আপডেট : ২০ মার্চ, ২০২৩ ১০:২৫
৬২ শতাংশ দুর্ঘটনা বেপরোয়া গতিতে
তৌফিকুল ইসলাম

৬২ শতাংশ দুর্ঘটনা বেপরোয়া গতিতে

গত রোববার মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে যাত্রীবাহী বাসটি খাদে পড়ে ১৯ জনের মৃত্যু হয়। ছবি: ফোকাস বাংলা

নিরাপদে ঘর থেকে বেরিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মরদেহ হয়ে ফিরছেন যাত্রীরা। সড়কে মৃত্যুর মিছিল যেন কোনোভাবেই থামছে না। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। মারা যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যানবাহনের বেপরোয়া গতি। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন অবাধে চলাচল। দক্ষ চালকের অভাব, নেই তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স। বাস্তবায়ন হয়নি চালকদের কর্মঘণ্টা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নির্বিকার বিআরটিএ।

গতকাল রোববার সকালে মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় ইমাদ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি খাদে পড়ে যায়। এতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। খুলনা থেকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী ইমাদ পরিবহনের বাসটির সামনের ডান পাশের চাকা এক্সপ্রেসওয়েতে ফেটে যায়। বাসটি তখন রেলিং ভেঙে পাশের খাদে পড়ে যায়। সে সময় বাসের গতিও ছিল বেশি। এক্সপেসওয়ের এ দুর্ঘটনায় ১৯ জন মারা গেছেন।

সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে, দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে এমনটিই উঠে এসেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, সারা দেশে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২১১ জন। ২০২০ সালে ৫ হাজার ৪৩১ জন এবং ২০২১ সালে ৬ হাজার ২৮৩ জন। ২০২২ সালে দেশে দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭১৩ জন নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিজুড়ে সারা দেশে ৪৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৮৭ জন এবং আহত হন ৭১২ জন। এর মধ্যে ১৮৩টি ঘটেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬১ দশমিক ৮০ শতাংশ।

এদিকে যেসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, সে বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণে বলছে, বাসের বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানোর কারণে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা।

এ ছাড়া রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও আইন অমান্য করা, ছোট যানবাহনের ব্যাপক বৃদ্ধি, সড়কে চাঁদাবাজি, রাস্তার পাশে হাটবাজার, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামানো, চালকের নিয়োগ ও কর্মঘণ্টা সুনির্দিষ্ট না থাকা এবং দেশব্যাপী নিরাপদ ও আধুনিক গণপরিবহন-ব্যবস্থার পরিবর্তে ইজিবাইক-ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশানির্ভর গণপরিবহন-ব্যবস্থার কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ দুটি। সড়কের ব্যবহারকারী সড়ক ব্যবহারের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানেন না। জানলেও তা মানতে চান না। আর দ্বিতীয় বিষয় যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণেও মারা যাচ্ছেন। এ অবস্থায় বিআরটিএ ও হাইওয়ে পুলিশের তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সড়কে আধুনিক প্রযুক্তি বসিয়ে মনিটরিং জোরদার করলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।’

মহাসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা আছে। তবে সড়ক পরিবহন আইনে বিভিন্ন শ্রেণির মহাসড়কে আলাদা গতিসীমা নির্ধারণ করার কথা বলা থাকলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।

আলাদা গতিসীমার বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ‘গাড়ির গতিসীমাটা কীভাবে নির্ধারণ হবে তার কোনো গাইডলাইন নেই। আমরা বুয়েটের এআরআইকে দায়িত্ব দিয়েছি স্প্রিড লিমিট গাইডলাইন তৈরি করার জন্য। কিন্তু এখনো সেটি হাতে পাইনি।’

নিরাপদ সড়কের প্রতিশ্রুতি এবং আইন শুধুই কি কাগজে-কলমে আবদ্ধ? ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়কের দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশে যখন আইন অনুমোদন করা হয়, তখন কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দেশের মানুষ। কিন্তু সেই আইনের এখনো নেই কোনো প্রয়োগ, পরিস্থিতির নেই কোনো অগ্রগতি। এখনো আগের মতোই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না ট্রাফিক আইন, কোন অদৃশ্য অপশক্তি রয়েছে অনিরাপদ সড়কের অন্তরালে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক শাহনেওয়াজ হাসানাত-ই-রাব্বি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘কেন দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটা এআরআইয়ের তরফ থেকে তদন্ত করা হবে। গতকালের ঘটনায় ওই গাড়িটির ফিটনেস ছিল না বলে আমরা জানতে পেরেছি। এই দুর্ঘটনায় মানুষ হতাহতের পরিমাণ বেশি ছিল। গাড়ির দৈর্ঘ্যের তুলনায় যদি বেশি যাত্রী থাকে, তাহলে বেশি মানুষ হতাহত হবে। গাড়ি, রাস্তা এবং ড্রাইভার এই তিনটির একটি কম্পোন্টের ত্রুটি থাকলে দুর্ঘটনা ঘটবে। দুর্ঘটনা রোধে আমরা টেকনিক্যাল কোনো হেল্প নিচ্ছি না। ‘স্পিড ক্যামেরা’ নামে একটা মেকানিজম আছে, সেটিও আমরা ব্যবহার করতে পারি। তা ছাড়া দুর্ঘটনা রোধে স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ের অভাব আছে। আইনের বাস্তবায়ন নেই। তাই এখন সময় এসেছে ট্রান্সপোর্টেশন ডিজাইনকে রিশিডিউল করার।’

এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘গতকালের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। যদি গাড়িটির ফিটনেস সনদ না থেকে থাকে, তাহলে ওই মালিকের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বিআরটিএ।’