আপডেট : ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ ১০:০৫
শিক্ষকসংকটে ব্যাহত শতবর্ষী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষা
হাসান মেহেদী, ঢাকা ও মাহফুজ নান্টু, কুমিল্লা

শিক্ষকসংকটে ব্যাহত শতবর্ষী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষা

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ। ছবি: দৈনিক বাংলা

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের একাদশ, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। বিপুলসংখ্যক এই শিক্ষার্থীর পাঠদানে রয়েছেন মাত্র ১২২ শিক্ষক। অর্থাৎ গড়ে ২৩৭ শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একজন শিক্ষক রয়েছেন। আবার দুই বিভাগে কোনো শিক্ষকই নেই। ধারে চলছে এসব বিভাগে পাঠদান।

কলেজটিতে বর্তমানে ২০ বিষয়ে স্নাতক ও ১৮ বিষয়ে স্নাতকোত্তর চালু রয়েছে। তবে এসব বিষয়ের কোনেটিতে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। সৃষ্ট পদ অনুযায়ী প্রতি বিষয়ে ১৮ জন শিক্ষক থাকার কথা থাকলেও কোনো বিভাগেই সেটি নেই। ফলে ক্লাস নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষকদের।

কলেজ ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ৬ জন, বাংলায় ৭, উদ্ভিদবিদ্যায় ৬, রসায়নে ১৪, অর্থনীতিতে ১০, ইংরেজিতে ১০, ইতিহাসে ২, তথ্য ও প্রযুক্তিতে ১, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ২, ইসলাম শিক্ষায় ৭, ব্যবস্থাপনায় ১১, গণিতে ৬, দর্শনে ৫, পদার্থবিজ্ঞানে ১২, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৬, সংস্কৃত বিভাগে ৩, সমাজকল্যাণে ৩, সমাজবিজ্ঞানে ৬, পরিসংখ্যানে ১ ও প্রাণিবিদ্যায় মাত্র ৪ জন শিক্ষক রয়েছেন।

এসব বিভাগের মধ্যে ইতিহাস, পরিসংখ্যান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, সমাজকল্যাণ, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন বিভাগের শিক্ষকসংকট সবচেয়ে বেশি। তবে একাদশ শ্রেণিতে ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও মার্কেটিং বিভাগে একজন শিক্ষকও নেই। হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে শিক্ষক নিয়ে এই দুই বিভাগের ক্লাস চালানো হচ্ছে।

১৮৯৯ সালের ২৪ নভেম্বর ঐতিহ্যবাহী এ কলেজটি প্রতিষ্ঠা হয়। ১২৪ বছর ধরে শিক্ষার বিস্তারে ভূমিকা রাখা কলেজটি শিক্ষকসংকটে জর্জরিত। ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রম।

প্রশাসনিক ভবনের তথ্যমতে, কলেজটির ক্যাম্পাস দুই ভাগে বিভক্ত। উচ্চমাধ্যমিক ক্যাম্পাস শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে। ডিগ্রি শাখাটি শহরের অদূরে ধর্মপুরে অবস্থিত। এ দুই শাখায় ২৭ হাজার ৯৯৪ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। অথচ এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পাঠদানে শ্রেণিকক্ষ রয়েছে মাত্র ৮৯টি। এসব কক্ষে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীর পাঠদান করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মনোযোগ হারাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবু জাফর খান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষক ও শ্রেণিসংকটে আছি আমরা। সেই ১৯৯১ সাল থেকেই শিক্ষকসংকট শুরু হয়েছে, যা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এর মধ্য দিয়েই পাঠদান করতে হচ্ছে। সুষ্ঠুভাবে ক্লাস চালাতে আরও ৪টি একাডেমিক ভবন ও ৬০টি শ্রেণিকক্ষ প্রয়োজন।’

কলেজটিতে সাতটি আবাসিক ছাত্রাবাসের মধ্যে এখন পাঁচটিতে ১ হাজার ১২৮ শিক্ষার্থী থাকতে পারেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আবার পরিবেশও শিক্ষার্থীদের আশানুরূপ নয়। বাধ্য হয়েই কলেজের বাইরের মেসগুলোয় ভাড়া থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

এ বিষয়ে ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী কলেজটিতে আবাসনসংকট প্রকট। ১০০ বছর পরে এসেও এখনো শিক্ষার্থীদের সংকট মেটানো হয় না। কলেজে অনেক জায়গা কিন্তু নতুন করে ছাত্রাবাস নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেই। অগত্যা আমাদের বেশি খরচ দিয়ে বাইরে থাকতে হয়।’

সংকটের মধ্যেও ভালো পারফরম্যান্স
সংকট থাকলেও প্রতিবছর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ভালো ফল করছে ভিক্টোরিয়া কলেজ। সর্বশেষ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত কলেজ পারফরম্যান্স র‌্যাঙ্কিংয়ে চট্টগ্রাম বিভাগে প্রথম হয়েছে তারা। এর আগে ২০১৭ সালেও চট্টগ্রাম বিভাগের পারফরম্যান্স র‌্যাঙ্কিংয়েও ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রথম হয়েছিল। কলেজের অবকাঠামো, শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষকদের মান, পরীক্ষার ফল, গ্রন্থাগারে সংগ্রহ, আইসিটি সাপোর্ট, সহপাঠ কার্যক্রমসহ ৩১টি সূচক বিবেচনায় নিয়ে এ র‌্যাঙ্কিং করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় কয়েক বছর ধরে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে এ কলেজ।

সহশিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও পিছিয়ে নেই ভিক্টোরিয়া কলেজ। থিয়েটার, বিতর্ক পরিষদ, স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠন বাঁধন, বিএনসিসি, স্কাউট, ক্যাম্পাস বার্তা, সাংবাদিক সমিতি নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে এসব সংগঠনের বেশির ভাগেরই নিজস্ব কক্ষ নেই। যেগুলোর আছে সেগুলোর অবস্থাও নাজুক।

জানতে চাইলে ভিক্টোরিয়া কলেজ বিতর্ক পরিষদের সভাপতি শাহনূর কিবরিয়া সুজন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক পরিষদের কার্যালয়টি জলাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। অনুশীলন করতে পারতাম না। এখন জলাবদ্ধতা সমস্যা না থাকলেও কার্যালয়ের দেয়াল জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। জাতীয়ভাবে আমরা চ্যাম্পিয়ন হলেও অবকাঠামোগত সুবিধা অনেক কম পাই।’

২৩ বছর ধরে বন্ধ ছাত্র সংসদ
১০০ বছরের বেশি সময় ধরে আলো ছড়ানো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২০ মে। ১৯৯৮ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা ও ছাত্ররাজনীতিকে গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে নিতে কলেজ ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক যোগ্য নেতৃত্ব তৈরিতে ছাত্র সংসদ চায় বেশির ভাগ ছাত্র সংগঠন। তবে এ নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসের পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়ার শঙ্কা জানিয়েছে ছাত্রলীগ।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ভিক্টোরিয়া কলেজ শাখা ছাত্রলীগের এক শীর্ষ নেতা দৈনিক বাংলাকে বলেন, ক্যাম্পাসে পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করছে। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে সব ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে অবস্থান নিতে চেষ্টা করবে। ফলে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত বাড়বে। সেই শঙ্কা থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষ আয়োজন করতে চায় না। তবে ছাত্রলীগের কোনো না নেই।