ম্যাচ তখন অন্তিম মুহূর্তে। আগের তিন সেটে ২-১-এ এগিয়ে কার্লোস আলকারাস। আর একটা ম্যাচ পয়েন্ট হলেই চতুর্থ সেটের খেলা খতম, ফাইনালেরও। শিরোপা জিতে যাবেন স্প্যানিয়ার্ড আলকারাস। সার্ভিস করলেন। এইস হতে দিলেন না ক্যাসপার রুড। অনেক চেষ্টা করে র্যাকেটে ছোঁয়া লাগালেও বল ধরে রাখতে পারলেন না কোর্টে। বল বাইরে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত হয়ে গেল, ৬-৪, ২-৬, ৭-৬ (৭-১), ৬-৩ গেমে জিতে গেলেন আলকারাস। হাতের র্যাকেট ছুঁড়ে দিয়ে ‘নাদাল’ হয়ে গেলেন!
ট্রফি হাতে নিয়ে সেটিতে কামড় দেয়া ট্রেডমার্ক উদ্যাপন রাফায়েল নাদালের। কিন্তু ট্রফি জেতার পর তাৎক্ষণিক যা করতেন, পরশু শিরোপা নিশ্চিত হওয়ার পর সেটাই করলেন আলকারাস। হাত-পা মেলে শুয়ে পড়লেন কোটের মেঝেতে। ঠিক নাদালের মতো!
টুর্নামেন্টজুড়েই দুর্দান্ত খেলেছেন আলকারাস। সেই ধারাবাহিকতা ছিল ফাইনালেও। কয়েক মাস ধরেই তো তার টেনিসে মুগ্ধতা বাড়ছে বিশ্বে, এবার যে আগ্রাসন আর স্ট্যামিনার প্রদর্শনী ফ্লাশিং মিডোর ফাইনালেও দেখালেন আলকারাস, তাতে তার মধ্যে কেউ ভবিষ্যতের নাদাল-ফেদেরারকে দেখে ফেললে হয়তো সেটি খুব বাড়াবাড়ি হবে না!
গ্র্যান্ড স্লামে এটাই ছিল আলকারাসের প্রথম ফাইনাল। কিন্তু খেলায় ‘প্রথম’-এর কোনো ছাপ ছিল না। শুরু থেকেই দাপট। কখনো দুরন্ত গতির সার্ভ, কখনো দর্শনীয় ফোরহ্যান্ড। কিংবা কখনো প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করে দিয়ে অবিশ্বাস্য ড্রপ শট! আলকারাসের বুদ্ধিদীপ্ত পারফরম্যান্সের সামনে প্রথম সেটে স্পষ্টত অনুজ্জ্বল নরওয়েজিয়ান ক্যাসপার রুড।
দ্বিতীয় সেটে রুড খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। প্রতিপক্ষকে কোর্টের কাছে টেনে পয়েন্ট জেতার কৌশল কাজেও লাগিয়েছেন। যা সাময়িক একটা চাপে ফেলে দিয়েছিল ১৯ বছর বয়সী আলকারাসকে। কয়েকটি ডাবল ফল্ট করে বসেছিলেন। সেটির সুযোগ নিয়ে সেট জিতে যান রুড।
পরের সেটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। যে যার জায়গা থেকে নিজের সেরাটা দিয়েছেন। দুটি সেট পয়েন্টে সেট জেতার কাছাকাছিও চলে গিয়েছিলেন রুড। কিন্তু দুই দফায় সেট পয়েন্ট বাঁচিয়ে আলকারাস তৃতীয় সেটটিকে নিয়ে যান টাইব্রেকারে। সেটি জিতে মানসিকভাবে এগিয়ে থেকেই শুরু করেন চতুর্থ সেট। সার্ভিস ব্রেক করে শুরুতেই রুডকে চাপে ফেলে দেন আলকারাস। সেই চাপ কাটিয়ে আর ফেরা সম্ভব হয়নি রুডের।
ম্যাচ জিতে ১৯৯০ সালে পিট সাম্প্রাসের পর সর্বকনিষ্ঠ ইউএস ওপেন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আবির্ভূত হন আলকারাস। হয়ে যান টেনিসের সর্বকনিষ্ঠ এক নাম্বারও। তার আগে এই রেকর্ডটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার লেইটন হিউইটের। ২০০১ সালে ২০ বছর ২৬৬ দিন বয়সে টেনিসের ‘নাম্বার ওয়ানে’র তকমা গায়ে লেগেছিল হিউইটের গায়ে। কাল ট্রফি জিতে র্যাঙ্কিংশীর্ষে ওঠার দিনে আলকারাসের বয়স? ১৯ বছর ১২৯ দিন। আলকারাসের স্বপ্ন, ‘আশা করি আরও অনেক বছর এখানে থাকব।’
হিউইটকে পেরিয়ে রেকর্ড গড়াতেই হিউইটের সঙ্গে তুলনা চলে আসে। যে সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্ব টেনিসে হিউইটের আবির্ভাব, সেটির বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারেননি তিনি। তবে ২টি গ্র্যান্ড স্লাম জেতা হিউইটের সঙ্গে কেউ আলকারাসকে মিলিয়ে দেখলে সেটি হবে ভুল। তার শক্তিনির্ভর খেলায় যে আগ্রাসন আর স্ট্যামিনা – তাতে লম্বা দৌড়ের ঘোড়া হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে এই তরুণ স্প্যানিয়ার্ডকে। স্বদেশিকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে সেটাই বলে দিলেন নাদাল, ‘আমি নিশ্চিত, তুমি আরও অনেক শিরোপা জিতবে।’
মেয়েদের টেনিসের সাবেক নাম্বার ওয়ান ট্রেসি অস্টিন বললেন, ‘তোমার শক্তি, কোর্টে নড়াচড়ার গতি, মানসিক শক্তি, (প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের) অস্ত্র এবং শারীরিক গঠন অসাধারণ। এ তো সবে শুরু।’
‘সবে শুরু’র সম্ভাবনা অস্ট্রিয়ার ডমিনিক থিম কিংবা রাশিয়ার দানিল মেদভেদেভের মতো আরও অনেকেরই। কিন্তু তাদের পারফরম্যান্সে না আছে ধারাবাহিকতা, না আছে প্রতিপক্ষকে দ্রুত হননের স্পৃহার সঙ্গে আগ্রাসী মানসিকতার মিশেল। জার্মানির আলেক্সান্দার জভেরভ, অস্ট্রেলিয়ার নিক কিরিওস, বুলগেরিয়ার গ্রিগর দিমিত্রভ, গ্রিসের স্টেফানোস সিৎসিপাসের খেলায়ও কিসের যেন একটা কমতি!
কিন্তু উড়ে এসে ইউএস ওপেনে জুড়ে বসে যেভাবে শিরোপা জিতে এক নাম্বার হয়ে গেলেন আলকারাস, প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের পরিবর্তিত কৌশলের সঙ্গে যে আগ্রাসনের গান শোনালেন, তার মধ্যেই ভবিষ্যতের টেনিস সুপারস্টারকে দেখতে না পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
.....................
জয়ের পর আলকারাস
‘এই দিনটার জন্যই টেনিস খেলতে শুরু করেছিলাম। তবে (শিরোপা জয়) এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। কয়েকটা সপ্তাহ স্বপ্নের মতো কাটল। ফাইনালে রুডের বিরুদ্ধে জেতা সহজ ছিল না। কারণ, এর আগেও ওর গ্র্যান্ড স্লামের ফাইনালে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু দিনটা ছিল আমার।’
হারের পর রুড
‘এই মুহূর্তে আলকারাস বিশ্বের সেরা টেনিস খেলোয়াড়। এটা ওর প্রাপ্য। টেনিসে ওর মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুব কম এসেছে। কোটের মধ্যে ওর গতি, খেলার বৈচিত্র্য আমাকে অবাক করেছে। ওর মধ্যে বেশ কয়েকজন বড় টেনিস তারকার গুণ রয়েছে। ওকে হারানো খুব কঠিন।’
.............................
## প্রথমবারের মতো ফাইনাল খেলা কার্লোস আলকারাসের এটিই প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা।
## ইউএস ওপেন জয়ের সঙ্গে টেনিসের এক নাম্বারও হয়ে গেছেন ১৯ বছর বয়সী আলকারাস। টেনিস ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ এক নাম্বার তিনিই।
## ২০০৫ সালে ফ্রেঞ্চ ওপেনজয়ী রাফায়েল নাদালের পর আলকারাসই সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ড স্লাম চ্যাম্পিয়ন।
## ১৯৯০ সালে পিট সাম্প্রাসের পর আলকারাসই ইউএস ওপেনের সর্বকনিষ্ঠ চ্যাম্পিয়ন।
## এই বছর পেশাদার সার্কিটে এটি আলকারাসের পঞ্চম ট্রফি। এর আগে তিনি জিতেছেন বার্সেলোনা, রিও, মাদ্রিদ ও মায়ামি মাস্টার্স।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা