গত জানুয়ারিতে মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে ১ লাখ ৫৯৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এ হিসাবে এক বছরে গড় লেনদেনের অঙ্ক দাঁড়ায় ১২ লাখ ৭ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ ৩৯ লাখ ৭১ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। শতাংশ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যত টাকা লেনদেন হয়, তা মোট জিডিপির ৩০ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
এই তথ্যই বলছে, দেশের অর্থনীতিতে কতটা অবদান রাখছে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস)। সরকারের নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ছোট-বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে একজন রিকশাচালকও অকপটে স্বীকার করবেন ‘এমএফএস ছাড়া আমার চলেই না!’
এক কথায় বলা যায়, ব্যাংকিংসেবায় বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন এনেছে মোবাইল ব্যাংকিং। সব লেনদেন এখন নিমিষেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এখন প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
কেবল টাকা পাঠানোই নয়, দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করেছে মোবাইল ব্যাংকিং। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল অর্থাৎ সেবামূল্য পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো অর্থাৎ প্রবাসী-আয় বা রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংসেবা এখন অন্যতম পছন্দের মাধ্যম। এই সেবার কারণে বেড়েছে নতুন কর্মসংস্থান। সবকিছু চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। সময় বেঁচেছে এবং ঝুঁকিও কমেছে।
মোবাইল ব্যাংকিং এখন শুধু টাকা-পয়সা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠানোর কাজেই সীমাবদ্ধ নেই। গ্রাহকদের জন্য প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সেবা নিয়ে আসছে তারা। এখন পর্যন্ত এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোনের এয়ার টাইম, ইন্স্যুরেন্সের টাকা, বিভিন্ন ধরনের বিল এবং পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে।
এত কিছু করেছে যে সেবা, দেশের অর্থনীতিতে প্রতি মুহূর্তে অবদান রেখে চলেছে যে সেবা- সেই সেবার ১২ বছর বা এক যুগ পূর্তি হচ্ছে আজ শুক্রবার। বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের ৩১ মার্চে। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে বিকাশ। পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যাংক এ সেবায় এসেছে। তবে খুব সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি মাই ক্যাশ, এম ক্যাশ, উপায়, শিওর ক্যাশসহ ১৫টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে। এর বাইরে ডাক বিভাগের সেবা নগদও দিচ্ছে এই সেবা। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, এমএফএস বাজারের ৭০ শতাংশের বেশি বিকাশের নিয়ন্ত্রণে, এর পরই রকেটের। বাকিটা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে।
ব্যাংকে না গিয়েও যে আর্থিক সেবা মিলবে, এমন আলোচনা ১২ বছর আগেও শুরু হয়নি। নব্বইয়ের দশকে যখন দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হয়, এই ফোনই যে একসময় অনেক আর্থিক লেনদেনের বড় মাধ্যম হয়ে উঠবে, এমন পূর্বাভাসও তখন কেউ দেয়নি। আর এক যুগ আগে যখন মোবাইল ব্যাংকিং শুরু হয়, তখন এই সেবার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তবে এখন বাস্তবতা হলো- বিকাশ, রকেট, নগদের মতো সেবা এখন প্রতি মুহূর্তের আর্থিক প্রয়োজনে অপরিহার্য অংশ। হাতের মুঠোফোনটিই এখন নগদ টাকার চাহিদা মেটাচ্ছে।
দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এখন এসব সেবার গ্রাহক। সারা দেশে এসব সেবায় নিবন্ধন হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি। যদিও সক্রিয় ব্যবহারকারীর হিসাব ৭ কোটির কিছুটা কম। ১২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের দেশে এই সংখ্যা নেহাত কম নয়।
এখন মোবাইল ব্যাংকিং শুধু টাকা পাঠানোর মাধ্যম না। এর ব্যবহার হচ্ছে সব ধরনের লেনদেনে। বিশেষ করে পরিষেবা বিল পরিশোধ, স্কুলের বেতন, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ ও অনুদান প্রদানের অন্যতম মাধ্যম। আর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টদের কাছেও যেতে হচ্ছে না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই টাকা আনা যাচ্ছে এসব হিসাবে। আবার এসব হিসাব থেকে ব্যাংকেও টাকা জমা শুরু হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড বা সঞ্চয়ী আমানতের কিস্তিও জমা দেয়া যাচ্ছে। এর ফলে একটি মুঠোফোনই যেন একেকজনের কাছে নিজের ব্যাংক হয়ে উঠেছে।
দৈনিক লেনদেন ৩৩০০ কোটি টাকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে ১ লাখ ৫৯৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, যা একক মাসের হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন। ৯ মাস আগে গত বছরের এপ্রিলে লেনদেন হয়েছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। গড় হিসাব বলছে, জানুয়ারিতে প্রতিদিন ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।
