মার্চ মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী সোয়া কোটি প্রবাসী ২০১ কোটি ৭৭ লাখ (২.০২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক গত সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর গত বছরের মার্চের চেয়ে বেশি সাড়ে ৮ শতাংশ।
বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্সের এই উল্লম্ফনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত সাতটি স্বাধীন রাজ্যের ফেডারেশন-সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটি থেকে গত মার্চ মাসে ৩০ কোটি ৭৬ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। একক দেশ হিসেবে যা সবচেয়ে বেশি। এই মাসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ৩০ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। আর সৌদি আরব থেকে এসেছে ২৮ কোটি ৩ লাখ ডলার।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৯ মাসের (জুলাই-মার্চ) হিসাবে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২২০ কোটি (২.২০ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে, যা গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন) চেয়েও ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। দেশটি থেকে রেমিট্যান্সের বর্তমান ইতিবাচক ধারা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশার কথা শুনিয়ে জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, অর্থবছর শেষে আমিরাত থেকে আসা রেমিট্যান্সের অঙ্ক ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
শুধু মার্চ মাস নয়, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারি এবং গত বছরের মে মাসেও সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে আরব আমিরাত থেকে। জানুয়ারিতে আমিরাত থেকে ৩৪ কোটি ৭৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল এক মাসের হিসাবে দেশটি থেকে আসা সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই আমিরাত থেকে এক মাসে এত রেমিট্যান্স দেশে আসেনি। ওই মাসে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল যথাক্রমে ৩০ কোটি ৮৭ লাখ ও ২৯ কোটি ৮৭ লাখ ডলার।
চলতি বছরের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতেও এই তিন দেশ থেকে প্রায় সমান রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এর আগে ২০২২ সালের মে মাসে আরব আমিরাত থেকে ৩৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল। ওই মাসে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল ৩২ কোটি ৯৯ লাখ ও ২৭ কোটি ৩২ লাখ ডলার।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে বরাবরই সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসীরা মোট ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। তার মধ্যে সৌদি আরব থেকে এসেছিল ৫৭২ কোটি ১৪ লাখ (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল যুক্তরাষ্ট্র ৩ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। আর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিল ২ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার।
কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্সপ্রবাহ ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমে যায়; আসে ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার। সব দেশ থেকেই কম আসে অর্থনীতির এই সূচক। গত অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে ৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার দেশে আসে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছিল ২ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে আসে ২ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার।
তবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রবাসী আয়ে ইতিবাচক ধারা লক্ষ করা যায়। প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। মাঝে কয়েক মাস ধীরগতি থাকলেও সবশেষ গত মার্চ মাসে ফের ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। সব মিলিয়ে ৯ মাসের (জুলাই-মার্চ) হিসাবে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু অবাক করা তথ্য হচ্ছে- এই ৯ মাসে রেমিট্যান্সে সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। জুলাই-মার্চ সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বাংলাদেশে এসেছে। সৌদি আরব থেকে এসেছে ২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে ১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরের পুরো সময়ে আরব আমিরাত থেকে যে রেমিট্যান্স এসেছিল, চলতি অর্থবছরের ৯ মাসেই তার থেকে বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। এমনকি ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্সের যে জোয়ার ছিল, সেই বছরের প্রায় সমান রেমিট্যান্স এসেছে জুলাই-মার্চ সময়ে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী ১৯৭৬ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য যত শ্রমিক বিদেশে গেছেন, তার প্রায় ২০ শতাংশই গেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ২০১১ থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটিতে কাজের জন্য গেছেন প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক। ১৯৭৬ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গেছেন প্রায় ২৮ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক।
বিএমইটির হিসাবে, বাংলাদেশের শীর্ষ শ্রমবাজার সৌদি আরব। ১৯৭৬ সাল থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশই গেছে দেশটিতে। সংখ্যার দিক থেকে যা ৫৫ লাখের বেশি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। তাদের বড় অংশই রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে; কাজ করছেন বিভিন্ন শ্রমঘন পেশায়।
আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স বাড়ার কারণ জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘২০২২ সালে আমরা প্রায় ১১ লাখ লোককে কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছি। এই সংখ্যা অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি গেছেন আরব আমিরাতে। তারই ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্সপ্রবাহে। গত বছর যারা গেছেন, তারা এখন পুরোদমে কাজ করছেন এবং বেতন-ভাতা পেয়ে দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন বেশ চড়া। তাই তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশ আমিরাতের অর্থনীতিতেও চাঙাভাব বিরাজ করছে। সেখানকার শ্রমিক ভালো বেতন পাচ্ছেন। বেশি টাকা দেশে পাঠাতে পারছেন। সে কারণেই দেশটি থেকে বেশি রেমিট্যান্স আসছে।’
অর্থনীতির গবেষক সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম অনেক বেশি হওয়ায় একটু বেশি টাকা পাওয়ার আসায় মাঝে প্রবাসীরা অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অবৈধ হুন্ডির বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নেয়ায় প্রবাসীরা এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাচ্ছেন। সে কারণে দেশে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে। আর আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স বাড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, গত বছর অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক আমিরাতে বেশি লোক কাজের জন্য গেছেন। তারা এখন দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন।’
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাতটি রাজ্যের নাম হলো আবুধাবি, আজমান, দুবাই, ফুজাইরা, রাস আল খাইমা, আশ শারজাহ এবং উম্ম আল কোয়াইন। প্রতিটি রাজ্যের শাসনব্যবস্থা বংশগত রাজতন্ত্র এবং প্রতিটি রাজ্যের শাসনকর্তার পদবি হলো ‘আমির’। ফেডারেশনের নিয়ম অনুযায়ী আবুধাবির আমির সংযুক্ত আরব আমিরাতের খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একইভাবে দুবাইয়ের আমির হলেন প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধান। আবুধাবি শহর এই ফেডারেশনের রাজধানী। আবুধাবি ফেডারেশনের বৃহত্তম রাজ্য, যা মোট ভূমির তিন-চতুর্থাংশের বেশি অংশ নিয়ে গঠিত। দুবাই এই ফেডারেশনের বৃহত্তম ও জনবহুল শহর এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র।
আরব আমিরাত মূলত পাথুরে মরুভূমি, উপকূলীয় সমভূমি এবং পাহাড়ের মিশ্র পরিবেশে গঠিত দেশ। তবে দেশটির অধিকাংশ অঞ্চল মরুভূমি। তেলশিল্পের কারণে এখানকার অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী এবং জীবনযাত্রার মানের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর একটি। ফেডারেশনের অর্থনীতি প্রধানত আবুধাবির উৎপাদিত তেলের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে দুবাইয়ের অর্থনীতি ব্যবসা ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি আরব আমিরাত তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেশটি পর্যটনশিল্প এবং পণ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিচ্ছে।
আরব আমিরাতে আছে অনেক দৃষ্টিনন্দন ও গগনচুম্বী ভবন। বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ অট্টালিকা ‘বুর্জ খলিফা’ দুবাই শহরেই। প্রশস্ত রাস্তা ও সুপার হাইওয়ের জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাতি আছে আমিরাতের। পারস্য উপসাগরের কূলে ৫ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ।
পামগাছের মতো দেখতে এই দ্বীপপুঞ্জের নাম ‘পাম জুমেইরা’। এটা পৃথিবীর বৃহত্তম কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জ। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যাত্রীর সংখ্যা বিবেচনায় পৃথিবীর চতুর্থ ব্যস্ততম বিমানবন্দর।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা