আপডেট : ২২ এপ্রিল, ২০২৩ ১১:৪০
শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে চার লাখ মুসল্লি
প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ

শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতে চার লাখ মুসল্লি

চার লক্ষাধিক মুসল্লির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদুল ফিতরের জামাত। ছবি: দৈনিক বাংলা

সর্বোচ্চ সতর্কতা ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারও দেশের সর্ববৃহৎ ঈদুল ফিতরের জামাত কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় এ জামাতে দেশে বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রায় চার লক্ষাধিক মুসল্লি অংশ নেন। এতে ইমামতি করেন বাংলাদেশ ইসলাহুল মুসলেমিন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, এবারও দেশ-বিদেশের চার লাখেরও বেশি মানুষ এ ময়দানে একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছেন।

গত শুক্রবার থেকে শুরু করে শনিবার কাকডাকা ভোর পর্যন্ত লাখ লাখ মুসল্লির ঢল নামে শোলাকিয়া ময়দানে। সকাল সাড়ে ৮টার আগেই মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। মাঠে জায়গা না পেয়ে আশপাশের রাস্তা-ঘাট, বাসাবাড়ির ছাদ, নরসুন্দা নদীর পারে মুসল্লিরা নামাজের কাতার করে দাঁড়িয়ে যান।

ঈদগাহ ময়দানের রেওয়াজ অনুযায়ী নামাজ শুরুর ১৫ মিনিট আগে পরপর তিনবার শটগানের গুলি ছুড়ে মুসল্লিদের নামাজে দাঁড়ানোর সংকেত দেয়া হয়।

শোলাকিয়ায় নামাজ আদায়ে দুই দিন ধরেই গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, বরিশাল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোরসহ ৬৪টি জেলা ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে কিশোরগঞ্জে লোক আসতে শুরু করে। অনেকে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের বাসায়, আবাসিক হোটেল, শহরের মসজিদগুলোতে এবং ঈদগাহ মাঠে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়ে রাত্রিযাপন করেন। ভোরে ট্রেন, বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, রিকশা, মোটরসাইকেল, সাইকেল ও হেঁটে হাজারো মানুষ কিশোরগঞ্জে আসেন। সবার গন্তব্য ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগা ময়দান।

নামাজ শেষে বাংলাদেশসহ মুসলিম উম্মার শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা হয়। কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ, জেলা পরিষদের প্রশাসক অ্যাডভোকেট মো. জিল্লুর রহমান, পৌরসভার মেয়র মাহমুদ পারভেজসহ বিশিষ্টজনেরা এ মাঠে নামাজ আদায় করেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতিবারের মতো এবারেও শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য ‘শোলাকিয়া স্পেশাল এক্সপ্রেস ট্রেন’ নামে দুটি বিশেষ ট্রেন চালু করে। একটি ট্রেন ভৈরব থেকে ভোর ছয়টায় ছেড়ে সকাল আটটায় কয়েক হাজার যাত্রী নিয়ে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে আসে। অন্যটি ভোর পৌনে ছয়টায় ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে সকাল সাড়ে আটটায় কিশোরগঞ্জে পৌঁছে। উভয় ট্রেন দুটি দুপুর ১২টায় আগত মুসল্লিদের নিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে ভৈরব ও ময়মনসিংহের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।

২০১৬ সালের জঙ্গি হামলার পর থেকে শোলাকিয়া ময়দানে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মাঠ ও আশপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ৬টি টাওয়ার স্থাপন করা হয়। এবারের ঈদের জামাতে টুপি ও জায়নামাজ ছাড়া আর কিছু সঙ্গে নিয়ে প্রবেশ করতে পারেনি মুসল্লিরা।

ঈদগাহ ময়দানকে লক্ষ্য করে চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রতিটি মানুষ যখন ঈদগাহ ময়দানে আসবেন পুলিশের চারটি স্থাপনা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। চেকপোস্ট হোক বা পিকেট হোক। আবার কোথাও কোথাও পাঁচ থেকে ছয়টি স্থাপনা পেরিয়ে ময়দানে আসতে হয়েছে। মাঠে ওয়াচ টাওয়ার ছিল ছয়টি। তার মধ্যে র‌্যাব সদস্যরা দুটি ব্যবহার করে আর চারটি ব্যবহার করে পুলিশ। মাঠে ছিল চারটি ড্রোন ক্যামেরা। মাইনো কোলারসহ ছিল ছয়টি ভিডিও ক্যামেরা। এ ছাড়া পুরো ময়দান ছিল সিসি ক্যামেরার আওতায়। যা দিয়ে ময়দানে নিরাপত্তা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হয়।

ফায়ার সার্ভিসসহ ছয়টি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে প্রস্তুত ছিল মেডিকেল টিম। ছিল পুলিশের কুইক রেসপন্স টিম। ঈদগাহ ময়দানের নিরাপত্তায় বোমা শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয়করণের একটি দল ঢাকা আসে শোলাকিয়া মাঠে। তারা মেটাল ডিটেক্টরের সাহায্যে বিশেষ অনুসন্ধান চালায় পুরো মাঠে। এ ছাড়া মাঠের নিরাপত্তার জন্য পাঁচ প্লাটুন বিজিবি সদস্যার ছিলি পুরো ময়দান এলাকাতে। র‌্যাবসহ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা ছাড়াও সাদা পোশাকে পুলিশ কাজ করে মুসল্লিদের নিরাপত্তায়। এই নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থেকে দেশের দূরদূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিরা নির্বিঘ্নে নামাজ আদায় করেন।

এ ছাড়া ২৮টি প্রবেশ পথে হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে নিরাপত্তা কর্মীরা আগত মুসল্লিদের দেহ তল্লাশি করে ঈদগাহে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়। মুসল্লিদের নিরাপত্তায় ঈদের আগের দিন থেকে শহরে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়।

ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে ২০১৬ সালের ৭ জুলাই ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্য, এক নারী এবং এক জঙ্গিসহ চারজন নিহত হন। এ জঙ্গি হামলায় পুলিশসহ ১৬ মুসল্লি আহত হন। কিন্তু তারপরও ভাটা পড়েনি ঐতিহাসিক এ ঈদগাহ ময়দানের ঈদের জামাতে মুসল্লিদের সমাগমে।

এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ১৮২৮ সালে এই মাঠে ঈদের জামাতে প্রায় সোয়া লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছিলেন। আর তখন থেকে এ মাঠের নাম হয় ‘সোয়া লাখিয়া’। পরে এই মাঠ শোলাকিয়া নামে পরিচিতি পায়।