দেশে বিনিয়োগে মন্দা চলছে। করোনা মহামারির মধ্যেও অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত অর্থবছরে জাতীয় বিনিয়োগ (বর্তমান মূল্যে) জিডিপির ৩২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সাময়িক হিসাবে চলতি অর্থবছরে তা কমে ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। সরকারি বিনিয়োগ কিঞ্চিৎ বাড়লেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বেশ খানিকটা কমেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে আগামী ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে চলতি বা বর্তমান মূল্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা; মোট বিনিয়োগ হয়েছে ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। এ হিসাবেই চলতি অর্থবছরে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে জিডিপির ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ।
গত মঙ্গলবার এই তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস। তবে এটি চূড়ান্ত নয়, প্রাথমিক বা সাময়িক হিসাব। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর) তথ্য হিসাব করে এই তথ্য প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপির আকার, প্রবৃদ্ধির হার ও মাথাপিছু আয়সহ অন্যান্য সূচক কিছুটা কমবেশি হয়ে থাকে। বরাবরই এমনটা হয়ে থাকে।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে দেশে জিডিপির আকার ছিল ৩৯ লাখ ৭১ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২ লাখ ৭২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ।
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেই মূলত দেশে বিনিয়োগ কমে গেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশেও বিনিয়োগে মন্দা চলছে। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘যুদ্ধের ধাক্কায় দেশে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। আন্তব্যাংক লেনদেনেই ডলারের দর ৮৬ টাকা থেকে ১০৮ টাকা হয়েছে; বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে আমদানি ব্যয় বেশ কমে গেছে। নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনী যন্ত্রপাতি), শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্যসহ সব ধরনের পণ্য আমদানিই কমেছে। ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় শিল্পদ্যোক্তারা শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানি না করে অপেক্ষা করছেন। কেননা, এখন আমদানি করে শিল্প স্থাপন করলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে; সে ক্ষেত্রে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। সে অনুযায়ী পণ্যের দাম না পাওয়া গেলে লোকসান হতে পারে। সে কারণে তারা হাত গুটিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। কয়েক মাস আগে এই প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।’ সব মিলিয়েই দেশে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) দেশে আমদানি ব্যয় কমেছে ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) হিসাবে এলসি (ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমেছে আরও বেশি ২৭ শতাংশ। ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমেছে ৫৭ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ; মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ৩১ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
গত কয়েক বছর ধরেই দেশের বিনিয়োগে মন্দা চলছে। জিডিপির ৩০ থেকে সাড়ে ৩১ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। গত অর্থবছরে তা ৩২ শতাংশ ছাড়ায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জাতীয় বিনিয়োগ জিডিপির ৩০ দশমিক ৫১ শতাংশ ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩১ দশমিক ২৩ শতাংশে ওঠে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ৩১ দশমিক ৫৭ শতাংশে ওঠে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিনিয়োগের হার কমে যাওয়ার পরিমাণটি বিবিএসের হিসাবের চেয়েও বেশি হতে পারে। কেননা, বিবিএস যে হিসাব দিয়েছে, তা ছয় মাসের হিসাব কষে দিয়েছে। পরের ছয় মাস (চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন) পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এই সময়ে ডলার সংকট আরও প্রকট হয়েছে। এই ছয় মাসে অর্থনীতির যে আরও বেশি ক্ষতি হয়েছে, তা কিন্তু বিবিএসের হিসাবে প্রতিফলিত হয়নি।’
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাময়িক হিসাবে চলতি অর্থবছরে ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বিনিয়োগের মধ্যে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা; জিডিপির ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর সরকারি বিনিয়োগ ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা; জিডিপির ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল জিডিপির ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর সরকারি খাতের বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ; সরকারি বিনিয়োগ ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ২৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ; আর সরকারের বিনিয়োগ ছিল ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মতিয়ার রহমান দৈনিক বাংলাকেয বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে জিডিপির সাময়িক হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থবছর শেষ হলে দুই-এক মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করা হবে। প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ৩০ পয়সা ধরে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাব প্রকাশ করা হয়েছিল। ডিসেম্বরে সেই ডলারের দাম বেড়ে ৯৭ টাকা ৮১ পয়সা হয়েছিল। সেই দর ধরেই জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাব করা হয়েছে। আর সে কারণেই টাকার অঙ্কে জিডিপির আকার বাড়লেও ডলারের হিসাবে কমেছে।’
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে চলতি বা বর্তমান মূল্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। ডলারের হিসাবে জিডিপির আকার ৪৬০ দশমিক ২২ বিলিয়ন থেকে ৪৫৩ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৯৩ ডলার থেকে ২৮ ডলার কমে হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ ডলার।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা