খাগড়াছড়ি সদরের পেরাছড়া ইউনিয়নের সাতভাইয়াপাড়া গ্রাম। এই গ্রামে জন্ম বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনীর। শহর থেকে দূরত্ব খুব বেশি না। তবে অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে সাতভাইয়াপাড়া বরাবরই পিছিয়ে পড়া একটি গ্রাম। সেই গ্রামটিকেই অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে মানুষ চিনতে শুরু করেছে। আর সবাইকে এই গ্রাম চিনতে বাধ্য করেছে আনাই ও আনুচিং মগিনী। যে মেয়েরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দেশকে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি এনে দিয়েছে, সেই মেয়েদের গ্রামের কথা তো জানতেই হয়।
গতকাল সোমবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে এনেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে আনা এই ট্রফি দেশের জন্যও প্রথম। সেই দলেরই দুই সদস্য আনুচিং ও আনাই। তাদের বাড়ি তো বটেই, তাদের গ্রামেও তাই এখন বইয়ে আনন্দের জোয়ার। গ্রামবাসীও অপেক্ষায় তাদের বরণ করে নিতে।
মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) সাতভাইয়াপাড়া গিয়ে কথা হয় আনাই ও আনুচিংয়ের বাবা রাপ্রু মগের সঙ্গে। তিনি বলছেন, আনুচিং ও আনাইয়ের ফুটবলে আসাটা মোটেও সহজ ছিল না। তাদের বাড়ি যেতে পার হতে হয় দুর্গম পথ। তাদের ফুটবলে আসার পথটাও ছিল তেমনই দুর্গম।
রাপ্রু মগ বলেন, আমাদের অভাব-অনটনের সংসার। মেয়েদের ঠিকমতো খাবার দিতে পারি না। পড়ালেখার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যেও দুই বোনের ফুটবলের প্রতি আগ্রহ ছোটবেলা থেকে। তখন তো ফুটবল কিনে দিতে পারিনি। ওরা বাড়ির উঠানে জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে খেলত। আমাদের মতো অভাবের সংসারে মেয়েরা ফুটবল খেলবে, সেটা তো ভাবতেও পারতাম না। তাই অনেক সময় বকাও দিতাম।
দুই বোনের ফুটবলে আসার কথা জানিয়ে রাপ্রু বলেন, একসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু হয়। আমরা খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু ওদের স্কুলের শিক্ষক দুই বোনকে খেলতে নিয়ে গিয়েছিল। টুর্নামেন্টে ওরা ভালো খেলে। আর আগ্রহ তো ছিলই। তা দেখেই ক্রীড়া শিক্ষক দুই জনকে নিয়ে যান রাঙামাটির ঘাগড়ায়। সেখানেই ফুটবল ঠিকমতো শিখতে শুরু করে। তারপর তো আজকে সবাই জানে ওদের কৃতিত্বের কথা।
২০১৮ সালে বয়সভিত্তিক ফুটবলে নেপালের মাটি থেকেই জয় ছিনিয়ে এনে দেশবাসীর কাছে পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করে খাগড়াছড়ির মেয়ে আনাই, আনুচিং ও মনিকা। তাদের ফুটবল নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়েছিল দেশ। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে ওই সময় তিন খেলোয়াডের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেয়া হয়। তবে তিনজনের বাড়িতে ঘর তুলতে সহায়তা ছাড়া আর কোনো আশ্বাস আলোর মুখ দেখেনি।
এ নিয়ে আক্ষেপ করে আনাই-আনুচিংয়ের মা আপ্রুমা মগীনি বলেন, পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে বাড়ির পাশের ছড়ার ওপর একটি কালভার্ট করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। চার বছরেও সেই কালভার্ট হয়নি। আরও অনেক প্রতিশ্রুতি আছে। এখন তো মেয়েদের খেলাধুলার আয়ে এখন সংসার চলে। প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন হলে হয়তো আমাদের জীবনটা একটু সহজ হতো।
মনিকা চাকমার গল্পটাও একই
খাগড়াছড়ির সবচেয়ে দুর্গম উপজেলা লক্ষ্মীছড়ি। সেই উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সুমন্তপাড়া। ভৌগলিকভাবে দুর্গম হলেও সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেই সাফল্য এনেছে সেই গ্রামের মেয়ে মনিকা চাকমা। আনাই-আনুচিংয়ের মতো সে-ও সাফ নারী ফুটবল দলের একজন সদস্য।
মনিকা চাকমার গ্রামের বাড়ি সুমন্তপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, তাকে ঘিরে বেশ উচ্ছ্বাস চলছে পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের মধ্যে। বিদ্যুৎ ও ভালো ইন্টারনেট না থাকায় সোমবার এ গ্রামের কেউ খেলা দেখতে পারেননি। কিন্তু মনিকাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার খবরটা পেয়েছেন। মঙ্গলবার দিনের বেলা তাই অনেকেই অনলাইনে দেখেছেন সেই খেলা। নিজেদের গ্রামের মেয়ের এমন সফলতায় তারা ভীষণ উচ্ছ্বসিত। খুশিতে মিষ্টি বিতরণও হয়েছে গ্রামে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা