি। ইটভাটার মাটি নেয়ার পর পুরো ভোলাকোট ইউনিয়নটি এখন পরিত্যক্ত বিলে পরিণত হয়েছে।’
ইটভাটা স্থাপনের জন্য অনুমোদিত জমি ৩ একর হলেও ভাটার মালিকরা দখল করছেন কমপক্ষে ৯-১০ একর। সে হিসাবে ইটভাটায় চলে গেছে লক্ষ্মীপুর জেলার ১ হাজার একর জমি।
কথা হয় সদর উপজেলার একটি ভাটার ম্যানেজার সোলাইমানের সঙ্গে। তিনি জানান, ইটের সাইজ অনুসারে একটি কাঁচা ইট তৈরিতে মাটি লাগে ০.০৮৫ ঘনফুট। বছরের অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিটি ভাটায় কমপক্ষে গড়ে ৮ রাউন্ড ইট পোড়ানো হয়। প্রতি রাউন্ডে ১০ লাখ ইট থাকে। এক একটি ভাটায় বছরে কমপক্ষে ৭০ লাখ ইট পোড়ানো হয়।
তিনি হিসেব করে দেখান, লক্ষ্মীপুর জেলায় ২০২২ সালের শুরুতে ১৩০টি ইটভাটার জন্য বছরে ১১ কোটি ঘনফুট মাটি লেগেছে, যা দিয়ে প্রায় ১শ কোটি ইট তৈরি হয়েছে। ইট তৈরির কারিগর জামাল এবং
আরও কয়েকজন ম্যানেজার একই তথ্য দিয়েছেন।
সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চর মনসা গ্রামের সবজি চাষি আবদুল বাতেন জানান, তার খেতের পাশে ইটের ভাটা। রাতদিন সেখানে পুড়ছে ইট, উড়ছে ধোঁয়া আর গ্রামের প্রতিটি কাঁচাপাকা সড়কে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাটিবাহী ট্রাক্টর গাড়ির ভয়ংকর শব্দ। ফসলের ক্ষতি, ইটভাটার ধুলোবালি এবং গাড়ির অত্যাচারে এ গ্রামবাসী পুরোপুরি অসহায়।
ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৯-এর তথ্য থেকে জানা যায়, একটি ইটভাটা স্থাপনের আগে প্রায় ১০টি সরকারি অফিস জড়িত থাকে। অন্যদিকে প্রতিটি জেলায় একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, বন কর্মকর্তা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের মনোনীত কোনো কর্মকর্তাসহ একটি তদারকি কমিটি রয়েছে।
ইটভাটা স্থাপনের বিধিনিষেধের মধ্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং লোকালয় থেকে কমপক্ষে ১ কিলোমিটার দূরে ভাটা স্থাপন করতে হবে। তাছাড়া আবাদি জমিতে কোনো ইটভাটা তৈরি করা যাবে না। কৃষিজমির মাটি ব্যবহার করা যাবে না। এলজিইডির রাস্তা ব্যবহার করা যাবে না। কাঠ পোড়ানো যাবে না। কিন্তু এর কিছুই মানছে না ভাটার মালিকরা।
পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ বাংলাদেশের মাহবুবুর রশিদ বলেন, ইটভাটায় শুধু মাটি ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, এখানে বাধ্যতামূলক শ্রম আছে, দাদনভিত্তিক শ্রম ও শিশুশ্রম আছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই এখন আর পোড়ানো ইট ব্যবহার করা হচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে দ্রুত পোড়া ইটের বিকল্প ব্যবহারে ফিরে যেতে হবে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহ আলম পাটোয়ারী বলেন, ‘ইটভাটা অনুমোদনের জন্য যে কমিটি আছে, তাতে স্থানীয় সরকার বিভাগের কেউ নেই। ফলে আমরা এগুলো বন্ধ করতে পারছি না।’
লক্ষ্মীপুর জেলায় এতদিন পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অফিস ছিল না। ফলে লক্ষ্মীপুর জেলার পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখাশোনা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তরের নোয়াখালী জেলা অফিস। সরেজমিন পরিদর্শন না করে কিংবা নীতিমালা না দেখে পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নোয়াখালী পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কোনো উত্তর দেননি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক তানজিদ তারেক বলেন, ‘সব কিছু জানে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক। আমরা জেলা প্রশাসককে তথ্য দিই। অন্য কাউকে তথ্য দিতে বাধ্য নই।’
রামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে হাবীবা মীরা বলেছেন, ‘রামগঞ্জে ২০টি ইটভাটা রয়েছে। কেউই আইন মেনে চলেন না। ইতিমধ্যে ৭টি ইটভাটায় অভিযান চালানো হয়েছে।’
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সূচিত্র রঞ্জন দাস বলেন, ‘কমলনগরে ১৮টি ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। পরবর্তী সময়ে অভিযান চালিয়ে গত কয়েক মাসে প্রায় দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কাজটি যেহেতু পরিবেশ অধিদপ্তরের, যদি তারা কোনো অভিযান করে আমরা তাদের সহযোগিতা করি।’
লক্ষ্মীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হারুন অর রশিদ পাঠান বলেন, ‘সম্প্রতি এ জেলায় আমরা দায়িত্ব পেয়েছি। দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই অনেক ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে জরিমানার পাশাপাশি ভাটা বন্ধ করে দিয়েছি। অবৈধ ইটভাটার তালিকা তৈরি করে প্রতিবেদন প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। আমরা নিজেরা ও জেলা প্রশাসকের সমন্বয়ে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছি। কিন্তু ফসলি জমির মাটি বিক্রির বিষয়ে কৃষি বিভাগ থেকে কখনো আমাদের কিছুই জানায়নি।’
জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বলেন, অবৈধ ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৮ থেকে ২০টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এ ছাড়া ফসলি জমির মাটি যেন ইটভাটায় যেতে না পারে সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনের নজরদারি থাকবে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা