আপডেট : ৮ এপ্রিল, ২০২৩ ১২:১২
‘সবচেয়ে সুরক্ষিত’ সঞ্চয়ের জায়গাই দুর্নীতির আখড়া
বাণিজ্য ডেস্ক, দৈনিক বাংলা

‘সবচেয়ে সুরক্ষিত’ সঞ্চয়ের জায়গাই দুর্নীতির আখড়া

সুইস ব্যাংক

মধ্য ইউরোপে আল্পস পর্বতের কোলজুড়ে ছোট্ট দেশ সুইজারল্যান্ড। ভ্রমণপিপাসুদের বরাবরের আকর্ষণ এই দেশের বরফে ঢাকা মনোরম পরিবেশ। তবে শুধু পর্যটকদের নয়, সুইজারল্যান্ড আকর্ষণ করে ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারীদেরও। সুইজারল্যান্ডের যেকোনো ব্যাংক সুইস ব্যাংক নামে পরিচিত। এই ব্যাংকই অর্থ সঞ্চয়ের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। বহু মানুষ সুইস ব্যাংকে পরিশ্রমের অর্থ রেখে নিশ্চিন্ত বোধ করেন। সুইস ব্যাংকের জনপ্রিয়তা মূলত এটির অর্থ সংরক্ষণ নীতির জন্য। গ্রাহকের পরিচয় গোপন রাখে সুইস ব্যাংক। ফলে কে এই ব্যাংকে কত টাকা রাখছেন, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। জনপ্রিয়তার এই চাবিকাঠিই সুইস ব্যাংককে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে। গ্রাহকের পরিচয় প্রকাশের নিয়ম না থাকায় কালো টাকা রাখার জন্য এই ব্যাংককেই বেছে নেয় দুষ্কৃতকারী, অপরাধী ও অসাধু ব্যবসায়ীরা।

সুইজারল্যান্ডে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ইতিহাস অনেক পুরোনো। অষ্টাদশ শতক থেকেই এই দেশের ব্যাংকগুলোতে টাকা সঞ্চয়কারীদের জন্য নিয়মাবলি নির্দিষ্ট করে আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে জেনেভা কর্তৃপক্ষ ব্যাংকিংব্যবস্থা-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেন। তাতে বলা হয়, ব্যাংকে টাকা জমা রাখা গ্রাহকদের পরিচয়সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে সুরক্ষিত রাখবেন।

রাজনৈতিক দিক থেকে সুইজারল্যান্ড বরাবরই শান্তিপ্রিয় এবং নিরপেক্ষ। ইউরোপ যখন বিশ্বযুদ্ধের নেশায় উন্মত্ত, তখনো জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ইটালির মধ্যবর্তী এই দেশ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছিল। এই দেশেই তাই সম্পদ সংরক্ষণে আগ্রহী হয়েছিলেন ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের উচ্চবিত্ত ধনী সম্প্রদায়।

তারপর থেকে ইউরোপে যতবার ব্যাংকসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন বা সংশোধন করা হয়েছে, গ্রাহকদের পরিচয় গোপন, সুরক্ষাই ছিল কর্তৃপক্ষের প্রাধান্য। ১৯৩৪ সালে ব্যাংকিং আইনে আরও কড়াকড়ি করে সুইজারল্যান্ড।

১৯৩৪ সালে আইন প্রণয়ন করে বলা হয়, সুইস ব্যাংকে গ্রাহকদের পরিচয় বা সেই সংক্রান্ত অন্য যেকোনো তথ্য বিদেশি সরকারের সঙ্গে ভাগ করে নেয়া আইনত অপরাধ। বিদেশি সরকার শুধু নয়, কারও কাছেই গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।

সুইস ব্যাংকিং অ্যাক্টের ৪৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, গ্রাহকের অনুমতি ছাড়া তার পরিচয় এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি কারও কাছে প্রকাশ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকি সুইস সরকার চাইলেও সেই তথ্য জানতে পারবে না। তথ্য প্রকাশ করা হলে অভিযুক্তের পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

সুইস ব্যাংকের এই গোপনীয়তার নীতিই তাকে বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। গ্রাহকের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় নেই এখানে। ফলে কর ফাঁকি দেয়ার সেরা ঠিকানা এই সুইস ব্যাংক।

যারা বিপথে কালো টাকা হস্তগত করেন, কর ফাঁকি দিয়ে যারা কালো টাকার অস্তিত্ব গোপন করতে চান, তারা দলে দলে সুইস ব্যাংকেই বেছে নেন টাকা রাখার জন্য। সুইস ব্যাংকের প্রচ্ছন্ন মদতে ফুলেফেঁপে ওঠে দুর্নীতি। শুধু সুইজারল্যান্ড নয়, অন্য দেশ থেকেই ধনী ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিরা সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন। নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশের ব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য অবশ্যই কর ফাঁকি।

২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকের নীতিতে খানিক পরিবর্তন আসে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সহায়তাবিষয়ক সংগঠনের আওতায় ৫০টির বেশি দেশ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। যার মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে করদাতাদের আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়ে সম্মত হয়। গ্রাহকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য প্রকাশ করতে সে সময় রাজি হয়েছিল সুইজারল্যান্ডও। যে কারণে তাদের ব্যাংকিং নীতিতে পরিবর্তন আসে।

২০২২ সালের শুরুর দিকে সুইজারল্যান্ডের ক্রেডিট সুসি ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। প্রকাশ্যে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, ওই ব্যাংকের গ্রাহকদের একাংশ আর্থিক তছরুপ, মাদক পাচারের মতো গুরুতর অপরাধমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দুই দশকের মধ্যে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ অর্থ জমা হয়েছে ২০২১ সালে। এই বছর শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য ৯৫ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। গত ২০২০ সালে সেখানকার ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে।