হৃদয় শুভ, শ্রীমঙ্গল
বিরল প্রজাতির গাছপালা ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর শ্রীমঙ্গল রেঞ্জের ২ হাজার ৭৩৫ হেক্টর বনভূমি। মূল্যবান কাঠ আর জীববৈচিত্র্যের কারণে এই বনভূমির দিকে দুষ্কৃতকারীদের নজর সব সময়। অথচ এই মূল্যবান গাছ, বন্য প্রাণী ও বনভূমি রক্ষায় সরকারের মনোযোগ নেই বললেই চলে। ফলে মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে ক্রমেই নিঃস্ব হচ্ছে এ বনাঞ্চল।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের শ্রীমঙ্গল রেঞ্জের অধীনে রয়েছেন মাত্র ১৮ জন বনরক্ষী। তারা আবার ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’। পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে মান্ধাতার আমলের লাঠি আর ‘প্রায় অচল’ দেশীয় অস্ত্র দিয়ে চলে নিরাপত্তা রক্ষার কাজ। নেই ঝুঁকি ভাতা, নেই ভালো বাসস্থান। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাদের এই বন ও বনের মূল্যবান সম্পদ পাহারা দিতে হচ্ছে। প্রায়ই বনদস্যুদের হামলার শিকার হতে হচ্ছে বনকর্মীদের। আর এতে হুমকির মুখে পড়েছে বিশাল এই বনভূমি।
শ্রীমঙ্গল রেঞ্চ কার্যালয় থেকে জানা যায়, মোট তিনটি বন বিটে বিভক্ত শ্রীমঙ্গলের বনভূমি। লাউয়াছড়া, কালাছড়া ও চাউতলী এই তিন বিটের মধ্যে সবচেয়ে বড় লাউয়াছড়া, যার আকার ১ হাজার ২৫০ হেক্টর। এ ছাড়া ১ হাজার ৫২ হেক্টরজুড়ে কালাছড়া ও চাউতলীতে ৪৩৩ হেক্টর সংরক্ষিত বনভূমি।
অনন্য জীববৈচিত্র্যের কারণে দেশ-বিদেশে বিখ্যাত লাউয়াছড়ার রেঞ্জ সদর দপ্তর ও বিটে রয়েছেন মাত্র ১১ জন বনরক্ষী। এছাড়া কালাছড়ায় চারজন এবং চাউতলীতে রয়েছেন তিনজন বনকর্মী, যা বন রক্ষায় একেবারেই অপ্রতুল।
সীমিত লোকবলের জন্য বন পাহারায় যে অস্ত্র রয়েছে তাও একবারে হাতেগোনা। রেঞ্জে বরাদ্দ ১৭টি আগ্নেয়াস্ত্রের ১০টিই অচল। যে সাতটি অস্ত্র সচল আছে তাও আবার সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবে চালানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা এতই দুর্বল যে, বনের এক প্রান্তে কোনো ঘটনা ঘটলে বিট অফিস থেকে বনকর্মী যেতে যেতেই দুষ্কৃতকারীরা অনায়াসে পালিয়ে যেতে পারে।
বন বিভাগ জানায়, এই তিন বনবিটে প্রবেশের জন্য অনুমোদিত রাস্তা রয়েছে আটটি। তবে চোরাই রাস্তা রয়েছে প্রায় শতাধিক। যার কারণে প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনকর্মীদের এই বনাঞ্চল পাহারা দিতে হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এ কাজ আরো বেশি কঠিন হয়ে যায়। অধিকাংশ সময়ই বনদস্যুদের মোকাবিলা করতে গিয়ে পিছু হটতে হয় বনকর্মীদের। আবার বনকর্মীদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। আর বনদস্যুদের হামলায় বনকর্মীরা আহতের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
সর্বশেষ চলতি বছরের ২১ জুলাই চাউতলী বিটে বনদস্যুদের হামলায় বিট কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন গুরুতর আহত হন। ২০২১ সালে একই বিটে বনদস্যুদের হাত থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচান সহকারী বন সংরক্ষক ও রেঞ্জ কর্মকর্তাসহ তিনজন বনকর্মী। ২০১৫ সালে কালাছড়া বনবিটে বনদস্যুদের হামলায় বিট কর্মকর্তা মাহমুদের বাম হাতের রগ কেটে গিয়েছিল। ১৯৯১ সালে ওই বনবিটেই বনদস্যুরা বিট কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছিল।
এভাবে বনরক্ষীদের পরাভূত করে বনের আগর, সেগুন, গর্জন, গামার, মেনজিয়াম, নাগেশ্বর, কড়ইসহ দামি দামি গাছ কেটে সাবাড় করছে দুর্বৃত্তরা। আর এসব ঘটনায় মামলা করেই দায় সারছেন বন কর্মকর্তারা। জানা যায়, গত ১০ বছরে এই বন থেকে গাছ চুরির অভিযোগে ২৬টি মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামি ১৩৬ জন। এর মধ্যে কয়েকটি নামই বারবার ঘুরেফিরে এলেও মিলছে না কোনো সমাধান। বন বিভাগের দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে কালাছড়া বনবিটের পার্শ্ববর্তী ভেড়াছড়া গ্রামের মো. হোসেন আলীর নামেই রয়েছে ২৩টি মামলা। একই গ্রামের মুসলিম মিয়ার নামে ১৬টি, বাছিত মিয়ার ১৯টি, মকসুদ আলীর ২টি ও জসিম মিয়ার নামে বন আইনে ৭টি মামলা রয়েছে।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গলের রেঞ্জ কর্মকর্তা শহীদুল হক বলেন, ‘আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বন পাহারা দিই। সব সময় ভয়ের মধ্য থাকতে হয়। অনেক সময় বনদস্যুদের মার খেতে হয়। এ অবস্থায় আমরা কী করতে পারি?’
আর বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজার রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক শ্যামল কুমার মিত্র বলেন, জনবল স্বল্পতার বিষয়টি পুরোপুরি সত্য। ১৮ জনের বাহিনী দিয়ে এই ২ হাজার ৭৩৫ হেক্টর বন, বনভূমি, বনজ সম্পদ এবং বন্য প্রাণী রক্ষা করা সত্যিই দুরূহ কাজ।’
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ‘শুধু লাউয়াছড়াতেই ১৮ থেকে ২০ জন লোক দরকার। সেখানে রেসকিউ সেন্টার আছে, গেটে কাজ আছে, বন রক্ষা আছে, টহল আছে, মোবাইল পার্টি আছে। দেশের অন্যান্য বন থেকে আমাদের এখানে কাজ অনেক বেশি। কিন্তু লোকবল কম। বর্তমান জনবল কাঠোমোর এক-তৃতীয়াংশ পদ শূন্য রয়েছে এখনো। আমরা বারবার লোকবল বাড়ানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিচ্ছি।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা