মোহাম্মদ হাননান
ঠিক কবে থেকে বাংলা ভাষায় পবিত্র কোরআন অনূদিত হয়ে আসছে, তা নিয়ে নানান মত ও বিতর্ক রয়েছে। প্রথমে এ বিষয়ে আসে গিরিশ চন্দ্র সেনের নাম। গিরিশ সেন কোরআন অনুবাদ করেছিলেন ১৮৮৫ সালে। তিনি পবিত্র কোরআনের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদক। অর্থাৎ কোরআনের ৩০ পারা তিনিই প্রথম একত্রে অনুবাদ করেছিলেন। তবে তারও আগের কয়েকটি ঘটনা-
এক. ১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মধ্য যুগের কবি শাহ মুহম্মদ সগীর পবিত্র কোরআনের সূরা ইউসুফ তাফসিরসহকারে কাব্যাকারে অনুবাদ করেন।
বাংলা ভাষায় এটাই পবিত্র কোরআনের অংশবিশেষের প্রথম অনুবাদ।
দুই. গদ্য আকারে পবিত্র কোরআন অনুবাদ শুরু হয় আরও ৪০০ বছর পরে। ১৮০৮ সালে রংপুরের আমীর উদ্দীন বসুনিয়া কোরআনের ৩০তম পারা (আমপারা) অনুবাদ করেন, তাও বাংলা পয়ার ছন্দে।
তিন. ১৮৬৮ সালে আকবর আলী প্রথম গদ্য আকারে ‘আমছেপারা’ নামে কোরআন অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। কোনো কোনো গবেষক আকবর আলীকেই কোরআনের প্রথম অনুবাদক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। [দেখুন, মোফাস্সির হাসান খান: পবিত্র কোরআনের ইতিহাস ও বঙ্গানুবাদের শতবর্ষ, বাংলা একাডেমি ১৯৯৭]
চার. ১৮৭৩ সালে পাদ্রি তারাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কোরআনের ১২টি পারা অনুবাদ করে পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে থাকেন। পুস্তক আকারে তা প্রকাশ হয় ১৮৮২ সালে।
পাঁচ. ১৮৭৯ সালে রাজেন্দ্রনাথ মিত্র কোরআনের প্রথম পারা সূরা বাকারা অনুবাদ করেন।
ছয়. এরপরই গিরিশ চন্দ্র সেনের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ১৮৮১ সালে প্রথম খণ্ড এবং ১৮৮৫ সালে তিন খণ্ড একত্রে প্রকাশ করে গিরিশ চন্দ্র সেন পবিত্র কোরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। গিরিশ চন্দ্র সেনের অনুবাদে একটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি অনুবাদের পাশাপাশি কোরআনের তাফসির অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি ঢাকার নরসিংদীর অধিবাসী। গিরিশ সেনের মাতৃভাষা ছিল ফারসি। ব্রাহ্ম সমাজের নির্দেশে তিনি আরবি উর্দু শিখে নেন এবং সফলভাবে পূর্ণাঙ্গ কোরআন অনুবাদ করেন। [কিন্তু গিরিশ চন্দ্র সেনের অনূদিত কোরআন মুসলিম সমাজে সমাদর লাভ করেনি।] যেসব কারণে মুসলিম সমাজে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল তার উপাদানগুলোর অন্যতম হলো-
১. গিরিশ চন্দ্রের অনুবাদে সংস্কৃতজাত শব্দ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত ধর্মীয় শব্দ অধিক ব্যবহৃত হয়েছিল। যা আরবি ভাষার মতোই সাধারণের কাছে কম দুর্বোধ্য ছিল না।
২. গিরিশ চন্দ্র সেনের অনুবাদে মূল আরবি পাঠ ছিল না।
৩. এর মধ্যে অনেক মুসলিম কোরআন অনুবাদে হাত দেন। মুসলিমের অনুবাদগ্রন্থে কোরআনের মূল আরবি পাঠ সংযুক্ত থাকায় তাদের অনুবাদ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং গ্রহণযোগ্যতা পায়।
৪. গিরিশ চন্দ্র সেন ব্রাহ্ম, হিন্দু নন। তৎকালীন মুসলমানের কাছে ব্রাহ্ম ও হিন্দুর পার্থক্য সুস্পষ্ট ছিল না। এখনো মুসলিমরা ব্রাহ্ম ও হিন্দুর পার্থক্য বোঝে না। রবীন্দ্রনাথকে মুসলিমরা হিন্দুই মনে করে। অবশ্য হিন্দুরাও রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু মনে করে। অথচ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রাহ্ম। ব্রাহ্মরা মুসলিমদের মতো এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এবং মূর্তি পূজা করে না। ব্রাহ্ম মেয়েরা মুসলমানদের চেয়েও কঠিন পর্দা করত। তবু ব্রাক্ষ গিরিশ সেন কর্তৃক কোরআন অনুবাদে মুসলিমদের জাত্যভিমানে আঘাত করেছিল। ফলে তারা সচেতনভাবে গিরিশ সেনের অনুবাদ থেকে দূরে থাকে।
সাত. গিরিশ চন্দ্র সেনের কোরআন অনুবাদের ঘটনা যে মুসলিম সমাজে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় পবিত্র কোরআন বাংলা ভাষায় অনুবাদে বাঙালি আলেমদের আগমনের ঘটনায়। বাঙালি আলেম সমাজ এর আগে কোরআন বঙ্গানুবাদের বিষয়টিতে ততটা গুরুত্ব দেয়নি, কারণ সে সময় পবিত্র কোরআনের আরবি, ফারসি এবং উর্দু অনুবাদ শিক্ষিত সমাজে সুলভ ছিল। সেকালে উচ্চ শ্রেণির হিন্দু-মুসলিম সমাজে ফারসি ও উর্দু ভাষা ব্যাপকভাবেই প্রচলিত ছিল। এ প্রেক্ষাপটেই মওলানা নঈম উদ্দীন সেই ঊষাকালে বঙ্গভাষায় পবিত্র কোরআন অনুবাদে এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোরআন অনুবাদ তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। মৃত্যুর পরে তার সন্তানরা পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেন।
একজন অমুসলিম কর্তৃক পবিত্র কোরআন অনুবাদে ভুলত্রুটি থাকতে পারে, যাতে মুসলিমদের ইমান-আকিদা সংশয়ে পড়তে পারে- এ চিন্তা থেকেও মুসলিমরা গিরিশ সেনের অনুবাদকে খুব একটা সুনজরে দেখেননি। যদিও মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখ গিরিশ সেনকে অভিনন্দিত করেছিলেন এবং ‘ভাই গিরিশ সেন’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
আট. মুসলমান এবং মুসলমানদের আলেমদের হাতে পবিত্র কোরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে মওলানা আব্বাছ আলীর হাতে। গবেষকদের মতে, মওলানা আব্বাছ আলী হলেন বাংলা ভাষায় কোরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মুসলমান অনুবাদক। এর আগে মওলানা নঈমউদ্দীন কোরআন অনুবাদের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তা পূর্ণাঙ্গভাবে সফল হয়েছিল তার সন্তানদের দ্বারা। কিন্তু মওলানা আব্বাছ আলী নিজেই পবিত্র কোরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ সমাপ্ত করতে সমর্থ হন। এ বিবেচনায় মুসলমান এবং তাদের আলেমদের মধ্যে তিনিই প্রথম কোরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করতে সমর্থ হন। তবে এটা গিরিশ চন্দ্র সেনের ২০ বছর পর ঘটে।
নয়. এরপর জোয়ারের মতো পবিত্র কোরআন বাংলা ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। ১৩৮৯ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮৪ জন পবিত্র কোরআন তরজমা করতে এগিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে ৭৬ জন মুসলিম, ২ জন হিন্দু, ৩ জন খ্রিষ্টান এবং ৩ জন ব্রাহ্ম। মুসলিমদের মধ্যে ৪২ জন সাধারণ মুসলিম, আলেম ২১ জন, পির-মাশায়েখ ৭ জন এবং বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ৬ জন।
দশ. বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ১৩৮৯-১৯৪৭ সময়ে যারা কোরআন তরজমা করেছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন- ১. কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর (১৩৮৯), ২. রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৯২২), ৩. মওলানা আকরম খাঁ (১৯২২), ৪. কবি নজরুল ইসলাম (১৯৩৩), ৫. বিজ্ঞানী ড. কুদরত-এ-খুদা (১৯৪৫), ৬. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৪৬)।
এগার. ১৩৮৯-১৯৪৭ সময়ে দুজন নারী পবিত্র কোরআন অনুবাদ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। তার মধ্যে বেগম রোকেয়া (১৯৩৩) এবং বেগম নূর মহল (১৯৪০) অন্যতম।
বাংলা ভাষায় কোরআন ১৮০৮-১৯৪৭ সময়ে যেসব জায়গা থেকে তরজমা হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, সেসব স্থানগুলোও ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর অধিকাংশ প্রকাশক ও মুদ্রাকর ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায় থেকে আগত। এর মধ্যে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ৩৬টি, ঢাকা থেকে ৬টি, টাঙ্গাইল থেকে ৩টি, রংপুর থেকে ২টি, কুমিল্লা থেকে ২টি, ত্রিপুরা থেকে ১টি, চট্টগ্রাম থেকে ২টি। ফরিদপুর, দিনাজপুর, চব্বিশ পরগনা, যশোর, নোয়াখালী, বরিশাল, নদীয়া, জামালপুর, হবিগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া থেকে একটি পুরো কোরআন অনুবাদের সংবাদ পাওয়া যায়। ৪টি অনুবাদের প্রকাশনা স্থান জানা যায় না।
তের. ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মনে হয়েছিল এ অঞ্চলে মুসলিমদের সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার অবাধ সুযোগ ঘটবে। কিন্তু পাকিস্তানিরা এখানে বাংলা চর্চার চেয়ে উর্দু চর্চার দিকে অধিক মনোযোগ দেন। বাংলা ভাষায় কোরআন চর্চাও বাধাগ্রস্ত হয়। ড. কুদরত-এ-খুদার অনূদিত কোরআনের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে ১৯৪৫ সালে। তিনি দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৪৭ সালে প্রকাশ করলেন ঢাকা থেকে। কিন্তু কিছু ভাষা ও শব্দের ব্যাপারে আপত্তি তুলে তার অনূদিত কোরআনের বিরোধিতা করা হয়। তবে ড. খুদাই পাকিস্তানের বাংলা ভাষায় প্রথম কোরআন অনুবাদক।
চৌদ্দ. পাকিস্তান আমলে কবি গোলাম মোস্তফা সূরা ফাতিহা অনুবাদ করে বিখ্যাত হন। ‘প্রার্থনা’ নামে তার এ অনুবাদ স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়। ‘অনন্ত অসীম/প্রেমময় তুমি/বিচার দিনের স্বামী’ ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু আল্লাহ অর্থে ‘স্বামী’ শব্দ ব্যবহার করে তিনি সমালোচিত হননি, কারণ তিনি পাকিস্তানপন্থি বুদ্বিজীবী বলে পরিচিত ছিলেন। অথচ ড. কুদরত-এ-খুদা ‘এবাদত’ অর্থে ‘পূজা’ শব্দ ব্যবহার করে সমালোচিত হন।
পনেরো. পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষায় পবিত্র কোরআন অনুবাদে বিশেষ উদ্যোগ দেখা যায় না। কারণ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যেখানে উর্দু হবে, সেখানে বাংলা ভাষায় কোরআন অনুবাদ করে কী লাভ হবে, এমন একটা মনোভাব লক্ষ করা যায়। এ প্রেক্ষাপটেই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতা আবদুল ওদুদ ১৯৬৬ সালে পবিত্র কোরআন অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগাররা, বিশেষ করে ঢাকার খাজা-নবাবরা কাজী ওদুদকে এমনিতেই পছন্দ করেন না, তার মধ্যে বাংলা ভাষায় কোরআন অনুবাদ, এটা তারা সহ্য করতে পারেননি। ফলে কাজী আবদুল ওদুদকে চিরদিনের জন্য ঢাকা ছাড়তে হয়। অথচ পবিত্র বাংলা সাহিত্যরসে সিক্ত হয়ে তার হাতেই প্রথম কোরআন প্রকাশিত হয়েছিল। তবে ১৯৬৪ সালে প্রথমবারের মতো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়ে ঢাকা থেকে কোরআন অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। ইসলামিক একাডেমি (পরে ইসলামিক ফাউন্ডেশন) থেকে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। আলেম এবং বুদ্ধিজীবীরা মিলিতভাবে এ অনুবাদে অংশ নেন। আরবি বাগধারা ও অলংকার এতে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া এ অনুবাদে এক পৃষ্ঠায় দুই কলামে বাংলা ও আরবি পাশাপাশি অবস্থান করায় তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
ষোলো. পাকিস্তান আমলের জড়তা ও স্থবিরতা কাটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পবিত্র কোরআনের কার্যক্রমে জোয়ার আসে। এর মধ্যে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মুফতি মোহাম্মদ শাফির তাফসিরকৃত কোরআন অনুবাদ করেন মাওলানা মুহিউদ্দিন খান। বাংলা ভাষায় প্রথম ঝরঝরে এক অনুবাদ কোরআন পাঠকরা লাভ করেন পরে। ১৯৯৪ সালে সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহাদের তত্ত্বাবধানে মদিনা থেকে প্রকাশিত হয়। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী এ অনুবাদ পাঠক্রমের বিরুদ্ধে সেদিন বাদশাহের কাছে অভিযোগ তুললে পরবর্তী সময়ে এর প্রকাশ ও বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীন বাংলাদেশে ২০০০ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ‘কোরআন শরিফ: সরল বঙ্গানুবাদ’ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি নিজে ভাষাসৈনিক ছিলেন বলে এত দিনের অপেক্ষিত একটি সহজ-সরল অনুবাদ তার হাত দিয়েই বেরিয়ে আসে।
লেখক: লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ
১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে কবি মুহাম্মদ সগীরের হাতে বাংলা ভাষায় কোরআন অনুবাদের ইতিহাসের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা এখন ব্যক্তি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপও পেয়েছে। পূর্বের তুলনায় আলেম সমাজের হাতে অনুবাদ কাজ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিশুদ্ধভাবে কোরআন চর্চার পথকে সমৃদ্ধতর করেছে।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা