পূর্বাচল উপশহরের সন্নিকটে শীতলক্ষ্যা নদীঘেঁষা জনপদ। তাঁত আর কৃষি ছিল এই এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা। কালের বিবর্তনে সেই কাঞ্চন পৌরসভায় গড়ে উঠছে ইমারত-অট্রালিকা, গড়ে উঠছে আবাসন কোম্পানি। বেড়েছে সংঘর্ষ ও সংঘাত। গত কয়েক বছরে সেই সংঘাতের বলি হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত আটজন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। পৌর এলাকার ৭০ হাজার বাসিন্দার কাছে কাঞ্চন এখন পরিণত হয়েছে আতঙ্কের জনপদে।
স্থানীয়রা বলছেন, এই পরিস্থিতির নেপথ্যে রয়েছে দুই পক্ষের বিরোধ, যে দুটি পক্ষের নেতৃত্বেই রয়েছেন বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় দুই নেতা রফিকুল ইসলাম রফিক ও গোলাম রসুল কলি। এখানকার অধিবাসীরা এতটাই ভয়ে থাকেন যে, দুপক্ষের নাম পর্যন্ত তারা মুখে আনতে চান না।
স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বলছেন, কাঞ্চনের বর্তমান পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম রফিক ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসুল কলির মধ্যে এই বিরোধ গত আড়াই বছরে চরমে পৌঁছেছে। এই সময়ে বড় ধরনের সংঘর্ষই ঘটেছে অন্তত ১১টি, যাতে দুপক্ষের প্রায় ২০০ ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এসব সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৪টি। পাঁচ দিন আগেও কাঞ্চনের মায়ার বাড়ি এলাকায় দুপক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন আহত হন। এর মধ্যে লোহা শাহিন নামে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মাসখানেক আগে বাংলা টিভির সাংবাদিক সোহেল কিরণের ওপরও হামলা হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি আবাসন কোম্পানি, বালুমহাল ও বালু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণই মূলত এই দুই আওয়ামী লীগ নেতার বিরোধের মূল কারণ। আর সেই বিরোধ থেকে সংঘর্ষ-সংঘাতের সূত্রপাত ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর। এরপর থেকে সংঘর্ষ আর শেষ হয়নি। দুপক্ষেরই রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। তাদের ভয়ে তটস্থ থাকতে হয় সব সময়।
কয়েকজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কাঞ্চন বাজার রূপগঞ্জের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় বাজার। এ বাজার থেকে রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার লোকজন বাজার করে নিয়ে যেত। প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার ব্যবসা হতো। কিন্তু দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা এই বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। সংঘর্ষ-সংঘাত শেষ না হলে এ বাজার ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা দুপক্ষের কাছেই সংঘাত থামিয়ে শান্তি ও ব্যবসায়িক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান।
স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি এখানকার ভাড়াটিয়ারাও আতঙ্কের মধ্যে থাকছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের বেশ কয়েকজন বলেন, কাঞ্চন একসময় ছিল শান্তির এলাকা। এখন সেই শান্তির মা মারা গেছে। কখন কোন জায়গায় মারামারি শুরু হয়, কেউ বলতে পারে না। মূল পৌর শহরের মধ্যে যে ছয়-সাতটি বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর শিক্ষার্থীদের নিয়েও সব সময় শঙ্কায় থাকতে হয় বলে জানালেন অভিভাবকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা আরও বলেন, দুপক্ষের বাহিনীতেই কমপক্ষে ২০০ লোক আছে। দাঙ্গা-মারামারি তো আছেই, এই বাহিনীর লোকজন তাদের নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, জমিদখল, মাদক কারবারিসহ সবই করে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী বলেন, একটা সময়ে রফিকুল ইসলাম রফিক ও গোলাম রসুল কলি একই বলয়ে রাজনীতি করেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য আর আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বে এখন পৃথক পথে হাঁটছেন দুজনেই। সাধারণ মানুষ ছাড়াও দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা সেই দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছেন।
কাঞ্চনের সাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা দেওয়ান আবুল বাশার বাদশা বলেন, আওয়ামী লীগের দুপক্ষের (রফিকুল ইসলাম রফিক ও গোলাম রসুল কলি) কারণে কাঞ্চন পৌরসভা আজ অশান্ত। কাঞ্চন বাজারের ব্যবসায়ীরাও ভালো নেই। সংঘর্ষ শুরু হলে দোকানপাট ফেলে রেখেই পালিয়ে যেতে হয়। ঘন ঘন এত গ্যাঞ্জামের কারণে কাঞ্চনবাসী সব সময় আতঙ্কে থাকেন।
জানতে চাইলে বর্তমান মেয়র রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, ‘রাজনৈতিক ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এসব ঘটনা ঘটে।’ তবে এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
অন্যদিকে মেয়র রফিককে দোষারোপ করে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসুল কলি বলেন, ‘কাঞ্চন একটা সময় শান্ত ছিল। রফিক মেয়র হওয়ার পর থেকে সে ও তার ভাইয়েরা এলাকার আধিপত্য দখলে নিতে নানা অনাচার-অত্যাচার শুরু করে। এসবের প্রতিবাদ করি আমি। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।’
জানতে চাইলে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ বলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই মূলত দ্বন্দ্ব। মাঝখানে সাত-আট মাস শান্ত ছিল। আমরা চেষ্টা করি যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে।’
রূপগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল হক দৈনিক বাংলাকে বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার দায়িত্ব পুলিশের। আমরা পুলিশকে বলেছি যেন কাঞ্চনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে। পুলিশও চেষ্টা করছে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা