অস্থিরতা চলছে দেশের তিনটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নির্যাতনের রেশ না কাটতেই বহিরাগতদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে চলছে অস্থিরতা। আর স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের পর বেসরকারি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় চার দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতার জন্য বহিরাগতদের ইন্ধনের সঙ্গে তৃতীয় পক্ষের উসকানি রয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চলছে।
এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে উপাচার্যদের নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহিংসতার পেছনে কোনো পক্ষ রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতার পেছনে প্রশাসনের দুর্বলতা দায়ী। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ঠিক রাখতে পারছেন না। করোনা পরিস্থিতির পর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এক ধরনের মানসিক অস্থিরতার মধ্যে আছেন। এই ধরনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরির পেছনে এটাও অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি।’
‘আমরা ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকে। পর্যায়ক্রমে আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও মতবিনিময় করব। যাতে কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি না হয়।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেটের পাশে বেশ কয়েকটি দোকানপাট এবং বিনোদপুর গেটসংলগ্ন পুলিশ বক্সে আগুন দেয়া হয়। সেখানে থাকা পুলিশের মোটরসাইকেলও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাতনামা ৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার দৈনিক বাংলাকে বলেন, শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই অগ্নিসংযোগের মতো দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িত নয়। এসবের পেছনে বহিরাগতদের ইন্ধন থাকতে পারে। পুলিশের মামলায় শিক্ষার্থীদের যাতে হয়রানি না করা হয় তা গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের রাজত্ব ছিল। এমনকি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার পরও ক্যাম্পাসে কোণঠাসা ছিল ছাত্রলীগ। পরে শিবিরের হাতে ছাত্রলীগের এক কর্মী খুন হওয়ার পর ক্যাম্পাস ছাড়েন শিবিরের নেতা-কর্মীরা। এরপর থেকে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের আধিপত্য থাকলেও ক্যাম্পাসের চারপাশে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের শক্ত অবস্থান রয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক দৈনিক বাংলাকে বলেন, এবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের কিছু আলামত দেখে বোঝা যায় একটি পক্ষ আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিল। কারণ তারা শিক্ষার্থীদের ওপর ককটেল ও হাতবোমা নিক্ষেপ করেছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় চারুকলা চত্বরে বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য পুড়িয়ে ফেলার প্রসঙ্গ তুলে ধরে মলয় ভৌমিক বলেন, জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা শুধু ক্যাম্পাসের চারপাশেই নয়, ক্যাম্পাসের অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যেও তারা অনুপ্রবেশ করেছে। এরা সব সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অস্থিতিশীল করতে চায়। নির্বাচনের বছর বলে এখন তাদের সেই চেষ্টা বেশি রয়েছে।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ছাত্রশিবিরের শক্ত অবস্থান ছিল। এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছে দৈনিক বাংলা। তারা বলছেন, আগামী বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন হবে। ফলে রাজনীতিতে এই বছরটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাম্পাসগুলো অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি তারই আলামত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকে সেটা আমাদের বড় দায়িত্ব। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে সব সময় সোচ্চার রয়েছি।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাগুলো নজরে রেখেছে সরকার। কারণ এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে স্বাধীনতাবিরোধীরা অনেক সক্রিয় ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এই গোষ্ঠী ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতনের রেশ কাটতে না কাটতেই বহিরাগতদের সঙ্গে মারামারিতে জড়ান বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। এর পর থেকে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গেটগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন শেখপাড়া বাজারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, হল প্রাধ্যক্ষ ও পরিবহন দপ্তরের ২১ শিক্ষক-কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগপত্রে ব্যক্তিগত কারণ দেখালেও উপাচার্যের সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগের ভাগবাঁটোয়ারা দ্বন্দ্বে তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে ক্যাম্পাস সূত্রগুলো বলছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের অনুসারী শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন আরও বাড়বে এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তার প্রভাব পড়বে বলে শিক্ষকরা মনে করছেন।
শিক্ষকদের পদত্যাগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার বলেন, পদত্যাগকারী প্রক্টর রবিউল হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বলয় তৈরি করেছেন। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক অনেক কাজেই তিনি প্রভাব রাখার চেষ্টা করেন। সব সময় এসব আবদার রাখা সম্ভব হয় না।
গত সোমবার রাতে আশুলিয়ার চারাবাগ মোড় এলাকায় লেগুনার সঙ্গে মোটরসাইকেলে ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে চালক ও স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সংঘর্ষের একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কয়েকটি দোকানপাট ভাঙচুর করলে স্থানীয়দের সঙ্গে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আগামীকাল শুক্রবার পর্যন্ত ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা