আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০৮:০৬
সরকার হটাতে ‘এক সুরে’ থাকতে চায় বিরোধীরা

সরকার হটাতে ‘এক সুরে’ থাকতে চায় বিরোধীরা

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: সংগৃহীত

আমানউল্লাহ আমান

নিজ দলের আদর্শ ও আন্দোলনের কৌশল ঠিক রেখে সরকার হটাতে নিজেদের এক সুতায় গাঁথার চেষ্টা করছে সরকারবিরোধী ডান, বাম ও মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন নেতারা। পাশাপাশি নিরপেক্ষ বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি থাকতে পারে অগ্রাধিকারের তালিকায়। সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দৈনিক বাংলাকে বলেন, আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একটা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে কাজ করছি এবং দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

রূপরেখায় বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনের বিষয় আসবে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আন্দোলনের রূপরেখায় বর্তমান সমস্যা ও সংকট তো থাকবেই। আমাদের মূল সমস্যা সরকারের পরিবর্তন, সেটার জন্যই আমাদের যুগপৎ আন্দোলন। একই ইস্যুতে নিজের নিজের জায়গা থেকে, নিজ নিজ দল থেকে একই সঙ্গে আন্দোলন করব।

এর আগে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ১১টি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি। সংলাপে বিরতি দিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও একই সুরে কথা বলছে। গত ৮ আগস্ট জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ-অধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ে আত্মপ্রকাশ করে সাতদলীয় জোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। আত্মপ্রকাশের পর থেকে সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে চাইছে জোটবদ্ধ দলগুলো।

জোটের আন্দোলনের রূপরেখা সম্পর্কে জানতে চাইলে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী দৈনিক বাংলাকে বলেছেন, যুগপৎ আন্দোলনের ধারণা আমরাই প্রথম দিয়েছি। বিএনপির সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি আলোচনাধীন আছে।  

সিপিবি-বাসদ ঐক্যের প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালের ১৮ জুলাই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’। সম্প্রতি জোটটির দুটি দল গণতন্ত্র মঞ্চে যোগ দিয়েছে।

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স দৈনিক বাংলাকে বলেছেন, বাম গণতান্ত্রিক জোট আছে। জোটের রাজনীতি নিয়ে সক্রিয় অবস্থানে রাজপথে আছি। বাম এবং গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সমবেত করার চেষ্টা করছি। আগামীতে যারা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির বাইরে বিকল্প শক্তির উত্থান চায়, দুঃশাসনের অবসান চায় এবং ব্যবস্থা বদলের সংগ্রাম করতে চায়, একই ধারায় জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম হবে। মূল সংগ্রাম জনগণের ঐক্য গড়ে তোলা।

সিপিবি ও বাম গণতান্ত্রিক জোট দ্বি-দলীয় ধারার বাইরে বিকল্প গড়ে তুলতে চায় দাবি করে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, যাদের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) বিরুদ্ধে লড়াই করে বিকল্প গড়ে তুলতে চাই, তাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং ওনাদের রাজনীতি বাদ দিয়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সঙ্গে যুগপৎ করবেন কি-না এটা প্রশ্ন হতে পারে।   

সিপিবি-বাসদ সূত্রে জানা যায়, আগামী ২২ সেপ্টেম্বর গণতান্ত্রিক বাম জোটের সম্মিলিত সভা রয়েছে। ওই সভায় জোটের চলমান ঘোষণা ও কর্মসূচিকে আরও সংক্ষিপ্ত আকার দেয়ার প্রস্তাব উঠতে পারে। রাজপথে শক্তি বৃদ্ধিতে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের নেতৃত্বাধীন ৯ সংগঠনের সঙ্গে সূত্রবদ্ধ হওয়ার আলোচনা চলমান রয়েছে।

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম দৈনিক বাংলাকে বলেছেন, বামজোট বর্তমান সরকারের অধীনেই রাজনৈতিক মীমাংসার পথ খুঁজছে বলে মনে হয়েছে। বামজোটের সঙ্গে একটা যুগপৎ কর্মসূচি করেছি। তারা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ নয়। জনগণ এই সরকারের পতন চায়। সেই ক্ষেত্রে বামজোটের সঙ্গে আগামী দিনে যুগপৎ আন্দোলন কতটা হতে পারবে সে বিষয়ে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল সন্দিহান। 

ফয়জুল হাকিম বলেন, সাম্রাজ্যবাদী মদদপুষ্ট এই ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের জন্য নিশ্চয়ই যুগপৎ আন্দোলন আগামী দিনে হতে পারে। বিএনপি এবং গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে কতগুলো মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু সরকারের পতনের জন্য ও আধিপত্যবিরোধী বিষয়ে যদি তারা ঐকমত্য পোষণ করে তাহলে একটা যুগপৎ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বাম জোট সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য’র নেতৃত্বাধীন ঐক্য ন্যাপ, ১৪ দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়া শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ বাম জোটের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছে। এই আলোচনায় মোস্তফা মহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরামও যুক্ত ছিল বলে জানা যায়।

এ প্রসঙ্গে বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ দৈনিক বাংলাকে বলেছেন, গণতন্ত্র মঞ্চ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে, আমরাও করব। ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছি। আন্দোলনের মাঠে যারা আছে তাদের সঙ্গে দেখা হবে। মাঠের আন্দোলনেই নির্ধারণ হবে যুগপৎ হবে- না ঐক্য হবে।

ক্ষমতাসীন জোটে থাকা দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ বা যুগপৎ আন্দোলনের কথা ভাবছেন না বলে দাবি করে বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, তারা সরকারের শরিক। তারা সরকারকেই ধারণ করে। এই মুহূর্তে তাদের সঙ্গে কোনো আন্দোলনের কথা ভাবছি না।

বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান দৈনিক বাংলাকে বলেছেন, সামনে দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনের পর জোট গঠন বা যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।  

ক্ষমতাসীন জোট ও বিরোধী জোটের বাইরে অবস্থান করছে মোস্তফা মহসীন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরীর গণফোরাম। দলটি সরকারবিরোধী আন্দোলনের বৃহত্তর ঐক্যের সঙ্গে থাকবে বলে জানিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়- এই দাবির ভিত্তিতে বিএনপিসহ বৃহত্তর ঐক্যের সঙ্গে থাকবে গণফোরাম।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। দফায় দফায় দলীয় কোন্দলের মুখে পড়ে গণফোরাম। পৃথক দুই অংশের একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. কামাল হোসেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে আবারও আলোচনায় আসেন তিনি।

তার দলের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেছেন, গণফোরামের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। দলকে সুসংগঠিত করার বিষয়ে ভাবছি। জোট বা যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে কোনো আলোচনা এখনো হয়নি। দল গুছিয়ে নিয়ে এ বিষয়ে অগ্রসর হবেন বলেও জানান তিনি।

সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল যুক্তফ্রন্ট। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জোটটি ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেয় যুক্তফ্রন্ট। বর্তমানে দুজন সংসদ সদস্য রয়েছে দলটির।

চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পযবেক্ষণ করছেন জানিয়ে বিকল্প ধারা বাংলাদেশের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান দৈনিক বাংলাকে বলেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মাঠ অনেকটা উত্তপ্ত। এই উত্তপ্ত মাঠে উত্তাপ ছড়িয়ে কোনো লাভ আছে? সময়মতো সিদ্ধান্ত নেব। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দলীয়ভাবে যা করণীয়, তা করব। তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে না যাওয়ার বিষয়েও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।