একে দরিদ্র পরিবারে জন্ম, তার ওপর আবার জন্ম থেকেই শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী। ফলে লেখাপড়া আর হয়ে ওঠেনি রূপালীর। কিন্তু তার কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল সব সময়। তাইতো সুযোগ যখন পেয়ে গেল, তখন সাঁতারটাই শিখে নিল বেশ ভালো করে। আর সে কারণেই এখন সব প্রতিবন্ধিতার ঊর্ধ্বে উঠে ‘স্পেশাল অলিম্পিক সামার ওয়ার্ল্ড গেমস-২০২৩’-এর সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাচ্ছে জার্মানির বার্লিনে। আগামী ১২ থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে এ প্রতিযোগিতা।
রূপালী খাতুনের (১৬) বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার মাইজপাড়া ইউনিয়নের তারাশি গ্রামে। বাবা টুকু মিয়া শেখ অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে রূপালী ছোট। বড় ভাইয়েরাও কৃষিকাজে নিয়োজিত। বোন সোনালী খাতুন দশম শ্রেণিতে পড়ে।
রূপালীর মা রিক্তা বেগম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল। এলাকায় খেলাধুলার আয়োজন হলেই ছুটে যেত অংশ নিতে। কিন্তু মেয়ে হওয়ায় স্থানীয় লোকজন আজেবাজে কথা বলত। এ কারণে ১৩ বছর বয়সে তার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়ে রাজি না হওয়ায় বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে প্রতিবন্ধীদের জন্য ভালো কোনো স্কুল না থাকায় মেয়েটি আমার পড়াশোনা করতে পারল না। তবে এখনো প্রতিবছর ২৬ মার্চসহ এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খেলাধুলায় অংশ নেয় রূপালী। পুরস্কার নিয়ে বাড়িতে ফেরে। তখন আমাদের ভালো লাগে।’
সরেজমিনে রূপালীদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, দুটি ঘরে ছয় সদস্যের এই পরিবারের বসবাস। রূপালী যে ঘরটিতে থাকে সেখানে তার বোন সোনালীর পড়ার টেবিল ও ১টি টেলিভিশন। ওই পড়ার টেবিলেই চলে তাদের সাজগোজের কাজ।
প্রতিবেশীরা জানান, রূপালীর প্রতিদিনের চাওয়া-পাওয়ার কাজ চলে ইশারায়। সে কবুতর খুব ভালোবাসে। ঝুপড়ি ঘরের পাশে বাবা-মা প্রতিবন্ধী মেয়ের শখ পূরণের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন কবুতরের একটি ঘর। প্রতিদিন সকাল-বিকেল সে ইশারায় খাবার ছড়িয়ে কবুতর ডাক দেয় আর মিট মিট করে হাসে।
রূপালীর বাবা টুকু মিয়া জানান, নড়াইল শহরে সিকদার ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিওর পরিচালক পান্নু সাহেব তাদের গ্রামে আসেন। তিনি রূপালীর সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তাকে সাঁতার শেখাতে চান। এরপর মরাচিত্রা নদীতে শুরু হয় রূপালীর সাঁতার প্রশিক্ষণ। একপর্যায় পান্নু সাহেব রূপালীকে খুলনায় এবং পরে ঢাকায় সাঁতার প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেন। এরপর সে দেশে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
তিনি আরও জানান, গত কয়েক বছরে দেশের ভেতর ৭টি সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় রূপালী। তার মধ্যে ৬টিতেই সে প্রথম হয়েছে। এভাবেই সে স্পেশাল অলিম্পিক বাংলাদেশ কর্তৃক অ্যাথলিট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ‘স্পেশাল অলিম্পিক সামার ওয়ার্ল্ড গেমস-২০২৩’-এ অংশ নিতে জার্মানি যাচ্ছে।
সিকদার ফাউন্ডেশনের পরিচালক মনজুরুর রহমান পান্নু বলেন, নড়াইলের স্বাবলম্বীর নির্বাহী পরিচালক কাজী হাফিজুর রহমানের প্রচেষ্টায় এলাকায় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ শুরু হয়। আমিও এতে জড়িত হই। অন্য অনেকের মতো রূপালীকেও প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তার ইচ্ছাশক্তি আর চেষ্টাই তাকে আজ স্পেশাল অলিম্পিকে নিয়ে যাচ্ছে।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়া সংগঠক বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের মহাসচিব এবং নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক (বার) আশিকুর রহমান মিকু দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে মোট ছয়জন প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে নড়াইলের রূপালী খাতুন একজন। নিশ্চয়ই সে দেশের জন্য মুখ উজ্জ্বল করে তবেই ঘরে ফিরবে।’
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা