দুই বছর ধরে বঙ্গবাজারে ব্যবসা শুরু করেছিলেন রাশেদ ইসলাম নামে ২৭ বছরের এক তরুণ। মহানগর মার্কেটের নিচতলায় ও দ্বিতীয় তলায় দুটি দোকান ছিল তার। ভাড়ায় নেয়া দোকান। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের বাসিন্দা রাশেদ বাড়ির জমি বিক্রি করে দোকান দুটি ভাড়া নিয়েছিলেন। ‘সিকিউরিটি মানি’ হিসেবে দোকান মালিককেও দিতে হয়েছিল অনেক টাকা। নারী-পুরুষ-শিশু সবার পোশাকই বিক্রি করতেন তিনি। দুই দোকান মিলিয়ে তার প্রায় ২০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। ক্যাশ বাক্সেও প্রায় ১ লাখ টাকা ছিল। আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বঙ্গবাজারের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাশেদ তার দুটি দোকানের অবস্থান দেখাচ্ছিলেন। সেখানে একটি স্টিলের কলাপসিপাবল গেট দাঁড়িয়ে আছে শুধু। আর দোতলার দোকানটি যেখানে ছিল, সেখানে কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট আর নেই। ছলছল চোখে রাশেদ বলছিলেন, ‘আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছি। ঈদের জন্য ধারদেনা করে মাল তুলেছিলাম। সব শেষ হয়ে গেছে।’
হাতে দোকানের এক গোছা চাবি দেখিয়ে বললেন, ‘এই চাবির গোছাটাই আছে, আর কিছু নাই। এখন সরকারই আমাদের ভরসা। সরকার যদি কিছু একটা করে দেয় তাহলে নতুন করে আবার শুরু করতে পারব। তা না হলে পথে বসতে হবে।’
রাশেদের মতো একই অবস্থা বঙ্গবাজারের প্রায় সব ব্যবসায়ীর। বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই কিছুই বের করতে পারেননি। আগের রাতে দোকান বন্ধ করে চাবির গোছাটা নিয়ে গেছেন বাসায়। সেই চাবির গোছাটাই এখন তাদের সম্বল, আর কিছুই নেই।
একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বঙ্গবাজারের ছোট-বড় বেশির ভাগ দোকানদার প্রতিদিনের বিক্রির টাকা দোকানের ক্যাশ বাক্সেই রেখে যান। প্রতিদিনই মাল কিনতে হয় তাদের। লেনদেন বেশির ভাগেই হয় নগদে। বড় ব্যবসায়ীরা শুধু ব্যাংকে লেনদেন করেন। এ কারণে ব্যবসায়ীদের মালামালের সঙ্গে দিনের বিক্রির টাকাও পুড়ে গেছে আগুনে। কবে আবার ব্যবসা শুরু করতে পারবেন সেই অনিশ্চয়তা আছেই, পাওনাদার আর দেনাদারদের হিসাবের খাতাগুলোও নেই। এগুলো এখন কীভাবে সমাধান করবেন, তাও ভেবে পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।
নাজমুল নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘বছরখানেক আগে ২৭ লাখ টাকা দিয়ে একটা দোকান কিনছিলাম। এখন সেই দোকান ফেরত পাব কি না সেই শঙ্কায় আছি।’ তার হাতেও দোকানের চাবি। চাবি ছাড়া আর কিছুই নেই তার সঙ্গে।
নাজমুল জানান, মহানগর মার্কেটের ৭৮০, ৭৮১, ৭৮২ নম্বর দোকান ছিল তাদের দুই ভাইয়ের। দোকানের নাম জেবি এন্টারপ্রাইজ ১ ও ২। গুলিস্তান মার্কেটের ২৬০৩ নম্বর দোকান ছিল জেবি এন্টারপ্রাইজ-৩ নামে। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চারটি দোকানে সব মিলিয়ে প্রায় ৭০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। নগদ টাকা ছিল প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। আগুনের খবর শুনে ওয়ারীর বাসা থেকে রিকশা নিয়ে এসেছিলেন সাড়ে ৬টার দিকে, কিন্তু কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। রক্ষা করার উপায়ও ছিল না।
শরীয়তপুরের বাসিন্দা নাজমুল বলছিলেন, ‘দুইটা বছর গেছে করোনায়। তখন অত ব্যবসা হয় নাই। এবার কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। ব্যবসা হবে বলে চারটি দোকানেই ভরা মালামাল তুলেছিলাম। সাধারণত শবে বরাতের রাত থেকে ঈদের বেচাকেনা শুরু হয়। এবার একটু দেরি হয়েছে। রোজার শুরু থেকেই ক্রেতা বাড়ছিল। কিন্তু এক আগুনে সব শেষ হয়ে গেল।’
অন্য সবার মতো রাশেদ ও নাজমুল দুজনের দোকানেই পাঁচ-ছয়জন করে কর্মচারী। মাসের শুরু হয়েছে, এখনো কারও বেতন দেননি। নিজেদের দোকান ভাড়া, বাসা ভাড়াও দেননি। ১০ তারিখে সব দেয়ার কথা। কিন্তু আগুনে পুড়ে সবকিছু এমনভাবে শেষ হয়ে গেছে যে, এখন ধার করে প্রতিদিনের খরচ চালাতে হচ্ছে। কপালে এমন দুর্ভোগ আসতে পারে- এমন কল্পনাও করেননি কখনো।
রাশেদ বলেন, ‘পাওনাদাররা তো দুই-চার দিন পর থেকে টাকা চাওয়া শুরু করবেন। কোত্থেকে এত টাকা দেব। নিজেইবা কীভাবে চলব। দ্রুত দোকান খুললে হয়তো ধারদেনা করে আবার শুরু করতে পারতাম। কিন্তু কবে শুরু করতে পারব তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। চোখে অন্ধকার দেখা ছাড়া আর কিছুই দেখছি না।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা