মঞ্চ থেকে পরিচয় মহসিনা আক্তারের। এবার যাত্রা সিনেমাতে। মঞ্চ কিংবা সিনেমা- অভিনয় তার পছন্দের জায়গা। আজকের আলাপে সে কথাই উঠে এল।
সাক্ষাৎকার: শরীফ নাসরুল্লাহ
অভিনন্দন, সিনেমায় অভিষেক হলো
অনেক ধন্যবাদ।
কীভাবে সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন?
একেবারে অকস্মাৎ। জড়াতে চাইছিলাম কী চাইছিলাম না, তার মধ্য দিয়েই জড়িয়ে গিয়েছি। ২০২০-এ প্রথমে আমরা পেন্ডামিকের জন্য ঘর থেকে বেরই হতে পারলাম না। একটা সময় একটু শিথিল হলো। তখন আমি টাঙ্গাইলে আমার বাড়ি গিয়েছিলাম। ওখানে ফোনটা এল। আমি সত্যি বলতে এসব বিষয়ে খোঁজ রেখেছি, কাজ করতে চেয়েছি এমন না। আমি আমার কাজ নিয়ে ব্যস্তই ছিলাম। এ সময় মন্ত্রাস চলছিল এ অর্থে যে, নাটকটা আমরা শুরু করলাম। ১৭ মার্চ লকডাউনের কারণে নাটকটা বন্ধ হয়ে গেল। লকডাউনে আমি বাড়ি চলে গেলাম। যখন একটু শিথিল হলো যাতায়াত করা যায়, তখন আমি বাড়িতে ছিলাম। ওই সময় আমাকে বলল যে, এ রকম একটা চিন্তা করা হচ্ছে। এখনো বিষয়টা তারা জানে না, কী হবে। আমাকে একটা ছোট্ট স্টোরি বোর্ডের মতো পাঠানো হলো স্টোরি লাইনের। আমি এটা করতে চাই কি না। প্রথমে যিনি ফোন দিলেন একজন কাস্টিং ডিরেক্টর সুমন ভাই। তিনি বললেন, আপু আপনি যদি হ্যাঁ বলেন আমি পিপলু আর খানকে বলব। আমি বললাম, ঠিক আছে আমাকে নাম্বারটা দেন। আমিই কল করব। যেহেতু উনি সিনিয়র। ওনার সঙ্গে কখনো আমার দেখা হয়নি। সত্য কথা বলতে, তাকে আমি চিনি যখন তিনি ‘হাসিনা: আ ডটারস টেল’ বানান। এই সুবাদে তার নামটা ভালোভাবে জানি। আমার হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গেই একটা নতুন নাম্বার থেকে ফোন চলে এল। পিপলু আর খান বললেন, আমি একটা প্রথমে ছোট ফিল্ম ভাবছিলাম এখন বড় ভাবছি বা অন্যকিছু, আপনি আমাদের এখানে একবার আসেন। উনি ‘রিজওয়ান’ দেখেছেন, সেটা অনেক আগে। বললেন, আমি যদি একবার যাই। সত্যি বলতে ঢাকায় আসার তখন ইচ্ছাটা অত ছিল না। কারণ এক ছুটি কাটাতে আসছি। বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকব। আমি একটু গাঁইগুঁই করছিলাম। কিন্তু উনি গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। গেলাম এই শর্তে যে, যাব এরপর চলে আসব। ওই দিন একটা সময় ওনাদের সঙ্গে থেকে চলে আসব। অডিশন বলা যেতে পারে, এ রকম আর কী। পরে এলাম। এভাবেই জড়ালাম। ওনারা যা করতে বললেন করলাম। তখন তিনি বললেন, আমরা চাই আপনি এটা করেন।
সিনেমায় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা কী
সে সময় আসলে ঘরে থাকতে থাকতে আর অনলাইন রিহার্সেল করতে করতে জীবনের সব আশা সীমানায় চলে এসেছিল। চারদিকে সবকিছু খুলছে, শুধু থিয়েটার খুলছিল না। খোলার কথাও না, যেখানে মৌলিক চাহিদা সংকট, জীবন নিয়ে সংকট, সেখানে থিয়েটার নিয়ে ভাবার কথাও না। সে সময় আমরা প্রস্তুত হচ্ছিলাম যে, কবে ‘মন্ত্রাস’ করব। তখন এই প্রস্তাব আসা আর সশরীরে করা এটা একটা বিশাল গিফট আমার জন্য। যখন সবকিছু স্থবির, তখন আপনি সচলভাবে এটা করছেন এটা একটা বড় ব্যাপার না?
মঞ্চ না সিনেমা কোনটা চ্যালেঞ্জিং
দুইটাই চ্যালেঞ্জিং। কাজের জায়গায় পার্থক্য আছে অবশ্যই। তবে আমি অভিনেতা হিসেবে যখন জানি যে, আমার কাজটা এপারে। ক্যামেরা হোক কিংবা মঞ্চ, আমার মনোযোগ সবসময় দর্শকও না, ক্যামেরাও না। সে ক্ষেত্রে আমার ওখানটায় ঝামেলা হয়নি। সবকাজেই ঝুঁকি আছে যতক্ষণ কাজটা শেষ না হয়। এটাই ঝুঁকি যে, কাজটা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মনোযোগ ধরে রাখা যায় কি না। আমার সব শক্তি দিয়ে কাজটা শেষ করতে পারি কি না। এই চ্যালেঞ্জ সব ক্ষেত্রেই আছে। মঞ্চে রাখঢাকের কোনো উপায় নেই, সবার সামনে দাঁড়াতে হবে। সেই তুলনায় সিনেমা অনেক বেশি ডিরেক্টরের হাতে, পরিচালক চাইলে ছোট করতে পারেন। পা কাজ করছে না, দেখলাম না। মাথা কাজ করছে না, অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলাম। মঞ্চে এই সুযোগটা থাকে না। সেই দিক থেকে বলতে গেলে, মঞ্চ কঠিন জায়গা।
পর্দায় অভিনয় কী চলমান থাকবে?
অভিনয় সেটা যেকোনো মাধ্যম হোক সবজায়গায় করব। থিয়েটারের কাজে যদি কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পর্দায় চলে গেলে অনেকেই মঞ্চ থেকে হারিয়ে যান।
এটা আমার চয়েস। আপনি যদি মনে করেন মঞ্চ না করলে আপনার হবে না। আপনি তাহলে সেখানে সময় ব্যয় করবেন। এখানে খারাপ-ভালোর কিছু নেই। এটা একেক জনের চয়েস। আমার লক্ষ্যটাই মঞ্চ ছিল। এ বিষয়ে আরও জানতে চাই, করতে চাই, করছি। একটা একটা করে ছোট ছোট স্টেপ পার করছি। শেষ পর্যন্ত আপনার পছন্দ কোনটা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
‘বিস্ময়কর সবকিছু’ কেমন চলছে?
আমরা যেটা ভেবেছিলাম যে, এ রকম থিয়েটার মানুষ দেখবে কি না। প্রথম যে শো ছিল, সেখান থেকেই অভিজ্ঞতা আলাদা। এটা ভাবার দরকার নেই যে, দর্শক দেখবে কি না। দর্শককে নিয়ে এত ছোট চিন্তা করার দরকার নেই। দর্শক তারটা বুঝুক। যদি আপনি ভালো ও প্রয়োজনীয় কনটেন্ট দেন, দর্শক দেখবে। স্পর্ধার যত নাটক করেছি, সবটিতে সাড়া পেয়েছি। কিন্তু ‘বিস্ময়কর সবকিছু’ থেকে একেবারে আলাদা অভিজ্ঞতা পেয়েছি। এখন হাতে অনেক শো। এই যে মানুষ বসে থাকে। তাদের মনে হয় না যে, দেড় ঘণ্টা হয়ে গেছে। এই যে মানবিক জায়গাটা ভাগাভাগি করা। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই যে একটা ব্যক্তির মনে ছাপ ফেলে যাওয়া এটা দরকার।
পেশাদার নাট্যচর্চায় আপনারা মানে স্পর্ধা নিয়ে একটা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, এখন পর্যন্ত অভিজ্ঞতা কী?
অভিজ্ঞতা হলো, প্রথম হচ্ছে নাটকের একটা মান নির্ধারণ করা। নাটক দেখে দর্শক যেন তৃপ্ত হন। দ্বিতীয়, আমাদের চিন্তা আমরা গ্লোরিফাই করি, আগে যারা কাজ করতেন তারা রিকশা ভাড়া নিতেন না। এই গ্লোরিফাই করার প্রবণতা এখনো আছে। এর মানে হলো, আমি চাই আপনিও ফ্রি করেন। এই মানসিকতাগুলো বদলাতে হবে। আমি যদি ফ্রি করি, তাহলে আমাকে অন্য জায়গায় অর্থ জোগানের জন্য কাজ করতে হবে। তাহলে কাজে আমার মনোযোগ থাকবে না। থিয়েটারে সময় দিতে হবে, তাই আমার জীবনযাপনের জন্য সপ্তাহে সাত দিন সকাল-বিকেল কাজ করতে হয়। আমি তো মানুষ। আমি কতদিন এভাবে কাজ করতে পারব। সেই জায়গা থেকে আমাদের এই গ্লোরিফাই করার প্রবণতা বদলাতে হবে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা তৈরি করতে হবে থিয়েটারে। এ কারণে আমরা ছোট ছোট পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমাদের যে থিয়েটার দল সেখানে যদি আমরা নানা প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম রাখি। যে অর্থ দিয়ে আমরা থিয়েটার করতে পারি এবং আমরা যারা সারা দিন শ্রম দেব, তারা যেন মোটামুটি একটা আয় করে জীবন চালাতে পারি। এটা সবগুলোই নিরীক্ষা। এটা সম্ভব। কারণ মানুষ এখন শিখতে চায়, জানতে চায়।
তার মানে দাঁড়ায় সাধারণত আমরা যদি পেশাদার নাট্যচর্চার চিন্তা করি, তাহলে রূপটা দাঁড়ায় এ রকম যে, একটা শো করা হলো, সেখান থেকে যে টাকা এল, সেটাই মূল অর্থ। কিন্তু ব্যাপারটা যদি এ রকম হয় যে, শোয়ের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, কর্মশালা বা আরও অন্য কিছু থাকে। সেগুলোও অর্থের উৎস হতে পারে…
অবশ্যই। আপনি দেখেন, প্রশিক্ষণ কীভাবে আপনার থিয়েটারকে লাভবান করবে। আপনি প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তার মানে আপনি প্রশিক্ষিত মানুষ তৈরি করছেন। অন্যদিকে আপনার সংগঠনে টাকা আসছে। আপনি যে পেশায় আসতে চাচ্ছেন সেটার একটা পথ তৈরি হচ্ছে। আবার এই টাকায় আপনি নতুন একটি নাটকও তৈরি করতে পারছেন। আবার এই নাটক দিয়ে দর্শকের কাছ থেকেও টিকিটের টাকা পাচ্ছেন। এগুলো সম্পূরক ভাবতে হবে। পরিশ্রম হয়তো অনেক হবে। কিন্তু কিছু একটা করতে চাইলে কাজ তো করতেই হবে।
নতুন আরেকটি নাটক মঞ্চে আনার কথা বলেছিলেন, তার কোনো খবর আছে?
অনুবাদ এগিয়েছে। আশা করছি আগামী বছর মার্চের দিকে আমরা নিয়ে আসতে পারব।
দর্শকের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু বলার আছে?
অবশ্যই। আমিও দর্শকদের মতোই। কারণ আমি এখন পর্যন্ত একটি শটও দেখিনি। আমিও অপেক্ষায় আছি। সবাই ভালো কাজ দেখুক। সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে থাকুক। বাংলাদেশের সিনেমা আরও প্রসার হোক। দর্শককে পাশে থাকতে বলব।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা