আপডেট : ১৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০৮:০৩
এক দশকে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন
আবদুর রহিম হারমাছি

এক দশকে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন

সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা লেগেছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। সেই চাপ সামাল দিতে ব্যয় সংকোচন করছে সরকার। তার প্রভাব বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়নেও পড়েছে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেটে উন্নয়ন বাজেট বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) এই এডিপির ১ লাখ কোটি টাকাও কম খরচ হয়েছে, মোট ব্যয় হয়েছে ৯৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-মার্চ সময়ে মোট এডিপির ৪০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।

বাস্তবায়নে বেহাল দশার কারণে গত ১ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় মূল এডিপি থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ বরাদ্দ কমিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকার সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সে হিসাবে এই ৯ মাসে সংশোধিত এডিপির ৪১ দশমিক ৬৪ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে, যা গত ১০ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে ৯৮ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল; বাস্তবায়নের হার ছিল ৪৫ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ।

অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সংশোধিত এডিপির ৩২ দশমিক ১০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছিল। প্রতিবছরই অর্থবছরের প্রথম ভাগে এডিপি বাস্তবায়নের হার কম থাকে, দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বাড়তে থাকে। কিন্তু এবার ৯ মাস পার হয়ে গেলেও সরকারের উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের গতি নেই। অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে অর্থাৎ ৭ মাসে ২৮ দশমিক ১৬ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছিল।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দুই বছরের করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা সামাল দিতে ডলার সাশ্রয় ও খরচ কমানোর সরকারি পদক্ষেপের প্রভাব পড়েছে চলমান এডিপি বাস্তবায়নে। তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, গত কয়েক বছরের মতো বছর শেষে এডিপি বাস্তবায়ন ঠিক ৯০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছবে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) গতকাল মঙ্গলবার সংশোধিত এডিপির বাস্তবায়নের হালনাগাদ প্রতিবেদনই প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অর্থাৎ বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো সংশোধিত এডিপির সরকারি অংশের ৫৬ হাজার ১৫১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ২ দশমিক ১৫ শতাংশ কম।

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতির অন্যতম প্রধান কারণ বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিরি গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। দৈনিক বাংলাকে তিনি বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত এক বছরে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ২৫ শতাংশ বেড়েছে। ৮৬ টাকার ডলার কিনতে এখন ১০৭ টাকা লাগছে। কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ১২০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, এখনো ১১৪/১১৫ টাকা। এতে সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বেশি পড়ছে। জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। এতে সব ধরনের নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে গেছে। রডের টন লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। সিমেন্টসহ অন্যান্য সামগ্রীর দামও বেড়েছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সরকারও ডলার সাশ্রয় ও খরচ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব কারণে অনেক প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। তাই সব মিলিয়েই এবার এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে। আমার মনে হয়, আগের বছরগুলোর চেয়ে এবার অর্থবছর শেষেও এডিপি বাস্তবায়ন কম হবে।’

আইএমইডির তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৪৫ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৪১ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৯-২০ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল যথাক্রমে ৪৫ দশমিক শূন্য আট শতাংশ ও ৪৭ দশমিক ২২ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের মোট এডিপি বরাদ্দের প্রায় ৮৩ শতাংশ বরাদ্দ আছে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের। এর মধ্যে সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ-স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ জুলাই-মার্চ সময়ে ৩০ শতাংশের কম বাস্তবায়ন করেছে।

সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাওয়া মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে এই ৯ মাসে খরচের দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে সেতু বিভাগ। মোট বরাদ্দের ৬৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ ব্যয় করেছে সংস্থাটি। তালিকার পরের স্থানে আছে যথাক্রমে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ (৫৬ দশমিক ২৭ শতাংশ) এবং বিদ্যুৎ বিভাগ (৫৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ)। এই ৯ মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ের পরিমাণ কমে ৩ হাজার ৬৪৭ কোটি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ৫ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ছিল।

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার বিভিন্ন প্রকল্পকে এ, বি এবং সি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে সি ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছে এবং সেগুলোর জন্য অর্থায়ন সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে।

সরকার সাধারণত প্রতিবছর মোট এডিপি বাজেটের প্রায় ৮০ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের ৯০ শতাংশেরও বেশি ব্যয় করে। এ বছর সার্বিক এডিপি বাস্তবায়ন ৮০ শতাংশে উন্নীত করা নির্ভর করবে সরকারের তহবিল বিতরণ সক্ষমতার ওপর।

এ প্রসঙ্গে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অর্থবছরের বাকি তিন মাস সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ বছর রাজস্ব আদায় খুব বেশি বাড়বে না। ফলে সরকারকে হয় ঋণ নিতে হবে বা সামগ্রিক ব্যয় হ্রাস করতে হবে। কিন্তু দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার বিশ্বব্যাংক, এডিবির কাছ থেকে বাজেট সহায়তার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো পাওয়া গেলেও এই অর্থবছরেও খরচ করা যাবে না। তাই বৈদেশিক সাহায্য সমর্থিত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার ওপর আরও জোর দেয়া উচিত ছিল।’

বাস্তবায়নের ধীরগতি প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইএমইডির এক কর্মকর্তা দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমিয়ে ডলার সাশ্রয়ে দেশি অর্থায়নের চলমান প্রকল্পে আমদানি অনুৎসাহিত করা হয়। কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন স্থগিত রাখা হয়। এ কারণে বাস্তবায়নের হার কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।’

ওই কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের উদ্যোগ থাকায় বিদেশি পণ্য আমদানি করতে হয়- এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। আবার অনেক সময় প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি ঠিক থাকলেও প্রকল্পের অর্থছাড় না হাওয়ার কারণেও বাস্তবায়ন কম দেখানো হয়। সেই রকম কয়েকটি প্রকল্পও আছে বলে তিনি জানান।’

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছিল। সে কারণে আমাদের ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নিতে হয়েছিল। তবে চাপ ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমার মনে হয়, অর্থবছর শেষে এডিপি বাস্তবায়নের হার সন্তোষজনকই হবে।’