‘সাংবাদিক আসছেন’ শুনে বিশ্রাম ছেড়ে ছুটে এলেন ষাটোর্ধ্ব শ্রমিক শফিকুল ইসলাম। বললেন, ‘কী আইন করল, যেটা মানা হচ্ছে না। আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ৫০ কেজি ওজনের বস্তার জায়গায় ৭০-৮০ কেজির বস্তা তুলতে হচ্ছে আমাদের। এত ওজন তুললে আমাদের শ্রমিকের একটা হাড় ভেঙে গেলে কে দেখবে? আমাদের জন্য আইন করে লাভটা কী হলো?’
সদর উপজেলার হিমাদ্রী, হাওলাদার, শাহী ও আমানতসহ কয়েকটি হিমাগারে গিয়ে এমন অভিযোগের কথা জানা গেল অনেক শ্রমিকের কাছেই। তারা বলছেন, নিয়ম ভেঙে হিমাগারগুলোতে আলুর বস্তা করা হচ্ছে সর্বনিম্ন ৬৫ কেজি থেকে সর্বোচ্চ ৮০ কেজি পর্যন্ত ওজনের। অথচ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এই বস্তার সর্বোচ্চ ওজন হওয়ার কথা ৫০ কেজি। হিমাগারগুলোর সামনে ‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা’ লেখা এ-সংক্রান্ত ব্যানারও বড় করে টাঙানো। কিন্তু সে নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
শ্রমিকরা বলছেন, জীবিকার তাগিদে এই ভারী বস্তাই বহন করতে হয় তাদের। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা পরিদর্শনে গেলে শ্রমিকরা এ বিষয়ে তাদের কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু এরপর কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো হিমাগার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দফারফা করে তারা চলে যান।
শহরের হিমাদ্রী হিমাগারের শ্রমিক রনি ইসলাম ও ইব্রাহিম জানান, রংপুর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ে কাজ করতে এসেছেন তারা। কিন্তু এখানকার চারটি হিমাগারে কাজ করে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের। আইন অমান্য করে তাদের দিয়ে ৭০-৮০ কেজির বস্তা টাঙানো হয়েছে।
হাওলাদার হিমাগারের ভেতরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শ্রমিক বলেন, ‘কিছুদিন আগে হিমাগারে কয়েকজন অফিসার আসছিলেন। আমাদের কথা শোনেননি। ঘুষ নিয়ে চলে গেছেন।’
৫০ কেজির বেশি ওজনের বস্তা তুললে অতিরিক্ত টাকা দেয়া হয় কি না, জানতে চাইলে শ্রমিকরা বলেন, অতিরিক্ত টাকা দেয়া হয় না। বরং প্রতিবাদ করলে বস্তার ওজন আরও বাড়িয়ে দেয়া কিংবা কাজ থেকে ছাঁটাইয়ের হুমকি দেয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি হাওলাদার হিমাগার পরিদর্শন করেছেন দিনাজপুর অঞ্চলের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক ফরহাদ হোসেন হাওলাদার বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের বেশ কয়েকটি হিমাগার পরিদর্শন করেছি। আলুর বস্তার ওজন বেশিও পাওয়া গেছে। আমরা হিমাগার মালিকদের সুপ্রিম কোর্টের আইন মানতে উৎসাহিত করছি। তাদের চিঠি দিয়েছি। শ্রমিকরা যে ঘুষের অভিযোগ করেছেন, তা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
সুপ্রিম কোর্টের আইন অমান্য করলে এই দপ্তরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা আছে কি না, জানতে চাইলে ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা শ্রম আইনে মামলা দিতে পারি।’ মামলা দেয়া হয়নি কেন- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা সতর্ক করেছি। পরবর্তী সময়ে মামলা দেয়া হবে।’
এদিকে আলু সংরক্ষণে হিমাগার মালিকদের গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের কারণেই শ্রমিকদের ওপর বোঝা বাড়ছে বলে অভিযোগ করলেন আলু ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ঠাকুরগাঁওয়ে এবার আলুর আবাদ কম হয়েছে। জেলার হিমাগারগুলোতে ভাড়া বেশি। তাই বেশির ভাগ আলু বাইরে চলে যাচ্ছে। আর বেশি মুনাফার লোভে হিমাগার মালিকরা সিন্ডিকেট করে নিজেরাই হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করছেন। তারাই শ্রমিকদের পিঠে বেশি ওজনের বস্তা চাপিয়ে দিচ্ছেন।’ সিন্ডিকেটের কারণে হিমাগারের আলু ভোক্তাদের বেশি দামে কিনতে হতে পারে বলেও আশঙ্কার কথা জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে একাধিক হিমাগার মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ঠাকুরগাঁও জেলা হিমাগার মালিক সমিকির সভাপতি মো. আবদুল্লাহ্ ও সাধারণ সম্পাদক সোহেল আরমানের মোবাইল নম্বরে কল করলেও তারা রিসিভ করেননি। মোবাইলে খুদে বার্তা দিয়েও পাওয়া যায়নি জবাব। সরাসরি কার্যালয়ে গিয়েও তাদের দেখা পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিচ্ছে। ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা না মানলে শাস্তি পেতে হবে। আইন বাস্তবায়নের জন্য হিমাগারগুলোতে অভিযান চালিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা