আপডেট : ১০ এপ্রিল, ২০২৩ ০৮:৩১
সাতক্ষীরায় স্বর্ণ ডাকাতিতে স্থানীয় পুলিশ
নুরুজ্জামান লাবু

সাতক্ষীরায় স্বর্ণ ডাকাতিতে স্থানীয় পুলিশ

ঢাকা থেকে প্রাইভেট কারে দুই কেজি স্বর্ণ নিয়ে সাতক্ষীরায় এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন চালক সাইফুল। সাতক্ষীরার চুকনগর থেকে সেই গাড়িটি অনুসরণ করে দুর্বৃত্তরা। পাটকেলঘাটা থানার শাকদহ ব্রিজের কাছে গাড়িটি থামানো হয়। এরপর চালককে চোখ বেঁধে তোলা হয় একটি মাইক্রোবাসে। আর তার গাড়িটি পড়ে থাকে সাতক্ষীরা বাইপাসে।

২৮ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে চালক সাইফুলকে হাত-পা বেঁধে মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে দেয়া হয় বাইপাসের জামতলায়। স্থানীয় এক দোকানদারের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিষয়টি স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও গাড়ির মালিককে জানান চালক। মালিক ভোরে গিয়ে চালক ও গাড়ি উদ্ধার করেন।

সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হবে পেশাদার কোনো ডাকাত দল এই স্বর্ণ লুট করেছে। কিন্তু অনুসন্ধান বলছে, স্বর্ণের বারসহ গাড়িটি নেয়া হয়েছিল সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ লাইনসের ভেতর, জেলা গোয়েন্দা কার্যালয়ে। আর স্বর্ণ লুটের সঙ্গে জড়িত খোদ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। বিষয়টি জানতেন জেলা পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামানও। তবে তিনি গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যদের চিহ্নিত করে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেননি। উল্টো সেই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেই ডাকাতির মামলা দিয়েছে পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। শেখ সফিউল্লাহ মনি নামে সেই ব্যবসায়ী এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

গত ২ এপ্রিল ব্যবসায়ী শেখ সফিউল্লাহ পুলিশ সদর দপ্তরের আইজিপি কমপ্লেইন সেলে ঘটনা উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ করেন। পুলিশ সদর দপ্তরে দেয়া অভিযোগ এবং ব্যবসায়ীর ভাষ্য নিয়ে অনুসন্ধান করেছে দৈনিক বাংলা।

প্রাইভেট কারের চালক সাইফুল দৈনিক বাংলাকে বলেন, “শাকদহ ব্রিজের ওখানে দুইটা ট্রাক দেখে আমি গাড়িটা থামাই। হঠাৎ চোখে টর্চলাইট ধরে আমাকে কয়েকজন টেনে গাড়ি থেকে নামায়। এরপর হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ও চোখ বেঁধে কয়েকজন আমাকে একটি মাইক্রোবাসে তোলে। গাড়ির ভেতর মারধর করা হয় আর ‘মাল’ কোথায় তা জানতে চায়। আমি যতই বলি যে আমি কিছু জানি না, তারপরও তারা মারতে থাকে। দুবার গাড়ি থেকে নামিয়ে মাটিতে বসিয়ে গুলি করার ভয়ও দেখায়। প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর আমাকে রাস্তার পাশে নামিয়ে দেয়।”

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা মূল্যমানের দুই কেজি স্বর্ণের বার বহনকারী টয়োটা ব্র্যান্ডের প্রাইভেট কারটি (ঢাকা মেট্রো-গ-২৫-৯৯৩৩) গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে সাতক্ষীরার উদ্দেশে রওনা দেয়। গাড়িতে প্রহরী অ্যাপের একটি জিপিএস লাগানো ছিল। গাড়িটি ওই দিন দিবাগত রাত সোয়া ১টার দিকে খুলনা থেকে সাতক্ষীরা সড়কের শাকদহ ব্রিজ এলাকায় পৌঁছে। সেখানে বালুর ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়িটি থামানো হয়। জিপিএসের তথ্য বলছে, ১১ মিনিটের মাথায় গাড়িটি গিয়ে থামে ১১ কিলোমিটার দূরে জেলা পুলিশ লাইনসের ভেতরে। সেখানে প্রায় ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট গাড়িটির অবস্থানের তথ্য পাওয়া যায়। পরে রাত ৩টা ৫০ মিনিটে গাড়িটি সেখান থেকে বের করে সাতক্ষীরা বাইপাস এলাকায় ফেলে রাখা হয়।

সরেজমিন সাতক্ষীরায় দেখা গেছে, খুলনা থেকে সাতক্ষীরায় যাওয়ার পথে শাকদহ এলাকা। শাকদহের পুরোনো সেতুর পাশেই নতুন সেতুর কাজ চলছে। সেখানে বালু আনা-নেয়াসহ সেতুর কাজে অনেক গাড়ি দেখা গেছে। এই প্রতিবেদকও একটি প্রাইভেট কারে শাকদহ সেতু থেকে পুলিশ লাইনস পর্যন্ত গিয়ে প্রহরী অ্যাপের মতো সমান দূরত্বের বিষয়টির সত্যতা পেয়েছেন।

সরেজমিনে পুলিশ লাইনসে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের নির্মাণকাজ চলার কারণে পুলিশ লাইনসের ভেতরেই পুনাক ভবনকে পুলিশ সুপারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একদিকে পুলিশ লাইনস স্কুল ও মসজিদ, আরেকদিকে জেলা গোয়েন্দা কার্যালয় (ডিবি)। ভেতরে প্রবেশে কড়াকড়ি। এই প্রতিবেদক রসুলপুরের গেট দিয়ে প্রবেশ করে প্রধান ফটক দিয়ে বের হতে চাইলে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা বাধা দেন। রাতে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ বলেও জানান নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা।

প্রহরী অ্যাপের মাধ্যমে গাড়িটি যে পুলিশ লাইনস এলাকায় নেয়ার তথ্য জানা গেছে, তার সত্যতা পাওয়া গেছে একটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজেও। সাতক্ষীরা-যশোর সড়কের পাশে অবস্থিত জেলা পুলিশ লাইনসের প্রধান ফটকের বিপরীতে ফেমাস ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি রড-সিমেন্টের দোকান আছে। ওই দোকানে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার একটিতে সড়কের চলাচল দেখা যায়। সেই সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে, প্রহরী অ্যাপের সময়ের সঙ্গে মিল রেখে একই সময়ে পুলিশ লাইনসের ভেতর থেকে প্রথমে দুটি মোটরসাইকেল ও পেছনে একটি প্রাইভেট কার বেরিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ লাইনসের ভেতর থেকে বের হয়ে সড়কে ওঠার পর প্রাইভেট কারটির হেডলাইট জ্বালানো হয়।

ধারণা করা হচ্ছে, প্রাইভেট কারের সামনের দুই মোটরসাইকেলে ছিলেন সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্য। কিন্তু তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে প্রাইভেট কারটি দেখে এর মালিক শেখ শফিউল্লাহ তার গাড়ি বলে নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, জিপিএস দেখে গাড়িটি তিনি সাতক্ষীরা-কলারোয়া সড়কের কদমতলা মোড় থেকে ডান দিকের একটি ছোট রাস্তার পাশ থেকে উদ্ধার করেছিলেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চালক সাইফুলকে মাইক্রোবাস থেকে সাতক্ষীরা বাইপাসের লাপসা গোলচত্বর থেকে বড় জামতলা যাওয়ার আগে একটি ইটভাটার পাশে নামিয়ে দেয়া হয়। তিনি সেখান থেকে হেঁটে ২০০ গজ দূরে বড় জামতলার একজন চা ও মুদি দোকানদারের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে বিষয়টি মালিককে জানিয়েছিলেন। সাইফুল যে মুদি দোকানদারের মোবাইল থেকে কল করেছিলেন তার নাম আজিজুর রহমান। তার দোকানের নাম আমেনা ভ্যারাইটিজ স্টোর। আজিজুর রহমান দৈনিক বাংলাকে জানান, তিনি প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৪টার দিকে দোকান খোলেন। একদিন ভোরে দোকান খোলার সময় একটি লোক খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার দোকানে এসে শাকদহ ব্রিজের কাছ থেকে পুলিশের চেকপোস্টে তার গাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে গেছে বলে জানায়। তাকে বেধড়ক মারধরের কথাও জানান তিনি। তিনি (চালক সাইফুল) তার মহাজনকে (গাড়ির মালিক) জানানোর জন্য মোবাইল থেকে একটা কল করতে চান।

আজিজুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমি মোবাইলটা দিই। আমি তার একটা ছবিও তুলে রাখছিলাম। তার শরীরে কাদা-মাটি ছিল। দেখে মনে হয়েছে তাকে অনেক মারধর করা হয়েছিল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেছিল। ঘণ্টাখানেক পর একটা প্রাইভেট কার এলে সে ওইটাতে উঠে চলে যায়।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে মাইক্রোবাসের মাধ্যমে স্বর্ণ লুটের এই অভিযান চালানো হয় সেটির নম্বর হলো ঢাকা মেট্রো-চ-১৫-১৮০৫। গাড়িটির মালিকানা শাহ জহির উদ্দিন ফকির নামে ঢাকার এক ব্যক্তির। তবে গাড়িটি বর্তমানে ব্যবহার করেন সাতক্ষীরা শহরের চালতেতলা মোড় বাটকেখালীর বাসিন্দা জাকির হোসেন। জাকির নিজেই ওই গাড়িটি ভাড়ায় চালান।

জানা গেছে, জাকিরের মাইক্রোবাসটি মাঝেমধ্যেই জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা ভাড়ায় ব্যবহার করেন। প্রযুক্তির সহায়তায় জাকিরের সঙ্গে আলোচিত এই ঘটনার আগে ও পরে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই ইন্দ্র মল্লিকসহ অনেকের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। জাকির নিজেও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে তার গাড়িটি ভাড়া দেয়ার কথা এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন। তবে ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতের সেই অভিযানের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান।

জাকিরের মাইক্রোবাসটি যে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানের জন্য ব্যবহার করা হয়, তা স্বীকার করেছেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের দ্বিতীয় কর্মকর্তা এসআই ইন্দ্র মল্লিক। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘জাকিরের গাড়িটা আমরা ব্যবহার করি। কিন্তু ওই রাতের (২৮ ফেব্রুয়ারি রাতের কথিত অভিযান) কথা আমি জানি না। আমি কোনো অভিযানে যাইনি, অন্য কেউ গেছে কি না জানি না। কারণ সব অপারেশন সম্পর্কে তো আমার জানার কথা নয়।’

ব্যবসায়ী শেখ শফিউল্লাহ জানান, ঘটনার পরের দিন তিনি বিষয়টি জেলা পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামানের বাংলোতে গিয়ে বিস্তারিত জানান এবং স্বর্ণের বারগুলো উদ্ধার করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান তার কাছে কোনো প্রমাণ রয়েছে কি না জানতে চান। ব্যবসায়ী শফিউল্লাহ প্রমাণ দেবেন জানালে তিনি ৯ মার্চ পর্যন্ত সময় নেন। পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের জন্য ব্যস্ত থাকবেন জানিয়ে ৯ মার্চের পর বিষয়টি দেখবেন বলে তাকে আশ্বস্ত করেন। এমনকি বিষয়টি নিয়ে থানায় কোনো অভিযোগ দেয়ার প্রয়োজন নেই বলেও জানান।

ব্যবসায়ী শেখ শফিউল্লাহ বলেন, ‘ওই দিনের পর থেকে পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামানের সঙ্গে একাধিকবার দেখা করার চেষ্টা করলেও দেখা করতে পারেননি। পুলিশ সুপারের মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপে একাধিক মেসেজ দিলে তিনি দেখলেও উত্তর দিতেন না।’

শেখ সফিউল্লাহ বলেন, ‘৬ মার্চ রাত আনুমানিক ৮টার দিকে হঠাৎ সাতক্ষীরা শহরে আমার বাসায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কয়েকজন সদস্য আসেন। এ সময় আমি বাসায় ছিলাম না। তারা বাসার মূল ফটকে এসে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। এ সময় বাসার ভেতরে থাকা আমার পরিবারের সদস্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়। রাত ১১টার দিকে পুলিশ সুপার নিজেই আমাকে ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি ফোন কেটে দেন। পরদিন আমার নামে কলারোয়া থানায় একটি মিথ্যা ডাকাতি মামলা দেয়া হয়।’

প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যদের স্বর্ণের বার ডাকাতি করার বিষয়টি পুলিশ সুপারকে জানানোর পর থেকেই এ-সংক্রান্ত প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়। সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ লাইনসের প্রধান ফটকের বিপরীতে ফেমাস ইন্টারন্যাশনাল নামে যে রড-সিমেন্টের দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরায় গাড়ি বের হওয়ার দৃশ্য ধরা পড়েছে, সেটি মুছে দিয়ে যান জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। ১ মার্চ ব্যবসায়ী শেখ শফিউল্লাহ বিষয়টি পুলিশ সুপারকে জানানোর পরদিন (২ মার্চ) দুপুর ১২টার পর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এএসআই মাজেদসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ফেমাস ইন্টারন্যাশনাল নামে ওই প্রতিষ্ঠানে যান। সেখানে গিয়ে তারা সিসিটিভির ফুটেজ মুছে দিয়ে আসেন। কিন্তু প্রযুক্তির সহায়তায় ওই দোকানের ডিলিটকৃত সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন এই প্রতিবেদক। দুটি ফুটেজে দেখা গেছে, রাত ৩টা ৫০ মিনিটে পুলিশ লাইনস থেকে দুটি মোটরসাইকেলের এস্কটসহ ব্যবসায়ী শেখ সফিউল্লাহর গাড়িটি বের হয়ে যাচ্ছে। মোটরসাইকেল দুটি হেডলাইট জ্বালিয়ে পুলিশ লাইনস থেকে বের হলেও গাড়িটির হেডলাইট বন্ধ ছিল। মূল সড়কে আনার পার প্রাইভেট কারের হেডলাইট জ্বালানো হয়। এ ছাড়া সিসিটিভি ফুটেজে এএসআই মাজেদের নেতৃত্বে যে সিসিটিভি ফুটেজ ডিলিটের চেষ্টা করা হচ্ছে তাও দেখা গেছে। জানতে চাইলে এএসআই মাজেদ দৈনিক বাংলার কাছে ফুটেজ ডিলিট করার বিষয়টি অস্বীকার করেন। পুলিশ লাইনসের গেটের সামনের দোকানে তিনিসহ অন্যরা এমনিতেই যাওয়ার দাবি করেন। ফেমাস ইন্টারন্যাশনালের মালিক মমিনুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে এড়িয়ে যান।

মামলা দিয়ে সেই ব্যবসায়ীকে হয়রানির চেষ্টা

গত ৭ মার্চ সাতক্ষীরার কলারোয়া থানায় একটি ডাকাতির মামলা করেন এসআই অনীল মুখার্জী। মামলার এজাহারে বলা হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ৬ মার্চ দিবাগত রাত ১টা ১০ মিনিটে এসআই অনীল মুখার্জী জানতে পারেন, সাতক্ষীরা-যশোর হাইওয়ের ৮ নম্বর কেরালকাতা ইউনিয়নের ইলিশপুর গ্রামের কোটার মোড় এলাকায় দুটি প্রাইভেট কার নিয়ে ডাকাত দলের সদস্যরা অবস্থান করছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর আসাদুজ্জামানসহ রাত ১টা ৪০ মিনিটে অভিযান চালান। এ সময় ডাকাত দলের সঙ্গে তাদের গুলিবিনিময় হয়। পরে ঘটনাস্থল থেকে ছয়জন ডাকাত সদস্যকে একটি বিদেশি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের দাবি করেন। ওই মামলার এজাহারে পলাতক হিসেবে ব্যবসায়ী শেখ শফিউল্লাহকেও আসামি করা হয়।

এ ছাড়া গত ৫ এপ্রিল কলারোয়া থানার এসআই ফরিদ আহমেদ জুয়েল বাদী হয়ে নাশকতার অভিযোগে একটি মামলা করেন। মামলায় স্থানীয় জামায়াতের আট নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই মামলায় পলাতক আসামিদের তালিকার সর্বশেষে শেখ শফিউল্লাহর নাম জুড়ে দেয়া হয়েছে।

ব্যবসায়ী শফিউল্লাহ বলছেন, তার স্বর্ণ লুটের পর তিনি তা ফেরত চাওয়ার কারণেই পুলিশ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। তিনি একজন ব্যবসায়ী। তার ডাকাতি করতে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। হয়রানি করার জন্য পুলিশ তার মোটরসাইকেলের দুটি শোরুম বন্ধ করে রেখেছিল। এমনকি শোরুম থেকে নতুন তিনটি মোটরসাইকেলও নিয়ে যায় সদর থানা পুলিশ। পরে অবশ্য কাগজপত্র দেখানোর পর রাতে থানা থেকে ফেরত দেয়া হয়েছে।

শফিউল্লাহ বলেন, ‘আমি ডাকাত হলে নাশকতার মামলায় আমার নাম দিয়েছে কেন? ডাকাতরা রাজনীতি করে নাকি? একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে হয়রানি করা হচ্ছে।’

শেখ শফিউল্লাহর জুয়েলারি ব্যবসায়িক অংশীদার সঞ্জয় কুমার দাস জানান, ‘গত ২৯ মার্চ রাত ২টার দিকে হঠাৎ করে সদর থানা পুলিশ তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। তার নামে কোনো মামলা-মোকাদ্দমা নেই। পরদিন সারা দিন থানায় বসিয়ে রেখে রাত ১২টার দিকে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এর আগে তার মালিকানাধীন (ঢাকা মেট্রো-গ-৩৭-৭৭৮৫) গাড়িটিও নিয়ে সদর থানায় আটকে রাখা হয়েছিল। পাঁচ দিন পর গাড়িটি ছাড়া হয়েছে।

সঞ্জয় কুমার দাস বলেন, ‘পুলিশ তার কাছে শফিউল্লাহর সন্ধান চেয়েছিল। কিন্তু শফিউল্লাহর অবস্থান তিনি জানেন না জানালেও তাকে অকারণে হেনস্তা করা হয়েছে। পুলিশ তার ক্ষতি করতে পারে বলে তিনিও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দিন পার করছেন।

স্বর্ণকাণ্ডে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন এক এসপি, তবু বন্ধ হয়নি লুট

সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরাকে বলা হয় চোরাকারবারির স্বর্গরাজ্য। বৈধ ব্যবসার আড়ালে এখানে অনেকেই চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত। এই সুযোগকেই কাজে লাগান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থানীয় সদস্যরা। বিশেষ করে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে স্বর্ণ ছিনিয়ে নিয়ে অন্য মামলায় জেলে পাঠানোর তথ্য পাওয়া যায়। তবে ব্যবসায়ীরা হয়রানির ভয়ে মুখ খুলতে চান না। বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই প্রশাসনের সঙ্গে ‘বিশেষ খাতির’ রেখে চলতে চান।

২০১৬ সালের অক্টোবরে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১২০ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ইয়াবা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছিলেন সাবেক এসপি আলতাফ হোসেন। ওই ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয় পুলিশ প্রশাসনে। ছয় বছর পর গত বছরের ১৮ মে তাকে চাকরিচ্যুত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৬-এর জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

স্থানীয় সূত্র বলছে, এসপির চাকরিচ্যুতির পরও একই ঘটনা ঘটেই চলছে। সাতক্ষীরার স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে এসব গল্প শোনা যায়। কিন্তু ভুক্তভোগীরা নিরাপত্তাহীনতার কারণে এসব বিষয়ে কথা বলতে চান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাতক্ষীরার একজন ব্যবসায়ী বলেন, সাতক্ষীরায় বিভিন্ন সময়ে কর্মরত পদস্থ কর্মকর্তা থেকে বিভিন্ন থানার ওসিদের সম্পত্তির খোঁজখবর করলেই সব সত্য বেরিয়ে আসবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান প্রথমে তার জেলায় এমন কোনো ঘটনা নেই বলে জানান। পরবর্তী সময়ে তিনি জানান, যিনি অভিযোগ করেছেন তিনি পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করার পর বিস্তারিত জানা যাবে। শেখ শফিউল্লাহকে একজন ডাকাত ও চোরাকারবারি হিসেবে আখ্যায়িত করে পুলিশ সুপার বলেন, ‘তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।’ এই প্রতিবেদক তার কাছে নিজস্ব অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে জিপিএস ও সিসিটিভি ফুটেজের কথা জানালে তিনি পুলিশ লাইনসের গেট বন্ধ থাকে এবং সেখানে কোনো গাড়ি ঢোকার সুযোগ নেই বলে দাবি করেন। ওই ব্যবসায়ী নিজেই ঘটনাটি সাজিয়েছে কি না তা তারা খতিয়ে দেখছেন বলেও মন্তব্য করেন। পরে এই প্রতিবেদককে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি তদন্ত করে যদি কোনো পুলিশের জড়িত থাকার তথ্য পান, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

পুলিশ সদর দপ্তরের আইজিপি কমপ্লেইন সেলের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক বেলাল উদ্দিন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে অসংখ্য অভিযোগ আসে। এ রকম একটি ঘটনার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু অভিযোগটি ফাইল হিসেবে আমার টেবিলে এখনো আসেনি। অভিযোগটি আমরা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেব।’