আপডেট : ১ মে, ২০২৩ ১৮:১৮
তাপেই কি রেললাইন বেঁকে যাচ্ছে?
তৌফিকুল ইসলাম

তাপেই কি রেললাইন বেঁকে যাচ্ছে?

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল করিডোরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার দাড়িয়াপুর এলাকায় প্রায় ৭০০ মিটার রেললাইন একাধিকবার আংশিক বেঁকে গেছে। একই জায়গায় একই ধরনের ঘটনা পরপর দুই দিন ঘটেছে। এতে রেললাইনের মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি এ ঘটনার কারণ সম্পর্কে জনমনে কৌতূহল জেগেছে।

যদিও পূর্বাঞ্চলের অনেক জায়গায় এখনো ব্রিটিশ আমলের লাইনে চলছে ট্রেন, রেললাইন ‘বাকলিং’ বা বেঁকে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে শুধু অতিরিক্ত তাপমাত্রাকেই দায়ী করছে। এমন ঘটনা স্বাভাবিক বলেও রেল কর্তৃপক্ষ দাবি করছে। তবে যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু তাপেই রেললাইন এভাবে বেঁকে যাওয়ার কথা নয়। পুরোনো রেললাইনে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার কারণেও এমনটি ঘটতে পারে।

দেশের অনেক স্থানে ব্রিটিশ আমলের রেললাইন দিয়েই ট্রেন চলছে এখনো। ২০১৪ সালের পর থেকে দেশে নতুন রেললাইন তৈরি হচ্ছে। তবে তার পরিমাণও কম। ব্রডগেজ রেললাইনে প্রতি মিটারে ৯০ পাউন্ড এবং মিটারগেজ লাইনে প্রতি মিটারে ৭৫ পাউন্ড ওজন থাকার কথা। কিন্তু বিদ্যমান লাইনে এমন ওজন থাকছে কি না সেটি দেখার বিষয়। এমন কারণেও রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। তবে রেল-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানের নতুন রেললাইনে প্রতি মিটারে ৬০ কেজি ওজন থাকছে। এতে করে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, সারা দেশে ৪৩ জেলায় প্রায় ৩ হাজার শূন্য ১ কিলোমিটার রেললাইন আছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে আছে প্রায় ১ হাজার ৩০ কিলোমিটার রেললাইন। এই অঞ্চলের রেললাইনের কোনো কোনো জায়গায় বেঁকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। সেগুলো নজরদারিতে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

পূর্বাঞ্চল রেলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক বাংলাকে বলেন, “তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণেই ‘বাকলিং’ এর ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও এমন ঘটেছে। তবে এবার একটু বেশি আকারে হয়েছে, তাই সবার নজরে এসেছে। যেখানে রেললাইন ঝুঁকিপূর্ণ সেখানে লোকজন পাহারা দিচ্ছে। তাপমাত্রা বাড়লে ভেজা চটের বস্তা, পানি, কচুরিপানা এগুলো রেললাইনে দিয়ে রাখা হচ্ছে।”

এদিকে রেলপথ পুনর্বাসনের জন্য একটি প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। সেই প্রকল্পের ডিপিপি সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় পূর্বাঞ্চলের মোট ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ সম্পূর্ণ নবায়ন করা হবে। ৪০০ কিলোমিটার রেলপথের রেললাইন বসানো হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘অত্যধিক তাপমাত্রার কারণেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পুরোনো বা নতুন যেকোনো লাইনে এমন হতে পারে। আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। একইসঙ্গে যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া দরকার, আমরা নিচ্ছি। ব্রডগেজ লাইনে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মিটারগেজ লাইনে এই সমস্যা হচ্ছে। কারণ ব্রডগেজ লাইনের স্লিপারের ওজন ৩৭০ কেজি এবং মিটারগেজে স্লিপারের ওজন ১৬০ কেজি। তা ছাড়া কাঠের স্লিপার পাতলা এবং তাপে দ্রুত উত্তপ্ত হচ্ছে। সারা দেশের কোন কোন রেললাইনে দুর্বলতা আছে, তার জন্য রেলপথ পুনর্বাসনের একটি প্রকল্প নিচ্ছি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কোন লাইনের কতটুকু কাজ করতে হবে সেটা আমরা আইডেন্টিফাই করতে পারব।’

পূর্বাঞ্চলের রেললাইনের স্থানে স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ এবং স্লিপার নষ্ট হয়ে যাওয়া, পাথর না থাকা, স্লিপারের নিচের মাটি সরে যাওয়ায় এসব রুটে ট্রেনের গতি কমিয়ে ট্রেন চালাতে হয়। এসব কারণেও অনেক সময় ট্রেন লাইনচ্যুত হচ্ছে। তা ছাড়া পুরোনো রেললাইনের টেম্পার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেটি নিয়মিত মনিটরিং করার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ শামসুল হক দৈনিক বাংলাকে, ‘শুধু তাপমাত্রার কারণে রেললাইন বাঁকে না। তাপমাত্রা তো কোনো একটা নির্দিষ্ট জায়গায় হয় না। তাপ বাড়লে বিরাট একটা এলাকাজুড়েই প্রভাব পড়বে। কিন্তু তাপের কারণে শুধু একটা জায়গায় লাইন বেঁকে গেল, তার আশপাশে কোনো সমস্যা হলো না- এটা কীভাবে হয়? তাপমাত্রা বাড়লে রেললাইনে সম্প্রসারণ হয়। লাইনের সেই সম্প্রসারণ হওয়ার জায়গাটা যদি ভরাট হয়ে যায় বা রেললাইন সম্প্রসারণ হওয়ার জন্য লাইনের মাঝখানে যদি পর্যাপ্ত জায়গা না রাখা হয় তাহলে রেললাইনের ‘বাকলিং’ হতে পারে। এর জন্য লাইনের নিয়মিত মেইনটেন্যান্স চালিয়ে যেতে হবে। না হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিই রেললাইন বেঁকে যাওয়ার একমাত্র কারণ নয়।

এদিকে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনার পর আজ ১ মে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসানসহ পূর্বাঞ্চল রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সিলেট রেললাইন পরিদর্শনে যাচ্ছেন।

গতি কমিয়ে চলার নির্দেশনা

রেললাইন বেঁকে যাওয়ায় ট্রেন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় সতর্কভাবে ট্রেন চালাতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। পূর্বাঞ্চল রেলপথের আখাউড়া-আশুগঞ্জ এবং আখাউড়া-মুকুন্দপুর রেল সেকশনের মধ্যে ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সর্বোচ্চ ৪০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এদিকে স্বাভাবিক সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রুটে ৭২ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে ট্রেন চলাচল করত। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে গত ১১ এপ্রিল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথে গতি কমানোর নির্দেশনা জারি রয়েছে।