আপডেট : ৭ মে, ২০২৩ ০৮:৩৩
কেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা?
জিয়াউদ্দীন আহমেদ

কেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা?

পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার অর্থ দেয়ার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্টর্মি যাতে নির্বাচন পর্যন্ত মুখ বন্ধ রাখে সে জন্য ট্রাম্প তার উকিলের মাধ্যমে ২০১৬ সালে এই অর্থ দিয়েছিলেন। টাকা দেয়ার কথা ট্রাম্প কখনো স্বীকার করেননি। তবে ২০১৮ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে ট্রাম্পের আইনজীবী বলেছিলেন যে, স্টর্মিকে তিনি নিজের থেকে অর্থ দিয়েছিলেন, ট্রাম্প দিতে বলেননি। ৭৬ বছর বয়সী ট্রাম্প আদালতে হাজিরা দিতে ফ্লোরিডা থেকে নিউইয়র্কে পৌঁছলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তিনি সঙ্গে সঙ্গে জামিনও পেয়ে গেছেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ওই মামলা ছাড়াও পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলস মানহানির মামলাও করেছিলেন। যে দিন ট্রাম্পকে গ্রেপ্তার করা হয় সেই দিন আরেকটি আদালতের রায়ে মানহানির মামলায় স্টর্মি হেরে গেছেন। শুধু তাই নয়, মানহানির মামলা ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় স্টর্মিকে ট্রাম্পের আইনজীবীর খরচ বাবদ ১ লাখ ২২ হাজার ডলার দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিডিয়ায় অসংখ্য নারী ঘটিত অভিযোগ উঠেছিল। অতি সম্প্রতি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ তুলেছেন জেসিকা লিডস নামের ৮১ বছরের এক বৃদ্ধা। আরেকটি মামলা করেছেন ৭৯ বছর বয়সী নারী কলামিস্ট ই জিন ক্যারল। তার অভিযোগ হচ্ছে, একটি বিলাসবহুল দোকানের ট্রায়াল রুমে ট্রাম্প তাকে ধর্ষণ করেছেন।

শুধু নারী ঘটিত অভিযোগ নয়, বিজয়ের পেছনে রাশিয়ার হাত থাকার অভিযোগ নিয়েও তার গদিতে বসার প্রথম দিন থেকেই এফবিআই তদন্ত শুরু করে। অবশ্য কোনো অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, এবিসি নিউজ, সিএনএন, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, টাইম ম্যাগাজিন, নিউজ উইক-কে সবচেয়ে ‘অসৎ এবং ভুয়া সংবাদমাধ্যম’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ‘ফেইক নিউজ অ্যাওয়ার্ড’ দেয়ার ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু এবার বোধ হয় ফেঁসে যাচ্ছেন।

লাখ লাখ লোক ট্রাম্পের প্রতি অনুরক্ত। কারণ তিনি তার সব কর্মকাণ্ডে আমেরিকার স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তাকে গ্রেপ্তার করা হবে এই আশঙ্কায় শত শত ট্রাম্পভক্ত রাস্তায় নেমে আসেন। প্রেসিডেন্ট পদে ট্রাম্পের জয়লাভের পর দিন নিউইয়র্ক টাইমসে অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যানের লেখায় উল্লেখ ছিল, ‘ট্রাম্পের জয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে’। কিন্তু তার এই ভবিষ্যদ্বাণী যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হয়নি। কারণ ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি হিসেবে বিবেচিত হয়। তার শাসনামলে বেকারের হার ছিল সবচেয়ে কম। তার অন্যতম সাফল্য হচ্ছে কর সংস্কার এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারপূর্বক বিরাজমান বিশ্ব উত্তেজনা হ্রাস করা। এখনো তিনি জোর গলায় বলে যাচ্ছেন যে, আবার ক্ষমতায় গেলে এক দিনের মধ্যেই তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে সক্ষম হবেন।

আমেরিকা এবং ইউরোপে পরস্পরের সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্যে কোনো আইনগত বাধা নেই। তারপরও পশ্চিমের দেশগুলোতে বিশেষ করে আমেরিকায় নির্বাচন এলেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নারীদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিরোধী মিডিয়ায় যৌন হয়রানি করার অভিযোগ উঠতে থাকে। নির্বাচনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপনের প্রধান কারণ হচ্ছে, সংবাদের সত্যাসত্য বিচারের ক্ষমতা সবার থাকে না। এ ছাড়াও স্বার্থের অনুকূল ভুয়া খবরে স্বার্থান্বেষীরা প্রলুব্ধ হয়, তাৎক্ষণিক যাচাইয়ের সুযোগ না থাকায় সচেতন লোকরাও এতে প্রভাবিত ও প্রতারিত হয়ে থাকে। ডিজিটাল যুগে প্রচুর অনলাইন নিউজ ইতিমধ্যে ভুয়া ও ঝুঁকিপূর্ণ তথ্য পরিবেশনার জন্য ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত হচ্ছে। ভুল সংবাদ প্রচারের পর মাফ চেয়ে পত্রিকা বেঁচে গেলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সুনাম আর পুনরুদ্ধার হয় না। তাই ব্যক্তি ভুয়া সংবাদ প্রকাশের আগেই আপস করতে বাধ্য হয়। সম্ভবত ট্রাম্পও এমন পরিস্থিতিতে পর্নো তারকা স্টর্মির মুখ বন্ধ করতে ঘুষ দিয়েছিলেন।

পশ্চিমের দেশগুলোতে শাবালক ছেলের কোনো মেয়ে বান্ধবী বা শাবালিকা মেয়ের কোনো ছেলে বন্ধু না থাকলে অভিভাবকরা অস্থির হয়ে ওঠেন। এই ক্ষেত্রে বিপদ হয় অভিবাসীদের। তারা ওই সব দেশের নাগরিকত্ব নিলেও ওদের সংস্কৃতি মানতে নারাজ। তাদের অবাধ মেলামেশার সংস্কৃতি থেকে নিজের সন্তানদের মুক্ত রাখতে নাস্তিক মা-বাবাও সন্তানদের ধর্ম শিক্ষায় নীতিনিষ্ঠ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে থাকেন, হিজাব বা বোরকা পরতে অভ্যস্ত করান, নামাজ-রোজা পরিপালনে কঠোরতা অবলম্বন করেন। তারপরও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে ডেটিংয়ে যাওয়ার সময় মেয়ের অজান্তে মা এক গ্লাস দুধের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণের পিল লুকিয়ে খাইয়ে দেন। কিন্তু পাকিস্তানের কিছু পরিবার অভিবাসী মারাত্মক কট্টর। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক গোচরীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে কোনোভাবে দেশে নিয়ে হত্যা করে পরিবারের সম্মান রক্ষা করে থাকে। এই হত্যাকে তারা বলে ‘অনার কিলিং’। অন্যদিকে বিবাহবহির্ভূত সন্তান ধারণ করা পশ্চিমের প্রায় সব দেশে জায়েজ। ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনেরও বিবাহবহির্ভূত বউ আর সন্তান রয়েছে। সেই সন্তানের জন্মের পর সারা ইংল্যান্ডবাসী আনন্দ করেছে, উল্লাস করেছে। চারটি সন্তান জন্ম নেয়ার পর বিশ্বসেরা ফুটবলার দিয়েগো মেরাডোনা তার শয্যাসঙ্গী প্রেমিকাকে বিয়ে করেন। তবে তারা প্রেমের ক্ষেত্রে নীতিনিষ্ঠ, যতক্ষণ বিশ্বস্ত ততক্ষণ বন্ধন অটুট রাখেন।

আইন ভঙ্গ না করে অতি সহজে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা গেলেও পশ্চিমের লোকগুলো তাদের নেতাদের পূতপবিত্র দেখতে চান, তারা প্রত্যাশা করেন তাদের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী থাকবেন সৎ ও বিশ্বস্ত। পতিতার সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সংসার করলেও জনগণের আপত্তি নেই। আপত্তি হচ্ছে বিশ্বাস ভঙ্গের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে। পর্নো স্টার মানে নীল ছবির নায়িকা, নীল ছবির নায়িকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সঙ্গে ট্রাম্প লিভ টুগেদার করলে বা সংসার পাতলেও জনগণ ভোট প্রদানে তা বিবেচনায় নিতো না। কিন্তু বউকে ঠকিয়ে গোপনে যৌন সম্পর্ক থাকার খবরটি নির্বাচনকালীন সত্য প্রমাণিত হলে হয়তো তিনি জয়ী হতে পারতেন না, হয়তো তার পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হতো। কিন্তু তাতে দেশের আইন ভঙ্গ হতো না। এই ক্ষেত্রে ট্রাম্প যে অপরাধটি করেছেন তা হলো, সত্য গোপন করা এবং ঘুষ দেয়া। একই অপরাধ করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ১৯৯৮ সালে ওভাল অফিসে ক্লিনটন-মনিকা যৌন সম্পর্কের খবর বিশ্বজুড়ে আলোচনার ঝড় উঠলেও ক্লিনটন প্রথমে তা অস্বীকার করেন এবং মনিকার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মিথ্যা বলায় প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে সে সময় অভিশংসনের হুমকিতেও পড়তে হয়।

৩৪টি অভিযোগে অভিযুক্ত ট্রাম্প। ট্রাম্প যাতে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারেন সে জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এসব মামলা- এই মতামত আমার নয়, ৯৩ শতাংশ রিপাবলিকানের, এটা ট্রাম্পের রাজনৈতিক দল। অন্যদিকে জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক দলের ৯৪ শতাংশ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা যথার্থ অভিধায় সমর্থন করছেন। অন্যদিকে ৫১ শতাংশ মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পকে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিষিদ্ধ করার পক্ষে। ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির লোক, গ্রেপ্তার হওয়ার পর ৪০ শতাংশ রিপাবলিকানের ট্রাম্পকে ভোট দেয়ার ইচ্ছা বেড়ে গেছে, অন্যদিকে মাত্র ১২ শতাংশ ট্রাম্পকে আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায় না। আগামী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের মধ্যে মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের আগে ট্রাম্পের সমর্থন ছিল ৪৮ শতাংশ, এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ শতাংশে। ট্রাম্পের সমর্থন বাড়লেও ৭৩ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করে যে, পর্নো চলচ্চিত্রের অভিনেত্রীর সঙ্গে ঘটনাটি সত্যি সত্যি ঘটেছে। স্টর্মি ড্যানিয়েলস এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমি মনে করি না যে, আমার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের অপরাধ কারাদণ্ডের যোগ্য’। তবে কারও মতামত দিয়ে আদালত চলে না, সব অভিযোগে দোষীসাব্যস্ত হলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ১৩৬ বছর জেলে কাটাতে হবে।

ট্রাম্পের প্রচুর অন্ধভক্ত রয়েছেন, তাদের আচরণ আমাদের তৃতীয় বিশ্বের আবেগী জনতার মতো। শত অপরাধেও তাদের নেতা নির্মল ও নিরপরাধী। ট্রাম্প হেরে গেলে ভোট কারচুপির অভিযোগে তার অন্ধ ভক্তরা গণতন্ত্রের প্রতীক ক্যাপিটাল হিল আক্রমণ করে তছনছ করে দেন, ট্রাম্পের গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদ শুনে তার সমর্থকরা রাস্তায় নেমে আসেন। ভালো-মন্দ বিচার না করে নিজের দল ও নেতাকে অন্ধভাবে সমর্থন করছেন রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটরা। রিপাবলিকানরা মনে করছেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা আমেরিকার গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে। অন্যদিকে ডেমোক্রেটরা মনে করেন গণতন্ত্রকে এ মামলা শক্তিশালী করবে। এগুলো সম্পূর্ণ আমাদের দেশের চিত্র। দলকে অন্ধ সমর্থন ছাড়াও কোনো নেতা বা নেত্রী আদালতে গেলে দলীয় আইনজীবীদের ঠেলাঠেলিতে শুধু পুলিশ নয়, সংশ্লিষ্ট নেতা বা নেত্রীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুরু হওয়ার পর হতে অজস্র অভিযোগ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়েছে এবং হচ্ছে, সব অভিযোগই ট্রাম্প অস্বীকার করেছেন। একজন প্রেসিডেন্টের অভিযুক্ত এবং গ্রেপ্তার হওয়া আমেরিকার ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। তাই ট্রাম্পকে ফাঁসিয়ে জো বাইডেন হয়তো খুশি, কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকার মান-ইজ্জত বোধ হয় আর থাকছে না।

লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক