আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১১:১৬
বন্যা-ঝড়ে বছরে ক্ষতি ১৩ হাজার কোটি টাকা

বন্যা-ঝড়ে বছরে ক্ষতি ১৩  হাজার কোটি টাকা

ছবি : দৈনিক বাংলা

বাংলাদেশের উপকূলে বন্যা-ঝড়ে বছরে ১৩ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্যে বন্যায় বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। এ অবস্থায় ক্রমবর্ধমান জলবায়ু ঝুঁকির সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন রক্ষার স্বার্থে উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করার জন্য বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে।

গত সোমবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশ: এনহেন্সিং কোস্টাল রিজিলিয়ান্স ইন চেঞ্জিং ক্লাইমেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা ঝুঁকির দিক উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ চলতি শতাব্দীতে দ্বিগুণ হতে পারে। জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে দেশের উপকূলীয় নদীগুলো বছরে ৫০ থেকে ৫০০ মিটার পর্যন্ত সরে যাচ্ছে। এ কারণে উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার ২৭ শতাংশ মানুষ বর্তমানে বন্যার ঝুঁকিতে আছে। চলতি শতাব্দীতে উপকূলীয় বন্যার এই ঝুঁকি বেড়ে ৩৫ শতাংশ হতে পারে।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে দেশের উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলোকে রক্ষায় সরকারের নেয়া বেশ কিছু উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩৫/১ নম্বর পোল্ডারে নদী খনন ও বাঁধ রক্ষার কাজ একসঙ্গে নেয়ায় উপকূলীয় এলাকা জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। একই সঙ্গে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, কক্সবাজারের হিমছড়ি, কলাতলী ও ইনানি সৈকত এলাকা রক্ষায় নেয়া উদ্যোগের কারণে ভাঙন বন্ধ হয়েছে।

উপকূলের ৬০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ম্যানগ্রোভ বনভূমি সৃজন করায় সাগরের ঢেউ থেকে বাঁধগুলোকে রক্ষা করা যাচ্ছে। বাঁধগুলোকে উঁচু করার জন্য বাড়তি খরচ লাগছে না।

প্রতিবেদনে বিশ্বের ৪৮টি বদ্বীপ এলাকার জলবায়ু ঝুঁকির একটি তুলনা টানা হয়েছে। এতে দেখা যায়, উপকূলীয় বন্যার ঝুঁকিতে থাকা বদ্বীপগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এই উপকূলীয় এলাকায় ১৩৭টি পোল্ডার অবকাঠামোগতভাবে ও সুন্দরবন প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়াল হিসেবে ভূমিকা রাখছে।

সুন্দরবনসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় ৪০০ প্রজাতির মৎস্যজাতীয় প্রাণী, ৫৩ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৩০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। বেঙ্গল টাইগার, কুমির, চিত্রা হরিণসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী এখানে আছে। শুধু সুন্দরবনেই বিশ্বজুড়ে বিপন্ন ১৭ প্রজাতির প্রাণী বাস করে।

প্রতিবেদনটির সহ-রচয়িতা স্বর্ণা কাজী। তিনি বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘উচ্চ বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে আমরা অতীত থেকে শিখতে পারি। উদ্ভাবনী সমাধানগুলো খুঁজে পেতে পারি।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের উপকূলীয় এলাকার জনসংখ্যা বেড়ে ৬ কোটি ১০ লাখে দাঁড়াবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের উপকূলের ৪ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যেতে পারে। এতে দেশের উপকূলীয় এলাকায় মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি আরও বাড়তে পারে।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার যে অভিযোজন পরিকল্পনা করেছে, তা বাস্তবায়নে ২০৫০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিবছর ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার দরকার হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপকূলে জলবায়ু সহিষ্ণুতায় বেশি বিনিয়োগ দরকার, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়নে সহায়তা করবে।

বিশ্বব্যাংকের ঊর্ধ্বতন দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও প্রতিবেদনটির সহ-রচয়িতা ইগনাসিও উরুশিয়া বলেন, ‘একটি মৌলিক শিক্ষা হলো, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান বা বনভূমি সৃষ্টি ও অবকাঠামোর মিশ্রণের হাইব্রিড সমাধানের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপকূলে প্রায় ছয় হাজার বহুমুখী আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। একেকটি কেন্দ্রে ৬০০ থেকে দেড় হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারে।

দেশের ৫০ শতাংশ উপকূলবাসীর ঘরবাড়ির দুই কিলোমিটারের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার ও ভোলায় আধা কিলোমিটারের মধ্যে। আর নোয়াখালী, বরিশাল ও নোয়াখালীতে চার কিলোমিটারের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র আছে। ২০২৫ সালের মধ্যে এই আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা সাত হাজারে উন্নীত করতে হবে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপকূলের মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ উন্নত ঘরে বসবাস করে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম মানুষ উন্নত ঘরে থাকে বরগুনায় ৭ শতাংশ। আর সবচেয়ে বেশি ভালো ঘরে থাকে খুলনায়, ৪২ শতাংশ। দেশের উপকূলবাসীর জীবিকা মূলত ফসল চাষ ও মাছধরাকেন্দ্রিক। সেখানে শিল্পকারখানার পরিমাণ খুবই কম। উপকূলীয় ১৯টি জেলার মধ্যে ১৫টির অধিবাসীদের গড় আয় জাতীয় গড় আয়ের চেয়ে কম।

বাংলাদেশ এবং ভুটানের জন্য বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ড্যান্ডান চেন বলেছেন, ‘উপকূলীয় স্থিতিস্থাপকতা একটি স্থির লক্ষ্য নয়, যা পূরণ করার জন্য বরং পরিবর্তনশীল অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার এবং উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর মধ্যে সমন্বয় খুঁজে পাওয়ার একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া ‘ চেন আরও বলেন, ‘গত পঞ্চাশ বছর ধরে বিশ্বব্যাংক জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তুলতে এবং দুর্যোগ-ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। আজ দেশটি দুর্যোগের প্রস্তুতি এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা উন্নত করার ক্ষেত্রে মূল্যবান অভিজ্ঞতা শেয়ার করে এবং অন্যান্য জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য একটি অনুপ্রেরণা।’

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, উপকূলীয় স্থিতিস্থাপকতায় আরও বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত সুবিধার একটি বিন্যাস তৈরি করবে।