আপডেট : ১৭ মে, ২০২৩ ১১:৪৮
পরিবার পরিকল্পনার সেবা পাচ্ছে না কেউই
মাসুম বিল্লাহ, গাইবান্ধা

পরিবার পরিকল্পনার সেবা পাচ্ছে না কেউই

গাইবান্ধার গ্রামাঞ্চলের নারীরা সরকারিভাবে ‍বিদ্যমান বিনা মূল্যের পরিবার পরিকল্পনা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়া সব ধরনের পরামর্শ ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত থাকছেন কিশোরীসহ গর্ভবতীরাও। প্রতি মাসে স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম, দলগত উঠান বৈঠক, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাউন্সেলিং বা স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও এসবের কোনোটিই করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

অভিযোগ রয়েছে জেলার সাত উপজেলায় এলাকাভেদে তিন থেকে আট বছর ধরে বিনা মূল্যের এসব সরকারি সেবা ও কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। এর ফলে সরকারি এসব সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নিম্ন আয়ের এক বিশাল জনগোষ্ঠী। আর জনবলের সংকটকেই এসব সেবা দিতে না পারার কারণ হিসেবে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্বাস্থ্য ও পছন্দ অনুযায়ী, নারীদের জন্য সরকারিভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হিসেবে প্রচলিত রয়েছে খাবার বড়ি, ইনজেকশন, ইমপ্ল্যান্ট (হরমোন সমৃদ্ধ অস্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি), আইইউডি (জরায়ুতে স্থাপন উপযোগী অস্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ) ও লাইগেশন (বন্ধ্যাকরণ) এবং পুরুষের জন্য রয়েছে এনএসভি (পুরুষ বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি) ও কনডম। তবে গাইবান্ধার স্থানীয় নারী ও একাধিক নবদম্পতির অভিযোগ, এসবের কোনোটিই তারা পাচ্ছেন না। শুধু তাই নয়, দুয়েকটি পদ্ধতি ছাড়া বাকিগুলো সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই।

এদিকে কিশোরীরা বঞ্চিত তাদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন বিষয়ে কাউন্সেলিং, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহার, বাল্যবিবাহ ও কিশোরী মাতৃত্বের কুফল, কৈশোর সহিংসতা প্রতিরোধ এবং প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ ও যৌনবাহিত রোগবিষয়ক সেবা ও কাউন্সেলিং থেকে। এ ছাড়া আয়রন বা ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেটের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তা থেকেও বঞ্চিত কিশোরীরা।

স্থানীয়রা আরও অভিযোগ করছেন, নবদম্পতি ও অন্তঃসত্ত্বা বা প্রসূতিরা গর্ভকালীন ও প্রসব-পরবর্তী পরামর্শ এবং পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিবিষয়ক সেবা থেকে একেবারেই বঞ্চিত। কিছু বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করলেও তা অপ্রতুল। ফলে এসব সেবা ও পরামর্শপ্রত্যাশী কিশোরী, নবদম্পতি ও গর্ভবতী-প্রসূতিদের একমাত্র ভরসা পল্লি চিকিৎসক বা গ্রাম্য ডাক্তার।

সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামের মুর্শিদা বেগম বলেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় ১০ বছর। প্রথম বাচ্চার বয়স ৯ বছর। প্রথমপর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা সেবা পেলেও গত আট বছরে পুরুষ বা মহিলা কারও কাছ থেকেই কোনো সেবা বা পরামর্শ পাইনি।’

একই অভিযোগ ওই এলাকার অন্য নারীদেরও। তারা জানান, আট বছর হলো পরিবার পরিকল্পনা অফিসের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ওই এলাকায় যান না। ফলে এলাকার নবদম্পতি, কিশোরী ও অন্তঃসত্ত্বা নারীরাও বিনা মূল্যের সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের কুমারগাড়ী গ্রামের রফিকুল-বিপাশা দম্পতি বলেন, ‘আমাদের বিয়ে হয়েছে তিন বছর হলো। আমার স্ত্রী আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এর মধ্যে কোনো ধরনের পরামর্শ বা সেবাই আমরা পাইনি। আমাদের কাছে ওই অফিসের কেউ কোনো দিন আসেনি। যেকোনো পরামর্শের জন্য স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়।’

ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের বাজেতেলকুপি গ্রামের মালেক মিয়া বলেন, পরিবার পরিকল্পনা অফিস থেকে প্রতি মাসে স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম, দলগত উঠান বৈঠক আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেয়ার কথা। কিন্তু চরাঞ্চলের কোনো ইউনিয়নে এ ধরনের সেবা দেয়া হচ্ছে না। ফলে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে এখানকার মানুষের মধ্যে কোনো সচেতনতা নেই।

বোয়ালী ইউনিয়নে কর্মরত ফ্যামিলি প্লানিং ইন্সপেক্টর (এফপিআই) আরিফুজ্জামান মণ্ডল বলেন, ছয় বছর ধরে এই ইউনিটে (বোয়ালী-৩ ক) পরিবার কল্যাণ সহকারীর (এফডব্লিউএ) পদ শূন্য। তাই ওই এলাকায় কোনো ধরনের সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া ওই ইউনিয়নে একজন ভিজিটর থাকলেও তাকে গাইবান্ধা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র (মাতৃসদনে) প্রেষণে দেয়া হয়েছে। ফলে বোয়ালী ইউনিয়নে স্যাটেলাইট কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

এদিকে কর্মী না থাকার কারণে দীর্ঘ সময় ওই সব এলাকার কিশোরী, নবদম্পতি ও গর্ভবতীদের সেবাবঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি জানা নেই সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহবুবা খাতুনের। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘এমন হওয়ার কথা নয়। যেসব ওয়ার্ডে পরিবার কল্যাণ সহকারীর (এফডব্লিউও) পদ শূন্য রয়েছে, সেখানে তার নিকটতম ইউনিটের কর্মীদের সেবা দেয়ার কথা। এর ব্যত্যয় হলে বিষয়টি দেখব।’

স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম ঠিকমতো হচ্ছে না স্বীকার করে মাহবুবা খাতুন বলেন, ‘সদর উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের মধ্যে চারটি ইউনিয়নে প্রতি মাসে আটটি স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম হওয়ার কথা থাকলেও হচ্ছে চারটি করে। জনবল না থাকায় বাকি ৯টি ইউনিয়নে কর্মসূচিটি চালানো যাচ্ছে না।’ এতে বৃহত্তর প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে স্বীকার করেন তিনি। বলেন, তিনি একাই জেলার চারটি উপজেলায় উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের তথ্যেও প্রকট জনবল সংকটের চিত্র উঠে আসছে। তথ্য বলছে, গাইবান্ধায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন খাতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুমোদিত পদ ৯৫৬টি। এর মধ্যে কর্মরত ৬৫৮ জন, শূন্য পদ ২৯৮টি। এর মধ্যে মাঠপর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কিত সেবা ও পরামর্শ বাস্তবায়নের জন্য ৮১টি ইউনিয়নের এই জেলার সাত উপজেলায় সাতজন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন মাত্র একজন, ৫৫ জন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের (এসএসিএমও) বিপরীতে রয়েছেন ৩০ জন।

এ ছাড়া জেলার সেবাপ্রত্যাশী কিশোরী, নারী, নবদম্পতি ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে সেবা দিতে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকের (এফপিআই) ৮২ পদের মধ্যে রয়েছেন ৬৯ জন, ৯৯ জন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকার (এফডব্লিউভি) বিপরীতে রয়েছেন ৪২ জন এবং ৪৭১ জন পরিবার কল্যাণ সহকারীর (এফডব্লিউএ) অনুমোদিত পদের ১৭২টিই শূন্য।

জনবলসংকটের কারণেই প্রান্তিক পর্যায়ে সেবা পৌঁছাতে না পারার কথা স্বীকার করে নিলেন জেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসের উপপরিচালক প্রসেনজিৎ প্রণয়। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘একজনকে দিয়ে একাধিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আগে একজন এফডব্লিউএ ৫০০-৬০০ জনকে সেবা দিতেন। এখন সেবা দিতে হচ্ছে ১৫০০-২০০০ জনকে।’ বিদ্যমান জনবল দিয়েই শূন্য এলাকাগুলোতে অন্তত এক দিন করে হলেও সরকারের বিনা মূল্যের এসব সেবা পৌঁছে দিতে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিলেন এই কর্মকর্তা।