২০২২ সালের এপ্রিলে একক মাস হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়; লেনদেন হয় ১ লাখ ৭ হাজার ৪৬০ টাকা। মে মাসে না কমে ৭৬ হাজার ৩১২ কোটি টাকায় নেমে আসে। শতাংশ হিসাবে গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ লেনদেন বেড়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ৮৪ হাজার ৭৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি এখন এমএফএস। শহর থেকে গ্রামে বা গ্রাম থেকে শহরে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে এই সেবা দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সেবার ওপর মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে। ফলে বাড়ছে গ্রাহক ও লেনদেন।
বিকাশ, রকেট, এমক্যাশ, উপায়, নগদসহ দেশে বর্তমানে ১৫টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক সেবা দিচ্ছে। ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’ একই ধরনের সেবা দিচ্ছে। তবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির মোবাইল ব্যাংকিংসেবা এই হিসাবে এতদিন অন্তর্ভুক্ত ছিল না। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নগদের মাধ্যমে করা লেনদেনও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
এমএফএসের কর্মকর্তারা বলছেন, রমজান মাস চলছে, কয়েক দিন পর ঈদ উৎসব। রোজা ও ঈদ সামনে রেখে চলতি মার্চ ও এপ্রিলে লেনদেন আরও বাড়বে। কেন বাড়বে তার কারণ ব্যাখ্যা করে কর্মকর্তারা বলেন, রোজা ও ঈদে সব ধরনের পণ্যের বেচাকেনা বেড়ে যায়। যার প্রভাবে এমএফএসের মাধ্যমে লেনদেনও বেড়ে যায়।
গ্রাহকদের উৎসাহিত করতে সম্প্রতি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের সীমা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন এই মাধ্যম ব্যবহার করে গ্রাহকরা দিনে এজেন্ট থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং ব্যাংক হিসাব বা কার্ড থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা করতে পারেন।
মোবাইল ব্যাংকিংসেবা যেমন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের জন্য সুবিধা করে দিয়েছে, আবার গৃহকর্মী ও কম আয়ের মানুষের কাছে বড় আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। কারণ অনেক শিল্পপতিকে এখন আগের মতো মাস শেষে ব্যাংক থেকে বস্তায় টাকা ভরে কারখানায় নিতে হয় না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেতন-ভাতা চলে যায় শ্রমিকদের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কাশেম মো. শিরিন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক শুরু থেকেই প্রযুক্তিতে এগিয়ে। ২০০৪ সালে আমরাই প্রথম এটিএম সেবা চালু করি। তবে এটিএম সেবার মাধ্যমে সব শ্রেণির কাছে ব্যাংকিংসেবা পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তাই গ্রামের তথা প্রান্তিক মানুষের কাছে ব্যাংকিংসেবা পৌঁছে দিতে আমরা বিকল্প কিছু খুঁজছিলাম। তারই অংশ হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিংসেবা চালু করা হয়।’ এ সেবার নাম পরিবর্তন বিষয়ে ডাচ্-বাংলার এমডি বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংসেবার নিজস্ব ব্র্যান্ড বা পরিচয় দাঁড় করাতেই ২০১৬ সালে নাম পরিবর্তন করে রকেট করা হয়। তারপর তো ইতিহাস।
এমএফএস লেনদেন বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর দৈনিক বাংলাকে বলেন, সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী মোবাইল আর্থিক সেবা দেশের মানুষের দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেনকে প্রযুক্তিনির্ভর করে সহজ, নিরাপদ এবং তাৎক্ষণিক করেছে। সামগ্রিক অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মানের ওপর যার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল ইকোসিস্টেম শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্যাশলেস সমাজ নির্মাণেও এই খাত ভূমিকা রাখবে।
এক মাসে গ্রাহক বেড়েছে ৩১ লাখ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক মাসের ব্যবধানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক বেড়েছে ৩০ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৪। জানুয়ারি শেষে এমএফএসের নিবন্ধিত হিসাব দাঁড়িয়েছে ১৯ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ১৩৭টি। ডিসেম্বরে ছিল ১৯ কোটি ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৭৩টি। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৬৯ হাজার ১১২টি।
অন্যান্য সেবা
মোবাইল ব্যাংকিংসেবা এখন আর শুধু টাকা পাঠানোতেই সীমাবদ্ধ নেই, রাজধানী ও জেলা শহরে গাড়িচালক ও গৃহপরিচারিকাদের বেতনও এখন দেয়া হচ্ছে বিকাশ, রকেট ও নগদের মতো সেবামাধ্যম ব্যবহার করে। শ্রমজীবীরাও এখন এমএফএস সেবার মাধ্যমে গ্রামে টাকা পাঠাচ্ছেন।
প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা দি ইকোনমিস্ট ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংসেবায় শীর্ষ দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সপ্তম। প্রথম অবস্থানে ছিল কেনিয়া, তারপর তানজানিয়া, বোতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, ক্যামেরুন, ফিলিপাইন। এর পরের অবস্থানই ছিল বাংলাদেশের। এরপর অবশ্য মোবাইল ব্যাংকিংসেবায় শীর্ষ দেশগুলোর কোনো তালিকা দেশে-বিদেশে কোনো গণমাধ্যম বা গবেষণা সংস্থা প্রকাশ করেনি।
কয়েকটি পদ্ধতিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে অর্থ আনা-নেয়া করা যায়। তার মধ্যে এজেন্টের কাছে গিয়ে সুনির্দিষ্ট মোবাইল নম্বরে টাকা পাঠানো, এজেন্টের কাছে গিয়ে হিসাব খুলে সেখানে টাকা জমা করে নিজের মোবাইলে স্থিতি বা ব্যালান্স নিয়ে কাউকে পাঠানো এবং ব্যাংকে হিসাব খুলে সেখানে টাকা রেখে নিজের মোবাইলে স্থিতি নিয়ে লেনদেন সবচেয়ে জনপ্রিয়। স্থিতির বিপরীতে মাস শেষে মুনাফাও পাওয়া যায়।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা