সরকারের সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকার অপচয় হচ্ছে। প্রায় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার বয়স্ক ও বিধবা ভাতার টাকা বেহাত হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া ৩৩ লাখ বয়স্ক ব্যক্তি ও ২৫ লাখ বিধবা যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও সহায়তা পাচ্ছেন না।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ওপর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। রোববার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে এ সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। আরও বক্তব্য রাখেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী এবং সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আরমা দত্ত।
ভাতা যাচ্ছে অযোগ্যদের হাতে
সিপিডির জরিপে উঠে এসেছে, ৩০ শতাংশ বয়স্ক ভাতা ও ৩৩ শতাংশ বিধবা ভাতা যাচ্ছে অযোগ্যদের কাছে। এর মধ্যে ১২ শতাংশ আছে, যারা এর সঙ্গে অন্যান্য ভাতাও পাচ্ছে।
জরিপে দেখা গেছে, এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভাতাই চলে যাচ্ছে অযোগ্যদের হাতে। অথচ এই টাকা দিয়ে আরও ৪৫ শতাংশ যোগ্য বয়স্ক ও বিধবাকে সাহায্য করা যেত।
জরিপ অনুসারে, দেশে ৩৩ লাখ বয়স্ক ব্যক্তি আছেন, যারা ভাতা পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু কোনো ধরনের ভাতা পাচ্ছেন না। আর ২৫ লাখ বিধবা আছেন, যারা কোনো ধরনের ভাতা পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু পাচ্ছেন না।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার ৫০০ টাকা করা দরকার। কারণ মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য ভাতা ১৫০ থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা যেতে পারে। আর এজন্য সরকারের বাড়তি খরচ হবে ৮৮ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা দারিদ্র্য দূরীকরণে কাজ করছে। তবে সেটা দরকারের তুলনায় কম। যে টাকা দেয়া হচ্ছে, সেটা অপ্রতুল। এর বাস্তবয়নে দুর্বলতা আছে। এখনো অনেক বয়স্ক ও বিধবা আছেন, যারা এই ভাতা পাচ্ছেন না। বয়স্ক, বিধবা ও স্কুলের ছোট শিশুদের ভাতা ছাড়াও আরও কিছু সাহায্য দরকার। এছাড়া সবাই ভাতা পাচ্ছে কি না সেটা নিয়মিত দেখভাল করতে হবে। সেখানে স্থানীয় সরকার, উপজেলা অফিস ও সমাজকল্যাণ অফিসের লোক থাকতে হবে।
সরকারের দৃষ্টিতে বৈষম্য কেমন
গত ১২ এপ্রিল সরকারের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এ সংক্রান্ত যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তাতে দেখা যায়, দেশে দারিদ্র্যের হার কমলেও আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে আয়ের বৈষম্যের সূচক ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২। সর্বশেষ হিসাবে, বৈষম্যের সূচক হয়েছে শূন্য দশমিক ৪৯৯।
আয় বৈষম্যের চিত্র ‘গিনি সহগ’ দিয়ে তুলে ধরা হয়। গিনি সহগে শূন্য নির্দেশ করে চরম সমতা অর্থাৎ সবার আয় বা সম্পদের পরিমাণ সমান। ১ নির্দেশ করে চরম অসমতা অর্থাৎ একজন ব্যক্তি সব অর্থ আয় করেন, বাকিরা কোনো আয় করেন না। ‘গিনি সহগ’ শূন্য দশমিক ৫০ হলে সেটা বিপজ্জনক ধরে নেয়া হয়।
দেশে ১৯৮৮ সালে গিনি সহগ ছিল শূন্য দশমিক ৩০ এর নিচে। ২০১৬ সালেও ছিল শূন্য দশমিক ৪৮২। এখন তা বেড়ে শূন্য দশমিক ৪৯৯, মানে দেশে আয় বৈষম্য বেড়েছে।
এমন পরিসংখ্যান নিয়ে প্রথমবার সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য এলো। যদিও পরিসংখ্যান প্রকাশের দিন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বৈষম্যের বিষয়টিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছিলেন।
বৈষম্য তুলনাহীন জায়গায় চলে গেছে: রাশেদ খান মেনন
সিপিডির অনুষ্ঠানে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমি আমার পার্লামেন্টারি (সংসদীয়) জীবনে বিশেষ করে ২০০৮ সালের পরের পার্লামেন্ট থেকে প্রতি বকতৃতায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছি। কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার শেষ বকতৃতায় বৈষম্যের কথা স্বীকার করলেন। এর আগে তিনি স্বীকারই করেননি যে দেশে একটা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় আমরা চলে গেছি। তিনি বলেছিলেন তার পরবর্তী বাজেটে এটা নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু সেটা হয়নি। ঘটনাটা আরও অনেক দূর গড়িয়েছে। শুধু গড়ায়নি, খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের রাষ্ট্রটি এখন অতি ক্ষুদ্র ধনিক গোষ্ঠী, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের হাতের মধ্যে বন্দী হয়ে গেছে।’
ক্ষমতাসীন দলের জোটসঙ্গী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কোনো দান-খয়রাত নয়। এটা অধিকারের প্রশ্ন। এটা আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যেই ছিল। সেখানে বলা হয়েছিল সাম্য, সামাজিক মর্যাদা আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করছি। এই প্রশ্নটিকে কখনোই দান-খয়রাত হিসেবে বলা যায় না। এটি আমাদের অধিকার।’
‘বাংলাদেশে প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়ে। এখন তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৭ সালে বয়স্কভাতা শুরু হয়। ২০১৬ সালে সোশ্যাল সেফটি নেট প্রোগ্রাম (এসএসএনপি) করা হয়। এখন এটাকে আপডেট করা হচ্ছে। এটা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নয়, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে আমাদের নিতে হবে।’
রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘সাধারণ মানুষের রাষ্ট্র করার জন্য আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা আমাদের দারিদ্র্যসীমা কমিয়ে আনতে পারলেও বৈষম্য এমনভাবে বেড়েছে যে, এটা তুলনাহীন জায়গায় চলে গেছে। করোনাভাইরাসের সময় সানেম বলেছিল, দেশের দারিদ্র্যসীমা ৪৫ শতাংশ হয়েছিল, যদিও সরকার এটা স্বীকার করেনি। আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরও বাড়াতে হবে।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা